শ্রদ্ধাবাসর!
-বিপ্লব
১/৯/২০০৮
নবদ্বীপে বৈষ্ণবদের জন্য চালু প্যারোডি-"মাগুর মাছের ঝোল, ভরা যুবতীর কোল-বলো হরিবল!"
ইহা সার্বজনীন সত্য। ভরা পেট এবং দেহকামনা মিটলে-মানুষের মন উড়ু উড়ু দার্শনিক ভাবনায় ডানা মেলে। ইহা হইতেই দার্শনিক তথা ধর্ম জিজ্ঞাসার শুরু এবং শেষ।
আমার অফিসমেট ক্রীস ইটো লজিক্যাল পজিটিভিস্ট। লজিক বা যুক্তিবাদ দুদিকে ধার দেওয়া তলোয়ার। তাই যুক্তির সপক্ষে পরীক্ষালদ্ধ প্রমানের গুরুত্ব বেশী পজিটিভিস্টদের কাছে। কিভাবে দাম্পত্য জীবনে সুখী হওয়া যায়-এই নিয়ে সেদিন এক বিশাল তর্ক। দীর্ঘ এক দশক সংসারের ঘানি টেনে নিজের দাম্পত্য জীবনে সুখ মরুভূমির মরিচিকা । অথবা সাধন বৈরাগীর ভাঙা একতারা-ও তার আর কোন দিন ই জোড়া লাগবে না-টুংটাং শব্দ ঠিক ই বেড়োবে। তোমার জীবনে সব থেকে বাজে সিদ্ধান্ত কি? বা জীবনের কোন সিদ্ধান্তটি তুমি বদলাতে চাও? প্রশ্নটি কোন গৃহপালিত স্বামীকে করা অনুচিত। এই জন্যেই দাম্পত্যঘটিত আলোচনা থেকে দশ হাত দূরে থাকি-কিন্তু সেইদিন ভাবলাম-আহা আমি না হয় লাশকাটা ঘরে শুয়ে আছি। কিন্তু যে দাম্পত্যজীবনে সুখী-তার কথা শুনিই না একটু!
-দাম্পত্যজীবনের তিনটে পিলার--পরস্পরের প্রতি সততা, সব কথা খুলে বলা এবং শ্রদ্ধা!
প্রথম দুটিতে আমার আপত্তি নেই। কারন-তা না হলে বিবাহিত সম্পর্ক দূরঅস্ত-ক্রেতা বিক্রেতার সম্পর্কটাই টেকে না। শ্রদ্ধার প্রশ্নে হোঁচট খেলাম। বাবা-মার ঝগড়ার মধ্যে বড় হয় নি-এমন বাঙালী দেখিনি।বিয়ে করে বৌয়ের গালাগাল হজম করার মতন পুরুশালীপেট নিয়েই বাঙালী পুরুষের বেঁচে থাকা। এতেব শ্রদ্ধার কথা শুনে চোঁয়া ঢেকুর উঠলো। আমি বললাম-
--কথাটা প্লেটোর ইউটোপিয়া। শ্রদ্ধার ব্যাপারটা আমার কেমন যেন অবৈজ্ঞানিক লাগে! শ্রদ্ধা এবং ঘৃণা-আসলেই একই মুদ্রার এপিঠ ও পিঠ। নিরেপেক্ষ মনোভাব নিয়ে চললেই আমার মনে হয় আমরা আরো অনেক বস্তুনিষ্ঠ থাকতে পারি। সেটাইত বৈজ্ঞানিক পথ- তাই নয় কি?
-বৈজ্ঞানিক পথে কি প্রেম হয়? না স্ত্রীকে ভালোবাসা যায়-?
-ঠিক, ঠিক। প্রেমিকার বৈজ্ঞানিক তথা বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষন করলে ভালোবাসা বেসিনের বাসন ধোয়া জল। তার থেকে প্রেমে কবিতাই ভাল! ভালোবাসা ব্যাপারটা গোলমেলে। প্রেমের প্রোটিন ডোপামাইন একবছর ও টেকে না। বিয়েটা টেকে সন্তান এবং সেক্সের ওপর! শ্রদ্ধায় কি বিয়ে টেকে?
