মুক্তবাজারের পুরোহিতদের এখন সমাজতন্ত্রে আজান!

-বিপ্লব  পাল 

ফেডারেল গভর্নমেন্ট যখন আমেরিকার বৃহত্তম মর্টগেজ কোম্পানী ফেনি মে আর ফ্রেডী ম্যাক অধিগ্রহন করে, আমি লিখেছিলাম মুক্তবাজারের জনকরা এখন সমাজতন্ত্রের কোলে মুখ লুকাচ্ছে। চোখের নিমেষেই নেমে এল আরো বিপর্যয়-লেহম্যান ব্রাদার্সের দেউলিয়া ঘোষনা-মেরিল লিঞ্চকে ব্যাংক অব আমেরিকার অধিগ্রহন-আর বৃতত্তম ইন্সিউরান্স কোম্পানি এ আই জিতে অধিকাংশ শেয়ার কিনে আমেরিকান সরকার বীমা মার্কেটকে বাঁচিয়ে দিল। ধন্য কলিযুগ! এই আমেরিকার চাপেই গোটা বিশ্ব অর্থনীতি সংস্কার করতে বাধ্য হয়েছে-যার মূলমন্ত্র অর্থনীতি বাড়াতে এবং গতি আনতে বেসরকারীকরন। আর আজ অস্তিত্বের সংকটে ইনসিউরান্স, হাউসিং এবং ব্যাংকিং পুরোপুরি রাষ্ট্রায়াত্ত্ব করতে বাধ্য হল আমেরিকা। আসলে সরকারের লাভ ই হল। অন্য সময় হলে যে দামে রাষ্ট্রায়াত্ত্ব করতে হত-এখন জলের দামে এই বিশ্ববিখ্যাত সংস্থাগুলির মালিক হলেন আমেরিকান সরকার। ট্যাক্স পেয়ার হিসাবে আমি পুলকিত! আরো পুলকিত পুঁজির এই ডিগবাজি দেখে! 

 ধনতন্ত্রের ভিত্তি এবং চালিকাশক্তি লোভ। কিন্তু লোভ ত সীমাহীন। তাই লোভের পায়ে বেড়ি পড়াতে মুক্তবাজারে অনেক আইন আনা হয়।  গত ত্রিশ বছরে আমেরিকায় এই ধরনের রেগুলেশন বেড়ে ৯০,০০০ থেকে ২৪০,০০০ হয়েছে। এতেই বোঝা যায়, পায়ে হাজার হাজার বেড়ি পড়িয়েও সীমাহীন লোভকে আটকানো যাচ্ছে না। পুরো ক্রাইসিসের পেছনেই আছে লোভের পিরামিড।  হাউসিং বাবল, সাব প্রাইম বার্স্ট হবে আমি ২০০৪ থেকে শুনে আসছি। সরকার প্রিডেটর লেন্ডিং এর বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিল?  না সে পথে গেলই না। কে চাই কম জিডিপি গ্রোথ দেখাতে!  

 লস এঞ্জেলেসে আমি আসি ২০০৩ সালের শেষে। বাড়ির দাম হু হু করে বাড়ছে।  লোকে  জমানো সবটাকা দিয়ে দুটো, তিনটে বাড়ি কিনছে।  সবাই লোন ও পাচ্ছে! প্রথম বছর শুধু সুদ গুনতে হবে! এতেব একটা বাড়ির ঋন শোধ না হতেই দুটো বাড়ি কিনে ফেলছে। একবছর অনেক দেরী। ছমাসেই  নতুন  বাড়ি বেচা কেনা করে ২০০,০০০ ডলার লাভ করেছে অনেকে। এই সুযোগে ভারতের,বাংলাদেশের অনেকে-যারা ছোট খাটো কাজ করত-রেস্টুরেন্টে জল দিত-সবাই দেখলাম হু-হা করে কোটিপতি হয়ে মার্সিডিজ চালাচ্ছে! চারিদিকে সবাই রিয়াল এস্টেট এজেন্ট! পার্কিং লটে বি এম ডাবলু, মার্সিডিজ নিয়ে দাঁড়িয়ে -আর আমার হাতে নতুন বাড়ির লিফলেট দিত! এমন কি ন্যুডবারে গিয়েও রক্ষা নেই। সেখানকার বিকিনি পরা সার্ভাররা পর্যন্ত রিয়াল এস্টেটের এজন্ট-সবর্ত্র যেখানেই লোকের সাথে পরিচয় হয়-আমাকে তাদের রিয়াল এস্টেট এজেন্সির কার্ড ধরায়। একটা বাড়ি বেচতে পারলেই তখন কোটিপতি। সস্তায় টাকা বানানোর এমন আফিং নেশায় পেয়ে বসলো আমেরিকান নিম্নমধ্যবিত্তদের যে আমি এমন ও নিজের চোখের দেখেছি-ছেলেকে দুধের বদলে জল খাইয়ে বাড়ী কিনতে ছুটেছে আমাদের রিশেপশনিস্ট! 

