ফেরারি বাবার বাবা হওয়া
রেজা ঘটক
আমার বাবা তখন ফেরারি। আদালতের রায়ে দণ্ডিত কোন পলাতক আসামী নয় বাবা। কোন ধরণের খুন-খারাবির সাথে জড়িত থেকে প্রতিপক্ষকে এড়িয়ে চলার মতো কাপুরুষও নয়। এমনকি রাজাকার আলবদর আলসামস বা পাক আর্মির ভয়ে পালিয়ে থাকা কোন মুক্তিযোদ্ধাও নয়। বরং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সব ধরণের সহযোগীতা ও সংগঠিত করার জন্য অকুতোভয় বিচ্ছিন্ন এক সংগঠক ছিল আমার বাবা। আর তার ফেরারি হবার একমাত্র কারণ অনেকটা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া আরেকটা সশস্র রাজনৈতিক দলের হত্যা হুমকি এড়ানোর কৌশল হিসেবে পালিয়ে বেড়ানো। মোটকথা বাবা তখন পুরোপুরি ফেরারি জীবন যাপন করেন। মাঝে মধ্যে সুবিধা মতো সময়ে ছদ্মবেশে বাড়ি থেকে ঘুরে যান। বাবাকে তখন মা ছাড়া আর কেউ প্রায়ই চিনতে পারেন না। আর কেউ মানে আমার বড় ভাই হোসেন, মেজো ভাই হাসান, বড় বুজি স্বপ্না, মেজো আপা রতœা, ছোট্ট বু রুনা আর পিচ্ছি আমি। আমরা কেউই তখন বাবাকে চিনতাম না। শুধুমাত্র মা চিনতো। তাও না দেখে চেনা। অর্থাৎ আমাদের কাচারি ঘরে বাবা হয়তো এসেছেন। এবার তাকে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। হাসান হোসেন ছেলে তাই এই কাজটি করবে বড় বুজি আর মেজো আপা। হাসান হোসেনকে মা অজানা আশংকায় লুকিয়ে রাখতো। কারণ হাসান হোসেনের বয়স তখন প্রায় পনের আর তেরো। বড় বুজির দশ, মেজো আপার সাত, ছোট্ট বুর পাঁচ আর আমার তখন মাত্র দেড় বছর। বড় বুুজি আর মেজো আপা তখন মার দেওয়া ফরমায়েস মতো কাচারি ঘরে খাবার পৌঁছে দেবে। প্রথম বারে দুজনের খাবার পাঠাতো মা। বড় বুজি আর মেজো আপা ফিরে এসে যে রিপোর্ট করবে তার ভিত্তিতে পরবর্তী চালান পাঠাতো মা। কাচারি ঘরে আসা লোকটি বাবা হলে অর্ধেক খাবার ফেরৎ আসতো। ফেরৎ আসা খাবারের সাথে পরবর্তী কয়েকদিনের খাবার যুক্ত করে আবারো পাঠিয়ে দিতো মা। কিছু পরিষ্কার জামা কাপড়ও সাথে থাকতো অনেক সময়। আর তা বড় বুজি আর মেজো আপাকে কাচারি ঘরে তা পৌঁছে দিতে হতো। কাচারি ঘরে আর যারা খাবার খেতে আসতো তাদের কেউ কখনো বাবার মতো একা আসতো না। দুইজনের বেশি আসলে তারা মার পাঠানো ওই খাবারই ভাগ করে খেতো। সেই সংখ্যাটি পাঁচ ক্রোস করলে আবারো বাড়তি খাবারের জন্য বড় বুজিকে মার কাছে রিপোর্ট করতে হতো। এভাবে কাচারি ঘরে আসা লোকদের শ্রেনীবিন্যাসে বাবা হল তৃতীয় পক্ষ। সবচেয়ে বেশি আসতো মুক্তিবাহিনীর লোকজন। তারপর আসতো পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সশস্র লোকজন। আর নিজের বাড়িতে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত অবস্থায় আসতেন আমার বাবা। কিন্তু কখন কে আসতো, কারা আসতো ঘরে বসে মা ঠিকই তা নির্ভুলভাবে নির্নয় করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতো। বাবাকে আবার অনেক সময় খাবার না খেয়েই অথবা জামা কাপড় না পাল্টিয়েই ফেরৎ যেতে হতো। কারণ হয়তো কাচারি ঘরে তখন কোন একটি সশস্র দলের লোকজন অবস্থান করছে। তারা মুক্তি নাকি নকশাল এটা বাবার হয়তো জানা নেই। তাই বাবাকে পালাতে হতো ইনফরমেশান গ্যাপের কারণে। কারণ কাচারি ঘরে যারা আছেন তারা মুক্তি না হয়ে নকশাল হলেই বাবার আর রক্ষে নেই। নির্ঘাত মৃত্যু। কাচারি ঘরে বাবার জন্য হয়তো যম অপেক্ষা করছে। এই ভয়টা বাবাকে সব সময়ই তাড়া করতো। আবার মুক্তি হলে তারা বাবার জন্য কিছু ইনফরমেশান রেখে যেতো। কখনো তা চিঠি আকারে। কখনো অস্র-গোলাবারুদ হিসাবে। কখনো কোনো তার্গেট পয়েন্টের নমুনা নকশা হিসেবে। জরুরি প্রয়োজনে কখনো কখনো মুক্তিদের সাথে বাবা সারাসরি দেখা করতেন। কিন্তু এইসব বিষয়গুলোর প্রায় সবই ঘটতো রাতের বেলায়। অন্ধকারে খুব গোপনে। এরকম কোনো রাতে যদি বাবা মুক্তিদের সাথে মিট করতেন, দেখা যেতো ঠিক পরের দিনই নকশালদের আগমন ঘটতো আমাদের কাচারি ঘরে। একবার তো নকশালের সশস্র লোকজন এক রাতের জায়গায় পরপর দুরাত আসায় বাবার সঙ্গে তাদের অল্পের জন্য সাক্ষাৎ ঘটেনি। কাচারি ঘরে যারা ওই রাতে ছিল তারা বাবার আগমন টের পাওয়া মাত্র অন্ধকারের উদ্দেশ্যেই কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়লো। সেদিন মেজো আপা খুব ভয় পেয়েছিল। আর বড় বুজির একা একা ঘরে যাওয়া উচিৎ হবে কিনা সেই আশংকায় মা ছোট্ট বুকে সঙ্গে দিয়েছিল। আর সেই সুযোগে ছোট্ট বু কবিতা আবৃতির মতো বাবা কখন কখন আসে, কিভাবে কিভাবে আসে, এসে কতোক্ষণ থাকে- এইসবই নকশালদের অনেকটা নির্ভুল বর্ননা করছিল। অথচ ক্লাসের পড়া কিন্তু ছোট্ট বু একদম পারতো না। কখনো কখনো তো ছোট্ট বুর কবিতা ওর আগেই আমার মুখস্থ হয়ে যেতো। আর তা নিয়ে মেজো ভাই হাসান তাকে কঠিন কঠিন সব সাজা দিতো। যাক অন্ধকারে ছোড়া গুলি থেকে বাবা ছিল নিরাপদ দুরত্বে। চেনা অলি গলি বাগান নালা ভেঙ্গে বাবা ঠিকই পালিয়ে রক্ষা পেলেন।
অগ্রাহায়ন মাস। উঠানে বিশাল বিশাল ধানের পালা অন্ধকারের মধ্যেও নিস্তদ্ধ পাহাড়ের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে। ঘরে বারান্দায় মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধান আর ধান। বসত ঘরের সবচেয়ে অন্ধকার ঘরটিতে মা তখন জীবন যুদ্ধে লড়ছে। মার ঘরে আরেকজন লোক আছেন। আমাদের কালা বু। কালা বু মানে বাবার মামী। সেই ঘরের সাথে আর যারা অদৃশ্য যোগাযোগ রাখছেন তারা হলো আমার দাদুভাই, দাদী, সেজো চাচি আর জোহরা ফুপু। দাদুভাই ছাড়া বাকিরা মঝে মধ্যে অন্ধকার ঘরের উদ্দেশ্যে কথা বলছেন। এই সময় কাচারি ঘরে আসল একদল সশ্রস্র লোক। তারা ভিতর বাড়ি থেকে নানা ধরণের সাহায্য প্রার্থনা করলো। সাহায্য তালিকার প্রথমটি হল বাবার উপস্থিতি। সেদিন আমার দাদী খুব দুঃসাহস দেখিয়ে কাচারি ঘরে আসা সশস্র লোকদের খুব বকা ঝকা করেছিলেন। কিন্তু বাবার উপস্থিতি ছাড়া তাদের নাকি আর কোনো বিকল্প জানা নেই। ছোটো কাকার বয়স তখন মাত্র সতের। ছোটো কাকাও হোসেন হাসানের মতো ভিতর বাড়িতে