সাদাভোট, কালোভোট
-বিপ্লব পাল
ভোট গণতন্ত্রে মহোৎসব। আরেক একটা মাত্র রাত্রি-তাহলেই আমরা জানতে পারব, আমেরিকা ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম কি না। বিশ্বের সর্বক্ষমতাবান মানুষটি কৃষ্ণাঙ্গ হলে নিসন্দেহে সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসে তা হবে মাইলফলক। আলেকজান্ডার, সিজার, চেঙ্গিস খান এবং শেষে বৃটিশ সম্রাজ্যের আধিপত্যের ইতিহাস নেহাতই গৌরবর্নের মানুষদের আধিপত্যের একচেটিয়া নিশান। সেই চল্লিশহাজার বছর আগে, হোমোসেপিয়েন্সের যাত্রাপথ যেখান থেকে শুরু-সেখানে থেকেও তারা পিছিয়ে পড়েছিলেন-ইরেশিয়ায়, তাদের সাদা চামরায় বিবর্তিত ভাইদের কাছে। পরবর্ত্তী কালে মানবসভ্যতায় কালোমানুষরা আবাহমানকাল ধরে ‘সাদা সভ্যতার’ দাশ। রোমানদের সময় মিশর ছিল দাশ-সাপ্লাইচেনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রোমের ইতিহাসের পরের দুহাজার বছরে, আফ্রিকার কালো মানুষরা দাসত্ব করেছে ইউরোপ, এশিয়া, আমেরিকা এবং তাদের নিজেদের দেশে।
মাত্র দেড়শো বছর আগেও, এদের মানব প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত বলে মানতে চান নি অনেক বায়োলজিস্ট! খোদ ইংল্যান্ডে ডারুইনের বিবর্তন তত্ত্বের রমরমার দিনে, একশ্রেণীর ‘বিজ্ঞানী’ আফ্রিকা থেকে কালো মানব-মানবী ধরে এনে, দর্শকদের বোঝানোর চেষ্টা করতেন বিবর্তনের ধাপে এরা আসলেই শিম্পাঞ্জি এবং মানুষের মধ্যে! এমনকি ডি এন এর আবিষ্কারক জেমস ওয়াটসনও এই দলের ই লোক। ইনি বারংবার দাবি করেছেন, বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রমানিত কালোদের বুদ্ধির দৌড়, অন্যদের অনেক পেছনে। কারন হিসাবে দাবি করেছিলেন, মানব জীন, নানান মহাদেশে বিভিন্ন আবহাওয়া এবং ইতিহাসের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়েছে। যদিও, হিউম্যান জেনোম প্রোজেক্টের বিজ্ঞানীরা তার ‘রেসিস্ট’ বক্তব্যকে শ্রেফ কষ্টকল্পনা বলেই মনে করেন। আসলে সেই আফ্রিকা থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু-এবং সেই কারনে ওয়াটসনের জীনেও ৯% আফ্রিকান ছাপ! পৃথিবীর প্রতিটা সাদা বা বাদামী মানুষের জীনেই ১০-৪০% পর্যন্ত আফ্রিকান মিউটেশন পাওয়া যায়-অর্থাৎ এরাই আমাদের আদিপুরুষ। অথচ মানব সভ্যতার গত পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস, কালো মানুষদের ওপর শোষন এবং অত্যাচারে ইতিহাস। শুধু কি তাই-এই হাবাটে বাঙালীদের মধ্যেও কালো মেয়ে জন্মালে মা কাঁদতে থাকেন-বাপের ধুতি ওঠে হাঁটুর ওপরে। কালোছেলে হলে মা দুঃখ করেন আফশোসে।
সামনের মঙ্গলবারে ওবামা ‘যখন’ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মসনদে বসবেন (আপাতত এমন না ঘটার কারন খুব কম ধরে নিয়ে) , সেই ইতিহাসে কি শেষ দাঁড়ি পড়বে?