শ্রদ্ধা নিয়ে ছোটবেলা থেকেই গোল হয়ে পড়ে আছি। আমার চোখ কান খুব খোলা-অন্যের কথা তখন ই কানে বাজে-যদি দেখি দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে খাপ খায়। ছোট বেলায় শেখানো হত-শ্রদ্ধা না থাকলে বিদ্যান হওয়া যায় না। 'অশ্রদ্ধা' ব্যাপারটা আস্তিনে ঢুকে যাচ্ছে -মনে ভয় ছিল তীব্র। সমস্যা হচ্ছে শ্রদ্ধার ব্যাপারটার সাথে ধর্মের যোগ খুব নিবিড়। দেখতাম যাদের শ্রদ্ধার ভাবটা খুব বেশী-তারা তত বেশী গাধা। এবং গরীব। স্বাধীন চিন্তা অনেক দূরের কথা-এরা চিন্তা করতেই অক্ষম। এরা কি করে 'বিদ্যান' হবে ভেবে কুল পেতাম না। আবার এটাও দেখেছি ঘৃণাতে মানসিক রোগ এবং অস্থিরতার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। ফলে ঘৃণা এবং শ্রদ্ধা-এই দুটো ব্যাপার থেকেই শতযোজন দূরে আমার অবস্থান। অনেকটাই ভয়ে-গাধা আর উন্মাদ হওয়ার ভয়।
সমস্যা চাইল্ড সাইকোলজী নিয়ে। বাচ্চা বয়স থেকে সব বাঙালী বাচ্চার সামনে একটা করে রোল মডেল টাঙানো। বাবা মায়েরা বলেন এর মতন হও-ওর মতন হও! যেমন ধরুন পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী পরিবারে নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের ঢাউস কতগুলো জীবনী সব সময় থাকে। আমার বাড়িতে ছোট বেলা থেকে দেখছি নেতাজির ওপর লেখা বিরাট বিরাট সব বই। ক্লাশ ফোর-ফাউভের আগেই সব শেষ করে দিয়েছিলাম। নেতাজি যে অতিমানব সে নিয়ে মনে সংশয় ছিল না। এই ভাবেই বাঙালী মানসে জন্ম নেন অতিমানব সুভাষ বোস, রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দ। যে পরিবারে সংস্কৃতি চর্চা বেশী-সেখানে রবীন্দ্রনাথ রোল মডেল। আবার যারা একটু ধার্মিক রক্ষনশীল পরিবারের সন্তান- তাদের সামনে বিবেকানন্দকে রোল মডেল হিসাবে তুলে ধরার চেস্টা করেন বাবা মা। কখনো বা এই তিনজনকেই বাঙালী বাচ্চাদের সামনে টাঙানো হয়- রোল মডেলদের প্রতি শ্রদ্ধায় যাতে 'অসংখ্য' ভালো গুনের অধিকারি হতে পারি আমরা। অনুমান করি বাংলাদেশে নেতাজি বোসের স্থলে শেখ মুজিবরের অতিমানব চরিত্রকে সামনে রাখেন তারা। সমস্যা হচ্ছে এতে বাঙালীদের মধ্যে শুধু অতিমানবরাই জন্ম নেন-মানুষের জন্ম বাঙালীদের মধ্যে বিরল।
নেতাজী সুভাসের চারিত্রিক দুর্বলতা-তার কোন বাঙালী জীবনী গ্রন্থে পাবেন না। এমনই সব জীবনীকার এরা-নেতাজির যে জার্মান স্ত্রী ছিল-সেটা পর্যন্ত আমি জানতে পারিনি ছোট বেলায়। পাছে তার ব্রহ্মচারী ইমেজে দাগ লাগে। সেটুকুও ঠিক ছিল। ইন্টারনেটের যুগে নেতাজীর ওপর আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে যা কাজ হয়েছে-সেসব জেনে নেতাজি সম্মন্ধে অতিমানব ইমেজটা ভেঙে চূরমার(১)-বুঝলাম-আসলে বাঙালীদের মধ্যে ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভংগীর সাংঘাতিক অভাব। ফ্যাসিজম এবং নাজিদের অমানবিক কার্য্যকলাপ নিয়ে নেতাজি খুব ভালো ভাবেই অবগত ছিলেন। তবুও তাদের কাছে কেন গেলেন নেতাজি? ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি এপ্রশ্নের একটাই উত্তর-ভারতের স্বাধীনতার জন্যে! আসল সত্যটা কি? নেতাজির পত্রাবলি বিশ্লেষন করলে-খুব পরিষ্কার(১)-তিনি আসলেই "একনায়কতন্ত্রের' বড় ভক্ত ছিলেন। গণতন্ত্র চান নি-তা নয়-কিন্ত একনায়ক হিটলার এবং মুসোলিনির বেশ গুনমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন নেতাজি! তুলনায় নেহেরু অনেক বেশী গণতান্ত্রিক-তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগী ছিল আরো অনেক বেশী স্বচ্ছ-অথচ নেহেরুকে বাঙালী জানে লম্পট প্রেমিক হিসাবে। নেতাজির অবদান আমরা কখনোই ভুলবো না-কিন্তু তার রাজনৈতিক চিন্তা কি এখনো প্রাসঙ্গিক?
