অভিজিৎ রায়ের ‘মার্ক্সসবাদ কি বিজ্ঞান?’ নিবন্ধ প্রসঙ্গে
আজাহারুল ইসলাম
এক
মুক্তমনায় প্রকাশিত অভিজিত রায়ের ‘মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?’ নিবন্ধটি মনোযোগ সহকারে পড়লাম। সুলিখিত এ নিবন্ধটিতে তার পাণ্ডিত্যের গভীরতা, যুক্তির প্রখরতা, বিষয় নির্বাচনের দক্ষতা, সর্বোপরি পাঠকের মনকে প্রভাবিত করার স্বভাবসুলভ বাককুশলতা প্রশংসাযোগ্য। তিনি প্রথম থেকেই আলোচনার মাধ্যমে দেখিয়েছেন মার্ক্সের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী পৃথিবী বদলায় নি। তিনি লিখেছেন, ‘পৃথিবী জুড়ে পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের যে আমূল ভবিষ্যদ্বাণী মার্ক্স করেছিলেন, আজকের বিশ্বের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে মনে হয় পৃথিবীর গতিপ্রকৃতি সেভাবে যায় নি।’ তিনি লিখেছেন, ‘বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জায়গায় সফলতা এলেও ধনতন্ত্রের পতন হয় নি, বরং বলা যায় ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নিজস্ব সিস্টেমের দুর্বলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে বিবর্তিত হয়েছে।’ তিনি বিভিন্ন দিক থেকে মার্ক্সের তত্ত্বের দুর্বলতা, অযৌক্তিকতা, অবৈজ্ঞানিকতা ও অবাস্তবতা ইত্যাদি বিভিন্ন পণ্ডিতবর্গের মতামতসহ তুলে ধরে শেষে বলেছেন, ‘যখন মার্ক্সের অনুরাগীরা দেখলেন পৃথিবীর গতিপ্রকৃতি মার্ক্সের দেখানো পথে যাচ্ছে না, তখন তাদের দরকার ছিল এই তত্ত্বকে বাতিল করে নতুন তত্ত্বের খোঁজ করা। তা না করে তারা পুরোন তত্ত্বকেই আঁকড়ে ধরে রইলেন এবং তত্ত্বকে জোড়াতালি দিয়ে এক ধরনের যথার্থতা দেয়ার চেষ্টা করলেন।’ এ পর্যন্ত বিষয়টা বেশ পরিষ্কার। বিভিন্ন যুক্তি, বিচার, তথ্য-উদ্ধৃতির মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে মার্ক্সবাদকে শুধু বাতিলই করেন নাই, উপরন্তু মার্ক্সের চিন্তার অনুরাগীদের উপদেশ দিয়ে তাদের সমালোচনা করে বলছেন, ‘তাদের দরকার ছিল এই তত্ত্বকে বাতিল করে নূতন তত্ত্বের খোঁজ করা।’ অর্থাৎ অনেক আগেই একাজটি তাদের করা উচিত ছিল।
মুক্তমনার এ নিবন্ধটির প্রায় সবটা জুড়েই রয়েছে মার্ক্সবাদ, মার্ক্সবাদী বিপ্লব ও বিপ্লবী নেতাদের নানা রকমভাবে নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করে কদর্য চিত্র এঁকে প্রমাণ করা যে, সর্বদিক থেকে সর্ববিচারে এগুলো খারাপ। তার লেখার শেষ দিকের সামান্য কিছু অংশ বাদে প্রথম থেকে প্রায় চার-পঞ্চমাংশ জুড়ে কোথায়ও একটি বাক্যও নাই যে মার্ক্সবাদ বা কোন মার্ক্সবাদী নেতার কর্মকাণ্ড সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশ্ব ইতিহাসে কোন ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। নানান পণ্ডিতের উদ্ধৃতি দিয়ে, চরম ব্যর্থতা এবং নিন্দার মধ্য দিয়ে সমস্ত মার্ক্সবাদী বিপ্লবী নেতার চরিত্র অঙ্কন দ্বারা তাদের একেবারে নেতিবাচক চেহারার মূর্তি বানানোর পরও মনে হল লেখকের যেন আফসোস হচ্ছে ‘এত কিছুর পরও, মার্ক্সবাদের তাৎপর্য এখনো অনেকের কাছেই প্রাসঙ্গিক।’ শেষ দিকে হয়তো আফসোসের সাথেই বলছেন যে, ‘এ ছাড়া ভুলে গেলে চলবে না যে, সমগ্র তৃতীয় বিশ্বসহ লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যে সমস্ত মানুষ মুক্তি সংগ্রামে শামিল, তাদের অনেকের কাছেই মার্ক্সবাদ এখনও আলোক বর্তিকা। সম্প্রতি নেপালে মাওবাদীরা যে ভাবে দীর্ঘদিনের রাজতন্ত্রকে উৎখাত করেছে, তা অনেক মার্ক্সিস্টকেই উদ্দীপ্ত করেছে। যুগে যুগে সেই উদ্দীপনা এবং সতত শোষণ মুক্তির আকাক্সক্ষাকে আমাদের কারো পক্ষেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়।’ হাঁ, তাদের ‘কারো পক্ষেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়’ ‘সেই উদ্দীপনা এবং সতত শোষণ মুক্তির আকাক্সক্ষাকে’। তাই বোধ হয় শেষ দিকে আবার বলছেন, ‘সেই চিরন্তন মুক্তির স্পৃহা, আকাক্সক্ষা, আর তা বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিত প্রাণ “কমরেড”রা অবশ্যই আমাদের নমস্য।’
বাক্যটা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে একটু স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মনে হল এ কী কথা? কিন্তু না একই নিশ্বাসে বলছেন ‘কিন্তু এটাও তো ঠিক শোষণ মুক্তির স্বপ্ন আর ‘মহান বিপ্লবের’ মাহাত্ম্যকে পুঁজি করে এই কমরেডরাই যখন ক্ষমতায় গেছে তারা নিজেরাই বনে গেছে একেক জন “প্রতিবিপ্লবী”।’ চমৎকার লেখনি কৌশল নিবন্ধকারের! বিপ্লব ও বিপ্লবীদের চরম নেতিবাচক চিত্র অঙ্কনের উদ্দেশ্যে কী মনোরম তুলির আঁচড়! এত যুক্তি-তকর্, তথ্য-প্রমাণের মধ্য দিয়ে নিন্দার ঝড় প্রবাহের মাধ্যমে মার্ক্সবাদ ও বিপ্লব এবং বিপ্লবীদের নেতিবাচক চেহারা অঙ্কিত ক’রে এবং বিশ্ব ইতিহাসের অগ্রযাত্রায় মার্ক্সবাদ ও তার বিপ্লবী নেতাদের ইতিবাচক কোন ভূমিকার কথা একবারও উল্লেখ না করার পরও এখন দেখা যাচ্ছে ‘সমগ্র তৃতীয় বিশ্বসহ লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যে সমস্ত মানুষ মুক্তি সংগ্রামে শামিল, তাদের অনেকের কাছেই মার্ক্সবাদ এখনও আলোক বর্তিকা’।
