ঠিকাদারতন্ত্র

-বিপ্লব  

(১) 

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমার উসাহ সেই কিশোর বয়স থেকে। ভারতেও আমি রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় ছিলাম-কিন্ত ছেদ পড়ল আমেরিকাতে এসে। একে এই দেশের নাগরিক নই-ভোটাধিকার নেই-আর আমেরিকানরা হচ্ছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী।  প্রবাসী কম্যুনিটির ক্ষুদ্র কুয়োর মধ্যে ব্যাঙাচী লম্ফনই অধিকাংশ দক্ষিন এশীয়দের জীবন নামচা-এবং শেষ পরিণতিও বটে। আমেরিকান রাজনীতির সাথে জড়ানোর স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্ত ছিলাম বহুদিন।  তবে ট্যাক্সের টাকাটা দিতে হয়-আর এটাও দেখছিলাম

ইরাক যুদ্ধের জন্য কি ভাবে জনপ্রতি ষাট হাজার ডলার ঋণ এখন আমেরিকানদের মাথায়। হাইস্কুলে ৩০% শিক্ষকের অভাব-যারা আছে তাদের যোগ্যতা আমাদের অজপাড়াগাঁয়ের শিক্ষকদের চেয়েও কম। আমেরিকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ছাড়া বাকিদের স্নাতক ডিগ্রীর মান অত্যন্ত নিম্নমানের-সেই মানও নিম্নগামী। না কোন সমীক্ষা থেকে বলছি না-গত আট বছরে খুব কমকরে হলেও শখানেক ইন্টারভিউ নিয়েছি এই সব নব্য ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাজুয়েটদের। চূড়ান্ত অপদার্থ। প্রায় সবক্ষেত্রে নয়-একদম ১০০% ক্ষেত্রেই নিতে বাধ্য হয়েছি ইউরোপিয়ান, চাইনিজ বা ভারতীয়দের-যারা আমেরিকান স্নাতক নন। আমেরিকান শিক্ষার মান সাধরন মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এতটাই বাজে। এম আই টি, স্টানফোর্ড অবশ্যই ব্যাতিক্রম-কিন্তু সেখানে সুযোগ পায় কজন? প্রথম একশোর অধিকাংশ স্কুল এখনো আমেরিকান-তবে সেটা প্রফেসর এবং গবেষনার মানে। আমেরিকান ছাত্রদের বর্তমান গড় স্টান্ডার্ড খুব খারাপ।  

আমাদের ট্যাক্সের টাকা যা শিক্ষাখাতে ভবিষ্যতের নাগরিকদের জন্য খরচ হওয়া উচিত-তা এখন ইরাকে আমেরিকান ঠিকাদারদের পকেটে। কদ্দিন আর সহ্য করব! ফলে খুব উসাহ জাগল আমেরিকান রাজনীতিতে রিপাবলিকান যুদ্ধবাজ লবির বিরুদ্ধে মাঠে নামার। এখনো ভোটাধিকার নেই-আমেরিকান নাগরিকত্ব  নেওয়ার কোন ইচ্ছাও আপাতত আমার নেই-তাই দ্বিধাগ্রস্থ। কিভাবে সম্ভব এদের রাজনীতির সাথে জড়ানো? শুধু ইচ্ছার ব্যাপার না-আমার ছেলে আমেরিকান নাগরিক। বুশ গত আটবছরে আমেরিকার যে বিপুল ক্ষতি করেছেন তাতে এদের ভবিষ্যত অন্ধকার। গত আটবছরে ভারত আরো পনেরোটা আই আই টি বানানোর পরিকল্পনা নিয়েছে-আর আমেরিকান রিপাবলিকান সরকার-যুদ্ধবাজ ঠিকাদারদের স্বার্থে ইরাক আর ইরাণ নিয়ে অর্থ এবং সময় নষ্ট করছে।  কুড়ি বছর বাদে কি হবে ভুলে যান-এখনই যা অবস্থা-আমেরিকান স্নাতকরা ভারতীয় এবং চাইনিজদের অনেক পেছনে। আমি আমেরিকাতে অন্তত চারটি গবেষনাগ্রুপে কাজ করেছি-হাতে গোনা কয়েকজ়ন বয়স্ক আমেরিকান ছাড়া সর্বদাই ভারতীয় বা চাইনিজদেরই দেখি। শিক্ষার ব্যাপারে সবাই লিপ-সার্ভিস দিচ্ছে-আর বাজেটের সিংহভাগ যাচ্ছে আমেরিকার যুদ্ধবাজ পররাষ্ট্রনীতির আড়ালে আবডালে লুকানো ব্যাবসাদারদের পকেটে। ফলে কিছু একটা করতে হবে এমন তাড়নায় লসএঞ্জেলেসের এক ভারতীয় ডেমোক্রেটিক নেতার স্বরণাপন্ন হলাম। তিনি বল্লেন হ্যাঁ-আমাদের আমেরিকান রাজনীতির সাথে না জড়ানোয় আজ সবথেকে সমৃদ্ধশালী প্রবাসী হয়েও আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান ইহুদিদের অনেক পেছনে। 

