বিপ্লব পালের “ধর্মের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ” প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া
আজাহারুল ইসলাম
ওয়েব সাইট “মুক্তমনা”য় প্রকাশিত “ধর্মের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ” করতে যেয়ে বিপ্লব পাল মহাশয় এক স্থানে স্বীকার করেছেন তার “সুপার যুক্তিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আইন বললে বিপ্লব পালের বৌ-ই শুনতে চায় না – তো পাড়া প্রতিবেশী!” এটা তার আত্মস্বীকৃতি। অর্থাৎ নিজের কাছে যতই “সুপার যুক্তিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আইন বলে মনে হোক না কেন, অন্যের কাছে এমনকি তার বৌ-এর কাছেও সেটা মনে হয় না। তার তথাকথিত যুক্তিপূর্ণ লেখার মান এখানেই পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি ধর্মের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করতে যেয়ে ঐ আত্মস্বীকৃতির পরেই নাস্তিকতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন যা বিষয়গতভাবে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। যাহোক তিনি পাঠকদেরকে তার মতে নাস্তিকদের বৃহত্তম সংগঠন “রিচার্ড ডকিন্স-ফোরাম”-এর সন্ধান দিয়ে বলেছেন, আজকাল তিনি সেখানেই তর্কযুদ্ধে বেশী ব্যস্ত থাকেন। তা থাকুন। আমাদের সে বিষয়ে আপাতত কিছু বলার নেই। কিন্তু ফোরামের সদস্যদের ধর্মের ভীতি এবং সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে তাদের অনীহা তার অনেক মনোকষ্টের কারণ বলে জানাচ্ছেন বটে। তারপর তিনি বলছেন “পৃথিবীতে নাস্তিকরা যেটুকু রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করেছে সেটুকু কমিউনিস্টদের তৈরী রাজনৈতিক শক্তির জন্যই। সমস্যা হচ্ছে এই কম্যুনিস্টদের মধ্যেই আবার জন্ম হয়েছে কুখ্যাত স্ট্যালিন, মাও এবং পলপটের মতন খুনীদের।” হাঁ, তার ভাষাতেই “পৃথিবীতে নাস্তিকরা যেটুকু রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করেছে সেটুকু কমিউনিস্টদের তৈরী রাজনৈতিক শক্তির জন্যই।” কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটা তার মোটেও পছন্দ নয়, কারণ কমিউনিস্টদের মধ্যে “কুখ্যাত” “খুনী” নেতাদের জন্ম হয়েছে। হাওয়াই জাহাজে বসে শূন্যে বাতাসে ভাসতে ভাসতে লেখা এ প্রবন্ধের কয়েক জায়গায় নেতাদের নাম এসেছে। তার ভাষায় নাস্তিকদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা “লেনিন, স্ট্যালিন, মাও বলপূর্বক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নরমেধ যজ্ঞ করেছেন। সেই সমাজ এবং রাষ্ট্র টেকেওনি।” তার নিবন্ধের শিরনাম “ধর্মের আধ্যাত্মিকতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ”। নিবন্ধের মধ্যে প্রথমে নাস্তিকদের প্রসঙ্গ চুকিয়ে তারপর সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মহানায়কদের প্রসঙ্গ টেনে এনে তাদের হেয় প্রতিপন্ন করার এ অপচেষ্টা কোন “সুপার বৈজ্ঞানিক” যুক্তি? আর এ ধরনের যুক্তি তিনি নিজে যতই “সুপার” মনে করুন না কেন, তার “বৌ বা পাড়া প্রতিবেশীরা” তাই কেউই গ্রহণ করেন না। আসলে তার মধ্যে প্রচণ্ডভাবে বিদ্যমান বাংলার সেই বহুল প্রচলিত প্রবাদ বা প্রবচনের মত “যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা” ধরনের স্বভাব ।
যা হোক, প্রথমেই একটা কথা বলে নিতে চাই, তিনি আজকে যে স্বপ্নের দেশে আছেন, যেখানে হাওয়াই জাহাজে উড়তে উড়তেও লেখেন, – সেই বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গঠন করতে কি ধরনের নরমেধ যজ্ঞ পরিচালিত হয়েছিল সেটা একটু ভাবুন তো! কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর থেকে ক্রমান্বয়ে ইউরোপীয় অধিবাসীরা দলেদলে নব আবিষ্কৃত মহাদেশটিতে বসতি স্থাপন করতে থাকে। স্থানীয় অধিবাসীদের সভ্যতা ধ্বংস করে, তাদেরকে হটিয়ে, মেরেকেটে তাদের জমি-জমা, ধন-সম্পদ ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে। উন্নত অস্ত্রের জোরে একের পর এক অঞ্চলের আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের নির্মমভাবে হত্যা করে ধীরে ধীরে গোটা মহাদেশটি দখল করে নেয় ইউরোপীয় অভিবাসীরা। বিভিন্ন জাতির ইউরোপীয় অভিবাসীদের অঞ্চলসমূহ একত্রিত করে উত্তর আমেরিকার একাংশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গঠন করেন জর্জ ওয়াশিংটন। প্রকৃত অর্থে ব্রিটেনের ছত্রছায়ায় থাকা বিজয়ী লুঠেরা জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে বৃহৎ একটি রাষ্ট্র কায়েম করেন তিনি, যার জন্মপটভূমির লুঠেরা ও দখলদার চরিত্র শুধু সে রাষ্ট্র ধারণ করে নাই, বরং ক্রমান্বয়ে আরো বিকশিত করেছে উন্নততর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও টেকনোলজির সাহায্যে, উন্নত মেধা ও বিপুল অর্থ এবং সর্বোপরি এতকাল অব্যবহৃত বা প্রায় অব্যবহৃত রয়ে যাওয়া সুবিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের সাহায্যে। