সমকামিতা (সমপ্রেম) কি প্রকৃতি বিরুদ্ধ? একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনঃস্তাত্বিক আলোচনা (৪র্থ পর্ব)
আগের পর্বের পর ...
যৌনতা মানব-জীবনের অত্যন্ত গোপনীয় দিক। মানুষের ‘প্রাইভেট-লাইফ’-এর সাথে এর নিবিড় সম্পর্ক। ফলে প্রকাশ্যে যৌনতা নিয়ে আমরা আলোচনা করি না। নানাভাবে ব্যাপারটা এড়িয়ে চলি। কখনো বোধ করি অস্বস্তি। সে সজন্য যৌনতা নিয়ে ভাল কোন গবেষণা আঠারো শতকের আগে শুরুই হয়নি, যদিও রগরগে ‘সেক্স ম্যানুয়াল’-এর অভাব সমাজে কখনোই ছিল না। বাৎসায়নের কামসূত্রের কথা তো আমরা সবাই জানি। এটি লেখা হয়েছিল বোধ হয় সেই দ্বিতীয় খ্রীষ্টাব্দে। তারও আগে ছিল রোমান কবি অভিডের (Ovid) লেখা ‘আরস আমাতোরিয়া’ বা ‘Arts of Love’। এছারা ১১৭২ খ্রীষ্টাব্দে লেখা ভারতীয় লাভ ম্যানুয়াল ‘অনঙ্গ রাঙ্গা’ কিঙ্গা গ্রীক ‘এলিফান্তিস’-এর কথাও হয়ত অনেকে জানেন। এগুলোতে নানাপদের আশন-কুশন আর ‘ক্যামনে স্ত্রীকে বশে রাখবেন’ – এ নিয়ে রগরগে উপাদান আছে ঢের, কিন্তু এগুলোর কোনটিতেই যৌনতা বিষয়টিকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার দৃষ্টিকোন থেকে দেখা হয়নি।
যৌনতার উপর প্রাথমিক গবেষণা বলতে আমরা অনেকে ফ্রয়েডের গবেষণাই বুঝে থাকি, যদিও ফ্রয়েডেরও আগে রিচার্ড ফ্রেইহার এ নিয়ে কিছু কাজ করেছিলেন। ফ্রেইহার যৌনতার বিভিন্নরূপকে লিপিবদ্ধ করে ১৮৮৬ সালে ‘সাইকোপ্যাথিয়া সেক্সুয়ালিস’ নামে ল্যাটিন ভাষায় একটি বই লিখেছিলেন । বিশ শতকের প্রথম দিকে সিগমুন্ড ফ্রয়েড তার বিভিন্ন মক্কেলদের সাথে কথোপকথোন এবং তাদের যৌন জীবনের বিভিন্ন ঘটনা অধ্যয়নের ভিত্তিতে যৌনতার যে তত্ত্ব প্রদান করেছিলেন তার প্রভাব পরবর্তী কয়েক দশক ধরে বজায় ছিল। তবে পরবর্তীতে ফ্রয়েডের অনেক গবেষণাই ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। যেমন, কোন আবদ্ধ পরিবারে বাবার দূরে থাকার কারণে কোন ছেলে কেন সমকামীমনোভাবাপন্ন হয়ে উঠতে পারে তা ব্যাখ্যা করতে দিয়ে ফ্রয়েড বলেন, ছেলেটি ‘ইদিপাস কম্পলেক্স’ থেকে মুক্ত হতে চাচ্ছে। আবার একই পরিস্থিতিতে একটি মেয়েশিশু কেন সমকামী হয়ে উঠতে পারে তা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যা হল, এতে থাকে তার প্রতি তার মার অবচেতন ঘৃণা (unconscious hatred of their mothers) কিংবা তার ভাইয়ের লিঙ্গের প্রতি ঈর্ষা (envy of a brother’s penis)। ফ্রয়েডের এ ধরণের ব্যাখ্যাকে ‘বৈজ্ঞানিক’ না বলে এখন ‘ফ্রয়েডীয় কুসংস্কার’ বলাই শ্রেয়। ড. হুমায়ুন আজাদ তার ‘নারী’ গ্রন্থে এধরণের ফ্রয়েডীয় কুসংস্কার সম্বন্ধে বলেছেন২৭,
‘...[নারী সম্পর্কে] ফ্রয়েডের সমস্ত সিদ্ধান্ত এখন গন্য হচ্ছে অবৈজ্ঞানিক বলে; শুধু অবৈজ্ঞানিক নয়, চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীলও : একরাশ পিতৃতান্ত্রিক, গোত্রীয় ও ব্যক্তিগত কুসংস্কার পেশ করেছিলেন মনোবিশ্লেষনরূপে। ফ্রয়েড যখন উদ্ঘাটন ও প্রকাশ করে চলেছিলেন মনের ‘অদৃশ্য’ সূত্র, শোনাচ্ছিলেন লিবিডো, অহম, অবচেতনা, ইডিপাস-ইলেক্ট্রা গূঢ়ৈষা, শিশ্নাসূয়ার পূরাণ; কামকে করে তুলেছিলেন বিশ শতকের আল্লা ... ফ্রয়েডের মানুষধারনাকেই ভুল মনে হয় আজ; পিতৃতন্ত্রের, গোত্রের ও নিজের দুঃস্বপ্ন মানুষ নামে তিনি উপস্থিত করেছিলেন বিজ্ঞানের মুখোশ পরিয়ে।’
