আমার স্বর্গ এখানে
একটা জিনিস আমি কোনদিন বুঝতে পারিনি। যাঁরা স্বর্গে চলে গেছেন, যেমন আমাদের নবীজী হজরত মোহাম্মদ (দঃ), এবং যাঁদের হাতে স্বর্গের গ্যারাণ্টিমারা সার্টিফিকেট আছে, তাঁদের জন্য আমরা এই জড়জগতের সাধারণ মনুষ্যকূল এত দোয়াদরূদ পড়ি কেন। স্বর্গবাসীদের জন্যে মর্ত্যবাসীদের খানিক হিংসা হতে পারে, কিন্তু দুশ্চিন্তা হবে কেন। আর যদি দুশ্চিন্তা না থাকে তাহলে দোয়া পড়ি কেন তাঁদের জন্যে। দোয়া বলতে আমি বুঝি মঙ্গলকামনা, আশীর্বাদ। শব্দটা ফারসি হলেও ‘সাহিত্য সংসদ বাঙ্গালা অভিধান’-এ তো এই মানেটাই দেওয়া আছে। আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে তো মনে হয় মহানবীর জন্যে আমার মত নগণ্য মানুষের দোয়া পড়াটাই শাস্তিযোগ্য ধৃষ্টতা বলে গণ্য হওয়া উচিত। আমার ধাঁধাটা এবার বুঝতে পারছেন তো ? কে যেন সেদিন বলছিল, জনাব মোহাম্মদ আতা ও তাঁর আঠারোজন সঙ্গীসাথী যাঁরা শাহাদত বরণ করে জান্নাতবাসী হলেন এগারোই সেপ্টেম্বর (২০০১) তাঁদের রূহের মাগফেরাতের জন্যে পাকিস্তানসহ আরো ক’টি দেশের পুণ্যবান মুসলমানগণ নামাজের শেষে আল্লার কাছে হাত তুলে দোয়া পাঠিয়েছেন। দোয়াটার একটু অপচয় হল না কি ? মানে তাঁরা তো উড়োজাহাজে করেই বেহেশ্তে চলে গেলেন। গ্যারাণ্টিড। শুধু তাঁরাই গেলেন না, সাথে করে বেশ কিছু নাসারাকেও নিয়ে গেলেন। এই নাসারাগুলো অবশ্য স্বর্গে যেতে পেরেছে কিনা সন্দেহ, শাস্ত্রমতে ওদের তো নরকের ইমিগ্রেশন পাওয়ারই কথা।
আতাসাহেবের উইলটা পড়ে বেশ মজা লাগল। অবশ্য সেটা যদি আদৌ আতাসাহেবেরই উইল হয়ে থাকে। কে জানে, কোন ইহুদী চাল কিনা ওটা। আসলে সমস্ত ঘটনাটাই তো ইহুদী চক্রান্ত হতে পারে। দিনকে রাত আর রাতকে দিন করার ব্যাপারে ওদের মত ওস্তাদ আর কে আছে। তবে ধরে নেওয়া যাক এটা সত্যি সত্যি আতাসাহেবেরই উইল। তাতে নাকি তিনি ইচ্ছাপ্রকাশ করে গেছেন যাতে তাঁকে কবর দেওয়া হয় খাঁটি মুসলমানদের পাশে। সেটা নিউ ইয়র্ক শহরে সহজ না’ও হতে পারে। তাছাড়া এতগুলো পোড়া লাশের মাঝে কোন্টা খাঁটি মুসলমানের লাশ আর কোন্টা নাসারার সেটা জিলিয়ানী সাহেব বুঝবেন কেমন করে। তার উপর কারো হাড়মাংস তো একত্র নেই। একজনের করোটি হয়ত লেগে আছে আরেকজনের ধড়ে, একজনের চোখ আরেকজনের কোটরে। এ-অবস্থাটা আতাসাহেব হয়ত ভেবে দেখেননি। আর হ্যাঁ, তিনি নাকি পইপই করে বলে গেছেন তাঁর জানাজাতে যেন কোন রমণী উপস্থিত না থাকে। সেটা সহজেই বোধগম্য। খাঁটি মুসলমানের মরালাশ দিয়ে জীবিত নারী করবে কি। তার কাজ হল জীবিত খাঁটি মুসলমানের কাছে। উইলটা করার সময় আতাসাহেবের উকিল হয়ত আরেকটা কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁকে। বেহেশ্তের হুরপরী। আমেরিকান এয়ারলাইন্সের