আত্মা নিয়ে ইতং-বিতং (শেষ পর্ব)
(উৎসর্গ: গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী – আত্মায় অবিশ্বাসী একজন পরিপূর্ণ ইহজাগতিক মানুষ)
আগের পর্বের পর ...
আমরা আগের পর্বে মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতার সময় কেন সুরঙ্গ দেখা যায় তা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখবার চেষ্টা করেছিলাম। তা থেকে বোঝা যাচ্ছে সুরঙ্গ-দর্শনের মাঝে অলৌকিক বা অপার্থিব কোন ব্যাপার নেই, নেই কোন পারলৌকিক রহস্য, যা আছে তা একেবারে নিরস, নিখাঁদ বিজ্ঞান। বলা বাহুল্য, ফেলু মিত্তরের গোয়েন্দাগল্পের মত ‘সুরঙ্গ-রহস্য’ শেষ পর্যন্ত সমাধান করেছে বিজ্ঞানীরাই। শুধু রহস্য সমাধান নয়, গাণিতিক মডেল টডেল করাও সারা। শুধু তাই নয়, টানেলের পাশাপাশি কেন যীশুখ্রীষ্ট কিংবা মৃত-আত্মীয় স্বজনের দেখা যাচ্ছে তারও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, ব্যাপারটা হয়ত পুরোটাই সমাজ-সাংস্কৃতিক। যীশুখ্রীষ্টের দেখা পান তারাই, যারা দীর্ঘদিন খ্রীষ্টীয় জল-হাওয়ায় বড় হয়েছেন, বাবা মা, শিক্ষক, পাড়া-পড়শীদের কাছ থেকে ‘খ্রীষ্টীয় সবক’ পেয়েছেন। একজন হিন্দু কখনোই মরণ-প্রান্তিক অভিজ্ঞতায় খ্রীষ্টের দেখা পান না, তিনি পান বিষ্ণু, ইন্দ্র বা লক্ষীর দেখা, আর ভাগ্য খারাপ হলে ‘যমদূতের’। আবার একজন মুসলিম হয়ত সেক্ষেত্রে দর্শন লাভ করেন আজরাইল ফেরেশতার। বোঝা যাচ্ছে, ধর্মীয় ‘দিব্য দর্শন’ কোন ‘সার্জনীন সত্য’ নয়, বরং, আজন্ম লালিত ধর্মানুগত্য আর নিজ নিজ সংস্কৃতির রকমফেরে ব্যক্তিবিশেষে পরিবর্তিত হয়। কাজেই, ঈশ্বর দর্শনই বলুন আর ধর্মীয় ‘দিব্য দর্শন’-ই বলুন, এগুলোর উৎসও আসলে মানব মস্তিস্কই। দেখা গেছে মস্তিস্কের কোন কোন অংশকে উত্তেজিত করলে মানুষের পক্ষে ভুত, প্রেত, ড্রাকুলা থেকে শুরু করে শয়তান, ফেরেশতা কিংবা ঈশ্বর দর্শন সব কিছুই সম্ভব। এ ব্যাপারটা আরো বিষদভাবে বুঝতে হলে আমাদের মস্তিস্কের একটি বিশেষ অংশ –‘টেম্পোরাল লোব’ সম্বন্ধে জানতে হবে।
টেম্পোরাল লোব : মস্তিস্কের ‘গড স্পট’?
বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানী আর গবেষকের দল অনেকদিন ধরেই সন্দেহ করছিলেন, ঈশ্বর দর্শন, দিব্যদর্শন, কিংবা ওহিপ্রাপ্তির মত ধর্মীয় অভিজ্ঞতাগুলো আসলে স্রেফ মস্তিস্কসঞ্জাত। সেই ১৮৯২ সালের আমেরিকার পাঠ্যপুস্তকগুলোতেও এপিলেপ্সির সাথে ‘ধর্মীয় আবেগের’ সাযুজ্য খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছিল। ব্যাপারটা আরো ভালমত বোঝা গেল বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। ১৯৫০ সালের দিকে উইল্ডার পেনফিল্ড নামের এক নিউরোসার্জন মস্তিস্কে অস্ত্রপ্রচার করার সময় ব্রেনের মধ্যে ইলেকট্রোড ঢুকিয়ে মস্তিস্কের বিভিন্ন অংশকে বৈদ্যুতিকভাবে উদ্দীপ্ত করে রোগীদের কাছে এর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইতেন। যখন কোন রোগীর ক্ষেত্রে ‘টেম্পোরাল লোব’ (ছবিতে দেখুন)-এ ইলেক্ট্রোড ঢুকিয়ে উদ্দীপ্ত করতেন, তাদের অনেকে নানা ধরণের ‘গায়েবী আওয়াজ’ শুনতে পেতেন, যা অনেকেটা ‘দিব্য দর্শনের’ অনুরূপ ৩০। এই ব্যাপারটা আরো পরিস্কার হল, ১৯৭৫ সালে যখন বস্টোন ভেটেরান্স এডমিনিস্ট্রেশন হাসপাতালের স্নায়ু-বিশেষজ্ঞ নরমান গেসচ উইন্ড-এর গবেষণায় প্রথম বারের মত এপিলেপ্সি বা মৃগীরোগের সাথে টেম্পোরাল লোবে বৈদ্যুতিক মিসফায়ারিং-এর একটা সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেল ৩১ । একই ক্রমধারায় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ু বিশেষজ্ঞ ভিলায়ানুর এস রামাচান্দ্রণ তার গবেষণায় দেখালেন, টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি রোগীদের ক্ষেত্রেই ঈশ্বর-দর্শন, ওহি-প্রাপ্তির মত ধর্মীয় অভিজ্ঞতার আস্বাদনের সম্ভাবনা বেশি ৩২। এগুলো থেকে হয়ত অনুমান করা যায়, কেন আমাদের পরিচিত ধর্ম প্রবর্তকদের অনেকেই ‘ওহি-প্রাপ্তির’ আগে ‘ঘন্টাধ্বনি শুনতে পেতেন’, ‘গায়েবী কন্ঠস্বর শুনতে পেতেন’ , তাদের ‘কাপুনি দিয়ে জ্বর আসত’ কিংবা তারা ‘ঘন ঘন মুর্চ্ছা যেতেন’৩৩ ।
চিত্রঃ মস্তিস্কের টেম্পোরাল লোব : অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন মস্তিস্কের এই অংশটিই হয়ত ধর্মীয় প্রনোদনার মূল উৎস। এই অংশটি নিয়ে গবেষণা করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিকতার সাথে এপিলেপ্সীর জোরালো সম্পর্কও পাওয়া গেছে।
এই ধরনের গবেষণা থেকে পাওয়া ফলাফলে উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্যানাডার লরেন্টিয়ান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মাইকেল পারসিঙ্গার আরো একধাপ সাহসী গবেষণায় হাত দিলেন। তিনি ভাবলেন, টেম্পোরাল লোবে বৈদ্যুতিক তারতম্য যদি ধর্মীয় প্রণোদনার উৎস হয়েই থাকে তবে, উল্টোভাবে – মস্তিস্কের এই গোদা অংশটিকে উদ্দীপ্ত করেও তো কৃত্রিমভাবে ধর্মীয় প্রনোদনার আবেশ আস্বাদন করা সম্ভব, তাই না? হ্যা, অন্ততঃ তাত্ত্বিকভাবে তো তা সম্ভব। ডঃ পারসিঙ্গার ঠিক তাই করলেন। তিনি টেম্পোরাল লোবকে কৃত্রিম্ভাবে উদ্দীপ্ত করে ধর্মীয় আবেশ পাওয়ার জন্য তৈরী করলেন তার বিখ্যাত ‘গড হেলমেট’। এই হেলমেট মাথায় পরে বসে থাকলে নাকি ‘রিলিজিয়াস এক্সপেরিয়েন্স’ আহরণ করা সম্ভব। হেলমেট বানানোর পর অফিশিয়ালি প্রায় ছ’শ জনের উপরে হেলমেট পরিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এদের প্রায় ৮০ শতাংশ বলেছেন, তাদের এক ধরণের অপার্থিব অনুভূতি হয়েছে ৩০ । তারা অনুভব করেছেন, কোন অশরীরী কেউ (কিংবা কোন স্পিরিট) তাদের উপর নজরদারি করেছে। অনেকের অভিজ্ঞতার লাটাই এর চেয়েও গজখানেক বেশি। যেমন, এক মহিলার হেলমেট পরার পর মনে হয়েছে তিনি তার মৃত মায়ের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। আরেক মহিলার কাছে এই অশরীরী অস্তিত্ব এতটাই প্রবল ছিল যে, পরীক্ষার শেষে যখন অশরীরী আত্মা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল যে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। হেলমেট মাথায় পরার পর ব্রিটিশ সাংবাদিক আয়ান কটনের পুরো সময়টা নিজেকে তীব্বতী ভিক্ষু বলে বিভ্রম হয়েছিল। বিজ্ঞানী সুসান ব্ল্যাকমোরের অভিজ্ঞতাটাই বোধ হয় এক্ষেত্রে সবচেয়ে মজার। তিনি নিউ সায়েণ্টিস্ট পত্রিকায় নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন এভাবে ৩৪ –
“আমার হঠাৎ মনে হল কেউ আমার পা ধরে টানছে, দুমড়ে মুচড়ে নষ্ট করে দিচ্ছে।, তারপর ধাক্কা মেরে আমাকে দেওয়ালে ফেলে দিল। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত; কিন্তু ঘটনাটা ছিল দিনের আলোর মতই পরিস্কার। আমার প্রথমে প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল, পরে রাগের স্থান ক্রমান্বয়ে দখল করে নিল ভীতি...।”
অধ্যাপক ব্ল্যাকমোর পরে বলেছিলেন ৩৫, ‘পারসিঙ্গারের ল্যাবরেটরীতে আমার সঞ্চিত অভিজ্ঞতা এক কথায় অবিস্মরনীয়। পরে যদি বেরিয়ে আসে কোন প্ল্যাসিবো এফেক্টের কারনে আমি এগুলোর মধ্য দিয়ে গেছি –আমি তাহলে অবাকই হব।’
চিত্রঃ মাইকেল পারসিঙ্গার উদ্ভাবিত ‘গড হেলমেট’।
তবে সবার ক্ষেত্রেই যে ‘গড হেলমেট’ একই রকমভাবে কাজ করেছে তা কিন্তু নয়। একবার গড হেলমেটের কার্যকারীতা দেখানোর জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বিখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্সকে। ডকিন্স বিবর্তনবাদে বিষেষজ্ঞ একজন বিজ্ঞানী, পাশাপাশি সব সময়ই ধর্ম, অলৌকিকতা প্রভৃতি বিষয়ে উৎসুক। ধর্মের একজন কঠোর সমালোচক তিনি। নিজেকে কখনোই ‘নাস্তিক’ হিসেবে পরিচিত করতে পরোয়া করেন না। ঈশ্বরে বিশ্বাস তার কাছে বিভ্রান্তি বা ‘ডিলুশন’, ধর্মের ব্যাপারটা তার কাছে ‘ভাইরাস’। এহেন ব্যক্তিকে হেলমেট পরিয়ে তার মনের মধ্যে কোন ধরণের ‘ধর্মীয় ফিলিংস’ ঢোকানো যায় কিনা, এ নিয়ে অনেকেই খুব উৎসুক ছিলেন।