বাংলাস্তান
দৈনিক বাংলাস্তান এর প্রধান শিরোনাম, সালতানাত এ খোদা, বাংলাস্তানের আমির, জনাব মাওলানা নাইমুল হক আমিনি দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়টির সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ ঘোষনা করেছেন।
নিচের আরেকটা শিরোনামে চোখ আটকে গেলো হঠাৎ করে, শান্তিনগর মোড়ে দুই মহিলা বোরখা না পড়ায় প্রহৃত। এ আর নতুন কী! গত ২ বছর ধরে দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে গেছে আমার। দেশের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশতো গৃহযুদ্ধেই মরলো। বেশীরভাগ হতভাগা সংখ্যালঘুরা পালালো দেশ ছেড়ে নয়তো নারায়ে তাকবিরের নীচে বেঘোড়ে দিল প্রান। অবশিষ্ঠ যা রয়ে গেল, শোনা যায় তারা নাকি ”জিজিয়া” দিয়ে থাকে, যা তাদের জীবনের নিরাপত্তা প্রদান করে। কত পরিচিত মুখ ভেজা চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল নিজ দেশ ছেড়ে, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বনধ ঘোষনা করা হয়, তখন বিশেষ দলটির ক্যাডাররা (ওরা বলে ফেদাইন) বেছে বেছে শিক্ষকদের রাতের আধারে মেরে গুম করে ফেললো। আজোব্ধি এই প্রশ্ন খুজে ফিরি আমি, একটা স্বাধীন দেশের আর্মি, পুলিশ তখন ছিলো কোথায়? কার নির্দেশ তারা তখন পালন করছিলো? পায়কারি হারে টিভি চ্যানেলগুতে অগ্নিসংযোগ করা হয় বিশেষ ২/১ টি ছাড়া। পত্রিকা অফিসেও চললো সমান তালে লুটতোরাজ। ওদের আক্রোশ ছিল যে পত্রিকাগুলোর উপর, সেগুলোকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিল। ওদের পুন্যের পাল্লাটাও ভারি হলো এই সুযোগে। কত শত বছর পর এই সুযোগ এসেছে, হেলায় ফেলে রাখা কি ঠিক?
পুন্যের পাল্লা ক্রমেই ভারি হতে থাকে। যখন সংসদে বসলো সেই দলটির বিশেষ লেবাস পরিহিত লোকেরা, যাদের খিলি পানের পিকে সংসদের দেয়াল লাল হতে থাকলো। ক্ষমতার মসনদে বসার ৭ দিনের মাথায় সংবিধান বাতিল ঘোষনা করে লেখা হয় নতুন করে। সবার প্রথম, যে কাজটা তারা করলো রাতের আধারে বোমা মেরে স্মৃতিসৌধ ও শহীদমিনারটি উড়িয়ে দিল। সাভারের মানুষ ১০ মাইল দুর থেকেও শুনলো সে শব্দ (নাকি শহীদের চিৎকার?)। নারীদের জন্য বোরখা পড়া বাধ্যতামুলক করা হল এক আইনের মাধ্যমে। বতিল ঘোষনা করা হল সমস্ত রাষ্ট্রিয় দিবস। এক দিনের ঘোষনায় ঢাকা ছাড়া বাদ বাকী সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষনা করা হয় যা গত ২ বছরের মাঝে খুলেনি, জানি ও যে খুলবে না কোন দিন। শিক্ষকদের বেশির ভাগই গায়েব কিংবা দেশ ছাড়া। জানি না কবে সেখানে জমিয়াতে উলুম টাইপের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে, সেই সাথে আরেকটা পুন্যের সাগরে ভাসবে দেশ।
