রোম্যান্টিক সমাজতান্ত্রিক বনাম সুবিধাবাদি ধনতান্ত্রিক
-বিপ্লব পাল
সামাজিক বিবর্তন বহতা নদী-তবে সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্র--ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র-এই ভাবে কেও সমাজের ভবিষ্যতবানী করতে পারে না। এই ধরনের মার্ক্সীয় চিন্তাধারা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক (Poverty of Historicism-Sir Karl Popper 1943)। সামাজিক ইতিহাস এই ভাবে প্রেডিক্ট করা সম্ভব নয়। শ্রেনী বিন্যাস, শ্রেনী সংগ্রাম সব অলীক কল্পনা-কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কারন গণিতের দৃষ্টিতে সমাজ একটি জটিল সিস্টেম-যার বিবর্তন অর্নিনায়ক। মার্ক্স ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা বস্তুবাদের ইতিহাস থেকে মানবজাতির ভবিষ্যত হিসাবে শোষন মুক্ত, শ্রেণী শুন্য সমাজতান্ত্রিক রাস্ট্রের ধারণার জন্ম দেন। স্যার কার্ল পপার (১৯৩১) , তার গবেষনার মাধ্যমে দেখান এই ধরনের ধারনা শুধু অবৈজ্ঞানিক ই নয়-দেশ এবং জাতির পক্ষে এক সর্বনাশা।
তাহলে পালটা প্রশ্ন আসবে-গণতন্ত্রে ভোট দেব কি ভাবে? কিভাবে জানবো কোন পার্টি দেশের জন্যে, আমার জন্যে ভাল? সেইত ভবিষ্যত বানীর প্রশ্ন! গণতন্ত্র ই লাটে উঠে যাবে ভবিষ্যতবানী না করলে!
সুতরাং এম্পিরিসিজমের মাধ্যেমেই করি বা মার্ক্সবাদের মাধ্যমেই করি -ভবিষ্যতবানী একটা দরকার-এবং তা যতদূর পর্যন্ত সম্ভব ত্রুটিমুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। যে সিস্টেমে এই সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়ে রাস্ট্রকে চালনা করা হবে –ধরুন নাম দিলামঃ সমাজতন্ত্র ( মার্ক্সবাদ বা এম্পিরিসিজম দিয়ে সেন্ট্রাল প্ল্যানিং)।
আবার ধরুন আমেরিকার রাজনীতি ইস্যুভিত্তিক। এখানেও এম্পিরিসিজম কাজে লাগিয়ে কিছু কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকে-কিন্ত বাকিটা বাজার মহারাজের হাতে। প্রেডিকশন ভিত্তিক প্রায় কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে মার্কেটকে আটকানো হয় না-লোকে অটো কারেকশনে বিশ্বাস করে। আমরা বলছি মুক্তবাজার অর্থনীতি।
সমাজতন্ত্র করতে গিয়ে আমরা কি দেখলাম? রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল। তাতেও সিস্টেমটা টিকত-কিন্তু মূল সমস্যা দাঁড়াল উৎপাদনে-লোকে খাটতে চাইল না-বিলিবন্টন ব্যাবস্থা ভেঙে পড়ল। ফলে এক অসহনীয় দারিদ্রের সৃষ্টি হল। ভেঙে গেল সমাজতন্ত্র।
আবার নেপালকেও দেখুন। ওরা যদি আজ সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে জাতির মুক্তি না চাইত-রাজতন্ত্রের নাগপাশ থেকে কিভাবে আধুনিক নেপালের উত্তরন হত? কি ভাবে সেখানকার শোষিত লোকেরা মুক্তির স্বপ্ন দেখত?
