প্রোপাগান্ডা মেশিন
ড. বিপ্লব পালের সাম্প্রতিক লেখা ‘বিপজ্জনক ধার্মিক’ পড়লাম। ঊনি ঠিকি বলেছেন। সম্ভবতঃ অনেকে শুধুমাত্র বাংলাদেশী ই-ফোরামগুলোতে অংশগ্রহনের কারণে ভেবে থাকেন শুধুমাত্র কোরাণেই বোধ হয় আধুনিক বিজ্ঞানের তথাকথিত ‘ইঙ্গিত’ দেওয়া আছে। কারণ এ সমস্ত বাংলাদেশী ই-ফোরামগুলোতে প্রতিদিনই কারো না কারো কাছ থেকে কিছু না কিছু ‘কোরানিক সায়েন্স’ সংক্রান্ত ‘কাট-এন্ড-পেস্ট’ পোস্ট আসে। আর সে সমস্ত ই-ফোরামগুলোর মডারেটররাও উচ্ছ্বসিত হয়ে সেগুলো তাদের ফোরামে প্রকাশ করেন। এ সমস্ত পোস্টের আধিক্য আর মাত্রা দেখে হয়ত অনেকে ভেবে নিতে পারেন - অন্য ধর্মের অনুসারীরা বোধহয় তাদের ধর্মগ্রন্থের স্বপক্ষে এরকম কোন ‘প্রমাণ’ হাজির করতে পারেন নি। কিন্তু এ ধরণের চিন্তা আসলে স্রেফ অজ্ঞানতাপ্রসুত - অনেকটা কুয়োর ব্যাঙ যেরকম নিজের কুয়োকে সমুদ্র ভেবে ‘মুগ্ধ’ হয়ে থাকে – অনেকটা সেরকম।
আমি কোরাণিক সায়েন্সের বাইরের কিছু উদাহরণ হাজির করি। হিন্দু ধর্ম দিয়েই শুরু করি ; এ সম্বন্ধে একটি কথা বলা প্রয়োজন। হিন্দু ধর্মের মধ্যে এত ধরণের আকর্ষণীয় রূপকথা, অতিকথা আর উপকথার ছড়াছড়ি যে সেগুলোকে খুব সহজেই আধুনিক বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর সাথে জুড়ে দেওয়া যায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কথাই ধরুন। সেখানে এত ধরণের রাজকীয় সমস্ত অস্ত্র-সস্ত্রের বর্ণনা আছে যে ওগুলোকে খুব সহজেই আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের সাথে মিলিয়ে দেওয়া যায়। দেবতাদের ‘পুষ্পক রথ’কে বানিয়ে দেওয়া যায় ‘স্পেশসিপ’। আমি বছর চারেক আগে কলকাতা বইমেলায় গিয়ে এ ধরণের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া অনেক বই দেখেছিলাম। প্রশান্ত প্রামানিক নামে এক জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখকের বইও কিনেছিলাম, বইটার নাম ছিলো - ‘ভারতীয় দর্শনে আধুনিক বিজ্ঞান’। তিনি তার বইয়ে বলেছেন কুরু-পান্ডবদের মধ্যকার কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আসলে সে-সময়য়কার এটোমিক ওয়ার ছাড়া কিছু নয়। প্রশান্ত প্রামানিক মনে করেন, দুর্যোধনেরই কোন মিত্র শক্তি পারমাণবিক যুদ্ধে ধ্বংস হয়েছিল মহেঞ্জোদাড়োতে আর সেটাই রূপক আকারে মহাভারতে তুলে ধরা হয়েছে। শুধু তাই নয়, যে নলজাতক শিশু (test tube baby) আর বিকল্প মা (surrogate mother) কে আধুনিক বিজ্ঞানের দান মনে করা হয় তা নাকি হিন্দু সভ্যতার কাছে নাকি নতুন কিছু নয়। দ্রোণ-দ্রোনী, কৃপ-কৃপীর জন্মের পৌরাণিক কাহিনীগুলি তারই প্রমাণ। এমনকি উপসাগরীয় যুদ্ধে ব্যবহৃত স্কাড আর প্যাট্রিয়ট মিসাইল নাকি হিন্দু পুরাণে বর্ণিত ‘বরুন বাণ’ আর ‘অগ্নিবাণ’ বই কিছু নয়। এমনকি ভারতের ‘দেশ’ এর মত প্রগতিশীল পত্রিকায় ২২ এপ্রিল ১৯৯৫ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বিজ্ঞান ও ভগবান’ নামের প্রবন্ধে হৃষীকেশ সেন নামে এক লেখক বেদান্তে বর্ণিত উর্ণনাভ এর সাথে বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের মডেলের সাথে তুলনা করেছেন। ইংরেজীতেও এ ধরণের প্রচুর বই আছে। যেমন, আমি রাজা রামমোহন রায়ের একটা বই পড়েছিলাম- ‘Vedic Physics’ নামে। সেখানে লেখক দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, ঋক বেদ আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে লেখা হলেও আধুনিক বিজ্ঞানের সব কিছুই উপস্থিত! একটা কথা বলে রাখি, এই রাজা রামমোহন রায় অবশ্য কিন্তু সতীদাহ বিলোপকারী সেই প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব রাজা রামমোহন নন। ‘বেদিক সায়েন্সের’ এধরণের আরো বই বাজারে আছে। কেশভ ভার্মা, ধঞ্জয় দেশপান্ডে, বিদ্যালাথ শাস্ত্রী, অমিত গোস্বামী, দীপক চোপরা সহ অনেকেই বিভিন্ন বই লিখেছেন হিন্দু ধর্মকে ‘বৈজ্ঞানিক’ প্রমাণ করে।
ভারতের খ্যাতনামা বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা একবার মাসিক ভারতবর্ষের ‘একটি নতুন জীবন দর্শন’ (১৩ নভেম্বর, ১৯৩৮) শিরোনামের একটি প্রবন্ধে এই মানসিকতাকে কটাক্ষ করেছিলেন এই বলে -‘সবই ব্যাদে আছ’! এ নিয়ে অনিলবরণ রায় নামের এক হিন্দুবাদী ধার্মিক নরকগুলজার শুরু করলে, এর ব্যাখ্যা মেঘনাদ সাহা দিয়েছিলেন এভাবেঃ
সবই ব্যাদে আছে !
প্রায় আঠারো বৎসর পূর্বেকার কথা। আমি তখন প্রথম বিলাত হইতে ফিরিয়াছি। বৈজ্ঞানিক জগতে তখন আমার সামান্য কিছু সুনাম হইয়াছে। ঢাকা শহরবাসী লব্ধপ্রতিষ্ঠিত এক উকিল আমি কি বৈজ্ঞানিক কাজ করিয়াছি তাহা জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি উৎসাহভরে তাহাকে আমার প্রথম জীবনের তদানীন্তন গবেষণা সম্বন্ধে সবিশেষ বর্ণনা দেই। তিনি দু-এক মিনিট পরপরই বলিয়া উঠিতে লাগিলেন, ‘এ আর নতুন কি হইল, এ সমস্তই ব্যাদ এ আছে’। আমি দু একবার মৃদু আপত্তি করিবার পর বলিলাম, ‘মহাশয় এ সব তত্ত্ব বেদের কোন্ অংশে আছে তাহা অনুগ্রহ পূর্বক দেখাইয়া দিবেন কি?’ তিনি বলিলেন, ‘আমি তো ব্যাদ পড়ি নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস তোমরা নূতন বিজ্ঞানে যাহা করিয়াছ বলিয়া দাবি কর, তাহা সমস্তই 'ব্যাদে' আছে।’
বলা বাহুল্য যে, বিগত কুড়ি বৎসর ধরিয়া বেদ, উপনিষদ, পূরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্র এবং হিন্ধু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া আমি কোথাও আবিস্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীনগ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে।
অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচর্য একাদশ শতাব্দীতে অতিস্পষ্টভবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। অর্থাৎ নিউটন আর নতুন কি করিয়াছে? কিন্তু এই সমস্ত "অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী" শ্রেণীর তার্কিকগন ভুলিয়া যান যে, ভাস্করাচর্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহ সূর্যের চারিদিকে বৃত্তাভাস (elliptical) পথে ভ্রমণ করিতেছে - একথা বলেন নাই। তিনি কোথাও প্রমাণ করেন নাই যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর এবং অপরাপর গ্রহের পরিভ্রমণপথ নিরূপণ করা যায়। সুতরাং ভাস্করাচর্য বা কোন হিন্দু, গ্রীক বা আরবী পন্ডিত কেপলার, গ্যালিলিও বা নিউটনের বহুপূর্বেই মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব আবিস্কার করিয়াছেন, এইরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ বই কিছু নয়।
মৃণাল দাসগুপ্ত নামের এক খ্যাতনামা বিজ্ঞানী আছেন ভারতে। তিনি ভারতের জাতীয় বিজ্ঞান আকাদেমীর বিখ্যাত বিজ্ঞানী। উনি হচ্ছেন আসলে অনেকটা বাংলাদেশের ‘শমসের আলী’। যিনি দাবী করেন, আজ আধুনিক বিজ্ঞান যে সমস্ত নতুন তত্ত্ব ও তথ্য প্রতিদিনই আবিস্কার করছে, তার সবকিছুই নাকি প্রাচীনকালের মুণি ঋষিরা বের করে গেছেন। বেদে নাকি সে সমস্ত আবিস্কার ‘খুবই পরিস্কারভাবে’ লিপিবদ্ধ আছে। মিঃ দাসগুপ্তের ভাষায়, রবার্ট ওপেনহেইমারের মত বিজ্ঞানীও নাকি গীতার বিশ্বরূপ দর্শনে এতই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে ল্যাবরেটরীতে আণবিক শক্তির তেজ দেখে নাকি গীতা থেকে আবৃত্তি করেছিলেন-
‘দিবি সূর্য্যসহস্রস্য ভবেদ যুগপদুত্থিতা।
যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ ভাসন্তস মহাত্মনঃ’ছোটবেলায় আমার দাদু হিন্দু ধর্মের নানা গল্প করতেন আমাকে পাশে বসিয়ে। তার কাছ থেকে একটা কথা প্রায়ই শুনতাম - ‘ব্রক্ষ্মার এক মুহূর্ত নাকি পৃথিবীর সহস্র বছরের সমান’। পরে বড় হয়ে দেখলাম এই কথাটাকে হিন্দুভাববাদীরা আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের সাথে জুরে দিয়ে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থে ‘টাইম ডায়েলেশন’ থাকার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতেন। আমি নিজে দেখেছি, রামকৃষ্ণ মিশন তাদের তাদের মুখপত্র ‘উদ্বোধন’ এ এই আপ্তবাক্য উল্লেখ করে বলা শুরু করেছে যে, কৃষ্ণ গহ্বর কিংবা সময় ধারণা নাকি মোটেই নতুন কিছু নয়। হিন্দুধর্ম নাকি অনেক আগেই এগুলো জানতে পেরেছিল। হিন্দুধর্মের বিভিন্ন পুরানে সৃষ্টিমুহূর্তে যে 'সুবর্ণময় অন্ডের' উল্লেখ আছে তা নাকি আসলে 'কসমিক এগ'। এদের প্রচেষ্টা অনেকেটা বুকাইলি, মুর কিংবা হারুন ইয়াহিয়াদের মতই। আমাদের অনন্তও তার ‘ভগবদ্গীতায় বিজ্ঞান অন্বেষণ এবং অন্যান্য’ প্রবন্ধে হিন্দু বকধার্মিকদের বিভিন্ন ভন্ডামীর উল্লেখ করেছেন। প্রবন্ধটি আমাদের সাম্প্রতিক ই-বুক ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম – সঙ্ঘাত নাকি সমন্বয়’তে সংকলিত হয়েছে। কাজেই, হিন্দু ধর্মে ‘বুকাইলী টাইপ’ বিজ্ঞানের সন্ধান নাকি ‘কেহ ই’ পায় নাই – এ ব্যাপারটা হয় মিথ্যাচার নয়ত অজ্ঞানতা।