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণের পর মরতে মরতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া অতি অল্প সংখ্যক রেড ইন্ডিয়ানকে সহায়-সম্পদহীন অবস্থায় বন্য জন্তুর মত “সাফারি পার্কের” ন্যায় অতি ক্ষুদ্র অঞ্চলের নির্দিষ্ট জায়গায় বসবাসের অনুমতি দেয়া হয়। সে অবস্থার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে? তাদের অর্থনীতি, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য , বাসস্থান ও শিক্ষার কতটা উন্নতি হয়েছে? যদিও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উন্নত রাষ্ট্র হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত। মার্কিন এক রাষ্ট্রনায়কের ভাষায়, “গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য সরকার।” এই সূত্রের কতটা রেড ইন্ডিয়ানদের বেলায় কার্যকর! বরং লক্ষ লক্ষ আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের হত্যার মাধ্যমে উচ্ছেদ করে এবং তাদের ভূ-সম্পত্তি ও সহায়-সম্পদ জবরদখল করে মার্কিন সভ্যতার জয় যাত্রা শুরু হয়েছিল। লুণ্ঠনতন্ত্রের সেই রাস্তা থেকে তারা আর ফিরে আসে নাই। হাঁ, হত্যা, লুণ্ঠন আর জবরদখল এই দখলদার ও লুঠেরা রাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অন্তর্নিহিত সত্য, আসল রূপ।
হত্যা ও লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে চালিত তাদের সেই বিজয় রথ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দলিত-মথিত করছে সে সব অঞ্চলের মানুষকে। সমগ্র পৃথিবীর সম্পদ, শ্রম ও মেধা লুণ্ঠন তার জন্য প্রয়োজন। যার কারণে ইরাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা অজুহাতে শুধু যুদ্ধ নয়, বরং চরম মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে তারা। আফগানিস্তানে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য তারা জঙ্গি ইসলামকে সর্বপ্রকার মদদ দিয়ে পরাক্রান্ত ও ব্যাপক বিস্তৃত করে। তাকে সর্বাত্মক সাহায্য দিয়ে আফগানিস্তানে বিজয়ীর বেশে ক্ষমতায় বসায়। এখন সেই জঙ্গি ইসলামকে উচ্ছেদের নামে সেখানে মিত্র বাহিনীকে নিয়ে যুদ্ধ করছে। ইরান ও সিরিয়ায় যুদ্ধের পায়তারা করছে, যে কোন সময় যুদ্ধ শুরু করতেও পারে। উত্তর কোরিয়াকেও চাপের মধ্যে রেখেছে। পৃথিবীর অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশগুলোতে সাহায্যের নামে তারা নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ প্রতিষ্ঠা করছে। আমাদের বাংলাদেশ, এমনকি বৃহৎ ভারতও তার থাবা বা স্বার্থ পরিকল্পনার বাইরে নয়। কৌশলটা শুধু একেক জায়গায় একেক রকম । এসব ব্যাপারে জানি না আলোচ্য প্রবন্ধ লেখকের কলম কতটা সক্রিয়।
গত শতাব্দী কালব্যাপী পৃথিবীতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমস্ত রকম সামাজিক শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সমাজ বিপ্লবীদের নেতৃত্বে শোষিত-বঞ্চিত মানুষেরা শোষণ-বঞ্চনার শৃঙ্খল ভেঙ্গে পাল্টা সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণের জন্য চেষ্টা করছেন। প্রথমে লেনিন-স্ট্যালিনের রাশিয়ায় সে সমাজের যাত্রা শুরু হয়। নতুন পথের যাত্রায় ভুল-ভ্রান্ত্রি হতেই পারে। সেটা স্বাভাবিক। ভ্রান্তি একবারে না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। তৎসত্বেও ইউরোপ ও এশিয়ার যে অঞ্চলগুলো নিয়ে সোভিয়েত সমাজের অভিযাত্রা, অর্থাৎ তৎকালীন ইউরোপের পশ্চাৎপদ রাশিয়ার কৃষি অঞ্চল ও এশিয়ার প্রায় যাযাবর, চরম অনুন্নত এবং অনুর্বর ভূমির উজবেক, তাতার, কাজাখ, তাজিক প্রভৃতি জাতি-গোষ্ঠীকে নিয়ে তার যাত্রা। সেখান থেকে বিংশ শতকের শেষ প্রান্তে এসে তার উন্নতির খতিয়ানটা একেবারে ছোট নয়।
