সমকামিতা (সমপ্রেম) কি প্রকৃতি বিরুদ্ধ? একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনঃস্তাত্বিক আলোচনা (২য় পর্ব)

অভিজি রায়

 

 

গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে :

“সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান”

প্রথম প্রকাশ:
ফেব্রুয়ারী, ২০১০

প্রকাশক:
শুদ্ধস্বর
৯১ আজিজ সুপার মার্কেট (৩য় তলা) শাহবাগ, ঢাকা।

ফোন: ০১৭১৬৫২৫৯৩৯ 
ই-মেইল: shuddhashar AT  gmail.com

বিস্তারিত এখানে।

‘সমকামিতা (সমপ্রেম) কি প্রকৃতি বিরুদ্ধ?’ প্রবন্ধটির প্রথম পর্ব প্রকাশের পর অনেক পাঠক কৌতুহলী হয়েছেন, শুধু সমকামিতা বিষয়ে নয়, আরো কিছু সংশ্লিষ্ট স্পর্শশকাতর বিষয়েও।  এর মধ্যে একজন পাঠক এই রূপান্তরকামিতা সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন বিশদভাবেভাবছি এ পর্বটিতে রূপান্তরকামিতা নিয়ে কিছু কথা বলব।  পরের পর্বে আমরা বার ফিরে যাব সমকামিতার আলোচনায়। একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। আই আইটির এক ভদ্রলোকের কথা জানতাম। খুব মেধাবী এক ছাত্র। কিন্তু পুরুষ হয়ে জন্মালে কি হবে, তিনি নিজেকে সবসময় নারী মনে করতেন।  নারীদের সাথে থাকতে বা বন্ধুত্ব করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হরতেন তিনি। ভদ্রলোকের নাম নৃসিংহ মন্ডল। দৈনিক আজকাল ১৯৯৯ সালের ১২ই আগাস্ট তাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল এই শিরোনামে- “ছয় বছর ধরে মেয়ে হতে চাইছে আই আইটির কৃতি ছাত্র”।  সনাতন চিকিসা পদ্ধতিতে মনে করা হয়, এধরনের লোকেরা নিশ্চয় মনোরোগি। ভারতের নামকরা ডাক্তারেরা তাকে পরীক্ষা করলেন, তার শরীরে হরমোনগত কোন তারতম্য চোখে পড়ল না, মানসিক বিকারের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না।  ডাক্তারেরা কি করবেন ভেবে পেলেন না।  শুধু চিকিসা ক্ষেত্রে নয়, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তৈরি হল একধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতির এবং জটিলতার।  নৃসিংহ মন্ডলও ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তিনি মানবাধিকার কমিশনের মধ্যমে নিজের “নারী হবার অধিকার” অধিকার প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন।  মেডিকেল বোর্ডের সামনে দ্বিধাহীন ভঙ্গিতে বললেন – “ছেলেবেলা থেকেই আমার মনে হত আমি ছেলে নই, মেয়ে। বাবা রেগে যেত। মা কিছু বলতেন না।

