চোরাবালি

-বিপ্লব  পাল 

I have learned to seek my happiness by limiting my desires, rather than in attempting to satisfy them-John Stuart Mill 

গুগলনিউজে চোখ বোলাতেই ভয়ংকর খবরটা দেখলাম। সান ফার্নানেন্ডনো উপত্যকা, যা দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়াতে বড়লোকদের থাকার জায়গা-সেখানে একদম অন্ধ্রপ্রদেশের তুলো চাষিদের আত্মহত্যার কায়দায় একজন বেকার উচ্চশিক্ষিত বাপ, তার তিন ছেলে এবং বৌকে গুলি করে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেছেন। মর্মান্তিক।  

 ভদ্রলোক পাগল নন। ফাইন্যান্সের এম বি এ। প্রাইস ওয়াটার হাউস এবং সোনিতে কাজ করতেন। যে জায়গায় থাকতেন-সেখানে বেশ কয়েকবার গেছি-খুব উচ্চউপায়ী না হলে, প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে পিকাসোর ফ্রেমে বাঁধানো  ওইসব পাহাড়-অভিবাসে থাকা স্বপ্নাভিলাস!  ফাইনান্সিয়াল মেলটডাউনে ভদ্রলোক বেকার বসে ছিলেন কমাস। হতাশায়  ভুগে এই করুন পরিণতি। 

আমেরিকানরা গুলিগোলা চালিয়ে দুচারটেকে রোজ ই মারছে-নতুন কি!  কিন্তু না-তাদের প্রায় সকলেই ছিল রোগগ্রস্থ। এই ঘটনাটি বিশেষ ব্যাতিক্রম। ভদ্রলোক দীর্ঘদিন প্রাইস ওয়াটার হাউসে সুনামের সাথে কাজ করেছেন-অসুস্থ নন-বরং কর্মী হিসাবে ভালোই ছিলেন। সোজা কথায় নিজেদের হাতে তৈরী চূড়ান্ত লোভের বলি হলেন নিজে।

আমি আমেরিকানদের সততা এবং উদ্ভাবনী উদ্যোগকে যতটা পছন্দ করি-ততটাই ঘৃণা করি এদের অবুঝ কৃত্রিম বস্তুমুখী জীবনকে। ক্যালিফোর্নিয়ায় গাড়ি দেখে লোকে মানুষ মাপে! এত অজস্র খরচ এদের-তার কোন কারণ খুঁজে পাই না কোনদিন। দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়াতে লোকে বাড়িতে রান্না করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। চাকরি-ফিটনেস-যোগা-কসমেটিক্স-রেস্টুরেন্টে খাওয়া-ভ্যাকেশন-ভাল গাড়ি-বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ড চেঞ্চ করা-এই হচ্ছে দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়ার জীবনবৃত্ত। মানুষ যখন মেটেরিয়াল দিয়ে নিজেকে মাপে-তখন আত্মসংহার ই তার একমাত্র পরিণতি। বস্তু দিয়ে নিজেকে বড় করা অসম্ভব-ফলে এই অধরা বস্তুমুখী জীবনের পেছনে ছুটতে গিয়ে অধিকাংশ আমেরিকানের জীবনই ট্রাজেডি।

আধুনিক বস্তুবাদি ধর্মনিরেপেক্ষ সমাজের ভিত্তি-জন স্টুয়ার্ট মিলের উটিলিটারিয়ানিজম। সমাজের প্রতি ব্যাক্তির কর্তব্য প্রসঙ্গে মিল কিন্তু বলেছিলেন, শুধু আইন বা চাকরি দিয়ে একজন মানুষ, সমাজ থেকে যা পেয়েছে তা ফিরিয়ে দিতে পারে না। এই ব্যাক্তিকেন্দ্রীকতা সর্বস্ব জীবন আইনের দিক থেকে বেঠিক কিছু নয়-সে যেমন চেয়েছে তেমন বেঁচেছে-কিন্তু এই সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ কি সমাজ বা মানবতার কোন কাজে আসবে?   