পালিয়ে থাকেন। কিন্তু যারা তখন কাচারি ঘরে তাদের ছোটো কাকার নামটি জানা ছিল। দাদীর কাছে তারা ছোটো কাকাকে চাইলেন। শর্ত হল বাবার উপস্থিতি না ঘটা পর্যন্ত ছোটো কাকা তাদের হাতে জিম্মি থাকবে। ছোটো কাকার পরিবর্তে দাদী তখন মেজো ভাই হাসানকে ওদের হাতে জিম্মি রাখলেন। বাবা না আসা পর্যন্ত হাসানই ছোটো কাকা হিসেবে প্রক্্ির দিচ্ছে। কাচারি ঘরে আসা সশস্র লোকদের মধ্যে ওই সময় মাত্র একজনই কেবল ঠিক আমার মায়ের মতোই উথালি পাথালি করছিল।
আমাদের বাড়ি থেকে সবচেয়ে কাছে মেজো ফুপুর বাড়ি। কেবলমাত্র মকবুল জামাই জানতো বাবা কোথায় আছেন। কারণ কোনো রাতে কাচারি ঘরে এসে যদি উল্টো পালাতে হতো সেক্ষেত্রে সেই রাতে মেজো ফুপুর বাড়ি থেকেই খাবার নিতেন বাবা। মকবুল জামাইর কাছে হাসানের জিম্মি হবার ঘটনা শুনে ভোর রাতেই মকবুল জামাই আর বাবা সশস্র অবস্থায় আমাদের বাড়িতে ঢুকলেন। আর ধানের পালাগুলো তখন নিঃশব্দে তাদের ঢাল হিসেবে বেশ সুযোগ করে দিল। মকবুল জামাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাচারির জানালায় উঁকি দিলেন। কাচারিতে মুক্তিবাহিনী নাকি নকশাল তা নিশ্চিত হতেই ওই উঁকি। মকবুল জামাই যখন নিশ্চিত হলেন যে কাচারি ঘরের সবাই মুক্তিবাহিনীর লোক, তখন বাবা আর মকবুল জামাই সেখানে সশরীরে হাজিরা দিলেন। বাবার উপস্থিতির কারণে হাসান জিম্মি অবস্থা থেকে আনুষ্ঠানিক ছাড়া পেলেও কাচারি ঘরে বসে বসেই তখন ঘুমাচ্ছিল।
ইতোমধ্যে দাদুভাই টের পেলেন যে বাবা কাচারি ঘরে হাজির হয়েছেন। তাই দাদুভাইও অনেকটা দুঃসাহস নিয়ে কাচারি ঘরে উঁকি দিলেন। ঠিক তখন ভিতর বাড়ি থেকে খবর আসল যে আমাদের আরো একটি ভাই জন্ম নিয়েছে। কাচারি ঘরে তখন মেজর খোকন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। বাগেরহাটের রামপালে পাক-বাহিনীর সাথে এক খণ্ডযুদ্ধে মেজর খোকনের পায়ে গুলি লেগেছিল। তাঁকে বাঁচাতে হলে বিকল্প একমাত্র ধনরাজ কবিরাজ। কিন্তু ধনরাজ কবিরাজের বাড়ি গোপালগঞ্জের গহরডাঙ্গায়। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় তিন সাড়ে তিন মাইলের পথ। বাবা ছাড়া আর কেউ ধনরাজ কবিরাজকে আনতে পারবে নাÑ এই খবরটি মেজর খোকনের সাথে আসা মুক্তিদের জানা ছিল। আরো জানা ছিল বাবা বাড়িতে থাকেন না। নকশালদের ভয়ে পালিয়ে থাকেন। আর অপরিচিত কেউ গেলে ধনরাজ কবিরাজ মরতে রাজি তো বাড়ি থেকে বের হবেন না। মকবুল জামাই আর বাবা সশস্র অবস্থায়ই আবার বেড়িয়ে গেলেন। ধনরাজ কবিরাজকে না পেলে মেজর খোকনের মৃত্যু নিশ্চিত। রক্তক্ষরণ কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। কাচারিতে আসা মুক্তিদের একটা দল আমাদের বাড়ির চারদিকে সশস্র অবস্থায় পাহারা দিতে থাকলেন। কালা বু আমাদের পূবের দরজায় ছোট্টো ভাইটাকে নিয়ে বসলেন। মাঝে মধ্যে পিচ্ছির চোখকে কালা বু নিজের আঁচল দিয়ে আড়াল করছেন আর পুরো শরীরে রোদ লাগাচ্ছেন। জোহরা ফুপু মাকে স্নান করিয়ে দিলেন। ওদিকে হাসানের পরিবর্তে এবার স্বয়ং দাদুভাই মুক্তিদের সাথে কাচারি ঘরে বসে থাকতে বাধ্য হলেন। সারা বাড়িতে একটা টান টান উক্তেজনা। কখন মকবুল জামাই আর বাবা আসেন। যদি ধনরাজ কবিরাজ না আসে তাহলে মেজর খোকনের মৃত্যু নিশ্চিত। আর দাদুভাই বা অন্যদের ভাগ্যে তখন কী আছে কেউ বলতে পারে না।