আর খ্রীস্ট ধর্মের বিজ্ঞানীরা যে কতভাবে বাইবেলকে বিজ্ঞান ‘প্রমাণ’ করার চেষ্টা করেছেন তার কোন ইয়ত্তা নেই। যেমন পদার্থ বিজ্ঞানী শ্রোডারের বইগুলো আমেরিকার বার্ন্স এন্ড নোবেলের তাকে সব সময়ই শোভা পায়। তার একটি বই হল - ''Genesis and the Big Bang: The Discovery of Harmony Between Modern Science and the Bible''. বইটা তিনি সম্ববতঃ লিখেছিলেন ১৯৯১ সালে। এর পর তিনি আরো বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন একই ভাবধারায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘The Hidden Face of God: Science Reveals the Ultimate Truth’ এবং ‘ The Science of God: The Convergence of Scientific and Biblical Wisdom’। এ সমস্ত বইয়ে শ্রোডার অংক কষে দেখানোর চেষ্টা করেছেন বাইবেলে বর্ণিত ৬ দিন আসলে মহাবিশ্বের মোট বয়সের (১৫.৭৫ বিলিয়নের) সমান। এ জন্য অবশ্য তাকে নানা ধরনের গানিতিক ফ্যাক্টর ট্যাক্টর দিনে গুণ করে কিছু ধানাই পানাই করতে হয়েছে – এই আর কি। খ্রীস্ট ধর্মে দীক্ষিত বিজ্ঞানী হুগ রসও এধরনের বিভিন্ন বই লিখেছেন। সেই ষাটের দশকে John C. Whitcomb লিখেছিলেন ‘Genesis Flood’ – নূহের আমলের মহাপ্লাবন কতখানি বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে সমর্থিত তা ‘প্রমাণ’ করে। বিজ্ঞানী – ফ্রাঙ্ক টিপলার - পদার্থবিজ্ঞানে অবদানের জন্য ইদানিং যত না বিখ্যাত, তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন খ্রীষ্টধর্মকে 'বিজ্ঞান' বানানোর জন্য। ওমেগা পয়েণ্ট নামে একটি তত্ত্ব দিয়েছেন টিপলার যা মহাসংকোচন (বিগ ক্রাঞ্চ)-এর সময় সিংগুলারিটির গানিতিক মডেলকে তুলে ধরে। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু টিপলার মনে করেন এই ওমেগা পয়েন্টই হচ্ছে ‘গড’। শুধু তাই নয়, যীশুর অলৌকিক জন্মকে (ভার্জিন বার্থ) তিনি বৈজ্ঞানিক বৈধতা দিতে চান যীশুকে বিরল xx male বানিয়ে, যীশুর পুনুরুত্থানকে ব্যারন এনিহিলেশন প্রক্রিয়ার সাথে তুলনা করেছেন, ইনকারনেশন বা অবতারকে বলেছেন বিপরীতমুখি ডিম্যাটারিলিজেশন পদ্ধতি, ইত্যাদি। এ সমস্ত রং-বেরং এর গালগপ্প নিয়েই নিয়েই তার সাম্প্রতিক বই The Physics of Christianity (2007)! বলা বাহুল্য মাইকেল শারমার, ভিক্টর স্টেংগর, লরেন্স ক্রাউস সহ অনেক বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকই টিপলারের যুক্তিকে খন্ডন করেছেন সময় সময়। ইন্টারনেটে সার্চ করলেই সেগুলো পাওয়া যায়। আবার আরেক ‘শমশের আলী’র দল তাওরাতকে বিজ্ঞানের আলোকে সত্য প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, যেমন―'' Thinking About Creation: Eternal Torah and Modern Physics, Andrew Goldfinger''। এ ধরনের আরো বই বাজারে আছে, যেমন, Brave New Judaism: When Science and Scripture Collide ইত্যাদি।
ফ্রাঙ্ক টিপলারের অনেক আগে ১৯৭৫ সালে ফ্রিজোফ কাপরা একই মানসপটে লিখেছিলেন ‘The Tao of Physics’ - প্রাচ্যের তাওইজমের সাথে বিজ্ঞানকে জুড়ে দিয়ে। চীনের প্রাচীন দার্শনিকেরা ইন এবং য়্যান (yin and yang) নামে পরস্পরবিরোধী কিন্তু একইভূত সত্ত্বার কথা বলেছিলেন – মানুষের মনে ভাল-মন্দ মিলেমিশে থাকার প্রসঙ্গে। ফ্রিজোফ কাপরা সেই ইন এবং য়্যানকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিলেন কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার জগতে – পদার্থের দ্বৈত সত্ত্বার (dual nature of matter) বর্ণনা হাজির করে – পদার্থ যেখানে কখনো কণা হিসেবে বিরাজ করে কখনো বা তরঙ্গ হিসেবে । আধুনিক পদার্থবিদ্যার শূন্যতার ধারনাকে মিলিয়ে দিয়েছেন তাওইজমের ‘চী’ (ch'i or qi)-এর সাথে। কাজেই কেউ যদি ভেবে থাকেন, ইহুদী, খ্রিস্টান, ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ, ও শিখরা তাদের ধর্মগ্রন্থের মধ্যে কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য পাননি কেবল পেয়েছেন শমশের আলী আর বুকাইলীর অনুসারীরা – তা হলে এই মিথ্যাচার কিংবা অজ্ঞতা সম্বন্ধে আর বলবার কিছু নেই।
কেইথ মুর আর বুকাইলী সম্বন্ধে যত কম বলা যায় ততই মনে হয় ভাল। বিপ্লব তার প্রবন্ধে অনেক কিছুই বলেছেন। আমিও এগুলো নিয়ে আগে অনেক লিখেছিলাম। লেবু কচলাতে কচলাতে এখন তিতা হয়ে গেছে। বুকাইলিজম অনুযায়ী, কোরানে যদি এত ‘সায়েন্টিফিক ইন্ডিকেশন’ থেকেই থাকে তবে মুসলিমরা সারাজীবন ধরে কোরাণ পড়ার পরও সেগুলো আবিস্কার করতে পারেন না কেন, তা এক বিরাট রহস্য। এ সম্বন্ধে বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী পারভেজ হুদভয় স্পষ্ট করেই তার ‘When Science Teaching Becomes A Subversive Activity’ প্রবন্ধে বলেন –
The problem with such claims to ownership is that they lack an explanation for why quantum mechanics, molecular genetics, etc., had to await discovery elsewhere. Nor is any kind of testable prediction ever made. No reason is offered as to why antibiotics, aspirin, steam engines, electricity, aircraft, or computers were not first invented by Muslims. But even to ask such questions is considered offensive.