এই সোভিয়েত সমাজ প্রতিষ্ঠা কালের নরমেধ যজ্ঞের কথা বলেছেন বিপ্লব বাবু। সোভিয়েত বিপ্লবে কতলোক হত হয়েছিল তা কি তিনি বলবেন? সেই সাথে অবশ্যই জানাবেন লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লব সংঘটিত হবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রসমূহের দ্বারা ইউরোপে সংঘটিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে – যাতে বিপ্লব পূর্ব রাশিয়ার জার সরকারও জড়িত ছিল সেই যুদ্ধে রাশিয়াসহ ইউরোপের কতকোটি লোকের প্রাণ বলি হয়েছিল? আমরা যা জানি তা হ’ল শুধু মৃতের সংখ্যাই ছিল দুই কোটি। আহতের সংখ্যা ছিল দুই কোটি দশ লক্ষ। সেটা কি তাহলে নরমেধ যজ্ঞ ছিল না! লেখক মহোদয় কি ভেবে উত্তরটা দিবেন? সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচবার জন্যই রাশিয়ার শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকরা লেনিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লব সাধন করে। দলে দলে শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকেরা মিলিতভাবে সমস্ত শহর-বন্দর-গ্রামে শাসন পরিচালনার জন্য যে কমিটি গঠন করে তারই নাম দেয় সোভিয়েত। সোভিয়েত ব্যবস্থা ইতিহাসের অগ্রগতিতে একটা নতুন সংযোজন। সোভিয়েত ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দায়িত্ব অর্পিত হয় লেনিনের উপর। রুশ বিপ্লবের পরপরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়ায় বিপ্লবী সরকার। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধও দ্রুত থেমে যায়। ঐ সময় রুশ বিপ্লব না হলে ইউরোপে আরো কত কোটি লোক যে যুদ্ধের বলি হত তা বলা শক্ত। শুধু সরাসরি যুদ্ধেই নয় – যুদ্ধের ফল স্বরূপ দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতেও বহু লোক মারা গেছে। যুদ্ধ থেকে সরে গেলেও নতুন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দোষে সমগ্র ইউরোপ সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে পুরাপুরি অসহযোগিতা করে। যুদ্ধ ও বিপ্লব পরবর্তী বিশৃঙ্খলা, খরা, পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড এবং অসহযোগিতা ইত্যাদির ফলশ্রুতিতে ১৯২১-’২২ সালে সোভিয়েত রাশিয়াতে দুর্ভিক্ষে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ লোক মারা যায়। শুধু অসহযোগিতা নয়, পুরো ইউরোপীয় শক্তির সাহায্যে প্রচণ্ড অন্তর্বিপ্লব, অন্তর্ঘাত সহ সবশেষে সম্মিলিত সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে ইউরোপীয় রাষ্ট্রবর্গ বিভিন্ন ফ্রন্টে ও সীমান্তে আক্রমণ চালায়। এর ফলে তাকে সেই শৈশবেই প্রচণ্ড প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সোভিয়েত রাষ্ট্র ও সমাজের বিরুদ্ধে মার্কিন, ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় অন্যান্য শক্তিবগের্র জঘন্য ষড়যন্ত্রের বিশদ বর্ণনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন বিখ্যাত দুই সাংবাদিক মাইকেল শেয়ার্স ও এলবার্ট কাহন-এর লেখা ‘ঞযব এৎবধঃ ঈড়হংঢ়রৎধপু অমধরহংঃ জঁংংরধ’ নামক বইতে বিশদ বর্ণিত হয়েছে, যা ১৯৪৬ সালে আমেরিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। বইটির বাংলা সংস্করণ কলকাতায় প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে। সত্যানুসন্ধানে ব্রতী দাবীদার কেউ হলে বইটি পড়ে দেখা উচিত। পালবাবু তেমনটি দাবী করেছেন যে তিনি সত্যানুসন্ধানী। তাই বইটি পড়লে হয়ত সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো তার জন্য সহজ হতে পারে।
লেনিন-স্ট্যালিনের গড়া সোভিয়েত রাষ্ট্রটি ৭২ বছরের মত টিকেছিল। রাষ্ট্র চালনায় অবশ্যই কিছু না কিছু ভুল-ভ্রান্তি তাদের ছিল। তা না হলে সোভিয়েত ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে কেন? পূর্বেই উল্লেখ করেছি ভুল-ভ্রান্তি থাকা অস্বাভাবিক নয়। এই অভ্যন্তরীণ ভুল বা তাদের নিজেদের ভুল মৌলিক উপাদান; বাহ্যিক ষড়যন্ত্র সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করতে পারে মাত্র। তা না হলে বিপ্লবের পর পরই বাহ্যিক ষড়যন্ত্রের কারণে সেটা ব্যর্থ হত। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নাই দ্রুত ভুল-ভ্রান্ত্রি সংশোধন করে নেবার নেতৃত্বের গুণাবলীর কারণে।
