আগরতলা : ঈশ্বরের শশুরবাড়ি

সরকার আমিন 

 

নিশ্চিত জানতাম আগরতলা সীমান্তে আমাদের জন্য ঠিক সময়ে অপেক্ষা করবে আগরতলার ভিন্নমাত্রিক কবি (অনেকটা আমাদের ব্রাত্য রাইসু যেন) প্রবুদ্ধ সুন্দর কর। সীমান্তের অতি জরুরী কিন্তু বাজে ফর্মালিটিজগুলো শেষ করে যখন আগরতলা প্রবেশ করবো প্রবুদ্ধ এসে গলা জড়িয়ে ৩/ ৪ মিনিট নিরবে দাঁড়িয়ে প্রকাশ করবে ওর স্বাগতিক আকুলতা। পাশেই দাঁড়ানো থাকবে গাড়ি। আমরা তাতে চড়ে বসবো। কবি প্রদীপ মজুমদার বলবে সাথে কত ডলার এনেছো? কিছুটা বিস্মিত হবো আচমকা এই প্রশ্ন শুনে। এরপর প্রদীপই বলবে আগরতলা বা শিলং যতদিন থাকছো আমি তোমাদের স্পন্সর। পকেটে হাত দিয়েছো তো খুন করে ফেলবো। কবি কৃত্তিবাস চক্রবর্তী আর তদীয় পতœী কবি-অনুবাদক কাকলি দি বলবেন হা, একি কথা, তোমরা থাকবা হোটেলে? আমাদের বাড়িটার এতোগুলো ঘর তবে কেন বানালাম? কবি দিলিপ দাশ বলবেন আইছেন লন আমার বাড়ি, রাইতে কি খাইবেন? গল্পকার সাদ কামালী বিস্মিত হবেন এসব আন্তরিকতা দেখে। আমি মৃদু হাসবো সাদী ভাইয়ের বিস্ময় দেখে। কারণ আমি এর আগে আগরতলা আরও একবার এসে দেখে গেছি আগরতলার মানুষের হৃদয় প্রমাণ সাইজ থেকে একটু বড়। ঠিক শ্বুশুর বাড়ির আদর পেয়েছি। গুন্টার গ্রাস নাকি কলকাতাকে ‘ঈশ্বরে বর্জ্য’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এবারের ভ্রমণের পর আমার মনে হয়েছে আগরতলা আসলে ঈশ্বরের শ্বুশুর বাড়ি। প্রকৃতি আর সহজ মানুষের মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা আগরতলার সাথে কলকাতার তুলনা চলে না।

২.

প্রবুদ্ধ বললো আগে ঠিক করো বাসায় থাকবা না হোটেলে থাকবা। কানাডা প্রবাসী বিশ্বনাগরিক গল্পকার সাদ কামালীর আগ্রহ হোটেলের দিকে । পাহাড়ের নামে নাম লংতরাই হোটেলে উঠলাম আমরা। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর আগরতলার প্রায় সব লেখক আসলেন আমাদের স্বাগত জানাতে। জমে গেল নিদ্রাঘাতি আড্ডা। অনুমান করলাম এই আড্ডা শেষ হলেও হতে পারে আজ রাতে অথবা তা চলবে অনন্তকাল। আগরতলায় শক্তপানীয় খুবই শস্তা। ব্যাকরাউন্ড মিউজিকের মতো যে যার মতো গ্রহণ করছেন রঙিনজল, আবৃত্তি করছেন কবিতা, পড়ে শোনাচ্ছেন গল্প। মাঝে মাছে ফুটফাট দু একটা জ্ঞানের কথা। এই রাতের আড্ডাটাকে ‘পৃথিবীর সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ট আড্ডা’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আমি অনেকটা অভদ্রের মতো ঘুমিয়ে পড়লাম। প্রবুদ্ধ পরের দিন জানালেন রাতটাকে ঈশ্বর ষড়যন্ত্র করে ছোট করে দিয়েছিলেন। এই রাতে উপস্থিত ছিলেন যারা সবার নাম মনে নেই তবে যদ্দুর মনে পড়ে উপস্থিত ছিলেন কবি সদানন্দ সিংহ, প্রবীণ কবি কল্যাণব্রত চক্রবর্তী, নন্দকুমার দেববর্মা, রঘুনন্দন সিংহ, শুভেশ চৌধুরী, দেবব্রত দেব, মাধব বণিক, কৃত্তিবাস দা তো অবশ্যই ।

৩.