 লস এঞ্জেলেস থেকে ১০০ মাইল দূরে মোরিনো ভ্যালির মরুভুমিতেও ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে উঠেছিল হাউসিং। আমি বুঝতাম না মরুভুমিতে গড়ে ওঠা এই আলাদিনের রাজ্যের প্রদীপের তেল আর কতদিন থাকবে।  

 বাড়ি কেনার চেস্টা করছিলাম। ভদ্রস্থ পথে সম্ভব নয় তখন। আমার চাকরী অরেঞ্জ কাউন্টিতে। প্রচন্ড বড়লোকদের জায়গা। তারপর ভালো স্কুল ডিস্ট্রিক্ট হলে আরো দাম বেশী। অরেঞ্জ কাউন্টির সবথেকে ভাল স্কুল ডিস্ট্রিক্ট আরভাইন-সেখানে ২০০৫ সালে দু বেডরুমের কন্ডো (ফ্ল্যাট) এর দাম দাঁড়ায় ৭০০ হাজার ডলারের ওপরে। যেখানে নাব্রাস্কার মতন ভাল শিল্প শহরেও ১৫০,০০০ ডলারে  আধ একর জমির ওপর দোতালা বাড়ি পাওয়া যায়। বাড়ির দামে ধ্বস নামবে-এমন একটা আভাস পাচ্ছিলাম বলে-কিনলাম না।  

 ২০০৫ সালের আগস্ট মাস থেকেই রিয়াল এস্টেট মার্কেটে চিনা মিউজিকের শুরু। সানবার্নাডেনো কাউন্টি, যেখানে স্কুল ডিস্ট্রিক্ট ভালো নয়-মেক্সিকানরা থাকে-সেখান থেকেই পতনের শুরু। ২০০৬ সালে অরেঞ্জ কাউন্টির ভাল স্কুল ডিস্ট্রিক্টগুলি তাও বাড়ীর দাম ধরে রাখে। আসলে লোকে ভাল স্কুলের জন্য ওই শহরগুলিতে বাড়ী কিনতে বাধ্য হয়। সানবার্নাডেনো কাউন্টিতে বাড়ীর দাম তখন ৪০% ধ্বসে গেছে। অরেঞ্জ কাউন্টি ধরে রেখেছিল। ২০০৭ সালের শুরু থেকে সেটাও বসে গেল। আসলে কেও বাড়ী বিক্রিকরতে পারছিল না। কারন আমার মতন নতুন ক্রেতারা তখন বাড়ির দাম পড়ে যাছে বলে কিনছে না। ধনতন্ত্র  দুদিকে ধার দেওয়া তলোয়ার-এটা ভুললে চলবে না। রাস্তায় ড্রাইভ করলে চারিদিকে চোখে পড়ত ফোরক্লোজার ( মানে ব্যাংক বেঁচে দিচ্ছে) বা সেলস! নিউপোর্ট বিচ-যেখানে মিলিয়ান ডলারে নিচে বাড়ি নেই-সেই শহরে প্রতি তিনটি বাড়ির একটি তখন ফোরক্লোজারে! কিন্তু কাস্টমার নেই। সমুদ্রের ধারে, পাহারের গায়ে ছবির মতন কোঠাবাড়ি-কেও কিনতে চাইছে না। আড়াই মিলিয়ানের বাড়ি-এক মিলিয়ানেও কেও কিনতে চাইল না। 