শোষণমূলক সমাজ কাঠামোর বিরুদ্ধে কার্ল মার্ক্স - ফ্রেডারিখ এঙ্গেল্স শোষণ মুক্তির একটা দর্শন দিয়েছিলেন, তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিলেন মাত্র। বাস্তবে সেটা প্রয়োগ করা তাদের জীবদ্দশায় সম্ভব হয় নাই। লেনিনের নেতৃত্বে সেই দর্শনের আলোকে বাস্তব সমাজ গড়তে যেয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার সংক্ষিপ্ত জীবনকালের মধ্যেও লেনিন কৃত ভুল সংশোধন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দিয়েছিলেন। তার এই ভুল সংশোধনের একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে সর্বাত্মক জাতীয়করণের পথ ত্যাগ করে নয়া অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা। কিন্তু অতিসংক্ষিপ্ত জীবনকালের কারণে আর কিছু ভুল সংশোধন করে যেতে পারেন নাই। বিশেষ করে পরবর্তী নেতৃত্বের গঠন ও সেই সঙ্গে বিপ্লবোত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতির উপযোগী দর্শন নির্মাণ ও বিকাশের কাজ। যার একান্তই প্রয়োজন ছিল। লেনিনের পরবর্তী সময়ে স্ট্যালিন ক্ষমতায় এসে বাহ্যিক শক্তিসমূহের সহযোগিতায় অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের মাত্রাধিক্যে বিচলিত হয়ে কঠোর থেকে কঠোরতর পথ গ্রহণ করেছেন। সন্দেহগ্রস্ততা তার বাতিকে পরিণত হয়েছিল। কঠোরতা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দিলেও দর্শন চিন্তার উন্নয়নে মোটেও সাহায্য করে নাই। পরবর্তী কালে সেই পথেই সোভিয়েত বিপ্লব অগ্রসর হয়ে তৎকালীন সময়ে বিস্ময়কর উন্নয়ন সাধন করলেও ধীরে ধীরে তার বিকাশগতি শ্লথ হয়ে যায়। বিপুল জনগণের ব্যক্তি উদ্যোগকে উন্মুক্ত করে দেবার মত পথের বিকাশ সেভিয়েত সমাজে ঘটতে পারে নাই। ফলে ব্যক্তি উদ্যোগ ঝিমিয়ে পড়ে, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ মাথাভারী শাসনের উদ্ভব ঘটায়। এর মূল যে কোনও ধরনের ব্যক্তিগত মালিকানা বিরোধী মার্কসীয় দর্শনের ভিতর নিহিত। এখানে একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা বোধহয় বুঝতে সুবিধা হবে। চীনে আজকে যে প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি উদ্যোগকে উৎসাহিত করে উৎপাদনের বিকাশ ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো হচ্ছে, সোভিয়েত রাশিযায় এই জাতীয় কোন উদ্যোগ নেওয়া হয় নাই। ধর্মীয় মৌলবাদের মতই মার্ক্সীয় মৌলবাদের অন্ধ অনুসারী রূপে তারা নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। যার ফলে তাদের কাক্সিক্ষত বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায় এবং অবশেষে মার্ক্সীয় দর্শনের অনুসারী প্রথম রাষ্ট্রটির অবসান ঘটে।
কিন্তু বিশ্বব্যাপী সীমাহীন শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পৃথিবীতে তা নতুন সমাজ নির্মাণের পথের সন্ধান দিল, যার প্রভাবে একদিকে যেমন শোষিত-বঞ্চিত মানুষেরা ও তাদের পক্ষের আদর্শবাদী মানুষেরা প্রচণ্ড প্রেরণা পেয়েছে, অন্যদিকে বুর্জোয়া সমাজ ও রাষ্ট্রগুলিও সংস্কার সাধনের মাধ্যমে কোন কোন ক্ষেত্রে জনকল্যাণের কর্মসূচী গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। হাঁ, সোভিয়েত বিপ্লবের পূর্বে বুর্জোয়া কোন রাষ্ট্রে একটা সামগ্রিক ব্যবস্থা হিসাবে জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী গ্রহণ কখনও দেখা যায় নাই, সেটা ভাবাও যেন অসম্ভব ব্যাপার ছিল। নতুন এই বিপ্লবের ভয়ে পাশ্চাত্যের সকল বুর্জোয়া দেশই কিছু না কিছু কল্যাণমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। তার কতটা সত্যিকার অর্থে গণপ্রীতি ও কতটা সমাজ বিপ্লবের পথ থেকে বঞ্চিতদের দূরে রাখার জন্য সেটা অবশ্য অন্য বিতর্কের বিষয়। ইউরোপের অনেক দেশেই আজকাল কল্যাণ রাষ্ট্রের চিন্তা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বিশেষ করে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলির কল্যাণমূলক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা মডেল হিসাবে দাঁড়িয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু সোভিয়েত বিপ্লবের আগে পৃথিবীর অন্য কোথায়ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা উল্লেখযোগ্য কোন জনকল্যাণমূলক কর্মসূচীই কোথাও গ্রহণের কথা চিন্তা করা কঠিন ছিল। অর্থাৎ সোভিয়েত বিপ্লবের ফল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র পড়েছে। এ কথা শুধু আমার নয়, অনেক সমাজ বিজ্ঞানীই এ কথা অকপটে স্বীকার করেন। আরেকটা লক্ষণীয় ব্যাপার হ’ল এই, যেসব অঞ্চল নিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল, তাদের সম্পর্কে সোভিয়েত শাসনতন্ত্রে লিখিত বিধান ছিল, সে অঞ্চলগুলোর জনগণ অর্থাৎ বেশিরভাগ জনগণ যদি আলাদা হওয়ার ইচ্ছা করে Ñ তবে তারা সোভিয়েত সাধারণতন্ত্র থেকে স্বাধীন হয়ে যেতে পারবে। শাসনতন্ত্রের ধারা অনুসারেই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলসমূহ বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেছে। পৃথিবীতে লেনিন-স্ট্যালিনের গড়া সোভিয়েত রাষ্ট্র ছাড়া তৎপূর্বে আর কোন রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রে এ জাতীয় বিধান বা নীতিমালার সন্ধান একেবারেই মেলে না । বাস্তবেও কোন যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াই সোভিয়েত রাষ্ট্র ছেড়ে তারা আলাদা রাষ্ট্র গঠন করেছে।