ড. হুমায়ুন আজাদের কথায় আবেগের আতিশয্য থাকলেও অতিশয়োক্তি নেই কোথাও। তবে তারপরও বলতে হয়, ফ্রয়েডর গুরুত্ব এখানেই যে তিনিই প্রথম যৌনতা নিয়ে প্রথাগত গবেষনার দ্বার উন্মোচন করেছিলেন।
প্রথাগত বলা হল এ করাণে যে, এই ধরনের গবেষনার অনেক আগেই আঠারো শতক থেকেই – কিছু দার্শনিক সমকামিতার ব্যাপারে নিজেদের ব্যক্তিগত অভিমত জানিয়েছিলেন। যেমন দার্শনিক ভলটেয়ারের (১৬৯৪ -১৭৭৮) কথা বলা যায়। ভলটেয়ার ১৭৬৪ সালে লেখা একটি প্রবন্ধে সমকামিতাকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ অনৈতিক প্রবৃত্তি বলে অভিহিত করেছিলেন; কিন্তু আবার এই আচরণের ব্যাপক প্রসার দেখে বিস্মিতও হয়েছিলেন৭। তিনি মনে করতেন, এই মানসিকতার উপর মানুষের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে কিংবা ‘গড়ম বেশী পড়লে’ সমকামিতার প্রকোপ বৃদ্ধি পায় বলে তিনি ভাবতেন। আরেক ফরাসী দার্শনিক রুশো (১৭১২ -১৭৭৮) মনে করতেন সমকামিতা মুলতঃ এসেছে আরব দেশগুলো থেকে। তবে যেহেতু সারা পৃথিবীর সকল দেশেই সমকামিতা ছড়িয়ে গেছে, তাই এর অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়াই সঙ্গত।
সমকামিতা সম্বন্ধে সরাসরি কিছু না বললেও ফরাসী চিন্তাবিদ দিদেরোর (১৭১৩-১৭৮৪) দৃষ্টিভংগী পরবর্তীতে সমকামীদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভংগি পাল্টাতে সাহায্য করেছিল। তিনি মানুষের যৌন প্রবৃত্তি নিয়ে অহেতুক নীতি কপচানোর ব্যাপারে চার্চের ভূমিকার সমালোচনা করেন। দিদেরোর মতামতকে গ্রহণ করে নিয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন সাহিত্যিক ও দার্শনিক চার্চের অসহিষ্ণু মনোভাবের নিন্দা করেছেন। এর মধ্যে ফরাসী সাহিত্যিক মার্কুইস দে সাদ এবং এমিল জোলার কথা আলাদা করে বলা যায়। এরা সমকামী মনোবৃত্তিকে জন্মগত বলে মত দিয়েছেন, এবং এও বলেছেন, এই মানসিকতাকে পরিত্যাগ করা যায় না।
এখন তো বলা যায়, সমকামিতা নিয়ে শরীরবৃত্তীয় এবং মনস্তাত্বিক গবেষণা শুরু হয়েছে অনেকদিন ধরেই। শুধু সমকামিতা নয়, পাশাপাশি রূপান্তরকামিতা, উভকামিতা এবং অপরাপর যৌনপ্রবৃত্তি নিয়েও সামগ্রিকভাবে গবেষণা হচ্ছে ঢের। এর ফলে যে যৌন-প্রবৃত্তিগুলো একসময় নিকষ অন্ধকারের কালো চাঁদরে ঢাকা ছিল, তা ধীরে ধীরে উঠে আসতে থাকে দিনের আলোতে। সমকামিতা নিয়ে যে দু’জনের গবেষনার কথা না বললেই নয়, তারা হলেন ব্রিটিশ ডাক্তার হেনরি হ্যাভলক এলিস (১৮৫৯-১৯৩৯) এবং জার্মান মনোবিজ্ঞানী ম্যাগনাস হার্চফিল্ড (১৮৬৪ - ১৯৩৫)। নিজে সমকামী না হলেও হ্যাভলক এলিসের স্ত্রী ছিলেন সমকামী। ফলে তিনি খুব কাছ থেকে সমকামি জীবন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমকামীতার আইনী