(নিবন্ধকারের মূল আফসোস কি এখানেই?) তবুও স্বীকার করেছেন! মার্ক্সবাদের ঘটনাকে শুধু অস্বীকার বা নিন্দা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তার ঐতিহাসিক ভূমিকাও বিশ্ব ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। তাই হয়তো স্বীকৃতি স্বরূপ বাক্য উল্লেখ করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পৃথিবী পরিবর্তনের অতীতের সকল বিপ্লবী সংগ্রামই কি তা হলে প্রতিবিপ্লবী? কারণ সব বিপ্লবী নেতাই বিপ্লব পরিচালনার প্রয়োজনেই কম অথবা বেশী একনায়কে পরিণত হন। বিপ্লব পরিচালনা, নূতন সমাজ গড়ে তোলা, পুরাতন সমাজের বাধাকে শক্ত হাতে দূর করার প্রয়োজনেই সেই চরিত্র গড়ে ওঠে। বিপুল ব্যাপক জনগণ সেটাকে আশীর্বাদ হিসাবেই মেনে নেয় শুধু মেনে নেয়ই না স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেও বিপুল সংখ্যক জনগণ উদ্বুদ্ধ হয়। নতুবা কোন বিপ্লবই বিজয় লাভ করে না। অতীতের সকল বিপ্লবের ইতিহাস সেটাই প্রমাণ করে। আর প্রতিক্রিয়ার সকল শক্তিই ইতিহাসের সেই বাস্তবতাকে ভয় করে। স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, সমাজে তথাকথিত শান্তি বজায় রাখা তাদের জন্য একান্ত কাম্য। শান্তি বজায় থাকলেই তো ‘এশিয়া এনার্জির মত রক্ত পিপাসু মুনাফালোভী বহুজাতিক কোম্পানী’রা তাদের মুনাফার পাহাড় গড়ে যেতে পারবে। বিপ্লবী নেতৃত্বের দ্বারা একনায়ক সুলভ নির্দেশের মাধ্যমে তাদের শোষণের পথ বন্ধ করলে বা তাদের প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপ বন্ধ করে দিলে বা তার জন্য শাস্তি বা মৃতদণ্ড দিলে বা তাদের অনুচরদের দণ্ড দিলে সেটা একনায়কী কর্মকাণ্ড বলে নিন্দার ঝড় তো তারা উঠাবেই! এটা অনিবার্য সত্য। কিন্তু তাই বলে কি শোষণ-নির্যাতন নির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় বিপ্লব চিরতরে থামিয়ে দেওয়া যায়? অতীতে যেমন স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাস বিদ্রোহ থেকে শুরু করে যে সকল বিপ্লবী সংগ্রাম হয়েছে সেসকল সংগ্রামের কি পৃথিবীর ইতিহাস পরিবর্তনে কোনই ইতিবাচক ভূমিকা নাই? ইংল্যাণ্ডে ক্রমওয়েলের বিপ্লব (১৬৪৯ খ্রীঃ-১৬৫৮খ্রীঃ), আমেরিকায় দাস প্রথা উচ্ছেদের জন্য আব্রাহাম লিংকনের দাস প্রথা বিরোধী বিপ্লবী যুদ্ধ (১৮৬১-১৮৬৫ খ্রীঃ), ফরাসী বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রীঃ) এগুলি তাহলে কী? ইতিহাসের অগ্রগমনে এসব বিপ্লবের কি কোন ভূমিকা নাই? এসব বিপ্লব বা বিপ্লবী যুদ্ধের নেতারাও কি কর্মকাণ্ড পরিচালনার কালে একনায়কে পরিণত হন নাই? তাদের সমর্থক বা অনুসারীদের দৃষ্টি দিয়ে না দেখে তাদের শত্রুদের দৃষ্টি দিয়ে দেখলে কি তেমনটাই দেখা যাবে না? তাহলে কি সব বিপ্লব ও বিপ্লবী নেতাদের সমস্ত কার্যকলাপকে বাতিল করে দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসের অগ্রগমনে তাদের অবদানকে অস্বীকার করতে হবে? ইতিহাসের অগ্রগমনের ধারাকেই তাহলে বাতিল করতে হয়। রক্ত পিপাসুদের স্বর্গরাজ্যে স্থীতিশীলতা রাখতে চাওয়া মানে তো রক্ত-পিপাসুদের রক্ত পিপাসা মিটাবার ব্যবস্থায় সহায়তা করা। এর বিরুদ্ধে বিপ্লবী সহিংসতা বা বিপ্লবী একনায়কত্বকে নিন্দা করা এবং নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করা মানে তো কৌশলে ‘রক্ত পিপাসু’দের সাহায্য করা, তাদের কৌশলী সৈনিকের ভূমিকা পালন করা, তাই নয় কি? বিষয়টি ভেবে দেখার আহ্বান জানাচ্ছি।
শেষ পর্যন্ত লেখক বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বলছেন, ‘আমি মনে করি বৈজ্ঞানিক নয়, বরং আধুনিক মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেই আজকের দিনে মার্ক্সিজমের গুরুত্ব এবং আরোপ যোগ্যতা বিবেচনা করা উচিত। কারণ সমাজতন্ত্রের অবস্থান এশিয়া এনার্জির মত রক্ত পিপাসু মুনাফালোভী বহুজাতিক কোম্পানির হীন উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে এখনো প্রচণ্ডভাবেই মানবিক অন্তত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তো বটেই। এটাকে অস্বীকার করা বোকামী।’ এখানে উল্লেখিত ‘প্রচণ্ডভাবেই মানবিক’ শব্দটি আমার কাছে দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে। কারণ ‘মানবিক’ শব্দটার পর তাহলে করণীয় কী তার কিছুই বলা হয় নাই বা ইঙ্গিতও দেওয়া হয় নাই। তাহলে মানবিক হওয়ার কারণে কি ভুক্তভোগীরা করুণা বর্ষণের আশায় দু’হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকবে? নাকি ‘এশিয়া এনার্জির মত রক্ত-পিপাসু মুনাফালোভী বহুজাতিক কোম্পানীর’ ক্রীড়নক হয়ে উঠবে? নাকি সঙ্গতভাবে শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে লড়াই করে ‘রক্ত-পিপাসু’ ঐ বহুজাতিক কোম্পানীদের উচ্ছেদ করে ‘বিপ্লব’ সম্পন্ন করবে? দেখা যাচ্ছে এই বিপ্লব সম্পন্ন করতেই লেখক মহোদয়ের ভীষণ আপত্তি কারণ তা করলেই শ্রমিকদের নামে নেতারাই একনায়ক হয়ে উঠবে! তাহলে কী করতে হবে? তাহলে বিপ্লব করা যাবে না। মানে স্থিতাবস্থা বজায় থাক।