 খাঁটি কথা-তা কি করতে হবে? 

 উনি তখন হিলারী ক্লিনটন ক্যাম্পেনের হোমরাচোমরা কমরেড। ভারতীয়দের হয়ে শুধু লস এঞ্জেলেস থেকেই হিলারীর জন্যে ছশো হাজার ডলার তুলেছেন। ক্লিনটন ক্যাম্পের প্রধান  সেনাপতি টেরীম্যাকলীফের সাথে তার হটলাইন।  তিনি বললেন লোক আনতে হবে হিলারী আসছেন একসপ্তাহ বাদে।  

আমি তখনো আমেরিকান গ্রাউন্ড রাজনীতির কিছুই জানি না। জিজ্ঞেস করলাম টেম্পো দিয়ে তার সভায় লোক জড় করতে হবে? আসলে আমার মনে ছিল সেই বিগ্রেডগোত্রীয় ব্যাপার। যেখানে গ্রাম থেকে জ্যোতিবাবুদের জন্যে লোক জড় করতে হত। ভাবলাম সেই জাতীয় কিছু হবে হয়ত। তাই গেঁয়োভুতের মতন জিজ্ঞেস করলাম 

-কোন গ্রাউন্ডে হচ্ছে? 

ভদ্রলোক আমার মুখের দিকে তাকালেন। গ্রাউন্ড? ব্রেভারলীহিলস শেরাটনে।  

ঘাবরে গেলাম। ওটা হলিউডের সেভেনস্টার হোটেল। 

-সেখানে এত লোক ধরবে? 

-কত? আগেরবার বড়জোর তিনহাজার লোক ছিল। এবার টার্গেট চার। 

-এত কম? 

-কম? চার হলেই এক মিলিয়ান ডলার উঠে যাবে! 

এবার মাথা ঘুরছে। বুঝলাম কোথাও একটা ব্যাপক ডিসকানেক্ট।  মিসকম্যুনিকেশন। ব্যাপারটা হল, হিলারী ক্লিনটনের বক্তৃতা শোনার নুন্যতম ফি-২৫০ ডলার। ওটা পলিটিক্যাল কনট্রিবিউশন। এছাড়া ৫০০,১০০০,২০০০ এবং সর্বাধিক ৪২০০ ডলারের টিকিট আছে। ৪২০০ ডলার আইনত সর্বাধিক। ৪২০০ ডলারের টিকিটে মহামান্য অতিথিরা হিলারীর সাথে লাঞ্চ করবেন। ২০০০ ডলারে হ্যান্ডশেক করার অনুমতি। ২৫০ ডলারে গ্যালারি থেকে বসে এইসব কান্ডকারখানা দেখা।  