স্বীকৃতির আগে সামাজিকভাবে এই মানসিকতাসম্পন্ন মানুষদের মেনে নেওয়া প্রয়োজন। ১৮৯৭ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘Sexual Inversion’ নামের একটি গ্রন্থ, আর তারপর ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘Psychology of Sex’। এলিস যে সময় এ ধরণের গবেষণা শুরু করেছিলেন সে সময়টায় ইংল্যান্ড ছিল পুরোমাত্রায় রক্ষণশীল। ফলে গবেষণা করতে গিয়ে এলিসকে দুরবিসহ অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। তার প্রথম বই প্রকাশের পর বইয়ের সবগুলো কপি পুড়িয়ে ফেলা হয়। প্রকাশককে পেতে হয় কঠিন শাস্তি। পরে তার গবেষণাকাজের অধিকাংশই আমেরিকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।
চিত্রঃ ম্যাগনাস হার্চফিল্ড- জার্মানীর গবেষক এবং মানবাধিকারকর্মী।
সমকামিতার গবেষনায় আরেকজন গবেষক -যার গুরুত্ব অপরিসীম তিনি হলেন জার্মানীর মনোবিজ্ঞানী ম্যাগনাস হার্চফিল্ড। তিনি সমকামীদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ নামে অভিহিত করে সমাজে বিদ্যমান লিঙ্গ সংক্রান্ত সনাতন ধারনা খন্ডন করতে প্রয়াসী হন। শুধু গবেষনাই নয়, তিনি সে সময় ‘সায়েন্টিফিক এন্ড হিউম্যানিটেরিয়ান কমিটি’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। হার্চফিল্ড ছিলেন যুক্তিনিষ্ঠ একজন মানুষ। তিনি যুক্তিনির্ভর কথা বলতেন এবং সব ধরনের বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা এবং বক্তব্যকে স্বাগত জানাতেন। সমকামিতার নানান দিক বিশ্লেষণ করার জন্য তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, মনোবিজ্ঞানী, নৃতাত্ত্বিক
এবং আইনজ্ঞদের তাঁর সংস্থায় স্থান করে দিয়েছিলেন। তার কমিটির শ্লোগান ছিল – ‘জাস্টিস থ্রু সায়েন্স’। বস্তুতঃ এই সংস্থার উদ্যোগে জার্মানীতে প্রথমবারের মত বৈজ্ঞানিকভাবে সমকামী মানসিকতার কারণ নির্ণয় করা শুরু হয়। শুধু তাই নয়, সমকামিতার আইনী স্বীকৃতির ব্যাপারে এই সংস্থা সচেষ্ট হয়। অখনকার জার্মান ফৌজদারী দন্ডবিধির ১৭৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সমকামিতা বিষয়ক আইন সংশোধনের জন্য হার্চফিল্ড পাঁচ হাজার বুদ্ধিজীবীর স্বাক্ষর সম্বলিত দরখাস্ত সরকারের কাছে পেশ করেন। ১৯১৩ সাল থেকে সহযোগী গবেষক ইভান ব্লোচের সাথে মিলে সমকামী মানুষদের সুষ্ঠু পুনর্বাসন এবং যৌনতা সম্বন্ধে দৃষ্টিভংগী পাল্টানো্র জন্য আন্দোলন গড়ে তুলেন, এবং এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ‘Institut für Sexualwissenschaft’ নামে আরেকটি সংগঠনও গড়ে তুলেন। ১৯৩৩ সালে নাৎসীরা ক্ষমতায় এসে হার্চফিল্ডের কাজ বন্ধ করে দেয় এবং এই প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। হার্চফিল্ড এবং সমমনা সমস্ত লেখকদের বই পত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আজকে ইন্টারনেটে নাৎসী বাহিনীর বই-পোড়ানোর যে সমস্ত ছবি পাওয়া যায়, তার অধিকাংশই আসলে হার্চফিল্ডের বিভিন্ন লাইব্রেরীর ২৮।
চিত্রঃ নাৎসী বাহিনী ১৯৩৩ সালে ক্ষমতা দখলের পর হার্চফিল্ড এবং সমমনা সমস্ত লেখকদের বই পত্র পুড়িয়ে দেয়।
এত কিছু করেও কিন্তু এ সংক্রান্ত গবেষণা থামিয়ে রাখা যায় নি। ফার্ডিন্যান্ড হ্যাক, এডিংটন সায়মন্ডস, ইভান ব্লোচ, ক্লারা থমসন, থিডর হেনরিখ, ইরভিং বেইবার, অটো গ্রস, হুকার, মিলার, স্কোফিল্ড, হেনরি বেঞ্জামিন প্রমুখ গবেষকের বহুমুখী গবেষণা গহীন আঁধার থেকে সমকামিতাকে নিয়ে আসল দিনের আলোয়। এদের মত গবেষকদের জন্যই সহমর্মিতা আর সহিষ্ণুতার ঢেউ এসে লাগে সমাজে। একদিন যাদের অচ্ছুৎ বলে গন্য করা হত, দেখা হত সমাজের ‘নিকৃষ্টতম জীব’ হিসবে, তাদের প্রতি বাড়িয়ে দেওয়া হল সাহায্যের হাত। সারা পৃথিবী জুড়ে বহুসংগঠন গড়ে উঠল এই সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক মানুষদের সাহায্য করার এবং তাদের মানবিক অধিকার রক্ষার তাগিদে। রক্ষণশীলতা, প্রগতিশীলতা, বিজ্ঞান ও বাস্তবতার প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ আর প্রতিসংঘর্ষে একটা সময় যৌনতা সংক্তান্ত সনাতন ধারনাই গেল পালটে। পৃথিবীতে শিল্প বিপ্লব, প্রযুক্তির বিপ্লব, এনলাইটমেন্টের পাশাপাশি হাত ধরে বিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করল ‘যৌনতার বিপ্লব’ – যা মানুষের যৌণতাসংক্রান্ত সামাজিক এবং মনঃস্তাত্বিক ধ্যান ধারণাকেই আমূলভাবে পালটে দিল। আর যে ব্যক্তিটির গবেষণা এই যৌনতার বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রানীবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আলফ্রেড কিন্সে (১৮৯৪ -১৯৫৬)।
কথিত আছে, প্রকৃতিপ্রেমিক এই তরুণ প্রফেসর কিন্সে গল ওয়াস্প নামে একধরনের বোলতার উপর ক্লাসে একদিন লেকচার দিচ্ছিলেন। সেখান থেকে আলোচনা কোন একভাবে চলে গেল বোলতাদের যৌনপ্রবৃত্তির দিকে। ক্লাসের অনেক ছাত্র সুযোগ পেয়ে এ সময় নানাধরনের প্রশ্ন করা শুরু করল। কখনও বা তা চলে গেল চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মানুষের যৌনপ্রবৃত্তির দিকেও। কিন্সে তার জীববিজ্ঞানের সীমিত জ্ঞানের আলোকে ছাত্র-ছাত্রীদের কৌতুহল মেটাতে থাকলেন। পুরো ক্লাস পরিণত হল এক ‘সরস’ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এমনকি এর জের পুরোমাত্রায় বজায় রইল ক্লাসের বাইরেও। অনেক ছাত্র-ছাত্রী কিন্সের কক্ষে এসে ব্যক্তিগতভাবে যৌনতা বিষয়ে নানা ধরণের পরামর্শ চাওয়া শুরু করল। কিন্সে দেখলেন, এই বিষয়টি নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ রয়েছে প্রচুর, কিন্তু পুরো বিষয়টিকে ঢেকে রাখা হয়েছে নীতি-নৈতিকতার অদৃশ্য কালো চাঁদরে। কিন্সে বুঝতে পারলেন, ‘সেক্স নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা না করার’ এই চিরায়ত সনাতনী প্রথাটা যে করেই হোক ভাংতে হবে। তিনি ছাত্রদের ডীনের কাছে ধর্না দিলেন, এবং ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যৌনশিক্ষার একটি কোর্স চালু করার পক্ষে ওকালতি শুরু করলেন। বললেন, ছাত্র-ছাত্রীরা