হাউসিং বুদবুদ আমার জীবনে অভূতপুর্ব অভিজ্ঞতা। কেন বলি। দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়াতে লোকজনের গড় আয় বেশ কম। মুল শিল্প হলিউড আর টুরিজম। কিছু অত্যাধুনিক শিল্প আছে। কিন্ত লোকের বাস ১৫ মিলিয়ান। ২০০৩ সাল থেকে প্রতি বছর এক মিলিয়ান লোক এসেছে এখানে। লসএঞ্জেলেস, এনাহেম, লংবীচ সব মিলিয়ে ৫৩ টি বৃহৎ শহর নিয়ে সোক্যাল! ওরেঞ্জ কাউন্টিতে বার্ষিক  মিডিয়ান ফ্যামিলি ইনকাম ৪৩,০০০ ডলারের কম। যদিও আমেরিকার সব থেকে বেশী মিলিয়ানার থাকে এখানে।  অথচ বাড়ীর মিডিয়ান দাম  ৫৬০,০০০ ডলার তখন। অর্থাৎ গড় ইনকামের ১২ গুন-যা কখনোই তিন-চারগুনের বেশী হতে পারে না। পৃথিবীর কোন দেশেই না। সুতরাং যে বাড়ীর দাম হওয়া উচিত ২০০,০০০ ডলার-তা হয়ে গেল ৬০০,০০০ ডলার। এটা কোলকাতা, দিল্লীর হাউসিং মার্কেটেও হয়েছে। তবে সংখ্যাটা এত ব্যাপক নয় বলে-ক্র্যাশটা হবে মাইল্ড। কিন্তু দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়াতে এই ভুমিকম্প মৃদু রইলো না-কারন তখন গত শেষ তিন  বছরে পাঁচ লাখ নতুন বাড়ি এসেছে মার্কেটে। 

এমন অবস্থায় যা হওয়ার তাই হয়েছে! লোভের যে বাঘের পিঠে চড়ে মার্কেট তৈরী হয়েছে-সেই বাঘ ই তাকে খেয়েছে। তাতে ফাইনান্সিয়াল মার্কেটের রাঘব বোয়ালরা, যাদের প্রায় অনেকের ই নিজস্ব প্রাইভেট জেট আছে , তারা তাদের মিলিয়ান ডলার বোনাস ঠিক ই পেয়েছে। শুধু গেল সেই মায়ের-যে ছেলেকে দুধের বদলে জল খাইয়ে মিলিয়ানার হওয়ার স্বপ্ন দেখত। 

১৯৩০ সালের গ্রেট ডিপ্রেশন ও আমেরিকা সমাজতন্ত্রের পথেই সমাধান করেছে। আমেরিকাতে রাজ্যগুলির রাষ্ট্রায়াত্ত্ব বিমা অনেকদিন থেকেই আছে।  এখন বিমার সবটাই রাষ্ট্রায়ত্ত্বকরন হল আর কি! আমেরিকার সেই অর্থে ইউরোপের থেকে কিছু কম-কিন্তু চিন বা ভারতের থেকে অনেক বেশী ওয়েল ফেয়ার স্টেট। গণতন্ত্র মানেই ঠেকে বা ধাক্কা খেয়ে সিস্টেমটা আস্তে আস্তে স্যোসাল ডেমোক্রাসির দিকে যাবেই। এটা অনিবার্য্য পরিনতি। কারন মুক্ত বাণিজ্যের ধাপ্পাবাজি যা শুধু সীমাহীন লোভে লালসা বাড়ায়-তা দিয়ে কোন সমাজ গঠন অসম্ভব।  

মানুষকে সম্পূর্ন পণ্য হিসাবে মডেল করা জৈবিক দৃষ্টীতে এক অবাস্তব কল্পনা। আমরা প্রতিটা মুহুর্তে আমাদের জেনেটিক সত্ত্বাকে বাঁচানোর চেস্টায় নিয়োজিত। এই সত্ত্বা চাইছে তার ভবিষ্যতের জেনেটিক কোডের বেঁচে থাকার গ্যারান্টি। ধরুন আমি বেসরকারী খুব নামী কোম্পানীতে একজন সরকারী অধ্যাপকের চেয়ে দেড়গুন বেতন পেলাম-তাও শুধু ভবিষ্যতের কথা ভেবে, আমার অনেক সহকর্মী অনেক কম মাইনাতে অধ্যাপক বা সরকারী চাকরীতে চলে যায়। কারন সেই নিরপত্তা। আপনি বলবেন এই নিরাপত্তার গ্যারান্টি  দিলে লোকে কাজ করে না। তাই ধ্বসে পড়ে সমাজতন্ত্র। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দেশের নাগরিকদের এই স্থিতিশীলতা না দিলে-তারা সমাজের ভবিষ্যত নাগরিক তৈরী করবে কি ভাবে?  আমার মতন অনেক মধ্যবিত্ত সন্তান এখন আমেরিকাতে চড়িয়ে খেয়ে

দুপয়সা রোজগার করে মুক্তবাজার নিয়ে বড় বড় বাত মারছেন। একবার ও কি ইনারা ভেবে দেখেছেন-তাদের বাবারা কতটা স্থিতিশীল ছিলেন? এই স্থিতিশীলতার জন্যে তারা ছাত্র অবস্থাতে ফ্যামিলি থেকে কতটা উপকৃত? এদের বাবার ওই কম পয়সার সরকারি চাকরিতে যে স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা তাদেরকে দিয়েছেন-তারা শতগুন ইনকাম করেও সেই নিরাপত্তা তাদের সন্তানদের দিতে পারবেন? 

