সারা প্যালিনের কুসংস্কার
-বিপ্লব পাল
আমেরিকা প্রবল কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশ। নেতা-নেত্রীরা জনগনের ই প্রতিচ্ছবি। তারাই বা ব্যাতিক্রম হবেন কেন?
রিপাবলিকান ভাইস-প্রেসিডেন্ট পার্থী সারা প্যালিন নারীর ক্ষমতায়ন প্লাস রিপাবলিকান রক্ষনশীল চরিত্রের ‘হলিউডি’ আইকন। সেটা নারকেল না তরমুজ না সলিড কাঁঠাল- তা আমেরিকান মিডিয়া ম্যাজিকের বদান্যতায় ম্যাজিক রিয়ালিজম। খোসার স্বাদ পর্যন্তই আমজনতার দৌড়। তবে ম্যাজিকও ফস্কায়। যেমন হঠাৎ সোরগোল উঠেছে প্যালিন আসলে একটি অতীব ভয়ংকর খ্রীষ্ঠান কাল্টে বিশ্বাসী।
কাল্টের নাম পেন্টেকোস্টালিজম। এরা ডাকিনী, যোগিনী, তুক-তাক, ফুঁক-ফাঁক ইত্যাদি যাবতীয় কুসংস্কারে বিশ্বাসী। যদিও নিজেদের ঢাক পেটাতে বাইবেলের স্বরণ নিয়ে থাকে। যারা বাংলার গ্রামে বা শহরে ওঝাদের খেলা দেখেছেন-তারা বিলক্ষন অবগত কিভাবে ওঝারা ‘শত্রুদের’ উদ্দেশ্যে একগাদা মন্ত্র, ঝাঁটা, পাতা ঝেড়ে ‘বাণ’ ছোড়েন। এই পেণ্টেকোষ্টালিজম শব্দটা খটমট-বেসিক বাপারটা ওই এক ই। ঠিক গ্রাম বাংলায় বা শহরে যা দেখেছেন- শত্রুদের উদ্দেশ্যে তুকতাক ‘বাণ’ চালাও!
গত বছর এক কেনিয়ান ওঝাকে ডেকে নিজের শত্রুদের উদ্দেশ্য ‘বাণ’ চালানোর এক ধর্মানুষ্ঠান করেন প্যালিন। সেই ভিডীও থেকেই এই বিতর্কের সূত্রপাত। ভিডিওটা আগে দেখুন।
কি বুঝলেন? বাংলার ওঝাদের কথা স্বরণে এল?
এই সব ডাকিনী-যোগিনী-ওঝা কালট, সব ধর্মেই আছে। এ হচ্ছে আদিবাসি সমাজের নৃতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার। যজ্ঞ করে শত্রুবিনাশের ডাক, ঋকবেদের ছত্রে ছত্রে। শত্রুর বিরুদ্ধে ভগবানের প্রোটেকশনের প্রতিশ্রুতি কোরান এবং বাইবেলেও ভুরিভুরি। তাহলে সারা প্যালিন এমন কি করলেন যার জন্যে মিডীয়াতে এত সোরগোল?
সমস্যাটা সেই শত্তুর সংক্রান্ত। পেণ্টেকোস্টালিস্টরা খ্রীষ্টান তথা আমেরিকার শত্রুর তত্ত্বে অতীব বিশ্বাসী। তবে তারা আমেরিকার বাহুবলের চেয়েও তুকতাকের ওপর বিশ্বাস রাখে বেশী। অহ-তুকতাক করে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদিদের বাগে আনতে পারলে মন্দ হত না! ইরাক এবং আফগানিস্থান এত মৃত্যু অন্তত আটকানো যেত! সমস্যা হচ্ছে সেই ঋকবেদের সময় থেকেই শত্রুনাশ যজ্ঞ মিলিটারি আক্রমনের প্রারম্ভিক মাত্র! অর্থাৎ এই ধরনের কাল্ট আসলেই যুদ্ধংদেহী আদিবাসি মানসিকতার প্রতিফলন। কোরান এবং গীতার নীতিমালা এইসব আদিবাসি প্রবৃত্তি গুলোরই উন্নত ধরনের প্যাকেজিং। সেই অর্থে বুশ এবং তার রিপাবলিকান পার্টি যুদ্ধ সংক্রান্ত ধর্মীয় নীতিমালার একনিষ্ঠ সেবক! প্যালিন আর এমন কি বেশী করলেন? সংস্কার এবং কুসংস্কারের মধ্যের লক্ষ্মণরেখা রিপাবলিকান পার্টিতে অদৃশ্য।
ভারতে ইন্দিরা গান্ধী শত্রুনাশে এমন যজ্ঞ করতেন। নাস্তিক নেহেরু বনাম তার উত্তরাধিকারী ইন্দিরা এবং রাজীবের মধ্যে পার্থক্যটা আকাশ-পাতাল। ইন্দিরা এবং রাজীবের সময় ১০ জনপথের বাড়িতে দিল্লীর এলিট ওঝাদের যাতায়াত সর্বজনবিদিত। নরসিংহা রাও ধার্মিক ছিলেন-তবে ধর্মে তার গভীর জ্ঞান ছিল বলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন না। বাজপেয়ী তথা বিজেপির প্রতিটি নেতা এবং নেত্রী প্রবল কুসংস্কারাচ্ছন্ন। যেটা আরো বাজে, এরা নিজেদের কুসংস্কার প্রীতিকে হিন্দুত্ব প্রীতি বলে দাবি করে ভোট কুরিয়ে থাকেন। প্রায় সব ধর্ম সংস্কারক ই আবাহমানকাল থেকে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কিছু না কিছু বক্তব্য রেখেছেন। গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর তীর্থঙ্কর, হজরত মহম্মদ, গুরু নানক, স্বামী বিবেকানন্দ-এরা প্রত্যেকেই কুসংস্কারকে আধ্যাত্মিকপথের পরিপন্থী বলেই দাবি করেছেন। তারমধ্যেও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বুদ্ধের বক্তব্য সবথেকে পরিষ্কার। বাকীদের কথামৃত ধরি মাছ, না ছুঁই পানি টাইপের।
তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে নি। সবধর্মেই ধার্মিকদের মধ্যে তাবিজ, তুকতাক, জলপড়া নিয়ে কুসংস্কার প্রবল। বৌদ্ধধর্ম কুসংস্কারের রমরমাতে ভারত থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আমেরিকাতেও নিম্নবিত্ত এলাকাতে ‘প্যারট রিডার’ সবর্ত্র দেখা যায়। এবং তাদের ক্লায়েন্টেল সবশ্রেনীর মহিলা।
নেতারা জনগণ থেকে আলাদা হবেন এমনটা ভাবাই ভুল। নেহেরু বা কামাল আতার্তুকের মতন নেতা পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল।
মেরীল্যান্ড ১০/২৫/০৮
ড. বিপ্লব পাল, আমেরিকাতে বসবাসরত পদার্থবিদ, গবেষক এবং লেখক। এক সময় ভিন্নমতের মডারেটর ছিলেন, বর্তমানে www.fosaac.tv সম্পাদনার সাথে জড়িত।