এগারো নম্বর ফ্লাইটে করে তিনি যেখানে গেলেন সেখানে তো বাহাত্তর জন হাস্যময়ী লাস্যময়ী কুমারী তাঁর আগমনের জন্যে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকবার কথা। বেহেশ্তের কুমারীরা দেখতে কেমন জানি না, কোনদিন জানার সুযোগও হবে না সেটা ভাল করেই জানি। তবে কার্যত তারা নিশ্চয়ই ক্লিনেক্স কোম্পানীর টিস্যুর মত। কিম্বা ডিসপোজেব্ল্ ডাইপার। একবার ব্যবহার করলেই ফেলে দিতে হয়। আল্লাতা’লার কুমারী-ফ্যাক্টরীটা হালে নিশ্চয়ই ডাবল্ শিফ্টে চলছে। মধ্যযুগের পর এই তো প্রথম এতবড় ডিম্যাণ্ড। এত শহীদ তো অনেকদিন আসেনি আল্লার আরশে। প্রত্যেকের জন্যেই বাঁধাধরা র্যাশন বাহাত্তর কুমারী। গুণ করে দেখুন সংখ্যাটা কোথায় দাঁড়ায়। কুমারীগুলি রি-ইউজেবল্ কিনা সেটা জানা থাকলে অঙ্কটা ঠিকমত করা যেত। বেহেশ্তের কুমারী-ফ্যাক্টরী আর বাংলাদেশের গার্মেণ্টস্ ফ্যাক্টরী একই রকম এফিশিয়েণ্ট বোধহয়। স্বর্গের মদিরা হল আরেকটা আকর্ষণ। আমার স্থূলমস্তিষ্কে খানিক ধাঁধা লাগে। মর্ত্যে এটাকে পান করে পাপীরা, স্বর্গে করে নেকীরা। যুক্তিটা দুর্বোধ্য মনে হয়। এক মিলাদমহফিলে সেদিন মৌলভীসাহেব বললেন, পাকপরওয়ান্দেগার স্বয়ং নেক মুসলমানের হাতে সুরার গেলাশ তুলে দেবেন। ওখানে নিশ্চয়ই ওয়েটারের অভাব। অভাব তো হবেই। মেয়ে ওয়েটারগুলি তো সব পুণ্যবানদের হারেম নিয়েই ব্যস্ত। আর পুরুষ যারা আছেন সেখানে তারা নিশ্চয়ই ওয়েটারের মত হীন কাজ করবেন না। যাইহোক, আতাসাহেবের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াটা তো সমাপ্ত হল না এখনো। শয়তানের দেশ আমেরিকায় যখন খাঁটি মুসলমান পাওয়া কঠিন তখন বুশসাহেবের উচিত হবে কিছু পয়সাকড়ি খরচ করে তাঁকে মধ্যপ্রাচ্যের কোন এক নাসারামুক্ত দেশে পাঠিয়ে দেওয়া। ইরানে খোমাইনিসাহেব আছেন। তাঁর পাশে জায়গা পেলে খুবই ভাল হয়। এক খাঁটি মুসলমানের পাশে আরেক খাঁটি মুসলমান। ইরান যদি রাজী না হয় তাহলে ইরাক আরেকটি সম্ভাবনা। বড়পীর আছেন সেখানে। মহান নেতা সাদ্দাম হোসেন এখনও শাহাদাত বরণ করেননি। সুতরাং তাঁর পাশে বসতিস্থাপনের আশা বাতিল করতে হয়, যদিও বুশমশাইয়ের মনে সে-রকম একটা গোপন ইচ্ছা নিশ্চয়ই উসখুস করছে। সবচেয়ে উৎকৃষ্ট জায়গা হল আফগানিস্তান। এর চেয়ে নেক জায়গা আর কোথায় আছে পৃথিবীতে। মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দুই নেতার নিবাস ওখানে। ওসামা বিন লাদেন আর মোল্লা মোহম্মদ ওমর। তাঁদের অঙ্গুলিনির্দেশে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ ইমানদার যুবক জান কোরবান করতে প্রস্তুত হবে, বিশেষ করে সেটা যদি ইয়াংকি-নিধনের মত একটি মহৎ কর্ম হয়। পাঠক নিশ্চয়ই জানেন যে তাঁরা একাধারে পরস্পরের শ্বশুর ও জামাতা, অর্থাৎ একে অন্যের কন্যাকে শাদী করেছেন। এমন মধুর মিলনের সম্পর্ক সংসারে বড়ই বিরল।