 ছেলেবেলা থেকেই মেয়েদের পোষাক পরতে পছন্দ করতাম। চিরকালই আমার ছেলেবন্ধুর চেয়ে মেয়ে বন্ধু বেশি। তাদের সঙ্গে মেলামেশা করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি”। চিকিসকেরা তাকে বোঝালেন, “একবার ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে গেলে ভবিষ্যতে কোন পরিস্থিতিতে চাইলেও আবার ছেলে হওয়া যাবে না”।  নৃসিংহের পালটা প্রশ্ন মেডিকেল বোর্ডকে – “সে পরিস্থিতি আসবে কেন? আমার যথেষ্ট বুদ্ধি-বিবেচনা আছে। আমি ভেবেচিন্তেই মেয়ে হতে চাই”। তার প্রতি প্রশ্ন ছিল – “সামাজিক অসুবিধা হতে পারে, চাকরী-বাকরীর অসুবিধা হতে পারে”। তার জবাব ছিল – “এখন স্কলারশিপ পাই। গবেষনার পরে দেশে বিদেশে চাকরী পাবই। আর সামাজিক কোন অসুবিধা আমার হবে না। আর হলেও আমার কিছু যায় আসে না” ।  আরেকটা উদাহরণ দেই। এ প্রসঙ্গে আমেরিকার পুরুষ রূপান্তরকামী জরগেন্সেনের লেখা “Christine Jorgensen: A Personal Autobiography” বইটির কথা বলা যায়।  ক্রিস্টিন জরগেন্সেনের আগের নাম ছিল জর্জ জরগেন্সেন। তিনি সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন।  তিনি নিজেকে নারী ভাবতেন। তার রূপান্তরকামী মানসিকতার জন্য চাকরী চলে যায়।  পরে ১৯৫২ সালে অস্ত্রপ্রচারের মাধ্যমে তিনি নারীতে রূপান্তরিত হন।  এ ধরনের অজস্র ঘটনার উদাহরণ হাজির করা যায়।  এগুলোর পেছনে সামাজিক ও মনস্তাত্বিক কারণকে অস্বীকার না করেও বলা যায় – এ ধরনের চাহিদা বা অভিপ্রায় প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়। আর সে জন্যই, প্রখ্যাত রূপান্তরকামী বিশেষজ্ঞ হেনরী বেঞ্জামিন বলেন, আপাত পুরুষের মধ্যে নারীর সুপ্ত সত্তা বিরাজমান থাকতে পারে। আবার আপাত নারীর মধ্যে পুরুষের অনেক বৈশিষ্ট্য সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। তিনি বলেন – “Every Adam contains the element of Eve and every Eve harbors traces of Adam, physically as well as psychologically.”  হেনরী বেঞ্জামিন  ছাড়াও  এ নিয়ে গবেষণা করেছেন রবার্ট স্টোলার, এথেল পারসন, লিওনেল ওভেসে প্রমুখ।  এদের গবেষণায় উঠে এসেছে দুই ধরনের রূপান্তররকামীতার কথা। শৈশবের প্রথমাবস্থা থেকে যাদের মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের মানুষ হবার সুতীব্র বাসনা থাকে তাদের মুখ্য রূপান্তরকামী বলা হয়। অন্যদিকে যারা দীর্ঘদিন সমকামিতায় অভ্যস্ত হয়েও নানারকম সমস্যায় পড়ে মাঝে মধ্যে নারীসুলভ ভাব অনুকরণ করার চেষ্টা করে তাদের বলে গৌন রূপান্তরকামী। ১৯৬০ সালে মনোচিকিসক ওয়ালিন্দার রূপান্তরকামীদের উপরে একটি সমীক্ষা চালান। তার এই সমীক্ষা থেকে জানা যায়, প্রতি ৩৭,০০০ এ একজন পুরুষ রূপান্তরকামীর জন্ম হচ্ছে অন্যদিকে প্রতি ১০৩,০০০-এ একজন স্ত্রী রূপান্তরকামীর জন্ম হচ্ছে। ইংল্যান্ডে এ সমীক্ষাটি চালিয়ে দেখা গেছে যে সেখানে প্রতি ৩৪,০০০ এ একজন পুরুষ রূপান্তরকামী ভূমিষ্ট হচ্ছে আর অন্যদিকে প্রতি ১০৮,০০০ এ একজন জন্ম নিচ্ছে একজন স্ত্রী রূপান্তরকামী। অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে সেখানে ২৪,০০০ পুরুষের মধ্যে একজন এবং ১৫০,০০০ নারীর মধ্যে একজন রূপান্তরকামীর জন্ম হয় ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে  দেখা যায়, জোয়ান অব আর্ক থেকে শুরু করে আজকের প্রথিতযশা জীববিজ্ঞানী জোয়ান (জনাথন) রাফগার্ডেন কিংবা বাস্কেটবল লিজেন্ড ডেনিস রডম্যান সহ অনেকের মধ্যেই যুগে যুগে রূপান্তর প্রবণতা বিদ্যমান ছিল এবং এখনো আছে২৯।  উইকিপেডিয়ার পেইজেও খ্যাতিমান রূপান্তরকামীদের একটি আংশিক তালিকা পাওয়া যাবে৩০