অপরদিকে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় সিকি অর্থাৎ প্রায় চারভাগের একভাগ মানুষ মাও-এর নেতৃত্বে চরম দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও পশ্চাৎপদতা অতিক্রম করে উন্নত এক নতুন পৃথিবী গড়ার মহা সড়কে প্রবেশ করেছে। তাঁর উত্তরসূরিদের পরিচালনায় চীনের বিকাশকে কেউ অস্বীকার করতে পারছে না। সকল উন্নত দেশই চীনের উন্নয়নের গতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সবেমাত্র সমাপ্ত বিশ্ব অলিম্পিক আয়োজনেও তারা এ যাবৎ কালের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। বিতর্ক চলছে সর্বকালের শ্রেষ্ঠত্ব কি না? ক্রীড়া নৈপুণ্যেও সর্বোচ্চ সোনা জিতে শ্রেষ্ঠত্বের স্থান দখল করেছে। অর্থাৎ এখন চীনকে অস্বীকার কিংবা উপহাস করার সাধ্য একমাত্র নির্বোধ বা মূর্খ বা বিশেষ উদ্দেশ্যপূর্ণ ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিপ্লব বাবুর চোখে “সেই সমাজ ও রাষ্ট্র টিকেও নি” এরকম মন্তব্যকে কোন অভিধায় অভিহিত করা যায় – তা আমি ভেবে পাচ্ছি না। বিষয়টি পাঠক মহোদয়গণের সদয় বিবেচনার উপর ছেড়ে দিলাম।
বিপ্লব বাবুর উদ্ধৃত নিবন্ধের বক্তব্য অনুসারে তার বেশির ভাগ সময় কাটে “রিচার্ডডকিন্স ফোরামে” তর্কাতর্কি করে। বেশির ভাগ সময় যেহেতু ঐ ফোরামেই তর্কাতর্কি করে কাটে সেহেতু স্বভাবত মনের কৌতূহল তার মূল পেশাগত দায়িত্বই কি “তর্কাতর্কি”? কারণ বেশির ভাগ সময় তিনি এতেই কাটান। তারপর প্রচুর লেখালেখি করেন বিভিন্ন ওয়েব সাইটে। এ ছাড়াও আরও কোথাও করেন কিনা জানি না। অন্য কোন পেশা থাকলে সেখানে সময় দেন কিভাবে জানি না, কারণ তার বেশির ভাগ সময় “ফোরামেই কাটে।” তার বর্ণনা মতেই এই ফোরামাটি নাকি বিশ্বের সবচেয় বড় নাস্তিক ফোরাম। এবং তিনি এই ফোরামের একজন বড় তার্কিক এবং যিনি বেশির ভাগ সময় এই “ফোরামে” তর্কাকর্তি করে কাটান – তিনিই এই প্রবন্ধের (২) লেখা অংশে বলছেন “ওরা আস্তিক আমি নাস্তিক – এই ব্যাপারটাই আমি বিশ্বাস করি না।” অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে তাঁর নিজের উপরেই তাঁর বিশ্বাস নাই। তিনি কী তা বোধ হয় তিনি নিজেই বোঝেন না। তা হলে তার “বউ” বা “পাড়া প্রতিবেশী” কী করে তাঁকে বিশ্বাস করবে? আর ওয়েব সাইটের পাঠকগণই বা কী করে তাঁকে বিশ্বাস করবে? তার বর্ণনা মতেই বিশ্বের বৃহত্তম নাস্তিক ফোরামের একজন প্রধান তার্কিক হয়েও পর মুর্হূতেই যখন বলছেন “ওরা আস্তিক আমি নাস্তিক – এই ব্যাপারটাই আমি বিশ্বাস করি না।” তখন এই প্রশ্ন কি বিশেষভাবে মনে জাগে না? হাঁ, তিনি হয়তো মোটেও নাস্তিক নন। অথচ নিবন্ধের প্রথম অংশের মধ্যে তিনি বাগাড়ম্বরে ঘোষণা করলেন, বিশ্বের বৃহত্তম নাস্তিক ফোরামে তকাকর্তি করে সবচেয়ে বেশী সময় ব্যয় করেন। নিবন্ধটি প্রথমে পড়ে মনে হয়েছিল বিশ্ব নাস্তিকদের সেরা তার্কিক বা সেরা ব্যক্তি হিসাবে নাস্তিকদের সেরা দায়িত্বটি তিনি পালন করছেন। এবং সেই প্রসঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক হলেও কায়দা করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের উপর একেচোট ঝাল ঝাড়লেন। তার পর নিবন্ধের দ্বিতীয় (২) অংশে প্রবেশ করেই তার সুর কেমন পাল্টে গেল, অত্যন্ত কোমল হয়ে গেল। আস্তিক-নাস্তিকের ব্যাপারটাই তার বিশ্বাস থেকে উঠে গেল। আস্তিক-নাস্তিকদের সমন্বয়ের মধুর মিলন সুর শ্যামের বাঁশীর মত বেজে উঠল। তার লেখনীতে ধীরে ধীরে জীবন মৃত্যুর প্রশ্ন উত্থাপন করে জেনেটিক সত্তার “বাচ্চা” দেখে হাসি মুখে ধরণীর বুকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগের মরমী বর্ণনায় সবাইকে আপ্লুত করে প্রশ্ন উত্থাপন করলেন, “কে হিন্দু? কে মুসলমান? কে নাস্তিক? সবাই একটা জেনেটিক সত্তা।” সুন্দর মরমী বর্ণনার মধ্য দিয়ে বহুকালের সেই মরমী সহজিয়া সাধকদের পুরোনো বাণী! অপূর্ব!! তবে কেন এত লাফালাফি? বিশ্বের বৃহত্তম নাস্তিক ফোরামে তার মহা ব্যস্ততার আড়ম্বরপূর্ণ বর্ণনা? আর সেই উপলক্ষ্যে সমাজতন্ত্রী নেতাদের পিণ্ডদান? এটা কি তার বিশ্ব ব্যাপী প্রচারের বিশেষ এক দায়িত্বেরই অংশ?