এবার আসুন দেখি-সমাজকে প্রেডিক্ট না করতে চাইলে-বাজার অর্থনীতির লাভ-খতিয়ান।
আমেরিকার ২০% লোক বর্তমান মরর্টগেজ ক্রাইসিসে সর্বস্ব খোয়াল-প্রিডেট্ র লেন্ডিং করলে এমন হবে সবাই প্রেডিক্ট করেছিল। যার বছরে মাইনা ৩০ হাজার ডলার, সে ৬০০,০০০ ডলার দিয়ে বাড়ি কিনতে পারে না-অথচ তাকে তাই করানো হল। সরকার ও কিছু করলো না। বাড়ীর দাম হলো আকাশ ছোঁয়া-অথচ ৫৫% লোকের বাড়ীর মর্টেজ পে করার সামর্থ নেই। ফলে কোন সেন্ট্রাল প্যানিং এর অভাবে-আজ আমেরিকার ২০% লোক বাড়ি এবং সর্বস্ব খোয়াতে চলেছে। একটু-সামান্য একটু সেন্ট্রাল প্ল্যানিং করলেই এটা আটকানো যেত।
২০০১ সালে কি দেখলাম? টেলিকম শিল্পের আয় বড়জোর ৬০ বিলিয়ান ডলার-সেখানে বিনিয়োগ হল, মাত্র একবছরেই প্রায় ৭৪ বিলিয়ান ডলার। শেয়ার মার্কেটের টাকায়-লোকের পেনশনের টাকায়। ২০০২-২০০৪। টেলিকম শিল্পটাই শুয়ে গেল।
আমার কোম্পানি উঠে যায় ২০০৩ সালে। ৮০% টেলিকমের লোক চাকরি হারায়। সেটাও ঠিক আছে-কিন্ত কোটি কোটি বৃদ্ধলোকের শেষ সম্বল নিঃস্ব হয়। আমার এক কলিগকে ৭৫ বয়সেও ক্যান্সার নিয়ে কাজ করতে দেখে দুঃখ হত। লোকটি হার্ভাডের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পি এই চ ডি। পেনশনের সবটাকা শেয়ার মার্কেটের জলে। হার্ভাডের পি এই চ ডির যদি এই অবস্থা হয়-ঊলূ খাগড়াদের কি হবে বলাই বাহুল্য! এটা সেন্ট্রাল প্ল্যানিং এ আটকানো যেত না? সামান্য একটু ভবিষ্যত বানীর ব্যাপার মাত্র!
আমেরিকায় শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা ভেঙে পড়েছে। বিত্তবান ছাড়া কারুর পক্ষে আর ব্যাচেলর ডিগ্রি, ভা ভালো কলেজে পড়া সম্ভব নয়। ৭০ মিলিয়ান লোকের কোন স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নেই। এগুলো সেন্টাল প্ল্যানিং, সামান্য একটু ভবিষ্যত বাণী করেই আটকানো যেত।
আবার আমেরিকাতেই যাবতীয় কিছু আবিষ্কার হয়েছে-বেঁচে থাকার সমস্ত ওষুধ থেকে ইন্টারনেট-টিভি-যা কিছু আমাদের আধুনিক জ়ীবন দিয়েছে-তা সব কিছু আমেরিকার অবদান। সমাজতন্ত্র কিছু যুদ্ধাস্ত্র আর ভালো অঙ্কের বই ছাড়া বিশ্বকে কি দিয়েছে? মৌলিক বিজ্ঞানে অবশ্যই কিছু অবদান রেখেছে। ব্যাস ওইটুকুই।
তাহলে আমাদের পজিশনটা কি হবে?
কোন দিকে আমরা রাষ্ট্রকে চালাবো?
সেই ভবিষ্যত কি আমরা জানি?
শুধু এটা জানি-যারা ভাবে শুধু সমাজতন্ত্র দিয়ে যাবতীয় সমস্যার সমাধান হবে-তারা রোম্যান্টিক পাগল-তারা জানেন না-সমাজতন্ত্র গড়লেই হয় না-লোককে দিয়ে কাজ করানো সমাজতন্ত্রে সাংঘাতিক কঠিন-পুরো কাঠামোটাই শুয়ে পড়ে!
আবার যারা ভাবেন নিয়ন্ত্রন মুক্ত বাজার অর্থনীতি দিয়েই দেশের উন্নতি হবে-তারা সুবিধাবাদি ছাগল। সমাজের অবহেলিত শ্রেনীর লোকদের কথা তারা ভাবতে পারেন না-শেয়ার মার্কেটে নিজের সম্পত্তির বৃদ্ধির সাপ মইয়ের লুডো খেলায় দিন গুজরান। আজ মর্টগেজ মার্কেটের ক্রাইসিস আটকাতে আমেরিকান সরকার, মর্টগেজ কোম্মানী অধিগ্রহন করতে বাধ্য হচ্ছে-অহ ! মুক্তবাজার অর্থনীতির বিড়াল শেষে এসে সমাজতন্ত্র্বের কোলে ঘাপটি মেরে আশ্রয়পার্থী! আর অন্যদেশকে উপদেশ হওয়া হচ্ছে তোমরা বাজার মুক্ত কর!
