ভারতের সাম্প্রতিক বিষ্ফোরন
বিপ্লব পাল
শুক্রবার সকালে সবে ব্যাঙ্গালোরে বোনকে ফোন করেছি বিষ্ফোরন পরবর্ত্তী খোঁজ খবর নিতে। হঠাৎ দেখি আমেদাবাদে ফেটেছে ১৭ টা এমোনিয়াম নাইট্রেটের বোমা। একদম খই ভাজার মতন বোমা ফাটছে ভারতে। সন্ত্রাসবাদি গোষ্টীটি নাকি নতুন-ভারতীয় মুজাহিদিন! ইসলামিক জিহাদের ভারতীয় সংস্করন। ভারতী নিরাপত্তা গোষ্ঠির লোকের
গালি খেয়ে বলছেন-এটা আসলেই পাকিস্থানি হুজির ‘বি’ টিম। আমেরিকার কানমলা খেয়ে –মতান্তরে চক্ষুলজ্জা বাঁচাতে-সর্বত্র ভারতীয় সংস্করন ব্যাবহার করতে হচ্ছে। ব্যাপারটা এমন-আগে এরা ছিল পাকিস্থানি দাঁড়কাক। আমেরিকা পাকিস্থানকে সন্ত্রাস দমনের জন্য ১০ বিলিয়ান ডলার দিয়েছে। সেনেটে প্রশ্ন উঠছে ১০ বিলিয়ান ডলার দেওয়া হল, আরো ১০ মিলিয়ান নতুন তালিবান তৈরী করতে? চক্ষুলজ্জা বলতেও তো একটা ব্যাপার আছে। তাই দাঁড়কাক গুলোর ওস্তাদ বললো-ভাই সব- কর রব-আমরা ভারতীয় জিহাদি। জিহাদ না থাকলেত পাকিস্থানের মিলিটারি ক্যাপিটাল এবং আমেরিকার অস্ত্র ব্যাবসা চলে না। তাই সামনে ভারতীয় জুরে দিলেই আমাদের ‘বস’রা খুশী।
সন্ত্রাসবাদ রাষ্ট্র এবং রাজনীতির সমান পুরানো। রাষ্ট্র অতীত না হলে সন্ত্রাসবাদ ও অতীত হবে না। ভারতের বৃহত্তম সন্ত্রাসবাদি গোষ্টী মাওবাদি রা। ভারতের প্রায় ৭৪ টা জিলা মাওবাদিদের দখলে। সম্পদের অসম বন্ঠন এবং স্বৈরতান্ত্রিক লুন্ঠনের প্রতিবাদে ভারতের শোষিত শ্রেনীর লোকেরাই মাওবাদি হয়। মত এবং পথের পার্থক্য থাকতে পারে-কার্য্য কারণ সম্বন্ধ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। জনভিত্তি নিয়েও সংশয় নেই।
প্রশ্ন উঠেছে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা ভারতীয় ইসলামিক সন্ত্রাসবাদি কারা? ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে শোষিত শ্রেণী চিরকাল কম্যুনিউস্ট পার্টির ক্যাডার। মাওবাদিদের একটা বড় অংশ মুসলমান। শোষনহীন সমাজের জন্য এরা মাওএর স্বরণ নেন-মহম্মদের নয়। হঠাৎ করে মধ্যপ্রাচ্য , পাকিস্থান এবং বাংলাদেশের ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের আদর্শে দীক্ষিত হচ্ছে কোন তরুণরা? এবং কেন?
ইসলামি সন্ত্রাসবাদি গোষ্টীর রাজনৈতিক লক্ষ্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত শরিয়া ভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র গঠন। ইসলামিক ভাতৃত্ব এদের মূল নির্যাস। সমস্যা হচ্ছে এরা সমাজ বিচ্ছিন্ন হলেও-এদের রাজনৈতিক আদর্শের অনুপ্রেরণা বৃহত্তর মুসলমান সমাজে বেশ ভালো ভাবেই বিদ্যমান। তসলিমাকে হায়দ্রাবাদের যে সংসদরা মারতে এসেছিল-তারা প্রকাশ্যেই নিজেদেরকে প্রথমে মুসলমান পরে ভারতীয় বলে মনে করে। অর্থাৎ তাদের আনুগত্য ও সেই ইসলামিক খালিফতের প্রতি। এবং ভারতীয় রাজনীতিতে এরা অচ্ছুৎ নন-কংগ্রেসের সাথে একই মন্ত্রীসভায় আছেন ইনারা। শুধু দুটো বোমা মারলেই যত দোষ?