আমার জানা মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণকারী ইউরোপের অন্যতম ক্ষুদ্র রাষ্ট্র আলবেনিয়া ছাড়া অন্য কোন সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র তাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে নাস্তিকতাকে আইন হিসাবে গ্রহণ করে নাই বা ধর্মপালনের বিরুদ্ধে আইন করে বাধা দান করে নাই। তবে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলি ধর্মকে প্রশ্রয় যেমন দেয় নাই তেমন প্রয়োজনে ধর্মের প্রভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রামও করেছে। পালবাবু প্রথমে বললেন “পৃথিবীতে নাস্তিকরা যেটুকু রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করেছে সেটা কমিউনিস্টদের তৈরী রাজনৈতিক শক্তির জন্যই।” তার পরেই পিণ্ড দিয়েছেন কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক ক্ষমতা সৃজনকারী সেই নেতাদের। তাহলে কি কমিউনিস্ট বা সেই সমাজতন্ত্রী নেতাদের পিণ্ডদানের জন্যই তার নাস্তিক সাজ? আর সেই সুবাদে কমিউনিস্ট বা সমাজ বিপ্লবীদের পিণ্ড দিয়ে জনগণকে বোঝানো, “বাবা তোমরা ও পথে কেউ যেওনা কারণ ওরা নাস্তিক আর প্রকৃতপক্ষে নাস্তিকতা ভাল নয় বড় খারাপ। দেখ না তারা সমাজতন্ত্র করতে যেয়ে নরমেধ যজ্ঞ করে! অতএব সাবধান! ও পথে নয়, চল আমরা ধর্মের আধ্যাত্মিকতার পথে ফিরে যাই। সেখানেই শান্তি। সব ধর্মের মূল কথা এক। পরম সত্যকে পাওয়া! আমি আগে নাস্তিক হ’লেও এখন এ পরম সত্য উপলব্ধি করেছি। অতএব সবাই আধ্যাত্মিকতার পথে ফিরে আসুন!” তার বক্ত্যবের মূল সুর এরকমই মনে হয়েছে।
হাঁ, একটা কথা সত্য, সব ধর্মের মূল সুরই আসলে এক, পরম অন্ধবিশ্বাস। এটা কোন মহা আবিষ্কার বা কোন নতুন আবিষ্কার নয়। নতুন করে বিপ্লব বাবুর সুরেলা বাঁশীতে সুরের মূর্ছনা তোলা মাত্র। এখানে তার বক্তব্যের মূল সুর হল ধর্মের আধ্যাত্মিকতার মধ্যেই মানুষের মুক্তি। পরম সত্তার সঙ্গে মিলনের পথ হল প্রকৃত পথ। আর সে পথেই সবাইকে চলার আহ্বান। আধ্যাধ্মিকতার পথে গেলে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই, এমনকি সেখানে বিজ্ঞানের সাথেও ধর্মের কোন পার্থক্য নাই! এটাই তার মূল কথা। শুনুন তার নিজস্ব কথায় “আধ্যাত্মিকতার একদম উচ্চ স্তরে হিন্দু এবং ইসলাম ধর্মের কোন পার্থক্য নেই। বিজ্ঞানের সাথেও ধর্মের পার্থক্য সেখানে বিলুপ্ত।” এখানে পালবাবুকে বিভিন্ন ধর্মের ও বিজ্ঞানের আধ্যাত্মিক মিলনের কীর্তন গানের মহা কীর্তনিয়া বলেই মনে হচ্ছে। এক জীবনের কত রূপ? “রিচার্ডডকিন্স-ফোরাম” থেকে আধ্যাত্মিকতার মহা কীর্তনিয়া গায়ক? বাহবা পাবার যোগ্য বটে! বিভিন্ন ধর্মকে বিশেষ করে ইসলাম ধর্মকে আধ্যাত্মিকতার নামে একটু “মডারেট” করা দরকার! কারণ লড়াকু ইসলাম – যে লড়াকু চরিত্র তার মধ্যে জন্ম লগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠিত তাকে আজ বাগে আনা দরকার। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশেষ করে সোভিয়েত রশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় জন্মগত ঐতিহ্যের অধিকারী লড়াকু ইসলাম সমাজতন্ত্রের শত্রুদের জন্য দরকার ছিল। তাই সমাজতন্ত্রের বিরোধী শিবিরের গুরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরম যত্নে লাদেনকে সৃষ্টি করেছে। সৃষ্টি করেছিল তালেবান যোদ্ধাদের। অর্থ, সম্পদ, অস্ত্র, স্ট্রিংগার ক্ষেপণাস্ত্র, মিডিয়া, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সবকিছু দিয়ে যোদ্ধা ইসলামী শক্তিসমূহকে নতুন করে উজ্জীবিত করেছিল। কিন্তু সোভিয়েতের পতনের পর এখন তাদের “সহিষ্ণু” ইসলাম, “মডারেট” ইসলাম দরকার। সোনার পাথর বাটি আর কি! নাকি কাঁঠালের আমসত্ত্ব? সেই জন্যই কি সহজিয়াবাদ, সূফিবাদ, অধ্যাত্মবাদ প্রভৃতি নামে অলংকৃত করে ইসলামের গলায় শান্তির ঘণ্টা বাঁধা যায় কি না সেই চেষ্টা? সে ক্ষেত্রে বিপ্লব বাবুদের মত লেখকদের সাধনায় যদি কিছু কাজ হয় তো মন্দ কি? চেষ্টা করে যাওয়াই তো উচিত! হাজার হলেও বর্তমান আবাসের স্বদেশ তো! “মডারেট” ইসলাম প্রতিষ্ঠায় তাঁর অধ্যাত্মবাদী প্রচার ফলবতী হতে পারে। তবে নাস্তিকতার নামাবলীটা পুরোপুরি নামিয়ে অধ্যাত্মবাদের পথে এগোলেই বোধ হয় ভাল হবে।