এ ধরনের প্রশ্ন মুক্তমনা সদস্যরা মুক্তমনা শুরুর সময় থেকে করে এসছে। জাহেদ তো তার অনেক প্রবন্ধেই উল্লেখ করেছে যে,
‘সেই ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি - আমাদের কোরানেই পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান নিহিত রয়েছে। অথচ কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে কাফির নাসারারা এত উন্নতি করছে – অথচ কোরাণ গবেষণা করেও আমরা কিছুই করতে পারছি না কেন? উত্তর আসে- সঠিক আমলের অভাবে। কিন্তু আমাদের কেউ কোনদিন বলে দিলনা – ‘সঠিক আমল’ জিনিসটি আসলে কি, কিংবা বক্তা নিজেই বা কেন ‘সঠিক আমলটি অভ্যাস করে কোটি কোটি মুসলমানের দুর্দশা লাঘব করছেন না। ... কোরাণে যদি আধুনিক বিজ্ঞানের এত ইঙ্গিতই থাকে তবে প্রশ্ন আসে পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও কেন মুসলিম দেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যা এক-পঞ্চমাংশেরও কম? পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম দেশে যত বিজ্ঞানী রয়েছে অমুসলিম ইসরায়েলের রয়েছে তার চেয়ে দ্বিগুন সংখ্যক বিজ্ঞানী’।
আমি আর অপার্থিব অনেকবারই আমাদের বিভিন্ন প্রবন্ধে বলেছি যে, বিজ্ঞানের দায় পড়ে নি ধর্মগ্রন্থ থেকে সবক নিয়ে আলোর সন্ধান লাভ করতে, বরং ধর্মগুলোই জেনে গেছে, বিজ্ঞান ছাড়া তারা টিকে থাকতে পারবে না। কাজেই, নিত্য-নতুন বৈজ্ঞানিক আবিস্কারগুলোকে ধর্মগ্রন্থের সাথে জুরে দেবার জন্য ধর্মবাদীরা এখন মুখিয়ে থাকে। তবে মজার ব্যাপার হল, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মগ্রন্থে 'আধুনিক বিজ্ঞানের' সন্ধান পাওয়া যায়, বৈজ্ঞানিক আবিস্কারগুলো প্রকাশ পাওয়ার পর, তার আগে নয়। একটি ক্ষেত্রেও এর কোন ব্যতিক্রম পাওয়া যায় না, আর ব্যাপারটা মোটেও কাকতালীয় নয়।
যা হোক, আমি একটি মজার তথ্য দিয়ে লেখাটি শেষ করি। বুকাইলি আর মুরের বইয়ের পেছনে পেট্রোডলারের প্রভাব তো ছিলোই, তার সাথে ছিলো কিছু বাড়তি বোনাস! কেইথ মুর তার ‘The Developing Human" গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন, তিনি তার বইটির পেছনে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আর্থিক এবং অন্যান্য সাহায্যের কথা স্বীকার করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ‘ওসামা বিন লাদেন’। ৯/১১ এর পর তিনি তার বইয়ের সংস্করণ থেকে লাদেনের নাম উঠিয়ে দেন। কারণটি সহজেই অনুমেয়। Freethoughtmecca নামের একটি সাইটে ওই ১৯৮৩ সালের বইটির স্ক্যান করা ছবিটি সংযুক্ত ছিলো। সম্ভবত টেরোরিস্ট হুমকির কারণে ইদানিং সাইটটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে ইন্টারনেটে সার্চ দিলে বিভিন্ন লেখায় এখনো এর সন্ধান মিলে। বিপ্লবের দেওয়া ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্ণালের লেখাটির লিঙ্কেও এর বর্ণনা আছে।
তবুও কি প্রোপাগান্ডার চাকা থেমে থাকে? এ ধরণের নির্লজ্জ 'বিজ্ঞানময়' প্রোপাগান্ডার জবাব দিতে আমার প্রায়ই রুচিতে বাধে। একই লেবু আর কাঁহাতক কচলানো যায়! তবুও মাঝে মধ্যেই কলম (থুড়ি কি-বোর্ড) তুলে নিতে হয় বৈজ্ঞানিক সচেতনতা আর সামাজিক দায়িত্ববোধের কারণেই।
পাঠকদের শুভেচ্ছা।
অভিজিৎ
২৪ আগাস্ট, ২০০৮
ড. অভিজিৎ রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক। সাম্প্রতিক প্রকাশিত সম্পাদিত গ্রন্থ – ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’। সম্প্রতি 'বিজ্ঞান ও ধর্ম : সংঘাত নাকি সমন্বয়?' শীর্ষক গ্রন্থ সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত। ইমেইল : [email protected]