আমি হোঁচট খেলাম। সি এন এন চ্যানেলে সবসময় দেখছি হিলারী আমজনতার কথা বলছেন। আমেরিকান গরীব-চাকরীহারানো তথা সর্বহারাদের কথা তার মুখে মুখে। নিউজে দেখবেন হিলারী এদের সাথে মিশে যাচ্ছেন-তোমাদেরই একজন টাইপের হাইপ! পরে জেনেছি সবটাই আমেরিকান মিডিয়া ম্যাজিক। সি এন এন যত ঘন্টা হিলারীকে দেখাবে-সেখানে মিনিট প্রতি কয়েক হাজার ডলার গুনে দিয়ে থাকে হিলারী ক্যাম্পেন ফান্ড।  এটাই আইন। প্রতিটা গ্যাদারিং এ কিছু বাছাই করা সর্বহারাদের নিয়ে আসে মিডিয়া রিলেশনের লোকজন। এদের সাথে তার ভিডীও ওঠে-আসল সত্যটা থাকে নেপথ্যে।  না- সর্বহারাদের কোন প্রবেশ অধিকার নেই তার মিটিং এ। তার কেন- ওবামার মিটিংয়েও খুব ই উচ্চমূল্যের টিকিট কেটেই ঢুকতে হয়। ছবি ওঠে-একদম পূর্বপরিকল্পনা মতন। আসলে ভিড় করে কিছু ব্যাবসায়ী ঠিকাদার গোষ্টির লোক-এরা এসে নিজেদের বিজনেস কার্ড বিতরন করেন। মূল ক্যাম্পেন এজেন্ডা কি-এদের কেও জানে না। হিলারী এবং ওবামা ক্যাম্পের অনেক ফান্ড রেইজার রথী মহারথি একদম লুম্পেন ব্যাবসায়ী। যারা প্রতিষ্ঠিত স ব্যাবসায়ী তাদের ওবামা বা হিলারীকে দরকার নেই।  মাফিয়া, অস -চূড়ান্ত বাজে চরিত্রের লোকজন ঘোরাফেরা করে এই সব ফান্ডরেইজারদের মধ্যে। না ভারত বা বাংলাদেশের ঠিকাদারদের  সাথে  এদের কোন পার্থক্য নেই। 

যাইহোক, লসএঞ্জেলেসে যিনি হিলারীর ক্যাম্পেনের দ্বায়িত্বে ছিলেন-তিনি একজন মহিলা। আমেরিকান ফেমিনিস্টরা হিলারীর বড় ভক্ত। হিলারী ক্যাম্পে মেয়েদের সংখ্যা ছিল বেশ বেশী। সমস্যা হচ্ছে ডিভোর্সী আমেরিকান পুরুষরা আবার সাংঘাতিক নারী বিরোধী। কারন তারা বৌদের হাতে সর্বস্ব খুইয়েছেন। এরা ছিল হার্ডকোর এন্টি হিলারী। হিলারী ক্যাম্পের নেত্রী মিশেল আমায় বল্লেন ভারতীর মেয়েদের সংগঠিত কর। পুরুষদের সার্পোট নিশ্চিত নয়। নির্দেশ অনুযায়ী আমি ভারতীয় কম্যুনিটির মহিলাদের নিয়ে হিলারীর ওপর বেশ কয়েকটি ভিডিও করি-এর মধ্যে একটি ভিডীও ইউটিউবে খুব জনপ্রিয় হয়।

http://www.youtube.com/watch?v=RgAuV2yV8ic 

টেক্সাস তখন হিলারী আর ওবামার যুদ্ধক্ষেত্র। টেক্সাসে হারলে হিলারী ক্লীন বোল্ড--এমন লগ্নে হিলারী ক্যাম্পের প্রধান সেনাপতি টেরী তার অনুচরদের নিয়ে ঘন ঘন স্ট্রাটেজী বৈঠক করতে লাগলেন। সেই ভারতীয় নেতাটি প্রতিটা টেলিকনফারেন্সে থাকতে পারছিলেন না-টেরীর সেক্রেটারীর অনুমতি নিয়ে আমাকে ঢোকালেন কনফারেন্স রেকর্ড করা জন্যে। 

আমি ত খুব খুশ। একটা ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা বলে কথা।  কয়েক মিনিট বাদেই আমার উত্তেজনা শেষ-এদের কান্ড কারখানা দেখে হাঁসতে হাঁসতে পেট ফাটছিল। 

সেই কনফারেন্সের বিষয়বস্তু শোনা যাক— 

এক ভদ্রমহিলা জানালেন ওবামা ক্যাম্পেনে  ব্যাপক ওবামার ছবি সাঁটা ন্যাপকিন পেপার দেওয়া হচ্ছে। হিলারী ক্যাম্পেন কি করে প্রত্যুত্তর দেবে? 