সেদিন শুনতে পেলাম আন্তর্জাতিক ইসলামের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হল আমেরিকাতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এটা কারও অজানা নয় যে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় শয়তান হল আমেরিকা। জ্ঞানবিজ্ঞানে সবচেয়ে উন্নত। সবচেয়ে শক্তিশালী। আমেরিকা কাত হলেই তো দুনিয়া কাত। বিশ্ববিজয়। তারপর আরামসে আজান দেওয়া যাবে হোয়াইট হাউসের চত্বরে। চাঁদতারাযুক্ত সবুজ পতাকা উড়বে প্রেসিডেণ্টের অফিসচূড়ায়। বিরাট স্বপ্ন। কত বছর লাগবে সিদ্ধ হতে কে জানে। হয়ত পুরো শতাব্দীটাই লেগে যাবে। লাগুক। মুসলমানের সবুর আছে। তবে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। একদিকে বিবিসাহেবার সাহায্যে সংখ্যা বাড়িয়ে যেতে হবে, আরেকদিকে দালানকোঠা, শপিং মল, খেলার মাঠ, বড় বড় সেতু, এগুলো উড়িয়ে দেওয়ার কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। ইনশাল্লাহ সাফল্য আসবেই একদিন না একদিন।
সম্ভবত সে-সাফল্য স্বচক্ষে দেখার ভাগ্য আমার হবে না। আমার ছেলেদেরও আয়ুষ্কাল পার হয়ে যেতে পারে তার আগে। নাতি-নাতনিদের কথা বলা যায় না। যে রেটে বিজ্ঞান নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করছে তাতে মনে হয় এই শতাব্দীরই শেষের দিকে লোকে একশ’ দেড়শ’ বছর অনায়াসে বেঁচে থাকতে পারবে। তবে শেষ বয়সে তাদেরও হয়ত ইয়ারপীস পরতে হতে পারে, সুতরাং হোয়াইট হাউসের আজান তাদের কাণে না’ও প্রবেশ করতে পারে। চিন্তা হল তার পরের প্রজন্মটাকে নিয়ে। বিশেষ করে মেয়েগুলোর জন্য। মেয়েদের ভয় তো অল্পবিস্তর সব সমাজেই, তবে আমাদের সমাজেই সবচেয়ে বেশি। হোয়াইট হাউসের আজান মানেই তো ওদের ভাগ্যাকাশে কেয়ামতের শিঙা। আপাদমস্তক বোরখা। স্কুলকলেজ বন্ধ। খেলাধূলা বন্ধ। প্রেমে পড়া বন্ধ। পরপুরুষের পানে দৃষ্টিপাত মানে মুণ্ডপাত। যাকে বলে শরিয়াতন্ত্র। খালেফাতুন রাশেদীন। ইসলামের স্বর্ণযুগ। আমেরিকার পতন মানে এই স্বর্ণযুগের পুনরুত্থান। এই স্বর্ণযুগের জন্যে বিশ্ববাসীর কতখানি আগ্রহ জানি না, আমার আগ্রহ নেই। আমার বন্ধুবান্ধব কারো আছে বলে মনে হয় না। দুয়েকজন যাদের আছে তারা আমেরিকার ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ছত্রছায়াতে বাস করেই রাশেদীনের স্বপ্ন দেখছে। পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাস হল নানারকম বন্দীত্বের শেকল ভেঙে মুক্তির আলো খোঁজা। আমাদের বেলায় যেন তার বিপরীতটাই সত্য। আমরা মুক্তির পথ ছেড়ে অবরোধের পথ খুঁজতেই যেন বেশি ভালবাসি।
