বৌদ্ধ ভিক্ষুগো আন্দোলনে আমার সংশয়...একটা অন্য পঠন

জামাল ভাস্কর

 

বার্মা বিষয়ে বিকল্প ভাবনাটা আসলে মাথায় ঘুরতে ছিলো কয় দিন ধইরাই কিন্তু কিছু বলতে পারতেছিলাম না ভয়ে...আন্দোলন বিষয়ে কইতে গেলে সামরিক জান্তা জাস্টিফায়েড হইয়া যাওনের একটা কিঞ্চিত সম্ভাবনা থাকে, আর সেই সম্ভাবনা উসাহিত করনটা খুব সুবিধার না। কারন সরলতার যুক্তিতে ফাইসা যাওনের একটা অভ্যাস এই সিভিলতার সমাজে আছে। প্রথম যেই দিন আন্দোলনটা শুরু হইলো ১৯ সেপ্টেম্বর...সেই দিন তথ্য ঘাটাঘাটির অভ্যাসের কারনেই জানলাম আন্দোলনের দুইটা ধারা চলতাছে...মূল ধারা হইলো সিতয়ে শহরের একটা মঠকেন্দ্রীক বৌদ্ধভিক্ষুরা...ঐ একই সময়ে ইয়াঙ্গুনেও জ্বালানী তেলের মূল্য বাড়ানের বিরুদ্ধে একদল সাধারন জনতা ছোটখাটো বিক্ষোভ প্রদর্শণ করতে ছিলো তা'ও সত্য...

তয় ২০ তারিখ থেইকাই মঠের বাইরে বাইর হইতে শুরু করলেন ভিক্ষুরা...আন্তর্জাতিক সকল তথ্য সোর্স থেইকা যা জানতে পারা গেলো এই আন্দোলনে ২৩ তারিখ পর্যন্ত সাধারন মানুষের সংলগ্নতা ছিলো না। ১৯ তারিখের বিক্ষোভকারীরা পর্যন্ত ঐ আন্দোলনে ছিলেন না। তবে ২৩ তারিখের শেষভাগ থেইকাই সাধারন জনতার একটা স্রোত সামরিক জান্তা বিরোধী এই আন্দোলনে যোগ দিতে শুরু করে। দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে জোরদার আন্দোলনে পরিণত হইতে শুরু করে সামরিক জান্তা বিরোধী এই প্রোটেস্ট।

গৌতম বুদ্ধের ধর্মাদশন নিয়া আমরা আমাগো ছাত্রবেলায় অনেক এক্সাইটেড ছিলাম...বস্তুবাদী অবস্থান থেইকাও আমরা মনে করতাম বা বইলা বেরাইতাম যে যদি কখনো কোন ধর্মের অনুগামী হই তাইলে তা বৌদ্ধ ধর্ম। অহিংস মতাদর্শ, ব্যক্তিক শুদ্ধতার কিছু বৈশিষ্ট্য আমাগো চরম আকর্ষণ করতো। নির্বাণ লাভের আকাঙ্খা আমাগো অবিশ্বাসী চেতনারে বিশ্বাসের কাঠামো না হইলেও একরম শান্তির পথ প্রদর্শণ করতো। আষ্টাঙ্গিক না বুঝলেও আমরা ভাবতাম শুদ্ধিকরণের এই মানবিক প্রচেষ্টা অন্য ধর্মের চাইতে পৃথক প্রবণতা দেয়।

কিন্তু সেই বৌদ্ধধর্ম আমাগো আর গ্রহণ করা হয় নাই...বস্তুবাদের ঘোর মনে হয় আরো শক্তিশালী!...তবে দিনে দিনে ধর্মের বিশ্বাস কাঠামোর জ্বালাটা বুঝতে সক্ষম হইছি। বিশ্বাস কাঠামো কেবল বিশ্বাসেই অপারেট করে না...তার প্রায়োগিকতা আর জৈবনিক অভ্যস্ততাও প্রয়োজন পরে। সকল ধর্মেরই প্রচারণামূলক প্রবণতা থাকে। বাক্যটা আংশিক সত্য হইলো...সকল বিশ্বাসই আসলে প্রচারণামূলক হয়। কারন প্রায়োগিকতা আর অভ্যস্ততার একটা বিষয় উপলক্ষ্য হয়...তা হইলো পরিবেশ নিশ্চিতকরণ। ধর্ম হিসাবে ইসলামের স্বরূপ আমরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করি...যে কোন ধর্ম সংখ্যাগরিষ্ঠ্য এলাকায় ধর্মগুরুগো চরিত্র বিশ্লেষণ করলে মনে হয় অন্য সকল ধর্মের অনুসারীগো বাস্তবতাও বুঝন যাইবো।