একটা পরিবর্তন ইদানিং খুব চোখে পড়ে, ৫ বছর আগে যখন শান্তিনগর হতে গুলশানে কর্মস্থলে যেতাম, বাসে হরেক রকম মানুষ দেখতাম। এখন উঠলে সেইম টাইপের সবাই। সবার মুখে দাড়ি, প্যান্ট ও দেখি একটু উপরে পড়ে বৈকি। আমিই বা বাদ কেন, প্রানে তো বাচতে হবে আগে। দিন কয়েক আগে এক ভদ্রলোককে সে কী মার, মারতে মারতে নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরুতে লাগলো। উনি যতই বলতে লাগলেন, ভাইয়েরা আমার, আমি অজাতশ্নশ্র“ মার ততই বাড়তে থাকলো, কে ওদের এই কঠিন বাংলা শব্দের মানে বুঝাবে, ভয়ে আমার হাত আপনাতেই চলে যায় গালে, পরখ করে দেখি যে আমার নতুন রাখা দাড়ি ১ মুঠো লম্বা কী না, তা না হলে সে মুহুর্তে টেনে হলেও ১ মুঠো লম্বা করতেই হবে, না হলে যে রেহাই নাই, আমাকেও মার খেতে হতে পারে।
আমরা মোটেও অবাক হইনি জাতীয় সঙ্গীত আর গৌরবের জাতীয় পতাকাটাকে যখন ওরা বদলালো। আমরা তো আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম এর জন্য, যেন আজ হয় কাল হয় এমন। আল্লামা ইকবাল রচিত এক কবিতা এখন আমাদের প্রানের জাতীয় সঙ্গীত। পতাকা থেকে লাল সূর্যটা মুছে ফেলে ওখানে সাদা রং দিলো। সাদা কিছুর নিশান। নিশান অন্ধকারের, নিশান বর্বরতার, নিশান খুরের পোঁচ এর, চা পাতির কোপের, একে-৪৭ এ ঝনঝনানির, কালো বোরখার, মুঠো দাড়ির, একশ দোররার, নিশান নিস্তব্ধতার !!!
অবাক লাগে এই ভেবে যে মহান ধর্মের অনুসারি বলে নিজেদের দাবি করে এই অর্বাচিনগুলো , সেখানে কিন্তু বলা আছে এর উল্টোটা । ইসলাম জোরজবরদস্তি করে না, ভালবাসা দিয়ে, শান্তি দিয়ে আসে। কোরান শরিফে স্পষ্ট ভাবে লিখা আছে অন্য ধর্মেও প্রতি শ্রদ্ধাপোষন করার কথা, কারন ওদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখালে ওরাও তাই করবে। কিন্তু আমি ভাবি আর ভাবি এরা আসলে কোন ধর্মের অনুসারি? ইসলাম ধর্মের তো মনে হয় না।
ছেলে মেয়ে কে নিয়ে অনেক চিন্তা আমার বউ এর । ওদের স্কুলের পড়ার বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিইবা করার আছে আমার , স্কুল কলেজ অবশিষ্ঠ যা আছে সবই তো ওদের পরিচালিত। পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের ক্লাস সিক্সে পড়–য়া ছেলের বাংলা বইটা একদিন আমি হাতে নিয়েছিলাম, এ কি দেখছি আমি? আমরা পড়েছি রবিন্দ্রনাথ, নজরুল , শুকান্ত। এদেও পড়ানো হচ্ছে নাম না জানা লেখকদের জিহাদি কবিতা ও গল্প। এর চেয়ে ভাল আমার ছেলেমেয়েরা ঘরে বসে শিক্ষা নিক মানবতার। জগতের বহু নাম করা পন্ডিতের বিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ছিল না। আমি চাই না আমার সন্তানেরা বাইরের বিভিষীকাময় পরিবেশ দেখুক, চাই না বোরখা না পরায় আমার মেয়েকে কেউ চাবুক দিয়ে পেটাক, দাড়ি না রাখার কারনে ছেলেকে রাস্তায় মারধর করুক।