তাহলে উপায়টা কি?বাস্তব হচ্ছে পার্ফেক্ট কোন সিস্টেম নেই। আমাদের প্রয়োজন আসলেই ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে-তাই ভবিষ্যত কিছুটা হলেও ভাবতে হবে-আবার উৎপাদনশীলতা-আবিষ্কার ও বাড়াতে হবে। কিছুটা পরিকল্পনা-কিছুটা মুক্ত বাজার অর্থনীতির হাতেই আমাদের ভবিষ্যত। ১০০% পরিকল্পনা করতে গেলে একনায়কতন্ত্র চলে আসবে। কিছু অটো কারেকশন-কিছুটা কন্ট্রোল-এই ভাবেই পরীক্ষা ( এম্পিরিসিজমের মাধ্যমে আমাদের এগোতে হবে)। পুঁজির বৃদ্ধি কখনোই একটা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে পাড়ে না-রাস্ট্রের লক্ষ্য হওয়া উচিত বর্তমান না-ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ, খাদ্য, পরিবেশের সুরক্ষা।
প্রানী জগতে আমরা দেখি পিঁপড়ে-বানর-সবাই সমাজ গড়ছে। ওদের ও রাজনৈতিক বিন্যাস আছে। ওদের বিন্যাস বদলায় খুব ধীরে-প্রাকৃতিক বিবর্তন মেনে। মানুষ কিন্ত নিজেদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিন্যাসের বিবর্তন ত্বরান্বিত করতে পারে। কারন মানুষ প্রকৃতিকে বশ মানিয়ে নিজের জেনেটিক সারভাইভাল উত্তোরত্তর বাড়িয়ে চলেছে। মার্ক্স এঙ্গেলেস মূলত সেটাই করতে চেয়েছিলেন-কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক দ্বান্দিক বস্তুবাদের পথ ছেড়ে দিয়ে--ঐতিহাসিক বস্তুবাদের রাজনৈতিক তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে সেটা করতে গিয়ে-এক মহান ধারনার সম্পূর্ণ সলিল সমাধি করেছেন। ভবিষ্যতের সমাজে সাম্যের চেয়েও দরকার, প্রতিটা লোকের জন্য শক্তি এবং খাদ্য সুরক্ষা। প্রযুক্তির যখন আরো উন্নত হবে, খাদ্য এবং শক্তি প্রত্যেকের জন্যে যখন পর্যাপ্ত হবে-শোষনমুক্ত, শ্রেণী মুক্ত সমাজ-আমরা এমনিতেই পাব। আধুনিক বিবর্তনবাদ থেকে খুব নিশ্চিত ভাবেই আমরা এখন জানি-আমরা রাস্ট্রের চেয়েও নিজেদের সন্তানের কাছে অনেক বেশী দায়বদ্ধ। এর অন্যথা কোথাও হয় নি।
তাহলে আমাদের পজিশনটা কি হল? আমরা কি চাইছি?
-ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য খাদ্য,শক্তি, পরিবেশ সুরক্ষা-এটার জন্যে সেন্ট্রাল প্ল্যানিং দরকার
-আমার উদবৃত্ত শ্রমের বৃহত্তর অংশটা ফ্যামিলির জন্যে, বাকীটা সমাজের জন্য দান করা।
-ভোগ্য পন্যের জন্য মুক্তবাজার অর্থনীতির অনেকটাই রাখতে হবে-শুধু যাতে আবিষ্কার গুলো হয় অর্থাৎ ধনতন্ত্র আর সমাজতন্ত্রের এই কৃত্রিম বিভাজন বিজ্ঞান সম্মত নয়। আমাদের বাঁচতে হবে এক মিশ্রতন্ত্রের সেমি-পার্ফেক্ট রাজনৈতিক সিস্টেমের ওপরে। এবং ক্রমাগত এম্পিরিসিজম-পরীক্ষা চালিয়ে -সেটাকে পারফেকশনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেস্টা করতে হবে। অবাধ মুক্ত বাজার অর্থনীতি বা বৈজ্ঞানিক্ সমাজতন্ত্র-পুরোটাই আষাঢ়ে গল্প। কেন যে লোকে এখনো বিশ্বাস করে-সেটাই বুঝি না।
ড. বিপ্লব পাল, আমেরিকাতে বসবাসরত পদার্থবিদ, গবেষক এবং লেখক। এক সময় ভিন্নমতের মডারেটর ছিলেন, বর্তমানে www.fosaac.tv সম্পাদনার সাথে জড়িত।