এভাবেই তিনি সুকৌশলে স্থিতাবস্থার পক্ষেই তার যুক্তি সাজিয়েছেন। মানে বাস্তব অবস্থা দৃষ্টে এশিয়া এনার্জিকে তিনি যতই ‘রক্ত-পিপাসু’ বলুন না কেন তার বক্তব্য বা বক্তব্যরূপী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনি ‘এশিয়া এনার্জির’ পক্ষেই কাজ করছেন। সুতরাং জর্জ বার্নার্ড শ-কে উদ্ধৃত করছেন, ÔRevolutions have never lightened the burden of tyranny, they have shifted it to another shoulder.’ (অর্থ: বিপ্লব কোনদিনই নিপীড়ক ও স্বেচ্ছাচারী শাসনের বোঝাকে হালকা করে নাই, বরং সেটাকে এক কাঁধ থেকে আরেক কাঁধে চালান দিয়েছে।) তাহলে লেখকের ‘মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ’ অনুযায়ী করণীয় সীমানা কোন পর্যন্ত? শুধু ছোটখাটো আন্দোলন-সংগ্রাম-প্রতিবাদ পর্যন্ত? হাঁ, তাহলে প্রতিটা দেশে তৃতীয় বিশ্বের যত নিপীড়িত দেশই হোক না কেন, বিপ্লব নয়, স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে। বিশ্ব ব্যবস্থাও স্থিতিশীল থাকবে। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার নায়ক মার্কিনী নেতৃত্ব বিশ্ব ব্যবস্থাকে অতি সহজে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে। আর যদি কখনও মনে করে কেউ বেয়াদবী করছে তখন তার নিজ তত্ত্ব অনুসারে আক্রমণ করে দখল করে নিবে, লুণ্ঠন করবে এবং বশংবদ কোন অনুগত মিত্রকে ক্ষমতায় বসিয়ে চিরস্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রিত সরকার কায়েম করবে, এবং এভাবে চিরস্থায়ী লুণ্ঠনের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করবে।
বর্তমানে উন্নত বিশ্বে পোস্ট-মডার্নিস্ট বা উত্তর-আধুনিক দর্শন চর্চার বিকাশ হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশেও উচ্চশিক্ষিত দর্শন-প্রিয় পণ্ডিতবর্গের কাছে তার ঢেউ পৌঁছেছে। অনেকেই প্রভাবিত হয়েছেন। এমনও মনে হয়েছে কেউ কেউ পোস্ট-মডার্নিস্ট চিন্তার অনুসারী হিসাবে নিজেকে ভীষণ গর্বিত মনে করেন, আর এই চিন্তায় কেউ বিশ্বাসী না হলে তাদেরকে মূর্খ, অশিক্ষিত, এমনকি বর্বর ভাবতেও পছন্দ করেন। জানি না সেই ধরনের ব্যক্তিবর্গ বাস্তবতার সঙ্গে নিজের এবং সমাজ জীবনকে কতটুক মিলিয়ে দেখেন। উত্তর আধুনিক দার্শনিক চিন্তার মর্মে আছে এই বার্তা যে, ক্ষমতার সাংগঠনিক কাঠামো বা ক্ষমতা কাঠামো খারাপ, ক্ষমতা সৃষ্টি করলেই সমস্যার সৃষ্টি হয়, সুতরাং সেটা পরিত্যাজ্য। ক্ষমতার মর্মে আছে দমন বা পীড়ন। কাজেই এক ক্ষমতা কাঠামোকে ভাঙ্গতে গিয়ে পাল্টা যে ক্ষমতা কাঠামো গড়ে ওঠে সেটাও হয় তাদের মতে সমান নিপীড়ক। সুতরাং তাদের মতে ক্ষমতায় যেয়ে বিপ্লবীরা নিজেরাই ডিক্টেটর হয়ে যায়, প্রতিবিপ্লবী হয়ে যায় কিংবা নিপীড়ক হয়ে যায়। অতএব পাল্টা ক্ষমতা গড়া যাবে না। সমাজ বিপ্লব করা যাবে না। শুধুমাত্র প্রতিবাদ, ছোটখাটো সংগ্রাম বা আন্দোলন করা যেতে পারে ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থেকে। জাতীয় বা আন্তজার্তিক পর্যায়ে সংগঠিত রূপে নয়। যাতে ক্ষমতা কাঠামোর মাধ্যমে কখনও কেউ আর ডিক্টেটর না হতে পারে যাতে নূতন করে আর কোন ক্রমওয়েল, রোবেসপিয়ের, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও, হো চি মিন বা ক্যাস্ট্রো সৃষ্টি না হতে পারে। কোন অবস্থায়ই বিপ্লব করা যাবে না। এজন্য মার্ক্সবাদকে অবশ্যই বাতিল করতে হবে। নতুবা শ্রেণী সংগ্রামের নাম করে তা বিপর্যয় সৃষ্টি করবে মাত্র। বিপ্লব মানেই তো নিষ্ঠুরতা, নরমেধ যজ্ঞ!
এই ধরনের বাণী শুনতে আপাত মধুর, চমৎকার লাগে বইকি! কিন্তু ফলশ্রুতি কী? স্থিতাবস্থা বিরাজ করুক সমাজের সর্বস্তরে, দেশে দেশে, সমগ্র বিশ্বজুড়ে! কোন ‘রক্তপিপাসু বহুজাতিক কোম্পানী কিংবা সেই বহুজাতিক কোম্পানীদের সরকারগুলি অন্য কোন তৃতীয় বিশ্বের দেশে শোষণ-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কায়েম করলেও তো কিছু করার নাই। কিছু প্রতিবাদ বা বড় জোর মানব বন্ধন জাতীয় কোন সাময়িক আন্দোলন ছাড়া। শোষণকারীদের জন্য সোনায় সোহাগার ব্যবস্থা নয় কি? ‘রক্ত পিপাসু মুনাফালোভী বহুজাতিক কোম্পানীর হীন উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে’ আসলে কোন কার্যকারী লড়াই হবে না। তারা নির্বিবাদেই তাদের ‘রক্ত পিপাসু’ চরিত্র বিস্তৃত করে চলতে পারবে চিরন্তন ভাবেই। বিপ্লবী সংগঠন, সংগ্রাম এবং বিপ্লবকে এভাবে বাতিল করতে পারলে বহুজাতিক কোম্পানীর শেয়ার বা স্টক কেনা শিক্ষিত ‘বহুজাতিক কোম্পানীর কর্মী বা শ্রমিকেরা’ যারা ‘নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারছে অনেক ভালভাবে এই পুঁজিবাদী সমাজেই’ সেই সব শিক্ষিত কোম্পানীর কর্মী বা শ্রমিকদের পক্ষে দ্বিধাহীন চিত্তে বলা সম্ভব জয়তু পুঁজিবাদ। কিন্তু প্রশ্ন, শতকরা কতভাগ লোক বহুজাতিক কোম্পানীতে কর্মী হিসাবে নিয়োজিত? বিশেষ করে নিবন্ধকারের বক্তব্য অনুসারেই ‘অন্তত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে’?