ভারতীয় ইসলামিক সন্ত্রাসীরা মোটেও মাদ্রাসা শিক্ষিত নয়-সবাই বেশ উচ্চশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার। যারা খেটে খায়-তারা ধর্মের ব্যাবসাটা ভালোই বোঝে-শুধু জীবিকার তাগিদে নিজেদের সমাজবিচ্যুত করতে চাই না বলে ধর্মের কাছে মাথা নত করে। মুসলমানদের মধ্যে যারা প্রতিবাদি-তারা খুব বেশী হলে মাওবাদিদের সাথে যোগ দেবে। সমস্যা হচ্ছে এক শ্রেণীর সচ্ছল উচ্চশিক্ষিত মুসলমান যুবকদের-যারা এক আদর্শ ইসলামিক রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর। হিন্দু মৌলবাদের ও এই একই সমস্যা। বেশ কিছু উচ্চশিক্ষিত হিন্দুদের ধারণা বৈদিক সমাজই শ্রেষ্ট্র। বেদে কি লেখা আছে-গুঁতো মেরে টু শব্দটিও বার করতে পারবেন না এদের পেট থেকে। এই শ্রেণীর মুসলমান যুবকদের ও সমস্যা এক। হাতে ধর্ম পড়ার সময় আছে-এতেব জিহাদি তৈরী করা খুড়োর কলে মাথা দিয়ে বসে আছে। ভালো মানুষকে সন্ত্রাসী বানানোর জন্য ধর্ম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট খুড়োর কল আর কি ই বা আছে? মানুষ চাঁদে উপনিবেশ সৃষ্টি করতে চলেছে-জ়েনেটিক বিপ্লবের ফলে বিয়ে, পরিবার, সন্তানের ধারণাগুলোই আমূল বদলাতে চলেছে-আর কিছু গোমূখ্য পড়ে আছে মধ্যযুগে লেখা ধর্মগ্রন্থে! কি না স্বয়ং আল্লা/ঈশ্বরের বাণী!!! এদের বোকা বানিয়ে রাজনৈতিক ব্যাবসা করা সব থেকে সহজ। বাস্তবে হয় ও তাই-এত বড় গাধা যারা তাদের কে গাধা বলার চেয়ে, ভাঙিয়ে খাওয়া অনেক বেশী বুদ্ধিমানের কাজ। অস্ত্রব্যাবসায়ীরা সেটাই করছে। বুদ্ধিমানের অর্থনৈতিক সংজ্ঞা নিজের সম্পদের বৃদ্ধির জন্য যে যুক্তিবাদি! সমস্যা হচ্ছে উচ্চশিক্ষিতরা ধর্ম কর্মের ভান দেখাতে পারে- উচ্চতর সামাজিক মুল্যায়নের জন্য।
কিন্তু মৌলবাদি হয় কিভাবে? আমার ধারণা সমাজবিজ্ঞান এবং নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানে প্রাথমিক ধারণার অভাব একটা বড় কারন। আমাদের উপমহাদেশে পরীক্ষাবিহীন বিজ্ঞান শিক্ষার আয়োজনে, বিজ্ঞানে ডিগ্রীধারি রা আসলেই বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার ছিটেফোটাও পায় না। অধিকাংশ বিজ্ঞানশিক্ষিত তরুণদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভংগী আসলেই চাষাভূষোর ও অধম। চাষারা শেখে হাতে নাতে -দেখে শেখে। এরা শেখে বই থেকে-ফলে জ্ঞান এবং চেতনাটাও থেকে যায় বইয়ের মধ্যে-মাথার মধ্যে ঢোকে না। মাথার মধ্যে ঢোকে শুধু আল্লাহ এবং ঈশ্বরের বাণী। কারন প্রশ্ন করতে হয় না-আনুগত্য কত সহজ-উপরি লাভ উচ্চশিক্ষিত ‘কোরানিক বিজ্ঞানীদের’ সামাজিক চাহিদা এবং প্রতিষ্টা প্রকৃত বিজ্ঞানী অপেক্ষা বেশী! নাস্তিক বিজ্ঞানীরা আমাদের সমাজে পাশ্চাত্যের অন্ধ দাস! কে বোঝাবে বিজ্ঞান স্থান-কাল নিরেপেক্ষ! অতটা বুঝলেত ঈশ্বর/আল্লার রাজনৈতিক বানীর গোঁজামিলটাও বুঝত!