সমাজতন্ত্রের আসল সমস্যা হচ্ছে নেপোটিজম, প্রতিভার অবমূল্যায়ন এবং উপযুক্ত ইনসেন্টিভের অভাব। এগুলো দূর করতেই প্রতিযোগিতা লাগে। প্রতিযোগিতা ছাড়া কোন সিস্টেম উন্নত হয় না। কিন্তু তার জন্যে কি মুক্ত বাজার জরুরী? হুগো শ্যাভেজ যে সিস্টেম চালু করেছেন সেটা বেশ ইন্টারেস্টিং। প্রথমত এক ই মার্কেটে একাধিক রাষ্ট্রায়াত্ত্ব কোম্পানী থাকতে হবে। তারাও সবাই শেয়ার মার্কেটে লিস্টেড হবে। দ্বিতীয়ত ছাঁটাই না হলেও মাইনার হ্রাস বৃদ্ধি হবে রেভিনিউ এবং লাভের ওপর। লোকসানে চলতে থাকলে মাইনে বেশ কমে আসবে। ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রায়াত্ত্ব কোম্পানীগুলির পারফর্মান্স বেশ ভাল। 

নিজে আমেরিকান মার্কেটের হাতে এমন ভুক্তভোগী, মুক্তবাজারের ওপর আমি নির্মোহ।  আজ ভালো চাকরী আছে-ভাল বাড়ি-গাড়ি আছে-মানে কাল থাকবে-সেরকম কোন নিরাপত্তা নেই। অথচ এর কোনটা ই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য না-উদ্দেশ্য পরবর্ত্তী প্রজন্মকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। এখানে মুক্তবাজার সম্পূর্ণ ব্যার্থ। আমেরিকানদের জীবন দেখলেই বোঝা যায় ৫% ধনীরা ছাড়া-বাকীদের জন্যে এদেশ অভিশাপ। দুডলারের বার্গার খেয়ে বেঁচে থাকা জীবনচক্রে দুশো পাউন্ডের বলদের নাম আমেরিকান।  

শুধু মুক্ত বাজার সফল নতুন উদ্ভাবনে। ইন্টারনেট, গুগুল,ওয়াইকি, মোবাইল-মুক্তবাজার ছাড়া অসম্ভব।  নতুন প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্পে মুক্তবাজারে অসুবিধা নেই-বরং তারাই সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে দিচ্ছে। ইন্টারনেট যেভাবে মানুষের সাথে মানুষের বিভেদ ঘুচিয়েছে-তা মানব ইতিহাসের অকল্পনীয় কৃতিত্ব। কিন্তু পরিশেবা ভিত্তিক শিল্পে যেমন ব্যাঙ্কিং, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিমা, মর্টগেজ, মাইনিং, মেটাল-এইসব ক্ষেত্রে হুগো শাভেজ মডেলে রাষ্ট্রায়াত্ত্ব প্রতিযোগিতা এবং উৎপাদন ভিত্তিক মাইনা চলুক। এসবের বেসরকারীকরন মানে দেশবাসীর সর্বনাশ অনিবার্য্য। এটাই আমেরিকা তথা ইতিহাসের শিক্ষা। 

ওয়াশিংটন ডিশি

৯/২৩/২০০৮ 

সুত্রঃ

http://www.nakedcapitalism.com/2008/03/japan-says-us-financial-crisis-worse.html

http://www.rense.com/general29/ruse.htm

http://www.breitbart.com/article.php?id=080914181841.fsmkqu8s&show_article=1

http://www.globalresearch.ca/index.php?context=viewArticle&code=COO20080919&articleId=10271

 


. বিপ্লব পাল, আমেরিকাতে বসবাসরত পদার্থবিদ, গবেষক এবং লেখক। এক সময় ভিন্নমতের মডারেটর ছিলেন, বর্তমানে www.fosaac.tv সম্পাদনার সাথে জড়িত।