সুতরাং সংগঠন, সংগ্রাম, বিপ্লবের পথ পরিত্যাগ করে শোষণকারী বহুজাতিক রক্ত পিপাসু কোম্পানীগুলোকে নির্বিবাদ শোষণের চিরস্থায়ী ইজারা দেয়া উচিত কিনা সেটা অবশ্যই বারবার ভেবে দেখার দাবী রাখে ─ অন্তত আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের তথা এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার শোষিত দরিদ্র দেশগুলোতে।
দুই
মার্ক্সবাদ ও মার্ক্সবাদী বিপ্লব সম্পর্কে অভিজিত বাবুর উত্থাপিত অভিযোগগুলোর কিছু কিছু সত্য বলে মনে করার পরও আমি বিষটি নিয়ে আলোচনা করছি এ কারণে যে, আমার কাছে মনে হয়েছে তিনি অভিযোগগুলো উত্থাপন করেছেন মার্ক্সবাদী তত্ত্বের সৃষ্টির প্রথম থেকেই যারা মার্ক্সের তত্ত্বের সর্বতোভাবে বিরোধিতা করেছেন, এমনকি তার জন্মভূমিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাকে যারা তিষ্ঠাতে দেন নাই, বসবাস করতে দেন নাই লণ্ডনে বাস শুরুর আগ পর্যন্ত, এমনকি তার পরেও লণ্ডন থেকেও তাড়ানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু ব্রিটেনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সে প্রচেষ্টা নাকচ করে দেবার ফলে অবশিষ্ট জীবন তিনি সেখানেই কাটাতে পেরেছিলেন তাদের সেই বিরোধী প্রচারের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ পথেই যেন এ নিবন্ধেও মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে আধুনিক যুক্তি সহযোগে।
কিন্তু যুগ পরম্পরায় সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি আর একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক এক ব্যাপক ব্যবধান নিয়ে বিরাজ করছে। তখন যারা তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, সেই সময়টা ছিল শিল্প বিপ্লবের কৈশোর যুগ। শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন ব্যক্তি উদ্যোগের উল্লম্ফন ঘটছে তেমন দয়ামায়াহীনভাবে নিষ্ঠুর শোষণের মধ্য দিয়ে নামমাত্র মজুরীর বিনিময়ে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত শ্রমিকদের অমানবিকভাবে খাটিয়ে নিয়ে পুঁজির সঞ্চয় করছে। অন্যদিকে সেই শোষণের হাত থেকে বাঁচবার জন্য গোটা পশ্চিম ইউরোপ জুড়েই শ্রমিক অসন্তোষ বিরাজ করছে। যদিও শ্রমিকদের শক্তিশালী কোন বিশেষ দিকদর্শন জানা ছিল না। এই পটভূমিতে শ্রমিক ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের সামনে কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস এই দর্শন হাজির করেন। বুদ্ধিজীবীসহ শিল্প জগতে শ্রমিক-মালিক উভয় অংশের মধ্যেই ব্যাপক সাড়া জাগায় এই মতবাদ। শ্রমিক পক্ষ আশা জাগানিয়া এক নতুন আলোর ঝলকানি হিসাবে এবং অন্যপক্ষ অর্থাৎ মালিক পক্ষ, বিব্রতকর এক প্রমাদ বা ভীতি নিয়ে দেখে এই মতবাদকে। ক্রমবর্ধমান শ্রমিক আন্দোলনের চাপে মালিকপক্ষ তাদের অমানবিক অত্যাচারের রূপ পাল্টাবার ব্যাপারে চিন্তা করতে বাধ্য হল। শ্রমিকদের জীবনের নানা অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া ক্রমান্বয়ে শুরু হল। এইভাবে ক্রমান্বয়ে গত প্রায় দেড় শতাব্দী কালব্যাপী নানা পথে শ্রমিকদের সুযোগ বৃদ্ধি করে পশ্চিম ইউরোপ বা পাশ্চাত্য আজকের জায়গায় এসে পৌঁছেছে। শ্রমিকদের ক্ষেত্র বিশেষে শেয়ার বা স্টক নেবার সুযোগ দিয়ে, শিক্ষিত কর্মী বা শ্রমিকদের নানা বিষয়ে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পৃথিবীব্যাপী ‘এশিয়া এনার্জি’ মার্কা বহুজাতিক কোম্পানীগুলো শোষণের জাল বিস্তৃত করেছে। শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। এ যেন মালিক পক্ষ তাদের শোষণের সহযোগী শক্তি বাড়াবার জন্য এই কৌশলকে আয়ত্ত করে গোটা পৃথিবী বিশেষ করে অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের গরীব অধিবাসীদের নানা কায়দায় লুণ্ঠন করছে।
আজকের পবিবর্তিত বিশ্বের পুঁজিবাদীদের এই জাতীয় বিভিন্ন প্রক্রিয়াকেই কি নিবন্ধকার বলছেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নিজস্ব সিস্টেমের দুর্বলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে বিবর্তিত হয়েছে? হাঁ, যুদ্ধ তো বটেই, তবে সেটা শ্রমিকদের সঙ্গে, এবং শ্রমিকদের ভিতর বিপ্লবী দর্শনের আবির্ভাবের ফলে সৃষ্ট চাপের সঙ্গে এই যুদ্ধ বললেই বোধ হয় সঙ্গত হত। তবে এই পরিবর্তনগুলো একদিনে বা এক যুগেও হয় নাই। প্রায় দেড় শত বছরের ধারাবাহিক ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। বুর্জোয়াদের ভিতরের হাজারো ভুলের সংশোধন বা পরিবর্তন হাজার প্রক্রিয়ার বা উদ্যোগের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। সে বিষয়টাও স্মরণে রাখার বিষয় বলে আমার মনে হয়। এবং প্রক্রিয়াগুলো বুর্জোয়ারা সম্পন্ন করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রবল লড়াইয়ের মুখে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এবং স্ফীত হবার প্রয়োজনেও বটে। এভাবেই বিভিন্ন গবেষণার মধ্য দিয়ে যন্ত্রপাতির আবিষ্কার ও উন্নয়ন এই পর্যায়ে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। মার্ক্সবাদের প্রভাব শ্রমিক সমাজের চেতনাকে প্রভাবিত না করলে এবং বুর্জোয়াদেরকে মানসিক চাপের মধ্যে না ফেললে এই মানবিক পরিবর্তনের অভিযাত্রা হয়ত আরও বহুযুগ ধরে উপেক্ষিতই থেকে যেত। বিশেষ করে রাশিয়াতে যখন সোভিয়েত বিপ্লব বিজয় লাভ করল তখন থেকে বুর্জোয়াদের মধ্যে এই চাপটা বহুগুণে বেড়ে যায়। তারা শ্রমিকদের প্রতি ক্রমান্বয়ে মানবিক হতে চেষ্টা করে কিংবা আরও সঠিকভাবে বললে বাধ্য হয়। অবশ্য সেই সঙ্গে তার চেয়েও বেশী চেষ্টা করতে থাকে মার্ক্সবাদ বিরোধী প্রচার ও সোভিয়েত বিরোধী কার্যকলাপকে এগিয়ে নিতে। অন্যদিকে মার্ক্সবাদী চেতনায় সংগঠিত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে কঠিন শ্রম সাধনার পথে কৃষিপ্রধান একটি দেশকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শিল্পপ্রধান দেশে রূপান্তরিত করেছিল সোভিয়েত নেতারা। লেনিনের মৃত্যুর পর যার নেতৃত্ব যায় স্ট্যালিনের হাতে। ক্রমান্বয়ে তিনি কঠোর ডিক্টেটরে পরিণত হন। এই পরিণতির কারণ রাশিয়ার বাস্তব পরিস্থিতি ছাড়াও মার্ক্সবাদের মধ্যেও অনেকাংশে নিহিত ছিল। আর মার্ক্সবাদের অভ্যন্তরের এই কঠোরতার বুনিয়াদের ফলেই অনুন্নত কৃষিভিত্তিক একটি দেশ সোভিয়েত রাশিয়াকে তুলনামূলকভাবে অনেক কম সময়ের মধ্যে শিল্পোন্নত একটি দেশেই শুধু পরিণত করা সম্ভব হয় নাই, সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মহাশক্তিধর জার্মানিকে পর্যুদস্ত করাও সম্ভব হয়েছিল।
হিটলারের সকল দাম্ভিক পরিকল্পনাকে ধূলিসাৎ করতে মূল ভূমিকা পালন করেছিল রাশিয়া। যদি সেদিন রাশিয়া হিটলারকে পরাজিত করতে না পারত তবে আজকের পৃথিবীর বিকাশের কাঠামোগত বিন্যাস এই পর্যায়ের হতো না। সেই ইতিবাচক দিকটা ভুলে যাওয়া মানেও সত্যকে ভুলে যাওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে জার্মান বাহিনী যখন সোভিয়েত রাশিয়ার বিশাল অঞ্চল দখল করে নেয় তখন জার্মান দখলকৃত অঞ্চলে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গড়ে ওঠা ‘পার্টিজান বিদ্রোহ’ বলে খ্যাত সোভিয়েত জনগণের এক বিশেষ গণযুেদ্ধর মাধ্যমে দখলীকৃত অংশের কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থক জনগণ বিপুল আবেগে আত্মত্যাগের পথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যার ফলে জার্মান বাহিনী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এটা সোভিয়েত মূল বাহিনীকে বিজয়ের পথে এগিয়ে যেতে বিরাটভাবে সাহায্য করে। এইভাবে জনগণের এমন স্বতঃস্ফূর্ত এবং এমন প্রচণ্ড ও সর্বাত্মক প্রতিরোধ যুদ্ধ তৎকালে আর কোথায়ও হয় নাই। এই আত্মত্যাগ সম্ভব হয়েছিল মার্ক্সবাদ দ্বারা উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেম থেকেই। মার্ক্সবাদ সোভিয়েত জনগণকে দেশপ্রেম ও শৃঙ্খলাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে এক সময় এভাবেই ভূমিকা পালন করেছিল। স্ট্যালিনের একনায়কত্বকে এখন অনেকে যেভাবে চিত্রিত করেন বিষয়টা যদি ঠিক সেভাবেই সত্য হত, তাহলে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, প্রথম পর্যায়ে সোভিয়েত রাশিয়ার বিশাল অঞ্চল জার্মান দখলীভুক্ত হওয়ার পরে সেই জনগণ কেন আত্মত্যাগের পথে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? ঐ মুহূর্তে অবশিষ্ট রাশিয়ার জনগণই বা কেন ইস্পাতদৃঢ় সমর্থন ও সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিল Ñ যার ফলে জার্মানীর টাকা দিয়ে কেনা পঞ্চম বাহিনীর আত্মঘাতী কার্মকাণ্ডকেও মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছিল? বিষয়টি কি ভাবিয়ে তোলে না?