২০০৭ সালের ১লা সেপ্টম্বর ক্যালিফোর্নিয়ায় বসে লেখা এবং “মুক্তমনা”য় প্রকাশিত “বাঙ্গালী ও গণতন্ত্র” নামক অপর এক নিবন্ধে বিপ্লব বাবু বলেছেন, “আত্মবিশ্লেষণে বাঙ্গালী খুব স্পর্শকাতর, দুর্বল। যেমন ধরুন আমি লস এঞ্জেলসে বসে সিপিএমের জন্য দেশের কিছু হচ্ছে না বলে গালাগাল দিচ্ছি। বাংলাদেশীরাও দেশের নেতাদের গালাগাল দিচ্ছেন। আসল সত্যটা কি? নেতাদের সাথে আমাদের পার্থক্য কোথায়? আমরা নিজেদের আখের গোছানোর জন্য মোটা টাকা কামানোর লোভে দেশ ছেড়েছিলাম। শুধু নেতারা টাকা কামালেই দোষ? কী নৈতিক অধিকার আছে আমাদের? যারা রাজনীতির সমালোচনা করছে তাদের কজন বিদেশের জীবনের আয়েশ কাটিয়ে দেশের মানুষের পেছনে দাঁড়াবে?” যারা বিদেশে গেছেন তাদের সবার সম্পর্কে বিপ্লব বাবুর এমন ঢালাও মন্তব্য আমার কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও তিনি অনেকখানি সত্য কথা বলেছেন। তার বক্তব্য “নিজেদের আখের গোছানোর জন্য মোটা টাকা কামানোর লোভে”-ই দেশ ছেড়েছিলেন। কাজেই টাকা কামানোর ব্যাপারে তাদের নীতি-নৈতিকতা থাকার কথা নাই, তাদের দরকার শুধু টাকা আর টাকা সেটা আমরা বুঝি। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো তাদের নিজেদের নীতি-নৈতিকতাহীনতার সাথে তুলনা করে কেন নীতি-চরিত্রহীন নেতাদের টাকা কামাইয়ের নির্লজ্জ সাফাই গাইলেন? তাদের সব অপরাধ জায়েজ করে দিলেন? চমৎকার! বিদেশে আখের গুছিয়ে, বিত্ত-বৈভব নিয়ে যদি কোন দিন তারা দেশে ফেরেন তবে কি নীতিহীন লুণ্ঠনকারী এই নেতাদের পাশেই তারা থাকবেন? কৃতজ্ঞতা বলে একটা কথা আছে না? তবে অনেকের সন্দেহ বিদেশের আয়েশী জীবন ফেলে প্রবাসীদের একটা বড় অংশই আর কোন দিন দেশে ফিরতে পারবে না। হয়ত পরিব্রাজকের মত বেড়াতে দু’একবার আসলেও স্থায়ীভাবে আর কোনদিন আসবে না। সে যা হোক, সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেটা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়।
“বাঙ্গালী ও গণতন্ত্র” নিবন্ধটির মধ্যে আরও লিখেছেন “তৃতীয় সমস্যা আদর্শবাদের। পশ্চিম বঙ্গে কমিউনিস্টদের উৎপাত। বাংলাদেশে ইসলামের। উভয় আদর্শ গরীবকে স্বর্গের স্বপ্ন দেখায়। পার্থক্যটা শুধু ইহকাল বনাম পরকালের।” অর্থাৎ তার অভিধানে বোধ হয় “আদর্শবাদ” শব্দের কোন বালাই নাই। তাহলে তিনি গরীব বা সাধারণ মানুষকে কিসের স্বপ্ন দেখাবেন? যদি কাউকে কোন স্বপ্ন দেখাতে না চান, স্বপ্ন দেখাতে না পারেন তবে কেন এত লেখালেখির ছড়াছড়ি? তাহলে লেখালেখিটাও কি বিপ্লব বাবুর টাকা কামাবার আর একটা “প্রজেক্ট” মাত্র? আসলে ব্যাপারটা কি? জানতে ইচ্ছা হয়।
লেখার কলেবর আপাতত আর বাড়াতে চাই না। উপসংহারে চলে আসতে চাই। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ে টিকে থাকার প্রয়োজনেই মানুষ আদিম যুগে যুথবদ্ধ ভাবে থাকতে বাধ্য হত। প্রকৃতির সঙ্গে, অন্যান্য হিংস্র প্রাণী জগতের সঙ্গে লড়াই ছাড়াও মানুষের এক যুথবদ্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য যুথবদ্ধ গোষ্ঠীর লড়াই লেগে যেত। পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম না হলে শক্তিশালী পক্ষ দুর্বল পক্ষকে সাধারণত মেরে ফেলত। পরবর্তী কালে কর্মক্ষমদের ধরে নিয়ে বন্দী হিসাবে শ্রমসাদ্ধ কাজে নিয়োগ করত। কর্মক্ষমতাহীন হয়ে পড়লে হয়ত তাদেরকে মেরে ফেলা হত নতুবা তারা না খেতে পেয়ে ধীরে ধীরে মারা যেত। ক্রমান্বয়ে বন্দীদের দিয়ে কাজ করানোটা লাভজনক হয়ে দেখা দিল। তাদের শ্রমের বাড়তি আয়ের উপর নির্ভর করে সমাজের এক ধরণের বাড়তি বিকাশ শুরু হল। এভাবেই দাস বা প্রায় দাসসম ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। ইতিহাসে যে দাস ব্যবস্থার সাক্ষাৎ আমরা পাই তা ক্রমান্বয়ে এভাবেই দীর্ঘ সময় নিয়ে বিকশিত হয়ে উঠেছিল।
সুদীর্ঘদিন এই দাস সমাজ ব্যবস্থা টিকে ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের মত দাস শ্রমনির্ভর বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। রোমান সাম্রাজ্য মানব ইতিহাসের ক্রম বিকাশে এক সময় বিরাট ভূমিকাও রেখেছে। এ ছাড়াও ছোট-বড় অরও অনেক রাষ্ট্র দাসশ্রমের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সভ্য দুনিয়ার একটা বিশাল অংশ নিয়েই এই দাস ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। সমাজ বিকাশের সেটাও একটা ধারা ছিল। তার কিছু ইতিবাচক দিকও ছিল। কিন্তু সে ব্যবস্থাও চিরন্তন হয় নাই। বিশাল রোম সাম্রাজ্যও