পাঁচ মিনিট ধরে সাজেশনের বন্যা। হিলারী অঙ্কিত কফিকাপ, ফুলদানি, প্লেট----সবকিছু নিয়ে দেদার আলোচনা । কি করে কাপ, ফুলদানি এইসব দিয়ে হিলারী সার্পোটারদের ভোটবাক্সে টানা যায় সেটা হচ্ছে মুখ্যবিষয়। হিলারীর মূল এজেন্ডা-আমেরিকান শিশুদের আরো শিক্ষিত করার কথা কোন  সার্পোটারের মুখে শুনি নি। কোন পলিশি আলোচনা নেই-শুধু ন্যাপকিন, প্লেট কাপের গল্প। এটাই নাকি স্ট্রাটেজী মিটিং।  

এরপর আমি বল্লাম বস, এর মধ্যে আমি নেই।  

আমেরিকান নির্বাচনের এখানেই ইতি টানলাম কিছুদিন। 

(২) 

এরমধ্যে চাকরি পরিবর্তন করে, পাকাপাকি ভাবে ওয়াশিংটন ডিসির উপকন্ঠে চলে আসি। ইতিমধ্যে হিলারী হেরে গেছেন। হোয়াইট হাউস আমার বাড়ি থেকে ত্রিশ মিনিটের ড্রাইভ। ডেমোক্রাটিক পার্টির এশিয়ান আমেরিকান ফান্ডের সভাপতি একজন বাঙালী-গৌতম দত্ত। পেশায় উকিল। হিলারী ক্যাম্পেনের সূত্রে পরিচয় । উনি বললেন তুমি একবার ডেমোক্রাটিক পার্টির হেড কোয়ার্টার ডি এন সিতে ঘুরে যাও। একটা ফান্ড রেইজিং পার্টি আছে। আমি কিছু ডেমোক্রাটিক সেনেটরদের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। তাদের ইন্টারভিউ নাও-ফরেন পলিশিটা তুমি ভালোই বোঝ। ওটার ওপর নেবে।  

সেই মোতাবেক আমি হোয়াইট হাওসের পাশে ডেমোক্রাটিক পার্টির হেডকোয়াটার-যা ডি এন সি বিলডিং নামে খ্যাত সেখানে এক সন্ধ্যায় হাজির হলাম।  গৌতম আমার জন্যে পাশ করিয়ে রেখেছিল। হিলারি সাপোর্টাদের গুমর মুখ দেখেই চেনা যায়। ওবামা সাপোর্টাররা আচ্ছাসে খানা-পিনা করছে। আর চারিদিকে সুন্দরী মহিলাদের ভীর। এটাও আমার কাছে একটা ধাঁধা। ভারতেও  সিপিএম এবং কংগ্রেসের জাতীয় সম্মেলনে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেখানেও দেখেছি সুন্দরী মেয়েদের সহাস্য উপস্থিতি। ক্ষমতার আলিন্দে বোধ হয় সুন্দরীদের আনাগোনা সর্বত্র বেশী!  

ওখানে কয়েক জন ডেমোক্রাটিক কংগ্রেসম্যানদের সাথে ফরেন পলিশি নিয়ে কতগুলো ইন্টারভিঊ নিলাম। অভিভুত হয়েছি সিলিকন ভ্যালীর কংগ্রেসম্যান এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান  মাইক হন্ডার সাথে কথা বলে। অত্যন্ত খোলামেলা লোক-[ উনার যে ইন্টারভিউটা নিয়েছিলাম সেটা এই লিংকে আছে

http://www.youtube.com/watch?v=E0TIMb71vv8

 ]। 

 উনি মনে করেন না ভারত-বাংলাদেশী-পাকিস্থানীদের আমেরিকানদের মতন হওয়ার দরকার আছে। বরং এই সব সংস্কৃতি আমেরিকাকে কি দিতে পারে সেই নিয়েই ভাবতে চান। অর্থা উনার বক্তব্য হল ভারতীদের আমেরিকান না হয়ে তাদের সংস্কৃতির ভালো দিকটা আমেরিকানদের শেখানো উচিত।  বৈচিত্রের মধ্যে এক্যই তিনি দেখতে চান আমেরিকায়। 