আন্তজাতিক রাজনীতিতে ধর্মগোষ্ঠীগুলি খবরের শিরোনাম হয় আজকাল। বিশেষ কইরা ইসলামিকরা...তাগো বিশ্বাসী আগ্রাসনের চরিত্র যতো না এই বিষয়ে ভূমিকা রাখে, তার চাইতে বেশী হয় তাগো সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থানের লেইগা। সাম্রাজ্যবাদ কইলে একরম জেনারালাইজ করা হয়...কওয়া উচিত কর্পোরেট রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থানের লেইগা। মূলতঃ সেমেটিক এলাকার ইসলামাইটরাই এই চরিত্রের প্রকাশটা একটু বেশি দেখায়। আর সেইসব এলাকাতে যুদ্ধ পরিস্থিতি অধিকন্তু যুদ্ধক্ষেত্রই তৈরী হইয়া গেছে। একটা মিল আছে এই পরিস্থিতি তৈরী হওনের পেছনে, সেমেটিক এলাকায় জ্বালানী তেলের খনিজ অনেক বেশি সহজ প্রাপ্য। অতীতে মানে ৬০ দশকের দিকেও এইসব এলাকা বিভিন্ন ঔপনিবেশিক আওতায় ছিলো...এরা স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর এইসব এলাকায় আঞ্চলিক সংহতির প্রচেষ্টা হইছে সংগঠিত আকারে। আর মধ্য এশিয়ার একটা বড় অংশে সোভিয়েত আধিপত্যবাদী অবস্থান ছিলো। আমেরিকা এবং অন্য আরো কয়টা কর্পোরেট রাষ্ট্র তখন এইসব জায়গায় এই সংহতি বিরোধী অবস্থান নিছে...মধ্য এশিয়ায় ইসলামাইটগো টাকার জোগান দিছে সোভিয়েত বিরোধী আন্দোলন সংগঠনে। পরবর্তীতে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিপর্যয়ের পর ইসলামাইটরা বেশ ভালোই অস্থিতিশীল করছে এইসব এলাকাগুলিতে। আম্রিকা বিরোধী জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী হইছে। আবার আভ্যন্তরীন বিরোধও বাড়ছে। এই রাজনীতি আমার খুব বোধগম্য না হইলেও আফঘানিস্তানের কিছু গল্প বিশ্বস্ত সূত্রে জানি। আফঘানিস্তানে লাদেন আছেন, আন্দোলন সংগঠিত করতেছেন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই পরিস্থিতি যেমন আছে...আবার সাদা চামরার ড্রাগ ডিলাররা পপি খেতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টাকা বিনিয়োগ করে...সেই পরিস্থিতিও সত্য বাস্তবতা!

বার্মার সামরিক জান্তার সুদীর্ঘ ইতিহাস নিয়া আসলে কিছু বলার নাই। ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় থাকনের টাইমে আমরা রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ হরহামেশা টানতাম...সামরিক জান্তা বিরোধী প্রথম আন্দোলন সংগঠিত হইছিলো সেইখানেই...তারপর সরকার সেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে...দীর্ঘ ৫ বছর পর তারে অনেক নিয়ম চাপাইয়া দিয়া সেই বিশ্ববিদ্যালয় আবার শুরু হয়। ততোদিনে বার্মা পৃথিবীর সবচাইতে বড় ড্রাগ চোরাচালানের রুটে পরিণত হইছে...ড্রাগ কঞ্জাম্পশনের দিক থেইকাও বার্মা পৃথিবীর প্রথম দিককার রাষ্ট্র হয়। যদিও তথ্যসূত্র সামরিক ছাউনীর নীচেই আচ্ছাদিত থাকে। যা জানি সব রাখাইন বন্ধুদের কাছ থেইকা। তারা বার্মায় যায় চোরাচালানীর স্বার্থে...এক ৩১ডিসেম্বর রাইতে আরাকান লিবারেশন ফ্রন্টের একদল গেরিলার সাথে সজারুর পোড়া মাংস আর চুয়ানি খাইতে খাইতে অনেক তথ্য শুনছিলাম।

সাম্প্রতিক সময়ে বার্মা-ভারত আর বাংলাদেশের সামুদ্রিক সীমান্ত আবার আলোচনায় আসলো...কারন অফ-শোর এক্সপ্লোরেশন আর আর উত্তোলনের বাস্তবায়ন শুরু করার চেষ্টা চলতেছে...তা নিয়া অল্পস্বল্প সীমান্ত সংঘাতও তৈরী হইছে। এইসব নিয়া আলোচনা শুরু হওনের সময়েই বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সামরিক জান্তাবিরোধী ক্ষোভে ফাইটা পরলো।

আলোচনার তথ্য আর উপস্থাপণা একটু বিক্ষিপ্ত হইতেছে সময় আর কিছুটা হাইপোথেটিক্যাল বিশ্লেষণ ধারার লেইগা। বিশ্বব্যাপী একটা সাধারন প্রপঞ্চ হইলো মৌলবাদের লগে কর্পোরেট রাষ্ট্র সমূহের বিরোধ সকল সময় অনেক প্রকাশ্য হইলেও, প্রচ্ছন্নে একই সম্পর্ক ঠিক উল্টা আচারে চলে। মৌলবাদীরা মুখে সাম্রাজ্যবাদের তখ্ত তাউস উড়াইয়া বহুত কিছু করনের হুমকী দিলেও ইতিহাসে তাগো উত্থানের লগে সাম্রাজ্যবাদের হ্যান্ডশেক নজীর ভুড়ি ভুড়ি। আইজকা ৩০ তারিখ যখন খবর আসে বার্মা আবার শান্ত হইয়া আসতেছে, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাগো সেই পুরাতন মঠে ফিরা যাইতেছে...জনতারা নেতৃত্বহীন অবস্থায় বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন বিক্ষোভে থাকলেও আর খুব বেশীদূর যাওনের সম্ভাবনা নাই বইলাই ভাষ্যকারগো ধারণা।

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচাইতে বেশীসময়ের সামরিক শাসনের নজীর রাইখা একটা দেশে এখনো সামরিক শাসকরা টিকা আছে আসলে কেমনে? ম্যারী কালাহান নামের এক আমেরিকান শিক্ষক তার সেমিনার পেপারে লিখলেন মজার কথা...বার্মিজ আর্মি তার আয়তন গত ১৫/২০ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বাড়াইছে। পরিসংখ্যানের যাদুকরী গ্রাফে দেখাইলে নাকি দেখা যায় মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০ শতাংশ সামরিক জান্তার সাথে কোন না কোন ভাবে সম্পর্কীত। রোহিঙ্গা বিষয়ক আমার এক ব্লগে সামরিক জান্তার বৌদ্ধধর্মের সাথে সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করছিলাম। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তারা মঠ আর মঙ্ক নিয়াই চলাফেরা করে। কিন্তু এইবারের আন্দোলনে যখন মঠের মানুষেরা তাগো বিরুদ্ধে যায় সেইটা আসলে কেবল সামরিক জান্তার অপশাসনের ইঙ্গিত দেয় না...সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তেরও নজীর বহন করে বইলা আমার মনে হয়...এতো দেশে সামরিক শাসন নিয়া পশ্চিমাগো এতো চুলকানি হয়...নিজেগো যুদ্ধবিমান পাঠাইয়া তারা সেইখানে গণতন্ত্রের বাক্সপেটরা নামায়...কিন্তু প্রায় ৫০ বছরের মতোন নাকি হইয়া গেলো বার্মিজ সামরিক জান্তার শাসন ক্ষমতায় অধীষ্ঠানের...সেইখানে অং সান সুকীরে একটু নামাইয়া দিয়া আসবো সেইটা তারা পারে না...কেবল গলাবাজীর নামে একটা নোবেল দিয়াই তারা খালাশ...