ভেঙ্গে পড়ে। এই চরম অমানবিক শোষণের হাত থেকে বাঁচার জন্য “দাস” শ্রেণী বার বার বিদ্রোহ করেছে। বৃহত্তম দাস বিদ্রোহ হিসাবে আমরা দেখতে পাই স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে বিশাল বিদ্রোহ। সে বিদ্রোহ রোমান সাম্রাজ্যকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্রোহ সফল হলেও শাসক ও শোষকদের সম্মিলত পরিকল্পনা ও নিষ্ঠুরতার কাছে শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ পরাজিত হয়। কিন্তু দাস ব্যবস্থা উচ্ছেদের বীজ রোপিত হয়ে যায়। এ ইতিহাস শিক্ষিত সমাজের সকলেরই আশা করি আরও বিস্তৃতভাবে জানা আছে। আমি শুধু প্রসঙ্গটা তুলে একটু স্মরণে আনতে চাই এবং প্রশ্ন রাখতে চাই, শোষণের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ ন্যায় সঙ্গত ছিল কি না? সে যুগে অবশ্যই একটা শ্রেণী অর্থাৎ এই দাস শোষণের ফলভোগকারী শ্রেণী এই বিদ্রোহকে ন্যায় সঙ্গত মনে করে নাই। প্রকাশ্যেই এর বিরোধিতা করেছে, দমন করেছে। চরম অবদমনকারী নেতাকে শ্রেষ্ঠ নেতা হিসাবে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কুর্নীশ করেছে। কারণ তারাও এই শোষণের প্রতক্ষ বা পরোক্ষ ফলভোগকারী। কিন্তু আজকের সমাজে এ রকম কি কেউ আছেন এই বিদ্রোহকে অন্যায় বলবেন? বোধ হয় প্রকাশ্যে কেউ বলবেন না। কিন্তু মনে মনে হয়ত অনেকেই বলতে পারেন। কারণ আজও তো বিবর্তিত পদ্ধতিতে দাস ব্যবস্থাই চলছে। কিন্তু হয়ত বাস্তবে বিবর্তিত পদ্ধতির দাস শোষণ সম্পর্কে আমার এই বক্তব্যকে এই শোষণের সরাসরি বা পরোক্ষ ভাবে ফল ভোগকারীরা কিছুতেই মানতে চাইবেন না। আজকে হয়ত অনেকেই দাস বিদ্রোহকে মুখে মুখে প্রকাশ্যে সমর্থন দিবেন। কিন্তু একই সঙ্গে যদি বলেন, “ দাস বিদ্রোহ না হয় ঠিক ছিল কিন্তু তাই বলে স্পার্টাকাস মনিব, মালিকদের বিরুদ্ধে এত নিষ্ঠুরভাবে এইসব হত্যাযজ্ঞ চালাল! যেখানে গেছে মালিক শ্রেণীর লোকদেরকে এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে! শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ তো টিকলো না, ঠকেই গেল। তবে কেন এত লোকের প্রাণ হানি করল? অতএব স্পার্টাকাসের নাম শুনলেই আমার গা ঘিনঘিন করে।” অর্থাৎ দাস বিদ্রোহ ঠিক আছে, কিন্তু স্পার্টাকাস ঠিক না, বরং সে একটা খুনী, নরমেধ যজ্ঞকারী Ñ তাই তো? তখন তার উত্তরে কি বলা যায় বলুন তো? মনের ভিতর থেকে এই ধরনের মতলববাজদের প্রতি ঘৃণা উগরানো ছাড়া আর কী উপায় থাকে?
শোষণের সেই আদিম স্তরের শুরু থেকে যুগ যুগান্তর অতিক্রম করে আজও চলেছে সেই দাসদের সেই স্পার্টাকাসদের উত্তরসূরিদের লড়াই। কখনও স্পার্টাকাসরা ভুল করে কখনও অনভিজ্ঞতা কিংবা ভুল ধারণার কারণে, কখনও নানা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে, এমনকি নিজ সমাজের সীমাবদ্ধতা কিংবা দর্শনের সীমাবদ্ধতার কারণেও ভুল করে। অনেক সময় জিতে গিয়েও সীমাবদ্ধতা ও অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে ভুল করে। কিন্তু আবার তারা ফিরে আসে। আসতে হয়, আসতে হবেই যতদিন সমাজে যত পরিবর্তিত আকারেই হোক, দাস শোষণকারী ও শোষিত দাসেরা রয়েছে, তত দিনই এ লড়াই থামবে না। কে এতে বিরক্ত বা অধৈর্য হল বা কে এর পক্ষে গেল বা দাস মালিকদের পক্ষে নানাভাবে ছলাকলা, ওকালতী করলো তাতে কিছু আসে যায় না। স্বর্গ থেকে দেবতাদের মত মাঝে মাঝে কিছু বাণী বিতরণ করে হয়ত কিছু মানুষকে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করা যায় মাত্র স্থায়ীভাবে এ লড়াই বন্ধ করা যায় না। ইতিহাস শুধু সাক্ষী রেখে যায় কে এই লড়াইয়ের পক্ষে, কে বিপক্ষে, কে নীরব দর্শক মাত্র। কে সামান্য ক্ষুদকুঁড়ার লোভে শোষকের কৃপা লাভের জন্য হন্যে কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করে ছুটে বেড়ায়। নব যুগের নতুন স্পার্টাকাসদের প্রতিনিধি লেনিন, স্ট্যালিন, মাওদের ভুলভ্রান্তি ও নিষ্ঠুরতার কাহিনী ও তাদের সীমাবদ্ধতার কাহিনী নিয়ে আলোচনার বাসনা রইল। কারণ আমি অন্ধ আবেগে সব কিছু নির্ভুল বলে মেনে নেওয়ার পক্ষে নই। সমালোচনা ও ভুল সংশোধনের পক্ষে, কিন্তু নতুন স্পার্টাকাসদের বিরুদ্ধে যেয়ে আধুনিক নব দাসমালিক সমাজের সমর্থক, ঘোষক, হুকুমবর্দার বা পাহারাদার নই।
আজাহারুল ইসলাম
E-mail : [email protected]
লিখিতঃ ১-১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৮