বেড়নোর সময় প্রচন্ড বৃষ্টি। আমার গাড়ী পার্ক করা অনেক দূরে। ডি এন সি বিলডিং এর সামনে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়েহঠা মাইক হোন্ডার লিমূজিন থামল আমার সামনে-উনি আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়িতে উঠে পড়তে বললেন। ভাবতেই পারছি না ডেমোক্রাটিক পার্টির সাংবিধানিক দ্বিতীয় ব্যাক্তিটি ( চেয়ারম্যান হাওয়ার্ড ডীনের পরেই যার স্থান ) আমাকে লিফট দিচ্ছেন। আমেরিকায় অবশ্য এটা সম্ভব। ভারতে আমাদের বাঙালী মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জনের জন্য দুঘন্টা অফিসে বসে থাকা এবং শেষে সাক্ষাকার ক্যান্সেল করার অভিজ্ঞতা আমার আছে।  উনাকে আমেরিকান রাজনীতির সম্পূর্ন টাকা ভিত্তিক খেলা নিয়ে একটা প্রশ্ন করেছিলাম ( ভিডিও টা দেখুন )। উনি গাড়িতে বললেন-আশা করি এখন যেটা বলবো অফ দি রেকর্ড। আমি বল্লাম নিশ্চয়।  বড়জোর কোনদিন বাঙালী উপন্যাসে লিখব!! 

-         দেখ আমি দ্বিতীয় জেনারেশনের জাপানী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমাদের সন্দেহ করা হত-অথচ আমি জন্মেছিলাম আমেরিকায়। চামড়ার রঙের যে কি জ্বালা তা আমি বুঝি। এখন আমেরিকান মুসলমানদের দুঃখটাও বুঝি। সেই জন্যেই রাজনীতিতে এসেছিলাম। অথচ কি হল দেখ-ক্রমশ আমিও সেই টাকার বৃত্তেই ঢুকে গেছি। তুমি ঠিক ই বলেছ এটা ঠিকাদারদের রাজনীতি। কিন্ত কোন মেইনস্ট্রীম পলিটিশিয়ান এটা বলার সাহস রাখে না। এদের চাপ অস্বীকার করে জনগনের জন্য কিছু করা খুবই কঠিন কাজ। অন্ধকার দিকটাই রাজনীতির আসল বাস্তব-আলোর দিকটা শুধু মিডিয়াম্যাজিকের জন্য। 

কি আর করা যাবে-গণতন্ত্র মানেই ঠিকাদারতন্ত্র-পৃথিবীর সবদেশেই। তবুও মিলিটারী শাসন বা কমিনিউজম থেকে হাজার গুনে ভাল। শুধু সমস্যাটা বিশাল আকার নেয় যখন অস্ত্রের ঠিকাদারও এর মধ্যে ঢোকে।                                                                                              

(৩) 

টাকা আর মেধা থাকলে প্রথম প্রজন্মেও আমেরিকান রাজনীতির শীর্ষে ওঠা যায়। কারন এদেশে টাকা আর মেধা সর্বাগ্রে বিবেচ্য। রাজনীতিটা গুটিকয় ফ্যামিলির হাতে কুক্ষিগত ছিল-এখন আর তা নেই। ডেমোক্রাটিক পার্টতে গৌতম দত্ত বা রমেশ কাপুর প্রথম প্রজন্মের। রিপাব্লিকানদের মধ্যে আছেন প্রফেসর এ ডি অমর বা হরি সিন্ধুর মতন প্রবাসীরা। ইনারা জাতীর স্তরের নেতা। এদের সাথে পরিচয় এবং আলাপের সূত্র ধরে বলতে পারি-কেওই ভারতীয় পরিচয় বর্জন করে আমেরিকান হওয়ার চেস্টা করেন নি।  আবার ভারতীয়ত্ব নিয়ে মাথাও ঘামান নি। এদের ফোকাস অর্থনীতি এবং উন্নয়ন। সেখানে জাতি পরিচয় উহ্য।  প্রফেসর অমর যেমন আমাকে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন রক্ষনশীলতার ধর্ম কি? হিন্দু, মুসলিম, খ্রীষ্টান সবার মধ্যেই রক্ষণশীল লোকজন পাওয়া যাবে।  উনার বক্তব্য হচ্ছে যদিও ভারতীয় বা দক্ষিন এশিয়ার লোকজন ডেমোক্রাটিক পার্টির সাপোর্টার-এদের ব্যাবহার এবং আচরন আসলেই রিপাবলিকানদের মতন-কারন তারাও রক্ষণশীল। কিন্তু রক্ষনশীল ক্রীষ্টিয়ানরা মনে করে তাদের রক্ষনশীলতা মুসলমান বা হিন্দুদের থেকে আলাদা। যা আদতেই সত্য নয়। এই রক্ষণশীল খৃষ্টানদের বর্ণবিদ্বেশের জন্যেই রিপাব্লিকানরা হিন্দু বা মুসলমানদের কাছে ব্রাত্য। উনি চাইছেন- রক্ষনশীল খৃষ্টানদের পার্টী থেকে রিপাবলিকানরা শুধু রক্ষনশীলদের পার্টি হৌক। রিপাবলিকান পার্টি নাকি উনার লাইনেই আছে!  