 

এখন কথা হচ্ছে মানবসমাজে রূপান্তরকামীতার আস্তিত্ব আছে কেন?  এ বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের ‘সেক্স’ এবং ‘জেন্ডার’ শব্দদুটির  অর্থ এবং ব্যাঞ্জনা আলাদা করে বুঝতে হবে।  সেক্স এবং জেন্ডার কিন্তু সমার্থক নয়। বাংলা ভাষায় শব্দদুটির আলাদা কোন অর্থ নেই, এদের সঠিক প্রতিশব্দও আমাদের ভাষায় অনুপস্থিত। সেক্স একটি শরীরবৃত্তিয় ধারণা।  আর জেন্ডার মুলতঃ সমাজ-মনস্তাত্বিক অবস্থা।  এই প্রসঙ্গে ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব সাইকোলজিতে’ বলা হয়েছে – 

Sex refers to the physiological, hormonal and genetic makeup (XX or XY chromosome) of an individual; Gender is a cultural category that contains roles, behaviors, rights, responsibilities, privileges and personality traits assigned by that specific culture to men and women.

 

হেনরি বেঞ্জামিন তার ‘ট্রান্সেক্সুয়াল ফেনোমেনন’ প্রবন্ধে প্রায়ই বলেছেন –

Gender is located above, and sex is bellow the belt.

 

অর্থা সোজা কথায়, সেক্স সমগ্র বিষয়টিকে 'দেহ কাঠামো' নামক ছোট্ট চৌহদ্দির মধ্যে আটকে ফেলতে চায়, যেখানে জেন্ডার বিষয়টিকে নিয়ে যেতে চায় অবারিত নীলিমায়।

 

যৌনতার শরীরবৃত্তিয় বিভাজন মেনে নিয়েও বলা যায়, সামাজিক অবস্থার (চাপের) মধ্য দিয়েই আসলে এখানে একজন নারী ‘নারী’ হয়ে উঠে, আর পুরুষ হয়ে ওঠে ‘পুরুষ’।  আমাদের রক্ষণশীল সমাজ নারী আর পুরুষের জন্য জন্মের পর থেকেই দুই ধরনের দাওয়াই বালে দেয়।  নানা রকম বিধি-নিষেধ ও অনুশাসন আরোপ করে।  পোশাক আষাক থেকে শুরু করে কথা বলার স্টাইল পর্যন্ত সবকিছুই এখানে লৈঙ্গিক বৈষম্যে নির্ধারিত হয়।  এর বাইরে পা ফেলা মানেই যেন নিজ লিঙ্গের অমর্যাদা।  কোন ছেলে একটু নরমভাবে কথা বললেই তাকে খোঁটা দেওয়া হয় ‘মেয়েলী’ বলে, আর নারীর উপর হাজারো রকম বিধি-নিষেধ আর নিয়মের পাহাড় তো আছেই।  ফলে দুই লিঙ্গকে আশ্রয় করে  তৈরি হয় দু’টি ভিন্ন বলয়।  কিন্তু সমস্যা হয় রূপান্তরকামি মানুষদের নিয়ে। এরা আরোপিত বলয়কে অতিক্রম করতে চায়।  তারা কেবল ‘যৌনাঙ্গের গঠন অনুযায়ী’ লিংগ নির্ধারনের সনাতনী প্রচলিত ধারনাকে মন থেকে মেনে নিতে পারে না।  তারা শারীরিক লিংগকে অস্বীকার করে বিপরীত লিঙ্গের সদস্য হতে চায়।  তারা মনে করে সেক্স নয়, জেন্ডার অনুযায়ী তাদের লিংগ নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন।  বস্তুতঃ বিগত কয়েক দশকে জেন্ডার সম্পর্কিত ধারণা যত ঋদ্ধ হয়েছে ততই লৈঙ্গিক বৈষম্যের প্রাচীর ভেঙে পড়ছে।  চিকিসাবিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতিতে সেক্সচেঞ্জ অস্ত্রোপ্রচারে এসেছে বিপ্লব। কানাডা, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশে রূপান্তরকামী মানুষের চাহিদাকে মূল্য দিয়ে সেক্সচেঞ্জ ওপারেশনকে আইনসিদ্ধ করা হয়েছে।  আমাদের মত সংখ্যাগরিষ্ট ষাঁড়েদের জন্য ব্যাপারটা ‘অস্বাভাবিক’ কিংবা ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ শোনালেও খোদ প্রকৃতিতেই বহু প্রজাতির মধ্যে সেক্স চেঞ্জ বা রূপান্তরপ্রবণতা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এমনি কিছু উদাহরণ পাঠকদের জন্য হাজির করিঃ