পরের দিনই ভোরে আমরা শিলং যাচ্ছি। বাসে করে। বাস কাফেলা, মানে একসাথে ২০/৩০টা বাস, ট্রাক, গাড়ি; সামনে পিছনে মাঝে ¯েটনগান ফিট করা সেনাদের স্কর্ট। ভয়Ñ যদি বিচ্ছিন্নতাবাদিরা আক্রমণ করে বসে। বেশ রাজকীয় ভ্রমণ। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে জিম্মি হলে মন্দ হবে না। সাদ কামালির কানাডিয়ান পাসপোর্ট। নাটকটা জমবে ভালো। ১০ ঘন্টার জার্নি শেষ করে আমরা যাব খালিয়া কাšিদ। ওখানে প্রদীপ আমাদের জন্য বাস স্টপেজে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে থেকেই অপেক্ষা করবে ,আর ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে থাকবে। প্রদীপের বাসায় রাতটা কাটিয়ে পরের দিন আমরা যাব শিলং আর স্বপ্নের চেরাপুঞ্জি। আমাদের আর তর সইছে না।

রাজকীয় বাসবহর রওয়ানা দিল। প্রাচীন কচ্ছপের মতো তার গতি। ভালোই হলো। পাহাড় দেখা যাবে প্রাণখুলে। চোখ খুলে রাখলাম। ছোটবড়মাঝারি পাহাড়ের উপর, কখনো পাহাড়ের পাশ দিয়ে চিকন রাস্তা। রাস্তার পাশে বিশাল খাদ। এই বুঝি বাসটা চিৎপটাং হয়ে যাচ্ছে । তেমনটা হলে ফুটবলের মতো গড়াতে গড়াতে বাসটা সিকিকিলোমিটার নিচে গিয়ে পড়বে। জার্নিটা ভয়ংকর সুন্দর। আমার জীবনে আর কোনদিন ঘটেনি। সাদি ভাই ধ্যানস্থ । আমি ভয়স্থ। মনে হচ্ছে এই বাস গন্তব্যে পৌঁছাবে না আদৌ। ড্রাইভারের সাথে মনে মনে আমিও গাড়ি চালাচ্ছি। এই,পড়ে গিয়েও পড়ছি না। কিন্তু না ড্রাইভার শক্ত মানুষ। এর উপর মনে হলো শক্তপানিও খেয়ে নিয়েছেন। ১৪ ঘন্টা জার্নি করে পৌছলাম বদরপুর। প্রদীপ গাড়ি নিয়ে দ-ায়মান। গেলাম প্রদীপের আস্তানায়। প্রদীপ বললো খালিয়াকান্দির প্রধান সব লেখক বুদ্ধিজীবী তোমাদের জন্য ঘন্টাখানিক ধরে বসে আছে রবীন্দ্র ভবনে। মতবিনিময় হবে। চলো । তড়িঘড়ি করে গেলাম সভাস্থলে। শুরু হলো আর এক প্রাণ খোলা আড্ডা । উপস্থিত ছিলেন উত্তর পূর্ব ভারতের বিখ্যাত সব মানুষÑ ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ, দিব্যেন্দ ভট্টাচার্য, নীতিশ ভট্টাচার্য, রীতা চন্দ, আবুল হোসেন ছেবরি, জীতেন্দ্র নাথ, তমোজিৎ সাহা, আশিষ রনজন, সুব্রতজিৎ, জসীমুদ্দিন, সুদর্শন ভট্টাচার্য। আমাদের নানা বিষয়ে কথা হলো। সাদী ভাই আর্বিভূত হলেন সূত্রধরের ভূমিকায়। প্রায় সব লেখক কলকাতার প্রতি বিরক্ত। ঢাকার প্রতি আসক্ত মনে হলো। ভাষায় সবারই সিলেটের টান। হৃদয়েও। আমি বললাম আমরা চেষ্টা করলেও অনেক কিছু বদলে ফেলতে পারবো না। ইতিহাস হচ্ছে অন্ধ ষাঁড়ের মতো। নিজের গতিতে চলে। বাংলা আমাদের ভাষা। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র এক নয়। মাঝখানে কাঁটা তার। কিšতু মন স্বাধীন। মানসিক ভ্রমণে পাসপোর্ট লাগে না, ভিসার জন্য লাইন ধরতে হয় না। চলুন না আমরা সারা পৃথিবীর বাংলাভাষী মিলে মনে মনে একটা ভুবন বানিয়ে ফেলি। সবাই সমর্থন করলো আমার এই আবেগপ্রবণ ভাষণ। প্রদীপকে বেশি স্পৃষ্ট হতে দেখলাম। তারপর কত পরিকল্পনা মনের রাষ্ট্রকে নিয়ে। গভীর রাতে প্রদীপের ঘরে আবার ‘সরস’ আড্ডা। রাত এক সময় একটু তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল।

৪.