আমার বংশধরদের জন্যে বিষয়সম্পত্তি কিছুই রেখে যাওয়া হল না। ভেবেছিলাম, এই স্বাধীনতাটুকুই থাকবে তাদের সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার। আমি তংকার মোহে এদেশে আসিনি, যদিও যৌবনের একটা সময় আমারও তংকার মোহ ছিল খানিক। কিন্তু এদেশের প্রধান আকর্ষণ ছিল এই স্বাধীনতাটুকু। আমার জীবনচালনার অধিকার ও দায়িত্ব কেবল আমারই, এই জ্ঞানটুকু। আমি যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাব, যা ইচ্ছে তাই খাব, পরব, বলব, লিখব, ভাবব, যাকে ইচ্ছে তাকে কাছে টানব বা দূরে ঠেলব, ইচ্ছে হলে মসজিদে যাব, ইচ্ছে না হলে যাব না, ইচ্ছে হলে রোজা করব, ইচ্ছে না হলে করব না। আমার এই মৌলিক স্বাধীনতাটুকু কেড়ে নেবার জন্যে কোন ধর্মপুলিশ নেই এখানে। আফগানিস্তানের বর্বর তালেবানদের মত এখানে কেউ দর্জির ফিতা নিয়ে টহল দেয় না রাস্তায় দাড়ির দৈর্ঘ মাপার জন্যে। এদেশে আমি ইচ্ছে করলে দাড়িগোঁফ সব কামিয়ে ফেলতে পারি, আবার ইচ্ছে করলে এমন লম্বা দাড়ি রাখতে পারি যাতে রাস্তা ঝাড়– দিয়ে গিনিজ-এর রেকর্ড বইতে নাম ছাপানো যায়। এদেশের পুলিশ বোরখাপরা মেয়েদের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে না খুরওয়ালা জুতো পরল কিনা কেউ বা আলতা পরেছে কিনা কেউ। ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুললে কাউকে শূলে উঠতে হয় না এখানে, শরিয়ার ওপর কটাক্ষ করলে মৃত্যুদণ্ড পেতে হয় না কাউকে। ধর্ম ও রাষ্ট্র স্বতন্ত্র জিনিস এখানে। এই স্বাতন্ত্র্যটুকু আমি বজায় রাখতে চাই। এই স্বাতন্ত্র্য ছাড়া গণতন্ত্র সম্ভব নয়, ব্যক্তিস্বাধীনতা বা মানবাধিকার সম্ভব নয়। জীবনের সব সুখের চেয়ে বড় সুখ এই ব্যক্তিস্বাধীনতা, এই মানবাধিকার। এই সুখটুকু আফগানিস্তানে নেই, ইরান বা আরবে নেই, পাকিস্তানে নেই, বাংলাদেশেও লোপ পেতে বসেছে। আমার মন কাঁদে জন্মভূমিতে ফেরার জন্যে, কিন্তু সমাজের বাধা, সন্ত্রাসের বাধা, হরতালের বাধা আর শরিয়ার বাধা আমাকে বারবার ফিরিয়ে আনে সেখান থেকে। আমি এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে চাই। এই খোলা আকাশের নিচে, এই বিশুদ্ধ বায়ুর মাঝে। হোয়াইট হাউসে আজানের ধ্বনি শোনার বাসনা আমার নেই। কোন আজানের ধ্বনিই আমি শুনতে চাই না। যে আজান আমার মনে বাজে না সে আজান দালানের গম্বুজে শোনার আকাক্সক্ষা আমার নেই। আমার বিধাতা যাঁকে আমি সেজদা করি তিনি মসজিদে থাকেন না, থাকেন আমার হৃদয়ে।