                                                                                                 

ঊত্তর আমেরিকার সমুদ্রোপুকূলে এক ধরনের ক্ষুদ্র প্রাণি খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এরা আটলাণ্টিক স্লিপার  শেল (Atlantic Slipper Shell) নামে পরিচিত। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এরা হল ক্রিপিডুলা ফরমিক্যাটা (crepidula formicata)। এই প্রজাতির পুরুষেরা একা একা ঘুরে বেড়ায়।   তারপর তারা কোন স্ত্রী সদস্যদের সংস্পর্শে আসে এবং সংগমে লিপ্ত হয়। যৌন সংসর্গের ঠিক পর পরই পুরুষদের পুরুষাংগ খসে পড়ে এবং এরা রাতারাতিও স্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরের পর এরা আর একাকী ঘুরে বেড়ায় না, বরং স্থায়ী হয়ে বসবাস করতে শুরু করে। প্রকৃতিতে পুরুষ থেকে নারীতে পরিনত হবার এ এক বিচিত্র দৃষ্টান্ত।  ক্রিপিডুলা নিয়ে গবেষণায় বেড়িয়ে এসেছে আরো নানা ধরনের বিচিত্র তথ্য।  বিজ্ঞানীরা এই এই প্রজাতির একটি সদস্যকে খুব ছোট অবস্থায় অন্য সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন। এবার পরীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, এর মধ্যে স্ত্রী জননাঙ্গের বিকাশ ঘটতে শুরু করেছে। কিন্তু যদি একে কোন পরিণত ক্রিপিডুলার সাথে রাখা হয়, তবে সে ধীরে ধীরে পুরুষে রূপান্তরিত হরে থাকে।

 

উত্তর আমেরিকার ওই একই অঞ্চলের ‘ক্লিনার ফিশ’ নামে পরিচিত এক ধরনের মাছের মধ্যে গবেষণা চালিয়ে রূপান্তরকামীতার পরিস্কার প্রমাণ পেয়েছেন।  এ মাছগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম ল্যাবারিডেস ডিমিডিয়াটাস (Laborides dimidiatus)।  এ প্রজাতির পুরুষেরা সাধারণতঃ পাঁচ থেকে দশজন স্ত্রী নিয়ে ঘর বাঁধে (নাকি ‘হারেম বাঁধে’ বলা উচি?)। কোন কারণে পুরুষ মাছটি মারা পড়লে  স্ত্রীদের মধ্যে যে কোন একজন (সম্ভবতঃ সবচেয়ে বলশালী জন) সংসার পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই দায়িত্ব গ্রহনের পর থেকেই ওই স্ত্রীমাছটির মধ্যে দৈহিক পরিবর্তন শুরু হয়ে যায়। দু সপ্তাহের মধ্যে সে পরিপূর্ণ পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে যায় (তার গর্ভাশয় ডিম্বানু উপাদন বন্ধ করে দেয়, এবং নতুন করে পুরুষাংগ গজাতে শুরু করে) এবং এবং অন্যান্য স্ত্রী মাছদের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। প্রাকৃতিক নিয়মে স্ত্রী থেকে পুরুষে রূপান্তরের এও একটি মজার দৃষ্টান্ত। রূপান্তরকামীতার উদাহরণ আছে এনিমোন (anemone) বা ‘ক্লাউন মাছ’দের (Clown Fish) মধ্যেও।  বিজ্ঞানীরা দেখেছেন সামুদ্রিক প্রবাল প্রাচীরের কাছাকাছি বেড়ে ওঠা মাছদের মধ্যে পরিবেশ এবং পরিস্থিতি অনু্যায়ী যৌনতার পরিবর্তন অতি স্বাভাবিক ঘটনা