আজ সকালে খালিয়াকান্দি থেকে আমরা যাচ্ছি শিলং। লক্ষ্য শিলং হয়ে চেরাপূঞ্জি। ৪/৫ ঘন্টার ভ্রমণ। প্রদীপ বললো আগরতলা থেকে খালিয়াকান্দি পর্যন্ত পথে যে সব পাহাড় দেখেছো তা হচ্ছে হাতির তুলনায় ইদুরের বা”্চা । আসল পাহাড় দেখবা একটু পর। প্রদীপ যে সত্যবাদী আধ ঘন্টা পর হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। এক একটা পাহাড় যেন হিমালয়। রাস্তার পাশেই মহাভয়ংকর খাদ। ড্রাইভারের দিকে অসহায় ভাবে দু একবার তাকাতেই তিনি আশ্বস্থ করার ভঙ্গিতে হাসলেন। বুঝলাম জীবনকে কত মূল্য দিই আমি । শিলং এর পথে গাড়ি দুর্ঘটনায়, গড়াতে গড়াতে পাহাড়ের পাদদেশে মরার কোন পরিকল্পনাই নেই আমার । তবু ঠাট্টা করে ড্রাইভারকে বললাম, দাদা যদি অগত্যা গাড়ি নিয়ে পড়তেই হয় দয়া করে সর্বোচ্চ চূড়া থেকেই পড়বেন। মরেও সান্ত¡না পাবো, যাই হোক, বড় পাহাড় থেকে পড়ে মরেছি। ড্রাইভার মৃদু হেসে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। আশ্বস্থ করে বললেন এই পথটা তার খুবই চেনা। চোখ বন্ধ করে দিলেও তিনি গাড়ি নিয়ে ঠিক শিলং পৌছে যাবেন। আল্লাহকে ধন্যবাদ, আমরা শিলং পৌঁছাতে পেরেছি। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার সেই শিলং। আহা শিলং। গাড়ি থেকে নেমেই আমরা গেলাম ভারত পর্যটন অফিসে। এখানে আমাদের স্বাগত জানালেন শিলং পর্যটনের প্রধান ত্রিপুরা রাজ বংশের সন্তান শঙ্খ দা। খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম। তিনি খাবার আনার ব্যবস্থা করেই গল্প জুড়ে দিলেন। জানালেন তসলিমা নাসরিনের সাথে তার বন্ধুতার গল্প। আমি বললাম ক্ষুধার্ত মানুষের সাথে সাহিত্য আলোচনা বিপজ্জনক। কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার আসলো। রাজার নাতির সাথে বিতর্কও জমে উঠলো। নাতি যত গুরুত্ব দেন তসলিমাকে আমি আর সাদী ভাই ততই বিগড়ে যাবার মতো মন্তব্য করতে শুরু করি। বেধে গেল মহা বিত-া। প্রদীপ আমাদের রক্ষা করলো তর্ক যুদ্ধ থেকে। তবে রাজার নাতিকে আমাদের কাছে মজার মানুষ বলেই মনে হলো।

৫.

পরদিন আমরা গেলাম চেরাপুঞ্জি। এইতো আমাদের আসল গন্তব্য। আমাদের আগরতলা ভ্রমণের কেন্দ্রীয় চরিত্রই হচ্ছে চেরাপুঞ্জি। শিলং পত্তনের আগে চেরাপুঞ্জি ছিল ইংরেজ সাহেবদের মূল শৈলাবাস। ১৮৭৬ সাল নাগাদ এক ভয়ানক ভূমিকম্পে চেরাপূঞ্জির পুরনো এলাকা ধ্বংস হয়ে যায়। তখন শিলংকে সাহেবরা তাদের শৈলাবাস হিসেবে পছন্দ করে নেয়। শিলং তখন ছিল আসামের অর্ন্তভূক্ত। চেরাপুঞ্জি বৃষ্টির সাম্রাজ্য, পূঞ্জির আগের নাম ‘সোহরা’। ‘চেরা’ মানে ছোট ঝরণা আর পূঞ্জি মানে পাহাড়। পর্বতের মতো বিশাল পাহাড়ে দাঁড়ালে মেঘ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। চেরাপঞ্জি পৌঁছে মনে হলো আমরা এমন জায়গায় এসে পড়েছি যেখান থেকে একটু চেষ্টা করলে স্বর্গকে হাত দিয়ে ছুতে পারবো। বিস্মিত হয়ে মনে মনে বললাম ‘এ কোথায় এলুম!’ বৃষ্টির অন্ধকারময় আচ্ছন্নতা, অদূরবর্তি পাহাড়ের ক্ষণে ক্ষণে রং বদলের ভেতর নিজেকে মনে হলো উণ¥তাল। মগ্নতা, আনন্দ, আর বিষাদ মিলে মিশে আমাদের পরিণত করলো আদিম মানুষে। এক সময় একখ- মেঘ এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল সারা শরীর। পায়ের তলে ভাসছে মেঘ। ডানে মেঘ বামে মেঘ। ছোট ছোট বৃষ্টির কণা মনে হলো ছুটে এসেছে হাজার বছরের কোন অন্ধকার গুহা থেকে। বোবা হয়ে ভাসতে লাগলাম মেঘের রাজ্যে এক নিমগ্ন শিশুর মতো। মৃত্যুর এক সেকে- আগেও কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করে তোমার কি মনে আছে চেরাপুঞ্জি? বলবো প্লিজ আমাকে আর একবার যেতে দাও।