বাবার সাথে কথোপকথন

সানজীব হোসেন

 


একমাস পার হয়ে গেল, আমার বাবা ডঃ আনোয়ার হোসেন আমাদের সাথে থাকতে পারেন না। ফলে তার সাথে সকালের নাস্তা আর করা হয় না, হয়না খাবারের টেবিলে বসে তার সাথে দেশ নিয়ে কোন আলোচনা। খাবারের টেবিলে আমি সাধারনত তার ডান পাশে বসতাম। এখন বাবার চেয়ারটি খালি পরে থাকে। তাই পারতপক্ষে আমি সেখানে বসি না। ভাবতে ভাল লাগেনা আমার বাবা আজ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।


কারাগারে গিয়ে দেখা করার সুযোগ কম। সপ্তাহে একদিন আমার মা ও ছোট বোনকে নিয়ে আমি বাবার সাথে দেখা করতে যাই। প্রায়ই আত্মীয় স্বজন আমাদের সাথে যান, মাঝে মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।


বাবার সাথে কথা বললে মনের ভেতর সাহস একশো গুন বেড়ে যায়। তার মাঝে তার আত্ম-বিশ্বাস দেখে মনে হয়, তিনি কি আসলেই কারাগারে নাকি অন্য কোথাও?


বাবার সাথে যখন কথা বলি, অনেক কিছুই তখন নতুন করে বুঝতে শিখি। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে নিয়ে তার ভাবনা কী, আমরা তা সহজেই তখন অনুধাবন করতে পারি। বাবা আমাকে বলেন যে, কিছু দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতঃফূর্ত ছাত্রআন্দোলন যে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ক্যাম্পাসের বাইরে এবং ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং সহিংস হয়ে সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তাতে তিনি গভীর ভাবে মর্মাহত হয়েছেন। বাবার কথা শুনে বুঝতে পারি যে আর সামান্য কোন সম্পদ ধংস হোক, তা তিনি বা কেউই চান না, চাইতে পারেন না।


বাবা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন থেকে সরকার-সেনাবাহিনী এবং নাগরিকদের এই ইতিবাচক শিক্ষাই নিতে হবে যে, সবাই প্রত্যেকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে আরও দায়িত্ববান হবেন এবং কেউই সীমা লঙ্ঘন করবেন না। আমি আরও অনুপ্রাণিত হই যখন বাবা বলেন যে ইউনিফর্মধারী সেনাসদস্যদের মত ছাত্র-শিক্ষক-জনতা প্রতিটি নাগরিকেরই মর্যদাবোধ রয়েছে। কারও পক্ষ থেকে কখনো যেন তা আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। বাবা বলেন বাংলাদেশের এই চরম বৈষম্যপূর্ণ সমাজে খেটে খাওয়া অধিকারবঞ্চিত মানুষ যেন সরকারের তরফ থেকে নিজেদের অবহেলিত বোধ না করে। এই উপলব্ধি যেন তারা লাভ করতে পারে যে সরকার তাদের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক। কারণ বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হলে কী প্রলয় ঘটে যেতে পারে কিছু দিন আগেই তা আমার সবাই প্রত্যক্ষ করেছি।
তবে তার সাথে কথা বলে এও বুঝতে পারি তার মনে জন্ম নেয়া এক সংশয়ের কথা। তিনি বার বার আমাদেরকে জিজ্ঞেস করেন সিএমএম কোর্টের বাইরে দাড়িয়ে মিডিয়াকে দেয়া তার ক্ষমা চাওয়া বিষয়টি ঠিকমত প্রচারিত হয়েছে কি না, দেশের সাধারণ মানুষ তার কথার মূল অর্থটি বুঝতে পেরেছেন কি না। তিনি বলেন যে একজন নীতিনিষ্ঠ শিক্ষক যেভাবে বিবেক ও সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত উপলব্ধি দ্বারা চালিত হন, ঠিক সেভাবেই তিনি চালিত হয়েছেন। তাই সত্য উচ্চারণে তিনি কখনও ভীত হন নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ঠিক সেই অবস্থান থেকেই জাতির বিভিন্ন সংকটমোচনে দিকনির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বিবেক ও সত্যের সেই একই অবস্থান থেকে আমার বাবা এই বিশ্বাসে উপনীত হয়েছিলেন যে, সেনাসমর্থিত তত্ত্ববধায়ক সরকার কর্তৃক দেশে একটি অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণ যোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া যেন কোন ভাবে বাধাগ্রস্ত না হয় , তার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্ট স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলনকালে ইউনিফর্ম পরিহিত সেনাসদস্যের উপর হামলায় তাদের আত্মমর্যাদা বোধ যেভাবে আহত হয়েছে তার দ্রুত নিরাময় প্রয়োজন। অন্যদিকে ২২ শে আগষ্ট রাত ৮ টায় কারফিউ জারির পর থেকে ২৩ শে আগষ্ট দিনব্যাপী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে এবং আবাসিক এলাকায় ও চারপাশে যৌথবাহিনীর অভিযানের যে খবরাখবর আসছিল, নিরীহ কর্মচারী এবং ছাত্র পরিচয় পাওয়া মাত্র যুবক ও রিপোর্টারা নির্দয় প্রহারের স্বীকার হচ্ছিল, তাতে আামার বাবা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন যে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করলেও ইউনিফর্মধারী সেনা সদস্যের উপর হামলাকে মেনে নিতে পারছে না সেনা সদস্যরা। আমার বাবার মনে এই ভাবনাটি বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার মুখোমুখি এই অবস্থান নিতে পারে না। তাই সেই উপলব্ধি থেকে সম্পুর্ন স্বঃপ্রণোদিতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষকের সত্যের সবল ও উচ্চতর অবস্থান থেকে সেনা বাহিনীর সম্মানিত জোয়ান থেকে শুরু করে সেনা প্রধান পর্যন্ত, প্রতিটি সদস্যের নিকট ছাত্রদের হয়ে আমার বাবা আন্তরিক ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। বাবা আমাকে বলেন যে এর জন্য সামান্যতম কোন লজ্জা বা গ¬ানি তিনি অনুভব করেননি।