এর কিছুই , কোন কিছুই হতোনা যদি বঙ্গবন্ধু তখন সধারন ক্ষমা না করতেন । যদি সেদিন বিচারে এদের ফাসি হতো। এই দমবন্ধ পরিবেশে আমাদের বাচতে হতো না, যদি না প্রসিডেন্ট জিয়া এদের রাজনীতিতে পূনর্বাসিত করতেন । হতো না যদি এরশাদ সংবিধানের একটা স্তম্ভ ভেংগে ইসলামকে রাষ্ট ধর্ম না করতেন। ক্ষমতার পলাবদলে আসলেন খালেদা জিয়া, উনি থাকলেন এক ধাপ এগিয়ে, সহযোগিতার হাত বাড়িযে দিলেন এদের দিকে। আর এক নেত্রী শেখ হাসিনা নিজের সার্থে জোট বাধেন এদের সাথে । পরের কিস্তিতে আবার খালেদা আবার এরা, এবার পতাকাবাহি গাড়ীতে। বিরাট শক্তি নিয়ে আর্মি, পুলিশ , বিসিএস ক্যাডার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সব ক্ষেত্রে পরিকল্পিত ভাবে এদের দোসরদের ঢুকানো হলো। তার পর এক জগা খিচুড়ি। বছরের পর বছর ধরে ছিল এক অদ্ভুত সরকার। যার নিয়ন্ত্রনভার ছিল এদেরই হাতে, আমরা যা টের পেয়েছি এগার বছর পর, যখন ওদের বিপ্লবের শুরু। সবাইকে হটিয়ে, ঝেটিয়ে বিদায় করে এরাই এখন রাজা। যাদেও ডানায় ভর করে এরা এখন ক্ষমতায় তারাই এখন এদেও করুনার পাত্র।
এর কিছুই হতো না যদি ২০০৮ এর ১৭ অক্টোবর আমিনী যখন সব মুর্ত্তি ভাংগার ঘোষনা দিল, তখনই যদি এই কথার জন্য রাষ্ট্র মামলা করতো। কেন তখন ওদের টিকিটাও ছুতে পারেনি সরকার? সিলেটের হাবিবুর রহমান যখন তসলিমা নাসরিনের মাথার দাম নির্ধারন করলো তখনেই তাকে দেয়া যেতে পারতো উপযুক্ত শাস্তি, তা না করে তাকে করা হয়েছে উৎসাহিত। যখন বলা হলো এদেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই, মুক্তি যুদ্ধ না, হয়েছিল গৃহ যুদ্ধ, একথার জন্য এই বক্তার দলটিকে কেন নিষিদ্ধ করা হয় নি? কেন এদের তখন দেশ থেকে বিতাড়ন করা হয়নি? এই সব ধর্মান্ধের বিরূদ্ধে কথা বলতে গিয়ে চৌদ্দ বছর হয় তসলিমা নাসরিন আজ ঘর ছাড়া। আজ আমার সোনার বাংলার এই দুর্দশার জন্য দায়ি কারা? অর্বাচীন ধর্মান্ধরা , নাকি যাদের ডানায় ভর করে এরা ক্ষমতায়; তারা?
তোমরাই দায়ি, যারা বিগত দিন গুলোতে দেশ চালিয়েছ, এদের ক্ষমতায় আসার পথ মসৃন করেছ, চুপ থেকেছ অথবা এদের কে বাহবা দিয়েছ। চুপ থেকেছ যখন তসলিমা নাসরিন কে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়, যখন হুমায়ুন আজাদের উপর আক্রমন হয়। যখন সংখ্যালঘুদের করা হয় ভিটে ছাড়া, মায়ের সামনে মেয়েকে করা হয় গনধর্ষন কোথায় ছিল তখন তোমাদের বড় বড় বুলি? এদের বিষ ফনাটা তখনই যদি কেটে দেয়া হতো, তা হলে আজ এই বাংলাদেশ হতো না বাংলাস্তান। স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে করতে পারতো না হাইজ্যাক।
ধিক তোমাদেও ধিক-----।
প্রিয় পাঠক এতক্ষন যে কাহিনীটা পড়লেন তা আজ থেকে তের বছর পরের বাংলাদেশ, সেটা শুধুই আমার কল্পনা হউক এটাই কামনা করি । কামনাটা সত্যি হওয়া নির্ভর করে আপনার আমার আমাদের সবার উপর। ধর্মীয় এসব উগ্রবাদিদের প্রতিহত করতে হবে সমাজের সকল ক্ষেত্রে। আমাদের সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে, আমরা কি ইতিহাসের অংশ হতে চাই নাকি নতুন ইতিহাস গড়তে চাই।