তাহলে আমেরিকান রাজনীতির বিরুদ্ধে লিখছি কেন? প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে-কেন এই রাজনীতি? কিসের জন্য  আমেরিকান রাজনীতি? কিছু ঠিকাদারদের স্বার্থভিলাশ পূর্ণ করা এইত ব্যাপার!  ধনী ভারতীয়রা টাকা এবং মেধার জোরে ডেমোক্রাটিক এবং রিপাবলিকান পার্টিতে এখন বেশ প্রভাব বিস্তার করেছে। মূলত এদের চেষ্টাতেই আমেরিকা কাছে টানছে ভারতকে। দুই মহান গণতন্ত্র পরস্পরের কাছে আসবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নেপথ্যের খেলাটা কি? আমিত শুধুই ব্যাবসাই দেখছি। সেটাও ভাল-অর্থ বিদ্যুত আই টির যৌথ ব্যাবসা নিশ্চয় কাম্য। কিন্ত সাথে সাথে আমেরিকার যুদ্ধের ঠিকাদাররাও ঢুকে পড়েছে। ভারতে রাশিয়ান অস্ত্রের দালালরা খুব সক্রিয়। এরা বড়জোর পলিটিশিয়ানদের ঘুঁষ দিয়ে থাকে। বিদেশনীতি বা যুদ্ধের সিদ্ধান্তে নাক গলায় না। আমেরিকান দালালরা এদের বাপ। দক্ষিন এশিয়াতে যুদ্ধং দেহী আবহ তৈরী করতে পাড়লে এদের ঠেকায় কে? পাকিস্থান হাতেই আছে। বাংলাদেশেও আমেরিকার পদলেহী তাবেদার সরকার। এবার ভারতের রাজনীতি মুঠোই এলে দক্ষিন এশিয়াতে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা ঠেকাবে কে? ইসলামী সন্ত্রাসের বারুদ এখানে মজুত।   এখন যেমন আমার ছেলের শিক্ষার টাকা কেটে ইরাকে অস্ত্রমহড়া চলছে-তখন ভারতীয় গণতন্ত্র আই আই টি স্থাপন করা বন্ধ রেখে বাংলাদেশ, পাকিস্থানের সাথে মহাপ্রভুদের সংকেতে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলবেন। এই দরিদ্রতম দেশগুলির অস্ত্রবাজেট আরো বাড়বে। সাথে সাথে বাড়বে বাংলাদেশ এবং পাকিস্থানের ভারত বিরোধিতা এবং পাকিস্থান ও বাংলাদেশকে সম্পূর্ন সন্ত্রাসবাদি রাষ্ট্র হিসাবে প্রমান করার ভারতীয় চেষ্টা। আমেরিকার পদলেহনে পাকিস্থান ক্রমশ এক তালিবানি রাষ্ট্র হয়ে উঠছে-তা আমরা দেখেছি। ভারত-পাকিস্থান-বাংলাদেশের সাধারন মানুষ একই সংস্কৃতির সুত্রে আবদ্ধ। আমেরিকাতে এটা আরো ভাল বোঝা যায়। অথচ বাংলাদেশ এবং পাকিস্থানের মিডীয়াতে ভারত বিরোধিতা বল্গাহীন। ভারতেও কোন সন্ত্রাসবাদি হামলা হলেই গোটা মিডিয়া পাকিস্থান এবং বাংলাদেশের লিংক খুজতে থাকে। ভারতীয় মিডিয়াম্যাজিকে এই দেশগুলি ইসলামিক্ সন্ত্রাসবাদি রাষ্ট্র। আর বাংলাদেশ-পাকিস্থানের মিডীয়াতে ভারতীয় সেনাবাহিনী এক নিষ্ঠুর পরিহাস। দেশের জনগণ যা খেতে চাই-মিডিয়া তাই খাওয়াচ্ছে। এতেব বারুদ মজুদ আছেই। আগুন লাগালেই জ্বলবে। এমন সুর্বণ সুযোগ অস্ত্রব্যাবসায়ীরা কি ছাড়বে?

