প্রসঙ্গঃ আকিমুন রহমানের দৃষ্টিতে বেগম রোকেয়া
রতন
‘রোকেয়া ছিলেন আমুল নারীবাদী। কিন্তু তিনি জানতেন তিনি পৃথিবীর এক বর্বর পিতৃতন্ত্রের অন্তর্ভূক্ত,তাকে বিদ্রোহ করতে হবে এই বর্বরতাকে স্বীকার করেই। এ রোকেয়া নিজের মধ্যে সংহত রেখেছিলেন প্রবল দ্রৌহিতা ও মর্ষকামিতা, পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণ ও পরাভূত করার জন্য তাকে সুখের সাথে সহ্য করতে হয়েছে পুরুষতন্ত্রের পীড়ন। কিন্তু তিনি পুরুষতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য নিরন্তর লড়াই করে গেছেন; তাঁর রচনাবলী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ধারাবাহিক মহাযুদ্ধ।‘
‘রোকেয়া সম্পের্ক ডঃ আজাদের মূল্যায়ন অসামান্য;‘ স্বীকার করেই ডঃ আকিমুন রহমান লিখেন, ‘ওটিই রোকেয়া সমন্ধে শেষ কথা হতে পারেনা।‘ এবং জানিয়ে দেন শেষ কথা।
উল্লেখ্য যে এক সময় ডঃ আকিমুন রহমান মীর নাসিরুদ্দিনের মূর্ত্তী ভাঙ্গতে গিয়ে প্রতিবাদের মুখে স্তব্ধ হয়ে পড়েন। মুখে বা কলমে প্রতিবাদের একটি শব্দ ও ফুঁটেনি। তাকে বাঁচাতে ডঃ হুমায়ুন আজাদ দেশের ছাপ্পান্নজন বরেন্য দেব-দেবীর মূখোশ খুঁলে দেন। নাসিরুদ্দিনের যে তথ্যের ভিত্তিতে তিনি কাজটি করেন সে তথ্যও ডঃ আকিমুন রহমানের ঝুলিতে ছিলোনা। ডঃ আজাদ বাংলার প্রসিদ্ধ আম খেতেন, খোসা খেতেন না। আর ডঃ আকিমুন রহমানের লেখাটি খোসা খেতেই বেশী পছন্দ করে আমাদের জানিয়ে দেয়।
ডঃ আকিমুন রহমান একজন নারীবাদী, প্রথাবিরোধী, মূর্ত্তীভাঙ্গার প্রকৌশলী হিসাবে আমার দ্বিমত নেই। প্রশ্ন হচ্ছে ‘লগি-বৈঠার‘ গণতন্ত্র আর শাবল হাতে মূর্ত্তী ভাঙ্গা দক্ষ শ্রমিকের কাজ নয়।
তাঁর শেষ কথার সবকিছুই বিদ্যমান ডঃ আজাদের গুটিকয় পংক্তিতে। তবে তিনি শোচনীয় ভাবে মর্মাহত হয়েছেন রোকেয়ার বোরকা ও সব স্মরণে।
বোরকা কোন বিধান নয়, পরিধানে সততা ও নারী মুক্তি বিঘ্নিত হয়না। যে পরে সে বর্বর সমাজে গন্ধমের আলো ঢাকতে ও অপরকে গন্ধমের নেশা থেকে বিরত রাখতেই পরে। পুরুষতন্ত্রের শিথিলতার যুগে মুসলিম পরিবারে উচ্চশিক্ষিত অতি আধুনিক নারীবাদী কোন মূর্ত্তীভাঙ্গার প্রকৌশলীকে, বিকিনি পরিহিত কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতের ক্লান্িত বা জ্বালা নিরসনে রাতের অতিথির সাথে রাত কাটাতে যে কারণে দেখা যায় না; বোরকা তেমনই কারণ।
তিনি লিখেছেন, ‘বৈধব্যের কালে রোকেয়াকে আবার বিবাহিত হতেই হবে এমন কোন কথা নেই, তবে হতে যে হবেই না এমন কোন ঐশ্বরিক বিধিও শুধু রোকেয়ার জন্য প্রস্তুত হতে পারেনা।‘ পরের পংক্তিতে, ‘রোকেয়ার মৃত্যু হলে সাখাওয়াৎ আবার বিবাহ না করে পারতেন না‘ ব’লে কি অর্থ বুঝাতে চাইলেন?
বিধবা জীবন যাপন কি শব পূঁজা? সধবাতে কি নারীমুক্তি? ভালবাসা কোন বাদের ধার ধারেনা। মৃতকে স্মরণ করা ভালবাসার টান। আর একটার পর একটা পুরুষ গ্রহন করা নারী স্বাধীনতা নয়; বিকৃত মগজের দেহের ক্ষুধা। বেগম রোকেয়ার সময়ে লেখিকার জন্ম হলে ডঃ আকিমুন রহমান না হয়ে আকিছাকি হয়ে মিশে যাওয়ার কথা। আজকের পুরুষতন্ত্রের শিথিলতা, অত্র এলাকায় নারীদের জ্ঞান অর্জনে, বিশেষ করে ‘মুসলিম পরিবারে‘ যে অগ্রতা এবং ডঃ আকিমুন রহমানদের যে বলার সাহসিকতা তার আলো জ্বেলেছিলেন বেগম রোকেয়া।
রামায়নে রাবণ কতৃক সীতা হরণ হয়েও আজো সতিই আছে। আর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে দু’টি অকাট্য মন্তব্যের অর্থ এমন, - রবীন্দ্রনাথকে শতবর্ষের অগ্রগামী মনে করা হলেও তিনি দ্বিতীয় লিঙ্গের মুক্তি কামনায় বিশ্বাসী ছিলেন না। অপরটি, রবীন্দ্রনাথ এমনই নিরামিষ ছিলেন না যে, মহিলাদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলবেন। তারপরও মন্তব্য দু’টির জ্যোতির্ময় স্বীকার করেন আকাশছোয়া রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথই।
বেগম রোকেয়া সম্পর্কে উপরে বর্ণিত ডঃ হুমায়ুন আজাদের উদ্ধৃতির বাহিরে ডঃ আকিমুন রহমানের শেষ কথা সৃষ্টিশীলতা নয়। রাম কাতা। আমরা তাঁর নিকট আশা করবো সৃষ্টিশীলতা, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে‘ এর মতো লেখা।
রেডিং, কালিফোর্নিয়া