প্রাচ্যের পশ্চাৎপদ সামন্তবাদী স্বৈরতন্ত্রের শাসনভুক্ত চীনকেও মার্ক্সবাদ উদ্বুদ্ধ করেছিল। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থেই সান ইয়াৎ সেন মার্ক্সবাদী বিপ্লবীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের সাথে ঐক্যের পথে চীনকে এগিয়ে নেওয়ার কর্মধারা নির্ধারণ করেন। কমিউনিস্ট বিপ্লবের পূর্বে চীনে দুর্ভিক্ষ ও বন্যায় প্রায় প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ লোক মারা যেত। বিপ্লবের পরেও কৃষি সংস্কারের সময় বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল। আলোচিত নিবন্ধের সংখ্যাতত্ত্বটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও সে ব্যাপারে আমি কিছু বলবো না। আমার বক্তব্য হল চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তাদের ভুল-ভ্রান্তিকে চিহ্নিত ক’রে, সংশোধন ক’রে চীনকে আধুনিক শিল্প-উন্নত জাতি হিসাবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সে সম্পর্কেই দু’একটি কথা বলা উচিত বলে মনে করি।
প্রাচ্যের সামন্ত স্বৈরতন্ত্রের নিগড়ে বাঁধা চীন, অশিক্ষা ও পশ্চাৎপদতার অন্ধকারে ডুবে থাকা চীন এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক বৃটিশ, ফরাসী ও ওলন্দাজদের দ্বারা সরবরাহকৃত ও পরিচালিত আফিম ব্যবসার প্রভাবে নেশায় ‘বুঁদ’ হয়ে থাকা ঘুমন্ত চীনকে মার্ক্সবাদী আদর্শ দ্বারাই জাগিয়ে তোলা এবং পথ চালিত করা হয়। ভুল-ভ্রান্তি কাটিয়ে উঠে অতিদ্রুত তারা আজ বিশ্ব উন্নয়নের এক মডেলে পরিণত হয়েছে।
প্রসঙ্গান্তরে আমি একটু উল্লেখ করতে চাই যে, নিবন্ধকার এক জায়গায় বলেছেন, ‘বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জায়গায় সফলতা এলেও ধনতন্ত্রের পতন হয় নি।’ ধনতন্ত্রের পতন হয় নি এটা যেমন ঠিক, ঠিক তেমনি বলা যায় যত হালকা ভাবে বলছেন ‘কিছু বিচ্ছিন্ন জায়গায় সফলতা এলেও’ এই কিছু জায়গা কিন্তু পৃথিবীতে জনসংখ্যার বিচারে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এবং ভূ-খণ্ডগত দিক থেকেও প্রায় তা-ই ছিল। তাহলে সেটা কি একেবারেই গুরুত্বহীন ব্যাপার? বিশেষ করে বাকী দুই-তৃতীয়াংশের মধ্যে এশিয়া আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার তৃতীয় বিশ্বের অঞ্চলগুলো বাদ দিলে ধনতান্ত্রিক উন্নত বিশ্ব বোধ হয় বিশ্বের এক তৃতীয়াংশও হবে না। তাই নয় কি? তবে তারা উন্নত, সম্পদশালী ও মহা ক্ষমতাধর শক্তি। তাদের দাপটে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্ব সর্বদা কম্পমান, শোষণে জর্জরিত, অতিষ্ঠ। এই শোষণের বর্তমান প্রধান রূপ দাতা রূপ ও বাণিজ্য রূপ। প্রয়োজনে তারা আক্রমণকারী রূপেও আবির্ভূত হয় বটে। যা বর্তমানেও চলছে। কিন্তু বিশ্বের ঐ এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল যে একদা মার্ক্সবাদী আদর্শে বিশ্বাসী সমাজ কাঠামোর মধ্যে এসেছিল এবং সাম্রাজ্যবাদী শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করতে পেরেছিল, সেটা অস্বীকার করি কী করে? মার্ক্সবাদের ভাবাদর্শই কি সেই শক্তি নয় যার বলে বলীয়ান হয়ে ক্ষুদ্র দ্বীপ-রাষ্ট্র কিউবা ‘বুর্জোয়া’ শক্তির শিরোমণি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল বিরোধিতা এবং সকল চক্রান্তকে উপেক্ষা করে নিজের অস্তিত্বটুকুই শুধু টিকিয়ে রাখে নাই, বরং ল্যাটিন আমেরিকার মানুষকে মার্কিন ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর থাবার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে অনুপ্রাণিত করছে, এখন পর্যন্ত সাহস যোগাচ্ছে? বিষয়টা কি ভেবে দেখার নয়? তাহলে মার্ক্সবাদের ইতিবাচক সব গুণকে একেবারে খারিজ করা যায় কী ভাবে? তাই মনে হচ্ছে এ প্রবণতাটা মার্ক্সবাদের আদিযুগের সেই সর্বাত্মক বিরোধিতাকারী বুর্জোয়াদের মতই একপেশে, আধুনিক যুগের যুক্তিবাদী মানুষের মত নয়। তাই কি লেখক শেষাবধি দ্বিধার সাথে বিষয়টাকে তৃতীয় বিশ্বের প্রেক্ষাপটে কিছুটা স্বীকৃতির সঙ্গে বলেছেন, এবং বহুজাতিক রক্ত শোষক কোম্পানী ‘এশিয়া এনার্জির’ শোষণের কথাও উল্লেখ করেছেন?