সেদিন কাগজে পড়লাম কাশ্মীরের খবর। দু’টি মুসলমান মেয়ে বাজারে গিয়েছিল কেনাকাটার জন্যে। হঠাৎ তাদের মুখে অ্যাসিড ছুড়ে মারল দুর্বৃত্তের দল। দুর্বৃত্ত বলাটা বোধহয় ঠিক হল না, আসলে ওরা মুক্তিযোদ্ধা। কাশ্মীরকে যারা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে চায় বা নিজেরাই স্বাধীন হতে চায়, তাদেরই কীর্তি ওটা। তালেবানদের পদাঙ্ক অনুসরণই তাদের উদ্দেশ্য। তালেবানরা ধর্মীয় রাষ্ট্র বানিয়েছে স্বাধীন হবার পর। কাশ্মীরের বীর যোদ্ধাগণ স্বাধীন হবার আগেই ধর্মীয় রাষ্ট্র স্থাপন করার কাজে লেগে গেছে। ধর্মের প্রথম কাজই তো মেয়েদের ঘরে ঢোকানো, যাতে ভবিষ্যতে কেউ বোরখা ছাড়া রাস্তায় বেরুবার সাহস না পায়। ভাবলাম, সত্যি সত্যি যদি স্বাধীন হয়ে যায় একদিন তাহলে তারা কি করবে। অসতী নারীকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে পাথর মেরে হত্যা করা ? মেয়েদের স্কুলকলেজ বন্ধ করে দেওয়া ? ওদের ঘরের ভেতরে আটকে রেখে দিনরাত দীনিয়াত পড়ানো ? পুরুষের ভোগের সামগ্রী ছাড়া আর সব কাজ থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া ? সবচেয়ে আশ্চর্য হলাম পড়ে যে মুক্তিবাহিনীর নারীশাখাও নাকি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে এই বর্বরতার। দাসত্বই যাদের কাছে স্বাধীনতার সমান তাদের কি কখনো স্বাধীন করা সম্ভব ?
কাশ্মীর আর আফগানিস্তানের মেয়েদের জন্যে আমার ভীষণ কষ্ট লাগে, তবে আমার সত্যি সত্যি কোন অধিকার নেই তাদের ব্যাপারস্যাপার নিয়ে কোন রাজনৈতিক মন্তব্য করার। কিন্তু বাংলাদেশ আমার জন্মস্থান। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের ব্যাপার নিয়ে মন্তব্য করার অধিকার আমি এখনো হারাইনি সব। দেশটার জন্ম হল ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভিত্তি করে। ধর্মের দালালদের সঙ্গে লড়াই করে করেই ত্রিশ লক্ষ লোক প্রাণ দিল একাত্তরে। আড়াই লক্ষ নারী হারালো তাদের সম্ভ্রম। মুসলমান দেশের বর্বর সৈন্যরা এসে হামলা করল সেই দেশেরই বাঙালিপ্রধান অঞ্চলে। তাতে সর্বনাশ হল আড়াই লক্ষ মেয়ের। এই সর্বনাশ করার অধিকারটুকু তারা পেল কোত্থেকে ? ধর্ম থেকে, না, জন্ম থেকে ? অথচ কি আশ্চর্য, ঐসময় যে-পশুরা আমাদের অসহায় মেয়েগুলোকে ধরে ধরে চালান দিয়েছিল সৈন্যশিবিরে, ঠিক তারাই বা তাদের বংশধরেরা আজকে বাংলাদেশেরই পথেঘাটে জোরগলায় চিৎকার করে বলছে, বাংলা হবে আফগান, আমরা হব তালেবান। এর চেয়ে বড় বিড়ম্বনা আর কি হতে পারে। এর চেয়ে বড় অপমান আর কি হতে পারে জাতির জীবনে। তবুও এই নির্মম বিড়ম্বনাকে, এই অসহ্য অপমানকে অকাতরে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন আমাদের রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা। ’৯৬-এর সংসদে তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র দু’জন, এবার (২০০১) সেটা দাঁড়িয়েছে ষোলতে। এই দেশটা কি সত্যি সত্যি স্বাধীনতার যোগ্য ?