বিবেকানন্দের কথা ভাবুন। বিবেকানন্দ ভারতীয় হিন্দু জাতিয়তাবাদের জনক। অনেকগুলি পোলে-গান্ধী নন-তিনি ই সর্বকালের সেরা ভারতীয়। কোন সন্দেহ নেই-হিন্দু জাতিয়তাবাদের রমরমা উত্থানের দিনে-তার জনপ্রিয়তা ভারতীয়দের মধ্যে এখন গান্ধীর চেয়ে অনেক বেশী। আমি ক্লাশ এইটে প্রথম বিবেকানন্দ রচনাবলী পড়ি। পাশ্চাত্য দর্শন খুব ভালো জানতেন স্বামীজি। ফলে তার রচনাবলী পড়ে মোহিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। বাঙালী এলিট বিবেকানন্দে আচ্ছম্ন। এমনকি মুসলিম বাঙালী এলিটরাও তার ই আদর্শে আল-আমিন মিশন খুলেছেন। বিবেকানন্দের চরিত্রের অন্ধকার দিক থাকতে পারে-ভাবতেই পারি নি। সেই অন্ধ শ্রদ্ধা। ঘোর ভাঙল নরসিমা পি সিলের গবেষনা পত্রে(২)। পরিষ্কার বোঝা যায় বিবেকানন্দ নিজের মার্কেটিং-লুক এংড ফিল-খুব ভাল বুঝতেন। ক্ষেত্রীর রাজা অজিত সিংহের কাছ থেকে দেদার সাহায্য নিয়েছেন-তার গুরুভাই স্বামী ব্রহ্মানন্দ কিন্ত পারেন নি। অজিত সিংহ অত্যাচারী মদ্যপ বলে ব্রহ্মানন্দ তার কাছে সাহায্য চাইতে অস্বীকার করেন-অথচ এই কারনে ব্রহ্মানন্দকে তিরস্কার করেছিলেন স্বামীজি(২)। আমেরিকায় তার সাফল্য নিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে চিঠি পাঠাতেন দেশে। এমন কি এরকম কথাও লিখেছেন-তিনি মাত্র দশ বছর থাকলেই-গোটা আমেরিকা সনাতন ধর্ম গ্রহণ করবে(২)। মুসলিম ধর্মপ্রচারকরা ইউটিঊবে এখন যেমন প্রচার চালায়-গোটা আমেরিকা যেন ইসলাম ধর্ম গ্রহন করছে। অথচ বাস্তব সত্য হচ্ছে গুটিকয় মহিলা বিবাহজনিত কারনে ইসলাম গ্রহণ করেন। বিবেকানন্দ ঠিক এই কাজটিই করতেন। তবে হ্যাঁ-তার বিদ্যাবুদ্ধির দৌঁড় ছিল বেশ বেশী-ফলে আমেরিকার একদম সম্ভ্রান্ত এলিটরাই তার শিষ্যত্ব নেন। তাছাড়া তার মার্কেটীং এর জন্যেই যদি ভারতীয়রা হারানো গৌরব ফিরে পায়-খারাপ কি? আফটার অল ধর্মের তো কোন অস্তিত্ব নেই। কোরান, গীতা সবটাই তো এক অবাস্তব সত্যের হান্ড্রেড পার্সেন্ট মার্কেটিং। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেই শ্রদ্ধা। বর্তমানে বাঙালী ভক্তরা স্বামীজির প্রতি শ্রদ্ধার ভারে কাতর। গীতা ছেড়ে ফুটবল খেলার উপদেশ বা জীবে শিব সেবার ধর্ম হজ়ম করার শক্তি তাদের নেই। ফলে গীতা, ফুটবল, জীব, শিব সববাদ দিয়ে-সেই প্যাচপেচে পচা হিন্দু কাদাতেই তাদের পথ চলা। এখানেই শ্রদ্ধা জিনিসটার সমস্যা-কারন শ্রদ্ধা 'নিরেপেক্ষ' চিন্তা করতে শেখায় না। ফলের লাল শালু মোড়া নারায়ণ শীলায় শ্যাওলা বাড়তেই থাকে।