অথচ এদের যারা বিরোধিতা করছেন সেইসব ভারতীয় বামপন্থীদের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং বুদ্ধির দৌড় শুন্যের কিছু নিচে। অসামরিক ভারত-আমেরিকা নিউক্লিয়ার চুক্তির অন্ধ বিরোধিতা একধরনের রাজনৈতিক আত্মহত্যা। আমাদের বিদ্যুতের খিদে মেটাতে নিউক্লিয়ার শক্তির বিকল্প এখন কমে আসছে-কারন ইউরেনিয়াম জ্বলানী ভূপৃষ্ঠে প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়। এই জ্বালানীর অভাবে ভারতের নিউক্লিয়ার বিদ্যুতকেন্দ্রগুলি ক্রমশ মরতে বসেছিল। নতুন বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন ছিল অসম্ভব। সুতরাং আমেরিকার সাথে ১২৩ চুক্তি সাক্ষর না করলে ভারতের বিদ্যু ভবিষ্যত হত অন্ধকার। তাছারা ইউরেনিয়াম জ্বালানী পাওয়া যাবে আমেরিকা বাদে অন্তত আরো পাঁচটি দেশ থেকে। সুতরাং ভারতকে শুধু যে আমেরিকা থেকেই কিনতে হবে এমন মানে নেই-অস্ট্রেলিয়া আরো সস্তায় ইউরেনিয়াম দিতে চাইছিল। এইসব না ভেবে  কম্যুনিউস্ট মহামতি প্রকাশ কারাত অন্ধ আমেরিকান বিরোধিতায় নামলেন।  ভারতীয়রা দেখল এইসব বামপন্থী নেতারা দেশের স্বার্থ না দেখে নিজেদের ক্ষমতা নিয়ে সার্কাস করতে বেশী উসাহী।  ফলে কেন্দ্রে ক্ষমতা হারালেন বামপন্থীরা। নেপথ্যে টাকার খেলা নিশ্চয় ছিল। কিন্তু এটাও ভাবতে হবে ভারতের তরুণ প্রজন্ম কম্যুনিউস্ট নেতাদের এইসব আত্মকেন্দ্রীক ঘুন ধরা বামপন্থার গলাধাক্কায় ক্রমশ দক্ষিনপন্থী রাজনীতির দিকে ঘেঁষছে। নতুন প্রজন্ম চাইছে আরো শিক্ষা, আরো টাকা, আরো স্বাচ্ছন্দ্য। আর এরা ধরে বসে আছেন চলছে না চলবে নার বস্তাপচা আলু। আদর্শবাদের ঘুনধরা কাঠে  স্টালিন এবং পলপটের মতন নরদানবের জন্ম হয়-তা এই প্রজন্ম জানে। এদেরকে সাথে পেতে হলে বাস্তববাদী হতে হবে-অন্ধ বামপন্থার দিন শেষ।  ভারত-আমেরিকা সামরিক এবং অসামরিক চুক্তিকে একই পংক্তিতে ফেলে বামপন্থীরা কার্যত জনবিচ্ছিন্ন এখন । প্রকাশ কারাতের স্ট্রাটেজিক ভুলে ভারত আমেরিকার সামরিক চুক্তির পথ প্রশস্থ। উনি বলতেই পারতেন দেশের স্বার্থে অসামরিক চুক্তি হৌক-কিন্ত আমেরিকার অস্ত্রব্যাবসায়ীদের সাথে সামরিক চুক্তি, বাঘের সাথে ঘর করা। ইতিহাস সাক্ষী। গভীরে না গিয়ে, কোন বুদ্ধিগম্য বিশ্লেষন ছাড়া,  সস্তার আমেরিকান বিরোধিতার পথে হাঁটলেন। ফলে অধিকাংশ ভারতীয়র কাছেই উনি ঘৃণিত। মধ্যেখান থেকে লাভ ঠিকাদারদের। বামপন্থার হঠকারি রাজনীতিতে দক্ষিন এশিয়ার আকাশে এখন কালোমেঘ। 