এশিয়া এনার্জির মত বহুসংখ্যক ‘রক্ত শোষক’ বহুজাতিক কোম্পানী অন্ুন্নত বিশ্বের দেশে দেশে নানা ফন্দিফিকির করে রক্ত শোষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের কোটি কোটি জনগণের ভাগ্য কিন্তু এই বুর্জোয়াদের পরিবর্তিত রূপের দ্বারা উপকৃত হচ্ছে না। মার্ক্সবাদের চেতনা উদ্ভূত সংগ্রামী আদর্শ, বিপ্লবী আদর্শই অকূলের দিশা হিসাবে এখনও অনেকের কাছেই প্রবহমান রয়েছে। তাহলে কী করে এই বাস্তবতা অস্বীকার করা যায়? পৃথিবীর অগ্রগতির ইতিহাস থেকে মার্ক্সবাদকে কী করে মুছে ফেলে দেওয়া যায়? যে আদর্শের আপাত কঠোর চরিত্রের মধ্যেও অনুন্নত বিশ্বের দ্রুত উন্নয়নের আঁকাবাঁকা এক পাকা মহাসড়ক রয়েছে কী করে তার অবদানকে একেবারে অস্বীকার করা যায়? বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা উচিত।
তিন
দর্শনের বিচারে মার্ক্সবাদের মধ্যে কিছু ত্রুটি আছে। মার্ক্সবাদই প্রথম দ্বন্দমূলক ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা প্রদান করে। এই মতবাদের সূত্রায়নের মধ্যে প্রথমেই প্রচ্ছন্নভাবে কিছু ভুল থেকে যায়। এঙ্গেলস তাঁর ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’-তে বলছেন, ‘গোত্র-প্রথা এমন একটি সমাজ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল যেখানে কোন অভ্যন্তরীণ বিরোধ ছিল না। এই প্রথা কেবল মাত্র এইরূপ সমাজেরই উপযোগী ছিল। জনমত ছাড়া এর আর কোন জবরদস্তি শক্তি ছিল না।’ কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং শ্রেণীভেদের উদ্ভবের ফলে ‘গোত্র প্রথার উপযোগিতা ফুরিয়ে গিয়েছিল। শ্রম বিভাগ এবং তার পরিণাম সমাজের শ্রেণী বিভাগ একে ধ্বংস করল। এর জায়গায় এল রাষ্ট্র।’ বস্তুত এখানেই ভাববাদের বীজ অতি সূক্ষ্মভাবে রোপিত হয়ে গিয়েছিল। কারণ শ্রেণী বিভাগ ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি উদ্ভবের পূর্বে প্রাচীন গোত্র সমাজ থেকে আধুনিক সভ্য সমাজে রূপান্তরকে দেখা হচ্ছে দ্বান্দিক বস্তুবাদের বিপরীতে শুদ্ধতাবাদী ভাববাদী সৃষ্টিকোণ থেকে। এই ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির ফলেই তারা আদিম সমাজের ভিতরে কোন অভ্যন্তরীণ বিরোধ বা দ্বন্দ দেখতে পান নাই, ফলে দেখতে পান নাই কোন রকমের শ্রেণীভেদ এবং ক্রমান্বয়ে আদিম গোত্রেরই রাষ্ট্রে রূপান্তর বা বিকাশকে। প্রকৃতপক্ষে সমাজ থাকলেই সেখানে কোন না কোন রূপে কিছু না কিছু দ্বন্দ্ব থাকবেই এবং ক্ষমতারও কিছু না কিছু অসম বণ্টন থাকবেই। তা না হলে ক্ষমতার কাঠামো টিকিয়ে রাখার জন্য কে অভিভাবকত্ব করবে? অতি সরলভাবে হলেও কে সেই সমাজ পরিচালনা করবে? কাজেই কোন না কোন ভাবে সেই সমাজ পরিচালনার জন্য যত শিথিলভাবেই হোক সেখানে ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। সেটা এককভাবে হোক অথবা সহযোগী সমন্বয়েই হোক। সমাজে সেই কাঠামো মূলত স্বেচ্ছামূলকভাবেই গড়ে উঠত। তবুও যে ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি নিয়ে তা গড়ে উঠত সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি আর দশজন থেকে বেশী ক্ষমতার অধিকারী ছিল। তারা সাধারণত প্রাচীন ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করেই সমাজ চালাত। কিন্তু তাই বলে ক্ষমতার প্রয়োগ সর্বদাই ব্যক্তি নিরপেক্ষ হত, এই ‘বিশুদ্ধ বিবেকবান’ ভাবনাটাই তো ‘বিশুদ্ধবাদিতা’ যার উদ্ভব অতি সূক্ষ্মভাবে হলেও ভাববাদ থেকে। একইভাবে শক্তিমানের প্রতি উপজাতি বা গোত্রের আনুগত্য সব সময়েই স্বেচ্ছামূলক ছিল তেমন বিমূর্ত আদর্শের চিন্তাটাও ভাববাদী। আসলে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সেই প্রাচীন যুগেও ছিল। তবে সেই যুগে এত জটিলতা ছিল না, ছিল না সূক্ষ্মতা ও বুদ্ধিবৃত্তির এত প্রভাব।
যেভাবেই ক্ষমতাসীন হোক না কেন আদিম সমাজেও নেতারা সমাজের অন্যান্য সদস্যদের থেকে বেশী ক্ষমতার অধিকারী ছিল। সেই সমাজেও যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবৃন্দের প্রতিভা কিংবা মনস্তাত্ত্বিক অথবা দৈহিক ক্ষমতা উপজাতি বা গোত্রের সদস্যদের নিরাপত্তা বোধকে তৃপ্ত করতে পারত কিংবা তাদের মনে সম্ভ্রম ও আস্থা জাগাতে পারত সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবৃন্দই যে সেই সমাজের নেতৃত্বের আসন পেত বা দখল করত তাতে সন্দেহের কোন কারণ নাই। এই দখল সর্বদাই শান্তিপূর্ণ উপায়ে হত এটা মনে করারও কোন কারণ নাই। গোত্রের শক্তিমান কোনও ব্যক্তির সঙ্গে ক্ষমতা বা নেতৃত্ব নিয়ে গোত্র প্রধানের কখনও কোন দ্বন্দ্ব বা লড়াই হত না, এমন কথা ভাববারই কি কোন যুক্তি আছে? প্রাণী জগতেও কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা নিয়ে, সুযোগ নিয়ে অহরহ যে লড়াই আমরা দেখি মানব সমাজ কি সেই লড়াইয়ের বাইরে ছিল? তাই মার্ক্সবাদ যখন সেই রকম কোন দ্বন্দ্বহীন সমাজের চিত্র আঁকে তখন তাকে অতি কাল্পনিক হিসাবেই ধরে নিতে হয়।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের নিয়ম অনুসারেই দ্বন্দ সর্বত্র বিরাজমান। একই নিয়মে সমাজের মধ্যেও দ্বন্দ্ব চির বহমান। মানব সমাজের ঊষা লগ্নে যখন সমাজ গঠন হয়েছে সেই সময় থেকেই সমাজে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তা চির বহমান থাকবে। হাঁ, ভবিষ্যতে মানুষের প্রচেষ্টায় সম্পদ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন ও সরবরাহ যুক্তিপূর্ণ এবং যথাসম্ভব ক্রটিমুক্ত ও মানবিক হবে এবং সে সমাজে অঢেল প্রাচুর্য আসতে পারে ধরে নিয়েও বলতে হয়, সমাজ যেহেতু কোন না কোন নিয়ম অনুসারে চলবে এবং কোন কর্তৃপক্ষও থাকবে, সুতরাং সেখানে দ্বন্দ্বও থাকবে। সেই দ্বন্দ্ব হবে সমাজ-কর্তৃত্বের সঙ্গে সমাজ-সদস্যদের এবং সমাজ-সদস্যদের নিজেদের মধ্যেও। ফলে ভিন্ন রূপে হলেও সামাজিক দ্বন্দ্বের এক বিশেষ প্রকাশ শ্রেণীদ্বন্দ্বও থাকবে। দ্বন্দ্বের ধরন আজকের মত নাও হতে পারে Ñ কিন্তু দ্বন্দ্ব থাকবে। কারণ দ্বন্দ্ব চিরন্তন। বিশ্বের মানব সমাজ যতদিন থাকবে, সেই সমাজে দ্বন্দ্বও ততদিন থাকবে।
রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বর্ণনা করতে যেয়ে দ্বন্দ্বহীন আদিম সমাজের যে কল্পনা এঙ্গেলস করেছিলেন, সেই কল্পনারই ভবিষ্যৎ প্রতিরূপ হিসাবে শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজ কল্পিত হয়েছে। এখানে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের নিয়ম অনুসারেই বলতে হবে মার্ক্সবাদের অভ্যন্তরে স্ব-বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ মার্ক্সবাদ মূলত সমাজকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের দৃষ্টিতেই বিশ্লেষণ করেছে। কিন্তু এখানে তা ভাববাদের নিগড়ে বন্দী হয়ে গেছে। তাদের কল্পিত শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজের আকাক্সক্ষা শাব্দিক অর্থে বাস্তবায়িত না হলেও প্রচুর্যময়, যুক্তিগ্রাহ্য এক সচ্ছল সমাজ মানুষ চেষ্টা করলে গড়তে পারবে তার জ্ঞান, মেধা ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অন্যায় ও যুক্তিহীন অমানবিক শোষণের পদ্ধতিকে উচ্ছেদ করে। তার জন্য অবশ্যই ক্ষমতা কাঠামো লাগবে। সেই ক্ষমতা কাঠামোর নায়কেরা যদি একনায়কী কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকাণ্ডের দ্বারা জনগণের জীবনে যুক্তিহীন বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে, তবে সেই যুগের মানুষ পাল্টা ক্ষমতা কাঠামো গড়ে একনায়কের বিরুদ্ধে অবশ্যই লড়াই করবে, যে কোন প্রক্রিয়ায়ই হোক না কেন, এবং তাকেও উচ্ছেদ করবে। বেশীর ভাগ জনগণের সচেতন আস্থার উপরই কোন ক্ষমতা কাঠামো শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে।