নারায়ন শীলের লেখা(২) বিবেকানন্দের ওপর গবেষনা পত্রগুলি দেখে সত্যিই মর্মাহত হয়েছিলাম। বহুদিন জমে থাকা শ্রদ্ধার ভাসমান জাহাজের ওপর টর্পেডোর আঘাত।কিন্তু বৈজ্ঞানিক সত্যের সর্বদাই দুই পিঠ-অন্যদিকটা মানতেই হবে। আমার মতন যুক্তিবাদি লোক ই যদি মানসিক দিক বিক্ষত হয়-অনুমান করতে পারি-ধর্মভীরু মুসলমানরা যখন হজরত মহম্মদের চারিত্রিক দুর্বলতার নানান সমালোচনা ইন্টারনেটে দেখেন-তারাও ক্ষত বিক্ষত হোন। কারন শ্রদ্ধার ওপর সেই বিরাট আঘাত। কিন্তু তসলিমা বা মহম্মদ আসগারের মতন যুক্তিবাদি লোকেরা এই আঘাত না দিলে-হজরত মহম্মদ সম্মন্ধে শ্রদ্ধানিরেপেক্ষ এক যুক্তিবাদি মতামত সম্ভব না। আর এটা না করলে সব কিছু মহম্মদ আর ইসলামের নামে চালিয়ে রাজনৈতিক ব্যাবসা চালাবে কিছু ধুরন্ধর ব্যাক্তি। তালিবানদের প্রাত্তন বিদেশমন্ত্রী হাসেমি এখন ইয়েলে পড়াশোনা করছেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল-পার্থক্যটা কি দেখছেন? হাসেমি বলেছেন-ইসলামিক বিশ্বে ইসলামের নামে কিছু চলালেই হল। কেও প্রশ্ন করে না। সেই সাহস বা ট্রাডিশনটাই নেই। এখানে একটা কিছু বললে-অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। ফলে আরো অনেক বেশী ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারে এরা।
শ্রদ্ধার সমস্যাটা এখানেই। শ্রদ্ধা প্রশ্ন করতে শেখায় না। শেখায় প্রশ্নহীন আনুগত্য। কখনো ইসলামের নামে, কখনো মার্ক্সের নামে, নিজের ধান্দাবাজি চালালেই হল। কেও-ত প্রশ্ন করবে না। এই ভাবেই সৎকার হয় রাষ্ট্রের ভবিষ্যত।
বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি-এরা যদি দুহাজার বছর আগে জন্মাতেন-নৃতত্বের নিয়ম মেনে-এরা হতেন বাঙালীর নবী বা অবতার। নেহাৎ ভিক্ট্রিয়ান যুগে জন্মেছেন বলে-এরা এখনো মানব-তবে মহামানব। বৃটিশ আমলে জন্মালে মহম্মদ নিশ্চয় নিপিড়িত আরব জাতির মহান উদ্ধারকর্তা হিসাবেই পরিচিতি পেতেন-নবী হিসাবে নয়। হজরত মহম্মদ বা নেতাজি-তারা যে কাজগুলি করেছেন-আমরা যদি তাদের কর্মবহুল ইতিহাসের নিরেপেক্ষ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষন না করি-এবং শ্রদ্ধার ভারে আমাদের বিচারবুদ্ধি লোপ পায়-এদের রোল মডেল হওয়া কোন কাজেই আসবে না। উৎপাদন ব্যাবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিন্যাসের দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। হজরত মহম্মদ সপ্তম শতাব্দীতে গরীব প্যাগানদের- ধনী প্যাগানদের শোষনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে কি রাজনৈতিক চিন্তা করেছেন-তা দিয়ে নিশ্চয় ক্ষুদার কবল থেকে বাংলাদেশকে বাঁচানো সম্ভব নয়। ঠিক তেমন ই-নেতাজি ভারতের উন্নয়নের জন্য ১৯৩০ সালে যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পরিকল্পনা নেন-আমরা জানি আজ তা বাতিল তত্ত্ব। অথচ শ্রদ্ধার ভারে অবনত হয়ে অধিকাংশ বাঙালীই এই সহজ সত্যের সাথে সহমত হবেন না।