আমাদের প্রতিটি কাজ ব্যাক্তিস্বার্থের জন্য-তার মধ্যেও আমরা সামাজিক স্বার্থের জন্যে কাজ করি। সমাজের মধ্যে ব্যাক্তিস্বার্থকে দেখা যায় অন্যদৃষ্টি দিয়ে। আজ ভদ্রলোকের যে তিনটি কিশোর ছেলে মারা গেল-এর জন্য দায়ি কে?  উনি যদি সামাজিক স্বার্থটাও একটু দেখতে শিখতেন, তাহলে স্বার্থের বৃত্তটা কি নিজের হৃদপৃন্ডে এসে শেষ হত? উনি কি দেখতে পেতেন না, উনি বা উনার ছেলেরা বস্তিতে বাসকরেও সন্মানের অধিকারি হতে পারত? জীবনের উদ্দেশ্যটা কি? গাড়ি বাড়ি নিয়ে বাঁচা না ছেলেমেয়ের মধ্যে নিজের জেনেটিক কোড বাঁচানো?  মানুষের ভালোবাসা নিয়ে বাঁচা জরুরী না বাঁচতে হলে লেটেস্ট কার, ফ্যাশন, আইফোন ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয়? ভেতরের মানুষটা কি এত ই অন্তসারশুন্য?  ভদ্রলোক এতদিন চাকরী করেছেন মানে জমানোটাকা ভালোই থাকা উচিত। তাহলে চাকরি না থাকা কালীন উনি সস্তার বাড়িতে উঠে গেলেন না কেন? বা কেন সস্তার চাকরি নিলেন না?  উচ্চবৈভবে না বাঁচলে বাঁচা নয়? আমরা কি এই কৃত্রিম সামাজিক অবস্থানের জন্য বাঁচি? 

প্রতিটা মানুষের দুটো প্রয়োজ়ন-অস্তিত্ববাদি (existential ) এবং পরিচিতিবাদি (identity)। খাওয়া, বাসস্থান, শিক্ষার প্রয়োজনে অর্থাৎ অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে আমরা যা করি-সেটা জরুরী। কিন্ত এর মধ্যেই আমরা শহরে অভিজাত এলাকায় প্রাসাদসম বাড়ি বা ছেলেকে নামী স্কুলে পড়িয়ে-নিজেদের একটা এক্সক্লুসিভ ক্লাবের মেম্বার বানাতে চাই! এটা অপ্রয়োজনীয় পরিচিতির সংকট (identity crisis)।  জনসাধারনের থেকে নিজেকে আলাদা করার প্রবনতা একটা রোগ। ভারতীয়, বাংলাদেশী, আমেরিকান সবার মধ্যেই আছে। বিজ্ঞানীরা বলেন-এটা অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষন করার চেস্টা। টাকা ছড়িয়ে, বৈভব দেখিয়ে, লেটেস্ট শাড়ী কিনে বা নিজের ভাল ফিগার দেখিয়ে, অন্যদের চোখ কাড়তে পারলে-দেহ থেকে ঝড়ে-ডোপামাইন আর এন্ড্রফিন হর্মোন।  মনে একটা হাই-ফিলিংস দেয়।  

কিন্তু আসলেই ওভাবে মানুষ আলাদা হয় না। দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা, মানুষের জীবনে ড্রাগের মতন নেশা। দুটো মানুষের মধ্যে জেনেটিক কোডের গড় পার্থক্য ১৫০০ ভাগের একভাগ। যতই প্রাসাদসম বাড়ি কেনো না কেন-আমেরিকান প্রাসাদে থাকা একজন মা তার ছেলেকে যতটা ভালবাসে, বাংলাদেশের কুঁড়ে ঘরে বসে একবেলা খেয়ে না খেয়ে আরেকজন মা তার ছেলেকে দুবেলা খায়িয়ে অনেক বেশী ভালবাসে। ছেঁড়া কাপড়ে আছেন বলেই সেই মায়ের কোন পরিচিতি নেই?  বৈভবে কি একজন পিতা বা মাতা বড় হন? অথচ পিতৃত্ব এবং মাতৃত্ব ই আমাদের সব থেকে বড় ধর্ম।

এই ভাবে নিজেদের আলাদা করা যায় না। আমরা আলাদা আমাদের চিন্তার স্বকীয় ভাবনায়। মার্সিডীজ কিনে, আইফোন কিনে কেও নিজেকে আলাদা ভাবতেই পারে। তবে সেটা আসলেই মানসিক রোগ। বিকার। অন্ধ কনস্যুমারিজমের অনুসারীদের ভবিষ্যত এই ভদ্রলোকের মতন চোরাবালিতে । সাথে সাথে সংসার, ছেলেমেয়েদেরও এরা ডোবাবেন। নিজের জীবনকে সমাজের আর পাঁচজনের কল্যানের জন্য  না লাগাতে পাড়লে, আত্মকেন্দ্রীকতার মানসিকবিকারে, মানুষ ধ্বংশ হতে বাধ্য।  

১০/৬/০৮ 

 


. বিপ্লব পাল, আমেরিকাতে বসবাসরত পদার্থবিদ, গবেষক এবং লেখক। এক সময় ভিন্নমতের মডারেটর ছিলেন, বর্তমানে www.fosaac.tv সম্পাদনার সাথে জড়িত।