পরবর্তী রিমান্ডকালে আমার বাবাকে জানানো হয় যে সেনা সদস্যরা তার বার্তাকে তাঁদের হৃদয়ের গভীরে স্থান দিয়েছেন এবং এর শুভ প্রভাব দেশবাসী প্রত্যক্ষ করবেন।


যেহেতু ৩০-৪৫ মিনিটের বেশী কথা বলার সুযোগ আমরা পাই না, আমার বাবা সাধারণত কথা বলেই যান। আমরা তন্ময় হয়ে শুনি। সব কথা মনেও রাখতে পারি না। তবে কিছু কথা তিনি প্রায়ই আমাদেরকে বলেন, যেগুলো কারাগার থেকে বের হয়ে আসার পর আমার কানে বাজতে থাকে।
আমার বাবা চান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্ট ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রজু করা গণমামলাসমূহ যেন প্রত্যাহার করা হয়। শিক্ষায়তন যেন খুলে দেয়া হয়। তিনি মনে করেন সীমাবদ্ধভাবে হলেও ঘরোয়া রাজনীতি শুরু করতে দেয়া দরকার এবং ধাপে ধাপে তা সম্প্রসারিত করে যেন এক পর্যায়ে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করা হয়। বাবা মনে করেন দেশের সাধারণ নির্বাচনকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর থেকে এগিয়ে আনার চেষ্টা সরকরের নেয়া উচিত। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য যাতে সহনীয় রাখা যায় সেই লক্ষ্যে দেশের স্থবির অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জনে পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। নাগরিকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সরকার যেন আইএমএফ এর সাথে অসম চুক্তিতে সরকার যাতে উপনীত না হয়। বাবা মনে করেন বর্তমান সরকারের এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত যাতে সমাজের খেটে খাওয়া ও নিুবিত্ত মানুষের আর্থিক দুর্দশা লাঘব হয়।


বাবার কথাগুলোর দিকে যদি ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে বর্তমান সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সারকার এসব কাজেই মনোযোগ দিচ্ছেন। বাবার অনেক কথাই আজ বাস্তাবায়িত হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সেনা বাহিনী মানুষের মনের ভাষাটি পড়তে পেরেছেন। তাহলো ভয় দেখিয়ে শাসন করা যায় না, জয় দেখিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করা যায়, তাদের মনের শংকা ও সংশয় দূর করা যায়। এদেশের মানুষ একমাত্র গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ছাড়া অন্য যে কোন শাসন যে গ্রহন করবে না, তাও তারা নিশ্চয় অনুধাবন করতে পেরেছেন।