প্রবল ধর্মীয় সমাজে বড় হওয়ার জন্যেই আমাদের মন শ্রদ্ধা ব্যাকুল। ছোট বেলার একটা ঘটনা বলি। আমি তখন ক্লাশ সিক্সে। পুজোর চ্ছুটিতে মামার বাড়ি-কালনা শহরে। বাঙলার খুব প্রাচীন শহর। বৈষ্ণব ধর্ম এবং বাংলা সাহিত্য মূলত নবদ্বীপ-কালনা-আর শান্তিপুর-গঙ্গার ধারে এই তিনটি শহর থেকেই শুরু হয়। শহরগুলো গঙ্গার এপিঠ ওপিঠ। আশির দশকের কথা-লোকজন তখনও খুব রক্ষণশীল।
লক্ষ্মী পূজোর দিন। আমার ছয় মামা। কমবেশী সবাই রক্ষনশীল-এর মধ্যে একজন আবার প্রবল ধার্মিক। পূজোর পর প্রসাদ বিতরন হচ্ছে-সেই মামাটিই বিতরন করছেন। আমি তখন বেশ কনফার্মড নাস্তিক। আসলে ছোটবেলা থেকে বাবা-মা আমাকে কখনো ই বলেন নি-ভগবানে বিশ্বাস করো। আবার বিশ্বাস না করতেও বলেন নি। সত্যটা কি-নিজে খুঁজে নাও-এই টাইপের ব্যাপার আর কি। ফলে ঈশ্বর বিশ্বাস ব্যাপারটা কি-ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে মনে ক্কি রকমের অনুভূতি হয়-এই জগত থেকে আমি সম্পূর্ণ বঞ্চিত। সামাজিক রীতি নীতি সবই মানতে হত। তবে ঈশ্বরের অত্যাচার কেও করেন নি। ফলে সদ্য সিং গজানো বাছুর নাস্তিক তখন-ঢুঁ মারতে ইচ্ছা হয় সবসময়। আমি মামাকে বললাম-এই সব পূজো-অর্চনায় আর বিশ্বাস করি না।
আমার বয়স তখন দশ। মামার বয়স বাইশ। ফলে প্রথমে বকুনি খেলাম-
-লক্ষ্মীর প্রসাদ, এরম কল্লে বাকী জীবন ভিক্ষে করবি
-কিস্যুই হবে না-গরীবরাই বেশী লক্ষ্মী পূজো করে।
এবার মামা আমায় সটান চড় মারল। আমিও রেগে গিয়ে লক্ষ্মীর পেসাদ পা দিয়ে ঘসলাম।
বাড়িশুদ্ধ হুলুস্থুলু কান্ড। বাড়ির উঠোন তখন নাট্যমঞ্চ। দাদু বেড়িয়ে এসে আমায় থাপ্পর মারলেন। মাকে বল্লেন তোর ছেলের মধ্যে এত অশ্রদ্ধা-অহমিকা -এর ভবিষ্যত অন্ধকার! ভবিষ্যতের অন্ধকার দরিদ্র জীবনের শত অভিশাপ বর্ষিত হল আমার মাথায়-হাজার হলেও লক্ষ্মীর পেসাদ! এখন বাস্তব সত্যটা হচ্ছে এই-আমার ছয় মামার মধ্যে সেই ধার্মিক মামাটিই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন নি। এখনো লক্ষ্মী পূজো করে চলেছেন -আর লটারীর টিকিট কাটছেন।
অধিকাংশ বাঙালীর মধ্যে সেই মামাকেই দেখি-ধর্ম, ব্যাক্তিপূজা-ইত্যাদি পরম শ্রদ্ধায় নিজেদের আচ্ছন্ন রেখেছে-আর মার্ক্সবাদ, ইসলাম,হিন্দুধর্ম ইত্যাদির 'টিকিট' কেটে চলেছে-যদি শ্রদ্ধার ভারে কোনদিন দেশের বা নিজেদের কিছু হয়! এই শ্রদ্ধার শ্রাদ্ধ না করতে পারলে-এদের কিস্যুই হবে না।সব বখবাস!
(১) Sen, S. 1999. Subhas Chandra Bose 1897-1945. From webarchive of this URL.
(২) Swami Vivekananda, a reassessment- Narasingha P Sil
ড. বিপ্লব পাল, আমেরিকাতে বসবাসরত পদার্থবিদ, গবেষক এবং লেখক। এক সময় ভিন্নমতের মডারেটর ছিলেন, বর্তমানে www.fosaac.tv সম্পাদনার সাথে জড়িত।