নিঃসন্তান কবিরাজ দম্পত্তির ঘরে বাইরে ওই দুইজন মাত্র মানুষ। ধনরাজ কবিরাজ আর তার সুন্দরী স্ত্রী রেনুবালা। রেনুবালা ধনরাজ কবিরাজকে গ্রামের বাইরে কোথাও যেতে দেন না। সেক্ষেত্রে রোগীকে কবিরাজের বাড়িতেই হাজির করার নিয়ম। কিন্তু মকবুল জামাই আর বাবা তো রোগী ছাড়াই সেখানে হাজির। ধনরাজ কবিরাজকে তুলে আনতে এখন ভয়ভীতি প্রদর্শন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। রেনুবালার উথালি পাথালি গড়াগড়ির মধ্যেই অস্রের মুখে ধনরাজ কবিরাজকে তুলে আনলেন তারা। ধনরাজ কবিরাজ তাঁর কবিরাজি বাকশো পেটাসহ নিঃশব্দে ঘর ছাড়ার আগে রেনুবালার উদ্দেশ্যে শুধু একবার পিছন ফিরে তাকালেন। সেই তাকানোর অর্থ হল যদি আমারে ওরা মাইরা ফেলায় তোমার সামনে বরং না মারাই ভালো।
আসরের নামাজের আগে আগে ধনরাজ কবিরাজকে নিয়ে মকবুল জামাই আর বাবা আবার উপস্থিত। তারপর টানা সাড়ে তিনঘন্টা ধনরাজ কবিরাজের অস্রপাচার চলল। মেজর খোকনের মৃত্যু আতংক ধীরে ধীরে বিলুপ হতে থাকলো। কিছু প্রয়োজনীয় কবিরাজি উপদেশ দিয়ে ধনরাজ কবিরাজ যখন বিদায় নিবেন, তখন ভিতর বাড়ি থেকে কালা বু আবদার করলেন একবার যেনো কবিরাজ নবজাতক ও মাকে দেখে যায়। কবিরাজ তাই করলেন। আর রাত বারোটার দিকে যখন মকবুল জামাই আর বাবা ধনরাজ কবিরাজকে রেনুবালার সামনে জীবন্ত হাজির করলেন, তখন রেনুবালা তাদের খই-গুড় দিয়ে খুব আপ্পায়ন করলেন। আর বাবাকে জড়িয়ে ধরে রেনুবালা ধর্ম বাবা ডাকলেন। একই দিনে একটা নবজাতক ছেলে আর একটা পৌঢ়া মেয়েকে পেয়ে বাবা তখন খুশিতে আস্রু জড়ানো কণ্ঠে বললেনÑ আমরা নিশ্চয়ই একদিন জয়ী হবো। আজ থেকে তুমি আমার বড় মেয়ে আর কবিরাজ আমার বড় জামাই।
মেজর খোকন যেদিন আমাদের বাড়ি ছেড়ে আবারো যুদ্ধে চলে যান, সেদিন আমার মায়ের সাথে তিনি দেখা করেছিলেন। যাবার সময়ে মেজর খোকন পিচ্ছির জন্য মাকে একটা এসএলআর গিফ্ট করলেন। আর পিচ্ছি ওটা হাতে তুলে নিতে না পারায় এসএলআরটা হল আমার সার্বক্ষণিক খেলার জিনিস। সাইত্রিশ বছর পার হয়ে গেলেও সেই এসএলআরটার কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। আহা কেমন তেলতেলে কালো ভারী সুন্দর যন্ত্রটা। ওটা নিয়ে আমি কতোজনকে যে সেই বয়সে ভয় দেখিয়েছি। ছোটো ফুপু আমাকে খাওয়ানোর সময় প্রায়ই ওই এসএলআরটার ভয় দেখাতো। আর বলতো শি¹ির খা, তোর যে যুদ্ধে যেতে হবে বাবা। আমার সেই প্রিয় এসএলআরটা একদিন বাবা কোথায় যেনো লুকিয়ে রাখলেন। নাকি কোথাও ফেলে দিলেন। বলেশ্বরের কাদাজল ঘাটলে কি সেই এসএলআরটা এখন ঠিক মতো পাওয়া যাবে? আজ তার কিছুই কী আর মনে আছে।
রেজা ঘটক/কাঁঠালবাগান/ঢাকা