আমার সব সময় আফসোস হত ১৯৭১এ কেন জন্মাইনি। তাহলেতো মুক্তিযোদ্ধা হতে পারতাম।
বাবা আমাকে এক “দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের” স্বপ্ন দেখিয়েছেন। যেই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সকল রাজনৈতিক দল. সামাজিক শক্তি ও সর্বপোরি দেশের সাধারণ মানুষকে নিয়ে একটি সুষ্ঠ , নিরপেক্ষ ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করবে। এই “দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের” ফসল হবে সত্যিকার অর্থেই একটি গণতান্ত্রিক সবল বাংলাদেশ। এই যুদ্ধে অতন্দ্রপ্রহরী হবে সেনা বাহিনী যা ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধেরই ফসল।


এই “দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের” মধ্য দিয়ে বিচার হবে দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিক এবং যুদ্ধাপরাধীদের। বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে অস্ত্রের চাইতেও বড় শক্তি হিসাবে কাজ করবে জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ-সৃষ্ট সবল ও টেকসই অর্থনীতি। এবং আমি হতে পারব বাংলাদেশের “দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের” একজন মুক্তিযোদ্ধা।


বাবার কথা শুনে আমি বুঝতে পারি তিনি আজও ৫৭ বছর বয়সে কর্ণেল তাহেরের সুযোগ্য ভাই, একজন প্রকৃত দেশ প্রেমিক, একজন নীতিনিষ্ঠ শিক্ষক। কারাগারের দেয়াল তার চিন্তা শক্তিকে খর্ব করতে পারেনি।


গতকাল টেলিফোনে আমার চাচাতো ভাই শ্রাবণ আমাকে বলল, “তুই চিন্তা করিস না, মনু চাচা (আমার বাবার ডাক নাম মনু) তার পুরোনো জায়গায় ফিরে গেছেন।” আমি তখন ভাবি ১৯৭৬ সালের কথা। একটি স্বড়যন্ত্র মামলায় আমার চাচা কর্ণেল তাহেরকে ফাঁসী দেয়া হয়েছিল। আমার বাবাসহ অনেকেই সেই মামলায় বহু বছর জেল খেটেছিলেন,এই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। আমরা কি ভুলে যাচ্ছি এই সেই পরিবার যেখানে সব ভাইবোন একযোগে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল এবং চার চারটি ভাই মুক্তিযুদ্ধে তাদের অসীম অবদানের জন্য বীরোত্তসূচক খেতাব অর্জন করেছিল? আমরা কি ভুলে যাচ্ছি যে এই পরিবারের কোনো সদস্যের পক্ষে তার নিজ দেশের বিরুদ্ধে স্বড়যন্ত্র করা সম্ভব না?
শার্ল দ্য গল যখন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, সেই দেশেরই চিন্তবীদ জন পল সারতে তখন খুব সোচ্চার । দ্য গল এর সরকারের ভুলগুলোই সারতে প্রকাশ্যে তুলে ধরছিলেন। দি গলকে জিজ্ঞেস করা হয়, “আপনি কেন র্সাত্রেকে কারাগারে প্রেরণ করছেন না?” উত্তর দ্য গল বলেন “আমরা আমাদের ভলতেয়ারদের কারাগারে প্রেরণ করতে পারি না।”


আমি আমার বাবাকে বাংলাদেশের একজন ভলটেয়ার হিসেবেই ভাবি।


কয়েক বছর আগে বাবাকে আমাদের পুরো পরিবারের পক্ষ থেকে একটি সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। বাবাকে উদ্দেশ্য করা মানপত্রে আমার আরেক চাচাতো ভাই মিশু শেষ লাইনে লিখেছিল, “আকাশের তীরে ঠেকা চাঁদ, রাত সবে শুরু।”


বাবা এখন জেলে। আমার কাছে যেন মনে হচ্ছে এক অনন্তকালের রাত্রি আমরা পার হচ্ছি। তবে আমি এটাও জানি যে একটি “দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের” মধ্য দিয়ে ভোর একদিন আসবেই, পূর্ব দিগন্তে সূর্য একদিন উঠবেই। খাবরের টেবিলে তখন আমি বাবার সাথে বসে নাস্তা করব, আলোচনা করব দেশ নিয়ে।

 

সানজীব হোসেন, ড আনোয়ার হোসেনের একমাত্র পুত্র