এভাবেই সমাজে দ্বন্দ্ব হবে, বিপ্লব হবে, নূতন ক্ষমতা কাঠামো গড়ে উঠবে। সমাজ বিবর্তনের এই খেলা চলবে চিরন্তন প্রক্রিয়ায়, অনন্ত কাল জুড়ে, মানব সভ্যতা যতদিন বহমান থাকবে।
এ কথার অর্থ কিন্তু মোটেও এ নয় যে মার্ক্সবাদ ব্যর্থ হয়ে গেছে। সামন্ত সমাজের পুরাতন শোষণ ও শাসন ব্যবস্থা ছিন্ন করে নূতন বুর্জোয়া সমাজের জন্ম হয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ ধরে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব পশ্চিম ইউরোপেই সৃষ্টি হয়েছিল। ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে ইংল্যাণ্ডে তা প্রথম রাজতন্ত্র বিরোধী রাষ্ট্র বিপ্লবের (১৬৪৯ খ্রীঃ-১৬৫৮খ্রীঃ) রূপ নেয়। এর প্রায় সোয়া একশতবর্ষ পরে ফরাসী বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রীঃ) সংঘটিত হয়। বিজয়ী ফরাসী বিপ্লব বেশীদিন স্থায়ী হয় নাই বটে, কিন্তু তার প্রভাবে গোটা পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে যে সমাজ পরিবর্তনের ঢেউ শুরু হয়, সেটা ধীরে ধীরে পশ্চিম ইউরোপ ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বকেও প্লাবিত করে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে পশ্চিম ইউরোপে শিল্প বিকাশ গতিলাভ করে এবং বুর্জোয়া সমাজ ক্রমবিকাশের পথে যাত্রা শুরু করে। প্রায় দশ বছর স্থায়ী ইংল্যাণ্ডে ক্রমওয়েলের বিপ্লবী শাসন সংস্কার এবং পরবর্তীকালে ফরাসী বিপ্লব স্বল্পকাল স্থায়ী হলেও তার মানে কিন্তু এই নয় যে ইতিহাসের অগ্রগমনে অর্থাৎ সমাজ বিকাশের কর্মধারায় এই সব বিপ্লবের কোন ইতিবাচক অবদান নাই। বরং সমাজ বদলের ইতিহাসে এদের যুগান্তকারী ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। সামন্তবাদী শাসন ও শোষণ মূলক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পরিচালিত এইসব বিপ্লব পুরনো সমাজকে আঘাত করে অনেক কিছু পরিবর্তিত করে নূতন মূল্যবোধ সম্পন্ন নূতন সমাজের জন্ম সম্ভব করলেও নূতন রূপে তা আরেক শোষণ ভিত্তিক সমাজের জন্ম দেয় বুর্জোয়া সমাজের জন্ম দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও পৃথিবীকে তা জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প বিকাশের মাধ্যমে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু বুর্জোয়া সমাজের মধ্যে শোষণ ভিত্তিক ব্যবস্থার কারণে যদি কেউ তার ইতিবাচক দিককে সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়ে শুধু নেতিবাচক দিকই তুলে ধরে সেটা কি ঠিক হবে? আদৌ না।
ঠিক তেমনি ভাবে গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতাহীন সামন্ততান্ত্রিক কৃষিনির্ভর রাশিয়া এবং পরবর্তীকালে গণতন্ত্রের আবহাওয়াহীন সামন্ত-সামরিকতন্ত্রের নিগড়ে বাঁধা চীন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দ্রুত শিল্প উন্নয়ন ও সমাজ উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয়ে বিশ্ব উন্নয়নের আরেকটি মডেল হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষের জীবন-মানকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়েছে। রাশিয়ার বিকাশের এক পর্যায়ে তারা তাদের অনুসৃত একদলীয় শাসনের পথ ত্যাগ করে শান্তিপূর্ণ উপায়েই বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছে। সমাজের অগ্রগতিকে আরও বিকশিত করার পথ খুঁজছে। চীনও নিজেদের অনুসৃত অর্থনৈতিক নীতি সংস্কার করে উন্নয়নের এক নিজস্ব মডেল দাঁড় করিয়েছে। চীনের উন্নয়ন, চীনা সমাজের বিকাশ পৃথিবীর উন্নয়নের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেই পরিগণিত হবে। কিন্তু অনুন্নত বিশ্বের এই সব অংশের এই দ্রুত উন্নয়নের মাধ্যমে বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছার প্রথম শর্তই ছিল মার্ক্সবাদে উদ্বুদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সমাজ বিপ্লব, যা তাদেরকে পৃথিবীর এক বিশাল জন-গোষ্ঠীকে এই পর্যায়ে পৌঁছাতে সমর্থ করেছে। এরপর যদি সেই সমাজের মানুষ তাদের আরও উন্নয়নের বোধ থেকে তাদের সমাজকে সংস্কার করে ভিন্ন কাঠামো গড়ে তোলে, সেটা তো বিপ্লবের ব্যর্থতা নয়, অবদানহীনতা নয়, বরং চিরন্তনতা।
বিশ্বের বিপুল সংখ্যক এই জন-গোষ্ঠীগুলোর জীবনের মানের এই অগ্রগতির মধ্যে যদি কেউ কোন ইতিবাচক উৎপাদান মোটেই খুঁজে না পান শুধুমাত্র মার্ক্সবাদের গন্ধের কারণে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নামের কারণে তবে সেই দৃষ্টিভঙ্গিটাকে কীভাবে ঠিক বলা যাবে? আসলে সেই দৃষ্টিভঙ্গিটাকে কী নামে অভিহিত করা যায়? আর যা-ই হোক বোধ হয় ‘সত্যানুসন্ধানী’ হিসাবে নয়। কারণ তা হলে বিশ্ব ইতিহাসের অগ্রযাত্রার ইতিহাসকেই অস্বীকার করতে হবে।
মার্ক্স-এঙ্গেলসও কিন্তু ইতিহাসের অগ্রগমনে বুর্জোয়া বিপ্লবের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে একবারের জন্যও অস্বীকার করেন নাই। সেটা স্বীকার করে নিয়েই তারা নূতন কালের উপযোগী ভেবে উন্নততর বিপ্লবের পথ হিসাবে কমিউনিজম বা সাম্যবাদের ধারণা উপস্থিত করেন। তাদের ধারণায় কিছু মৌল ভুলও থাকতে পারে এবং সেটা আছে বলেও আমি মনে করি। কিন্তু তাই বলে কি তাদেরকে বা তাদের বিপ্লবের সমগ্র তত্ত্বকেই উড়িয়ে দিতে চাওয়া হবে? ফরাসী বিপ্লবে যে দার্শনিক ও চিন্তাবিদের প্রভাব সবচেয়ে প্রবল ও গভীর তিনি কি রুশো নন? কিন্তু রুশো মানুষ সম্পর্কে যে বিশুদ্ধতাবাদী ধারণা উপস্থিত করেছিলেন সেটা কি ভুল ছিল না? আসলে কি কোনও মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্ম নেয় যে কথা তিনি বলেছিলেন? আসলে তো এক অর্থে বন্ধনের মধ্য দিয়েই মানুষের জন্ম ও অগ্রযাত্রা। তবে যে বন্ধন এক সময় মুক্তির দ্যোতক হয় তা-ই আর এক সময় সাদামাঠা ভাষায় বন্ধন তথা ক্ষতিকর বন্ধন হয়ে দেখা দিতে পারে। তখন তার বিরদ্ধে মানুষ মুক্তির নূতন সংগ্রাম গড়তে গিয়েই নূতন বন্ধন গড়তে বাধ্য হয়। কারণ সামাজিক মানুষ সমাজ-সৃষ্ট কোন সমস্যার বিরুদ্ধেই একা সংগ্রাম করতে পারে না। সংগ্রাম করতে গিয়েই তাকে সঙ্গে নিতে হয় আরও অনেককে। আর এভাবে সৃষ্টি হয় নূতন বন্ধন।
সুতরাং রুশো একটা মৌল জায়গায় ভুল। আর ভুল বলে তার সবটাই ভুল এ কথা কি বলা যাবে? কিংবা ফরাসী বিপ্লবে তার চিন্তার অবদানকে কি অস্বীকার করা যাবে? অথবা ফরাসী বিপ্লবে যে বিপুল রক্তপাত ঘটেছিল তার জন্য কি মানব সভ্যতায় এই বিপ্লবের সুমহান অবদানকে অস্বীকার বা নাকচ করা যাবে? কিন্তু সেই বিপ্লব কালে এবং পরবর্তী কালেও অনেক দিন পর্যন্ত ব্রিটেনসহ রাজতন্ত্র শাসনাধীন সমগ্র ইউরোপ নরমেধ যজ্ঞের বিরোধিতার নামে ফরাসী বিপ্লবের বিরুদ্ধে কী মরীা অপপ্রচারে লিপ্ত ছিল তা কি আমাদের একেবারে কিছুই জানা নাই?