না, হোয়াইট হাউসের আজান আমি শুনতে চাই না। প্রার্থনা করি আমার বংশধরকেও যেন শুনতে না হয় কোনদিন। আমার নাতনির মুখে কেউ যেন অ্যাসিড না ছোড়ে কখনো। আমেরিকাতে জন্মগ্রহণ করেও তাকে যেন হিজাব পরতে বাধ্য না করে কেউ। হিজাব যদি সে নিজের ইচ্ছাতে পরতে চায়, পরুক, কিন্তু অন্যের ইচ্ছাতে পরতে না হয় যেন। সে যদি বিকিনি পরে সমুদ্রের পানিতে সাঁতার কাটতে চায়, কাটুক, তাতে যেন বাধা না দেয় কেউ। সে যদি বন্ধুবান্ধব নিয়ে ডিস্কোতে গিয়ে রকের তালে নাচতে চায়, নাচুক। তাতে যদি বাবা-মা বাধা দিতে চায়, দিক, ধর্মপুলিশ যেন না দেয়। তার শ্বাসনালী যেন রুদ্ধ করে না ফেলে কেউ। সে যেন পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে পূর্ণমানব হয়ে উঠতে পারে। তার ব্যক্তিত্ব, স্বাতন্ত্র্য, তার মেধা, তার নিজস্বতা যেন পূর্ণ মর্যাদা লাভ করতে পারে সমাজের কাছ থেকে। হোয়াইট হাউসের আজানের চেয়ে হাজারগুণ বেশি কাম্য আমার তার স্বাধীনতা, তার ব্যক্তিসত্তার পূর্ণবিকাশ।
ইরান আর ইরাকের যুদ্ধের সময় শুনতাম বারো-তেরো বছরের নিষ্পাপ নিরীহ ছেলেগুলোর হাতে বন্দুক দিয়ে বলা হত, যুদ্ধে গিয়ে শহীদ হলে তাৎক্ষণিক পুরস্কার পাওয়া যাবে আল্লার কাছ থেকে। রীতিমত লিখিত সার্টিফিকেট নাকি দেওয়া হত স্বর্গের। সেই স্বর্গে আছে সীমাহীন সুরার সাগর, আছে অগণিত সম্মোহনী কুমারী। আমি এই স্বর্গকে বিশ্বাস করি না। এই স্বর্গের বর্ণনা আমাকে লজ্জা দেয়, বিব্রত করে। সুরাপান আমি কোনদিনই পছন্দ করিনি, স্বর্গেও করব না, যদি সেখানে যেতেই হয় অগত্যা। স্বর্গের কুমারীকে ভোগ করার কল্পনা আমার বিবমিষা জাগায়, মনে করিয়ে দেয় আমার ফুলের মত নিষ্কলুষ বোনগুলোর কথা। আমি যে স্বর্গ চাই সে-স্বর্গ পতিতালয় নয়। আমার স্বর্গ এখানেই, এই মহামানবের সাগরকূলে। যেখানে মনুষ্যত্ব আছে, নারীর প্রতি সম্মান আছে, কুমারী কিশোরীর প্রতি আছে স্নেহের দৃষ্টি, সেখানেই আমার স্বর্গ।
ড. মীজান রহমান, কানাডার অটোয়ায় বসবাসরত গণিতের অধ্যাপক। পঞ্চাশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেছেন বেশ ক’বছর। বিশ্লেষনধর্মী প্রবন্ধকার হিসেবেও সুপরিচিত। প্রকাশিত গ্রন্থ সাতটি, সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ 'দুর্যোগের পূর্বাভাস' (২০০৭)। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে লিখিত উপরের প্রবন্ধটি 'দুর্যোগের পূর্বাভাস'-এ সংকলিত হয়েছে।