ভারতে মুসলমানদের আনুপাতিক অবস্থা খুব ভালো নয়-বৈষম্যটাও বাস্তব-তবে অধিকাংশ মুসলমান এর জন্যে মোটেও হিন্দুদের দায়ী করেন না-বরং নিজেদেরকেই তারা দোষ দেন। একটা বড় কারন বোধ হয় মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্থান এবং বাংলাদেশের চূড়ান্ত ব্যার্থতা এদেরকে নিশ্চিত করেছে ইসলাম মহান হলেও ইসলামিক রাষ্ট্র নরকের কূপ-গণতন্ত্র সেখানে অসম্ভব। একজন ভারতীয় মুসলিমের যেটুকু রাজনৈতিক অধিকার আছে-বাংলাদেশ বা পাকিস্থানে মুসলিমদের তার সিকে মাত্র ও নেই-কারন গণতন্ত্র ই নেই! ( কথাটা আমেরিকান সাংবাদিক টম ফ্রীডম্যানের )। সুতরাং বঞ্চনার প্রশ্ন থাকলে, একজন ভারতীয় মুসলিম কম্যুনিজমের দিকেই ঝোঁকে বেশী। ইসলামিক সমাজের দিকে যাওয়ার প্রশ্ন এতদিন ছিল না। এবার সেটাই দেখছি। তবে এদের সাংগঠনিক রিপোর্ট বলছে-ভারত থেকে জিহাদি রিক্রুট করা বেশ কঠিন। কারণ অধিকাংশ ভারতীয় মুসলিম মোটেও ভারত বা হিন্দুদের ওপর রেগে নেই। বিজেপি বা বজরং দলের ওপর রাগ থাকতে পারে। তবে সেটা এতটা নয় যে জীবন পণ করে সন্ত্রাসবাদের বাজি খেলবে। বাকী যেটা থাকল সেটা টাকার খেলা। টাকা ছাড়াতো সন্ত্রাসবাদ অসম্ভব। টাকাটা পাকিস্থান থেকে আসছে মানা গেল। সমস্যা হচ্ছে তাহলে আমেরিকার ১০ বিলিয়ান ডলারের পাকিস্থানের সন্ত্রাসীনির্মূলকরন প্রকল্পে আসল কাজটা কি হচ্ছে? সন্ত্রাস দমন না সন্ত্রাসী সৃষ্টি? আমারতো দ্বিতীয়টাই মনে হচ্ছে। কারণ তাতেই মহাপ্রভুদের লাভ। সি আই এ কিছুই জানে না-এটা হতেই পারে না। ইসলামিক সন্ত্রাস না থাকলে আমেরিকান মিলিটারি বরাদ্দ বাড়াবে কে?
সব ই বুঝি। শুধু দুঃখ হয় এই যে- ওটাত আমাদের রক্তজল করা ট্যাক্সের টাকা। যাওয়ার কথা ছিল আমাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাখাতে। ওরা মূর্খ হচ্ছে হৌক-পকেট ভরুক ব্যাবসায়ী আর ঠিকাদারদের। একদিকে ধর্মান্ধ গাধার দল-অন্যদিকে অস্ত্রব্যাবসায়ী গাধাপালক। মধ্যে খানে বসে সন্ত্রাসবাদের গুঁতো খাচ্ছি আমরা।
বিপ্লব ৭/৩০/০৮
ড. বিপ্লব পাল, আমেরিকাতে বসবাসরত পদার্থবিদ, গবেষক এবং লেখক। এক সময় ভিন্নমতের মডারেটর ছিলেন, বর্তমানে www.fosaac.tv সম্পাদনার সাথে জড়িত।