এতেব বন্ধুগণ ঠিকাদারতন্ত্রকে আটকাবে কে? আমেরিকা এবং ভারতে এরা অপ্রতিরোধ্য। যাদের প্রতিরোধ গড়ার কথা-সেই বামপন্থীরা মূক বধির শিশুসুলভ বিশ্লেষনে বিশ্বাসী। আমেরিকাতে অতিবামপন্থীরা-যাদের এক্সট্রীম লেফট বলা হয়-সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন। জনগন চাইছে  ব্যাবসায়ীদের সাঁড়াশি চাপ থেকে মুক্তি-আর এরা শোনাচ্ছে আদর্শবাদের বাতিল তত্ত্ব। ফলে জনগন ওবামার পরিবর্তনের তত্ত্বেই বিশ্বাস করছে বেশী। যদিও ওবামা ক্যাম্পেনের টাকার সোর্স বিশ্লেষন করার পরে আমি নিশ্চিত নই-ঠিকাদারদের হাত থেকে কিভাবে আমেরিকাকে বাঁচাবেন ওবামা। নেমকহারামী করবেন? বিশ্বাস হয়? আমার হয় না। ওবামার ইতিহাস বলছে গিরগিটির মতন রং পরিবর্ত্তন করতে তিনি ওস্তাদ।  বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষন লোক-সেটাই একমাত্র ভরসা।  

ভারতীয় বামপন্থীদের কথা যত কম বলি-তত ভাল। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী সরকারের কমরেডদের ছেলে মেয়েরা প্রায় সবাই ঠিকাদার। ঠিকাদার কমরেডদের কাছ থেকে ইঁট কাঠ না কিনলে, আপনাকে ঠিকানা দেখিয়ে দেওয়া হবে। নিজের দল ঠিকাদার মাছিতে ভনভন করছে-আর প্রকাশ কারাত আমেরিকান ঠিকাদার তাড়ানোর চেষ্ঠা করছেন! 

পাকিস্থান কম্যুনিউস্ট পার্টী বলে একটি পার্টির অস্তিত্ব আছে-আমি তাদের ইমেল পেয়ে থাকি। পাকিস্থানে আদৌও এদের কেও চেনে কিনা সন্দেহ। বাংলাদেশের সুর্দীর্ঘ বামপন্থী ঐতিহ্য ছিল। এখন সেখানে সি পি বি ভেঙে উপদল-তস্যদলে ভর্ত্তি-যাদের সদস্য সংখ্যা মুষ্ঠিমেয়। কমরেড মনি সিং বাংলাদেশের  বাস্তবকে বিশ্লেষন করতে চূড়ান্ত ভাবেই ব্যার্থ হয়েছিলেন। মার্ক্সবাদের সম্পূর্ণ ভুলবিশ্লেষনে জমি হারিয়ে এরা এখন লুম্পেন বুর্জোয়া পার্টিগুলোর ঠিকাদারদের উঠোন ঝাঁড় দিচ্ছেন। জ্যোতিবসু এবং হরকিশেন সিং এর বাস্তববাদি নেতৃত্বে ভারতীয় বামপন্থীদের সে দুর্দিন এখনো আসেনি-তবে প্রকাশ কারাত  বেশী দিন নেতৃত্বে থাকলে সেই ভবিষ্যত সমাগত। 

অবুঝ জনদরদী বামপন্থী বন্ধু অপেক্ষা বিচক্ষন বুর্জোয়া শ্রেণীশত্রু আম জনতার কাছে অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য। ভারত এবং আমেরিকা-দুটোদেশে এটাই জনগণের দুর্ভাগ্যজনক ভবিষ্যত।  বামপন্থার কোন গ্রহনযোগ্য বিকল্প না আসা পর্যন্ত  ঠিকাদারতন্ত্রের মালগাড়িতে মহাপ্রস্থানের পথে চালান হওয়াটাই এখন মধ্যবিত্ত জীবনের অধিবাস্তবতা। 

মেরীল্যান্ড

http://biplabpal2000.googlepages.com

www.vinnobasar.org

 ৮/১৭/২০০৮


. বিপ্লব পাল, আমেরিকাতে বসবাসরত পদার্থবিদ, গবেষক এবং লেখক। এক সময় ভিন্নমতের মডারেটর ছিলেন, বর্তমানে www.fosaac.tv সম্পাদনার সাথে জড়িত।