রেশিস্টরা মানছেন না।
প্রথমত, ওবামা, পুরো কালো নন। সাদা মা, কালো বাবা। এবং মানুষ হয়েছেন সাদা দিদিমার কাছে। সাদারা বলছেন, ওবামা কালোদের আর্থসামাজিক অবস্থান এবং ‘জেনেটিক’ গঠনে ( যদিও তা বিজ্ঞান সমর্থিত নয়) মানুষ নন। তাই অন্যরকম। মানে এমন একটা কালো লোক, সব সাদাদের ডিবেটে নাস্তানাবুদ করছে-সাদারা তাকে গুরু হিসাবে মেনে নিচ্ছে। এটা মানা শক্ত। তাই ‘এস্কেপ রাউট’ খোঁজা। তবেও এটাও বাস্তব-আমেরিকান কালোদের যতার্থ ১০০% প্রতিনিধি তিনি নন-হতেও চান না। যেভুলটা কৃষ্ণাঙ্গ নেতা রেভারেন্ড জ্যাকসনরা করেছেন-নিজেদের কালো, অত্যাচারিত বলে ঢেউ তুলতে গেছেন-সেই পাঁকে পা দেন নি ওবামা। সুযোগ ও ছিল না। কারন মানুষ হয়েছেন সাদা দিদিমার কাছে। ফলে জাতের সস্তা রাজনীতি না করে-শ্রেফ নিজের বুদ্ধিমত্তা এবং বিচক্ষনতাকে আমেরিকানদের কাছে তুলে ধরতে পেরেছেন। ফলে রেভারেন্ড জ্যাকসনের মতন কালো নেতাদের ধৈর্য্যচুতি ঘটেছে-তিনি ওবামাকে বলেছেন সাদালোকেদের সাজানো ঘুঁটি। লাভ কিছু হয় নি। আসলে নতুন আমেরিকান প্রজন্ম মানুষের রং, বংশ গৌরব এবং অর্থবিত্ত নিয়ে খুব নির্লিপ্ত। অতীত এরা জানে না-জানতে চাই ও না। ফলে ওবামার মধ্যে ইতিহাসের কি বীজ লুকিয়ে আছে তাই নিয়ে এদের মাথা ব্যাথা নেই। ওবামা তাদের কথা বলছেন-এটাই যথেষ্ঠ। তাই আশা করা হচ্ছে এইসব তরুনদের উৎসাহে এবার ১৩০ মিলিয়ান আমেরিকান ভোটদেবে-যা সর্বকালীন রেকর্ড।
আসলে আমেরিকার বিত্তশালীতা, ধণবৈভব হিমশৈলের মতন। এখানে প্রাচুর্য্য দেখা যায়-কিন্তু দারিদ্র ঘরের মধ্যে ঢাকা। এই নতুন বিশ্বে শিক্ষা বিনা, মানুষ অচল নয়া পয়সা। অথচ, অধিকাংশ মধ্যবিত্ত আমেরিকান ছেলে মেয়েদের পেশাদারি শিক্ষায় পাঠানোর মতন পয়সা বাবা মায়েদের নেই। ব্যাঙ্কের লোন নিয়ে পড়ে চাকরি নেই-চলে গেছে ভারত বা চীনে! দেউলিয়া এই আমেরিকান সমাজের সবকিছু-শিক্ষা দুর্বল, চাকরী বিদেশে, চিকিৎসা দিনকে দিন আরো দুর্মুল্য হচ্ছে-বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়ায়, ফ্যামিলিও আনস্টেবল! তাহলে নতুন আমেরিকান প্রজন্ম পাচ্ছেটা কি?
ভারত বা চীনের নতুন প্রজন্ম এর থেকে অনেক বেশী ভাগ্যবান। গত ১৫ বছরে ভারতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সংখ্যা বেড়েছে ৮ গুন। ভারতে এখন বছরে ৩০০,০০০ আর চীনে ৩৪০,০০০ ইঞ্জিনিয়ার তৈরী হচ্ছে। সেখানে আমেরিকার সংখ্যাটা গত দশ বছরে ষাট হাজারে ঘুরপাক খাচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক কাঠামো এখনো বলবৎ থাকায়, প্রতিভাবান ভারতীয় বা চীনারা সেরা শিক্ষাটা পাচ্ছে। আমেরিকায় বাপের টাকা না থাকলে আগে যাও বা কিছু করা যেত-এখন সেই সুযোগ নেই। ধনতন্ত্র শিক্ষা বা স্বাস্থ্যে চলে না। এটা এখনো না বুঝলে, বোঝার সময় এসেছে-ওবামা এই পরিবর্তনের কথাই মূলত বলেছেন। তরুন যুবকেরাও নিজের বর্তমান দুরাবস্থা চিন্তা করে, নিসন্দেহে বুঝেছে আমারিকার ক্রমবর্ধমান দেউলিয়াপনার বিরুদ্ধে এক বিশাল পরিবর্ত্তন জরুরী।
ধণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের সমর্থকদের অবুঝ বানরলম্ফে ওবামা সামিল হন নি। রোগ অনুযায়ী প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন। সেখানে জন ম্যাকেইন ধনতন্ত্রে অবিচল আস্থা রাখেন। আমি মনে করি না, আমেরিকার নতুন প্রজন্ম , যারা নিজেদের বঞ্চনার কথা আস্তে আস্তে ঠেকে শিখছে-তাদের আস্থা ধণতন্ত্রের প্রতি অটুট। যেমন আমার এক পি এই ডি করা কলীগ, দুঃখ করছিলেন, এডুকেশন লোন শোধ দিয়ে, হাতে কিছু থাকে না। তা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-আচ্ছা বাপু তুমি কি লোন শোধ দিয়ে দিয়েছ?