মার্ক্সবাদের ক্ষেত্রেও বিরোধিতার নানান রূপ আমরা দেখে আসছি তার জন্মলগ্ন থেকেই। তার অন্ধ পূজার রূপও আমাদের অজানা, অচেনা, অদেখা নয়। যারা একটা মতবাদে কম-বেশী যাই হোক সঠিকতা কিংবা নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে কালোপযোগিতা থাকলেই সেটাকে বিজ্ঞান নাম দিয়ে ধর্মের পর্যায়ে নিয়ে যান তারা সেই অন্ধ পূজারীদের দলেই পড়েন। তার সমালোচনা নিশ্চয় করতে হবে। কিন্তু সমালোচনার ধরনটাও অনেক কিছু বলে দেয়। কে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে কার কীভাবে সমালোচনা করছেন তা থেকেও অনেক কিছুই বেরিয়ে আসে।
এটা ঠিক যে বিপ্লবের নূতন তত্ত্বের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেটা কি পুরাতন বিপ্লবী তত্ত্ব ও তার অবদানকে সম্পূর্ণরূপে খারিজ করে দিয়ে গড়া সম্ভব? নেতিবাচক অবস্থান যদি দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে রাখে তাহলে তার ভিতর থেকে ইতিবাচক দিকগুলিকে বের করে নেওয়া যাবে কী করে?
পৃথিবীর এগিয়ে যাবার পথে নানান সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে। আড়াই হাজার বছরেরও বেশ কিছু আগে প্রাচীন গ্রীসে একাধিক স্বাধীন নগর সমাজ বা নগর রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেগুলো পরিচালিত হতো। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের চর্চা হতো। কিন্তু সমাজ ছিল মূলত দাস শ্রম নির্ভর। দাসদের কোন স্বাধীনতা বা নাগরিক অধিকার ছিল না। দাস ব্যবস্থার শোষণমূলক পথেই সেই সমাজের প্রাচুর্য সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সমাজেও মানুষের চিন্তাশক্তি বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। থ্যালিস (আনুমানিক ৬৪০ খ্রীঃপূর্বাব্দ), পাইথাগোরাস (আনুমানিক ৫৮২-৫০৪ খ্রীঃপূর্বাব্দ) ডেমোক্রিটাস (জন্ম আনুমানিক ৪৬০ খ্রীঃপূর্বাব্দ), সক্রেটিস (৪৬৯-৩৯৯ খ্রীঃপূর্বাব্দ), প্লেটো (৪২৮-৩৪৮ খ্রীঃপূর্বাব্দ) এবং এরিস্টোটল (৩৮৪-৩২২ খ্রীঃপূর্বাব্দ)সহ বহু দার্শনিককে সেই সমাজ জন্ম দিয়েছিল। অবশ্য সেই দার্শনিকদের অগ্রবর্তী চিন্তার সাথে সেই সমাজ সর্বদা সমতালে এগোতে পারে নাই। গণতন্ত্রের ধারার সৃষ্টিকারী সেই নগর রাষ্ট্রের ঐতিহ্যকে ধারণ করে পরবর্তী কালে পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। কাজেই গণতান্ত্রিক ধারা পশ্চিম ইউরোপ তাদের পুরাতন ঐতিহ্য থেকেই পেয়েছে। বিশ্ব ইতিহাসের অগ্রগমনের ধারায় কি প্রাচীন সেই নগর রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, দার্শনিকদের চিন্তা এবং সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কোন ইতিবাচ অবদানই নাই? যদিও তারা সমাজে দাসপ্রথা চালু রেখেছিল এবং দাসদের কোন নাগরিক অধিকারই দেয় নাই অর্থাৎ দাস শ্রমের শোষণের উপরই তাদের সমাজ দাঁড়িয়ে ছিল তবু সেই জন্য কি তাদের অন্য সব ইতিবাচক দিককে বাতিল করে দিতে হবে? দাস শ্রম শোষণের উপর দণ্ডায়মান সেই গ্রীক সভ্যতার অবদানকে অস্বীকার করা, বুর্জোয়া সমাজ ভিন্ন প্রক্রিয়ার শোষণমূলক ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত বিধায় তার অবদান অস্বীকার করা কিংবা শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় মার্ক্সবাদে উজ্জীবিত সমাজ বিপ্লবীদের প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে অস্বীকার করা বা শুধু নেতিবাচক দিককে চিত্রিত করে বাতিল করার চেষ্টা মানে এক চোখা হরিণের মত বিশেষ এক দিকে দৃষ্টি আবদ্ধতা বা পক্ষপাতিত্বের নামান্তর মাত্র। সে বিষয়টা আমরা অস্বীকার করি কী করে? কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে একই সমাজের অভ্যন্তরস্থ বৈষম্য, বিভিন্ন সমাজের বিকাশের পার্থক্য ও অসমতার কারণে এক সমাজ কর্তৃক অন্য সমাজ দখল বা শোষণের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম তা থামাবার যত কৌশলী চেষ্টাই করা হোক না কেন তা বেশীদিন থামিয়ে রাখা যায় না। কোন না কোন ভাবে তা মাথা তুলবেই, পাল্টা আঘাত করবে এবং শেষ পর্যন্ত সেই দ্বন্দ্বের সমাধান করবে। এটা মানব সমাজ বিকাশের অমোঘ নিয়মের মধ্যেই পড়ে। এক চোখা হরিণ হয়ে এটা ঠেকানো যাবে না।
E-mail : [email protected]