 

চিত্রঃ এনিমোন বা ক্লাউন মাছদের মধ্যে সেক্স চেঞ্জ অতি সাধারণ একটি ঘটনা। প্রাকৃতিক ট্রান্সেক্সুয়ালিটির বাস্তব উদাহরণ।

ইউরোপিয়ান ফ্লে অয়েস্টার (European Flay Oyster) ও অস্ট্রা এডুলিস (Ostra edulis) প্রজাতির ঝিনুকেরা যৌনক্রিয়ার সময় পর্যায়ক্রমে স্ত্রী ও পুরুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বস্তুতঃ এদের একই শরীরে স্ত্রী ও পুরুষ জনন অংগের অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে।  বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, এই প্রজাতির ঝিনুকেরা পুরুষ হিসেবে যৌনজীবন শুরু করার পর ধীরে ধীরে স্ত্রীর ভূমিকায় রূপান্তরিত হয়। ইংল্যান্ডের সমুদ্র উপকূলে  এই ধরনের ঝিনুক প্রচুর পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায় যেগুলো প্রতিবছর একবার করে তাদের যৌনতার পরিবর্তন ঘটায়। কিন্তু ভূমধ্যসাগরীয়  উষ্ণ অঞ্চলে ওই একই ঝিনুকের দল প্রতি ঋতুতেই তদের যৌন রূপের পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে। নারী থেকে পুরুষ কিংবা পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরের আকছার প্রমাণ পাওয়া গেছে ইউনো মার্জিনালিস (Uno marginalis) নামের আরো একটি প্রজাতির ঝিনুকের মধ্যেও।  সামুদ্রিক পোকা বলিনিয়ার মধ্যেও এ ধরণের রূপান্তর ঘটে থাকে। যৌনতার পরিবর্তন হরহামেশাই ঘটে চলেছে কিছু মাছি, কেঁচো, মাকড়শা এবং জলজ ফ্লি ডাফনিয়াদের মধ্যেও, এমনকি এদের অনেকেই পরিবেশ ও পরিস্থিতির সু্যোগ নিয়ে  ‘যৌনপ্রজ’ থেকে ‘অযৌনপ্রজ’তেও রূপান্তরিত হয় ।

 

তাহলে এখন প্রশ্ন হল, এই সমস্ত উদাহরণ এখানে দেওয়ার উদ্দেশ্য কি? উদ্দেশ্য হল, প্রকৃতির বৈচিত্রময় জীবজগতের সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া।  সেই সাথে এটাও মনে করিয়ে দেওয়া যে ব্যাপারগুলো এত সোজাসাপ্টা নয়, যে আমরা হলফ করে বলে দিতে পারব শুধু আমরা বিষমকামীরাই প্রাকৃতিক, আর বাকীরা সব ‘বানের জলে ভাইস্যা আইছে’ । এরকম ভাবার আগে আমাদের বোঝা উচি যে, সাদা-কালো এরকম চরম সীমার মাঝে সবসময়ই কিছু ধুসর এলাকা থাকে। আর সেই ধুসর এলাকায় নির্বিঘ্নে বাস করে সমকামিতা, উভকামিতা, উভকামের সমকামিতা, রূপান্তরকামিতার মত যৌনপ্রবৃত্তিগুলো।

 

৩য় পর্ব পড়ুন...

 


ড. অভিজি রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক ইমেইল : [email protected]