আমি হেঁসে ফেললাম। ১৯৯১ সালে আই আই টিতে, তখনকার ডলার মূ্ল্যে আমাদের প্রতি সেমিস্টারে বারো ডলার টিউশন ফি দিতে হত! সমতুল্য একই শিক্ষা আমেরিকাতে পেতে গেলে দিতে হত পাঁচ হাজার ডলার। পরে ‘আমেরিকান মডেলের’ অন্ধ অনুসরনে আই আই টিতেও টিউশন ফি বাড়তে থাকে! কিন্তু যাইহোক, তা কখনোই সেমিস্টার প্রতি পাঁচ-দশহাজার ডলার না!
বেচারার মুখ দেখে বুঝলাম শকড। আসলে ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছে সমাজতন্ত্রের সবকিছু বাজে-কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা যখন তাকে অন্যরকম স্বাদ দিচ্ছে- নিজেরা ধণতান্ত্রিক সমাজের প্রচারে মুর্গী হয়েছে না মেনে উপায় কি? আমেরিকান পলিসি মেকাররা ফ্রি মার্কেট ইকোনমীর নামে যে স্টীমরোলার এদের জীবনের ওপর চালিয়েছেন-তা এরা আর কদিন সহ্য করবে? আগে মিডিয়ার প্রচারে কুয়োর ব্যাঙ হয়ে বাঁচার উপায় ছিল। এখন চোখের সামনে দেখছে-সমাজতান্ত্রিক কাঠামোয় বিনে পয়সার শিক্ষা পাওয়া চীনা বা ভারতীয়রা শিক্ষাটা তাদের থেকে বেশী ই পেয়েছে। আর তারা টাকা ঢেলে শুধু সুদ গুনছে! না আছে চাকরি-না এদের ‘দামী’ শিক্ষাকে কেও পাত্তা দিচ্ছে! হতাশ না হয়ে উপায় কি? লোক ঠকিয়ে শিক্ষার বেসাতি বেশী দিন চলতে পারে না। ওবামা ঠিক এই গুরুত্বপূর্ন জায়গাতেই আমেরিকান নতুন প্রজন্মকে এক নতুন সুর্যোদয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।
তবে ওবামা এতটা সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তন মোটেও বলছেন না। ওর সমাধান মুমুর্ষ রোগীকে স্টেরয়েড দেওয়ার মতন। এতে কাজ হবে বলে আমি মনে করি না। সেই অর্থে ওবামা কিছু সলিড পরিবর্ত্তন আনবেন-সেটা আমার কাছে দুরাশা। ডেমোক্রাটরা আসলে -এমনিতেই শিক্ষা, গবেষনাখাতে টাকা বেশী আসে-যুদ্ধ যুদ্ধ সর্বনেশে খেলা কমে-ওই জাতীয় কিছু হবে আর কি। সেটা ভালোই। তবে নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা তাপ্পি মেরে কতটা মিটবে-আমি সন্দিহান।
মেরীল্যান্ড ১১/৩/২০০৮
ড. বিপ্লব পাল, আমেরিকাতে বসবাসরত পদার্থবিদ, গবেষক এবং লেখক। এক সময় ভিন্নমতের মডারেটর ছিলেন, বর্তমানে www.fosaac.tv সম্পাদনার সাথে জড়িত।