যে হারে (রসময়গুপ্ত মার্কা) চটি বই পড়ে সেক্স সম্বন্ধে ভুল ভাল ধারণা পাচ্ছে, তার থেকে আমরা একাডেমিকভাবে কিছু পড়াই না কেন! কিন্সে শেষ পর্যন্ত তার আবেদন মঞ্জুর করিয়ে ছাড়লেন। তিনি ফুল হাউজ অডিটোরিয়ামে একাডেমিকভাবে প্রথম ‘সেক্স কোর্স’ –এর উপর ক্লাশ নিতে শুরু করলেন। তবে সে ক্লাস উন্মুক্ত ছিল কেবল শিক্ষকবৃন্দ, গ্র্যাজুয়েট কিংবা সিনয়র ছাত্র, কিংবা বিবাহিত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। কিন্সে আগের মতই ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কৌতুহল মিটাতে লাগলেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে খুব আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, মানুষের যৌনপ্রবৃত্তি এবং যৌনজীবনের উপর বিজ্ঞানভিত্তিক কোন ভাল সমীক্ষাই বাজারে নেই। ফলে একটা সময় কিন্সের নিজেকেই যৌনপ্রবৃত্তি নিয়ে গবেষণায় নামতে হল। সম্পূর্ন ব্যক্তিগত উদ্যোগে সমীক্ষার প্রয়োজনে প্রশ্নাবলী তৈরি করলেন, এবং দীর্ঘ সময় ধরে এ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। সম্পুর্ণ নিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবে এ গবেষণা চালিয়ে ১৯৪৮ সালে লিখলেন ‘Sexual Behavior in the Human Male’ নামে একটি যুগান্তকারী বই; এবং এর পাঁচ বছর পর ১৯৫৩ সালে বের করেন ‘Sexual Behavior in the Human Female’। গ্রন্থদুটির মধ্য দিয়ে মানব জীবনের এমন কিছু দিক উন্মোচিত হল যা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য নতুন, এবং অনেকের কাছেই খুব ‘অস্বস্তিকর’। এমনকি এসব তথ্য দেখে কিন্সে নিজেও খুব বিস্মিত হয়েছিলেন। সেই পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই কিন্সের গবেষণা থেকে বেরিয়ে এল, মানুষকে সামাজিকভাবে কেবল বিষমকামী বলা একেবারেই ঠিক নয়, বহু মানুষ আছে যারা যৌনপ্রবৃত্তিগত দিক দিয়ে সমকামী। শুধু তাই নয়, তিনি বললেন, যৌনপ্রবৃত্তিকে কেবল বিষমকাম আর সমকাম – মোটা দাগে এই দু’ভাগ করাটাও বোকামী। যৌনতার সম্পুর্ণ ক্যানভাসকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পরিমাপ করার জন্য কিন্সে উদ্ভাবন করলেন তার বিখ্যাত ‘কিন্সে স্কেল’। এ স্কেল সমন্ধে কিন্সে তার বইয়ে বলেন ১২,
‘পুরো জনসমষ্টিকে কেবল হোমোসেক্সুয়াল আর হেটারোসেক্সুয়াল – এ দুই নির্দিষ্ট ভুবনের বাসিন্দা মনে করা ভুল হবে। পৃথিবীটা কেবল – ছাগল আর ভেড়ায় বিভক্ত নয়। প্রকৃতিতে খুব কম ক্ষেত্রেই এ ধরণের চরমসীমার রাজত্ব দেখা যায়, এর চেয়ে বরং এখানে থাকে বিবিধ উপাদানের সুষম বন্টন।’
কিন্সের স্কেলেটি নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। স্কেলের দুই প্রান্তকে ‘০’ এবং ‘৬’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। ০ দাগে অবস্থিত ব্যক্তিরা পরিপূর্ণভাবে বিষমকামী, আর ৬ দাগে অবস্থিত ব্যক্তিরা সম্পুর্ণভাবে সমকামী। দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী অবস্থা পাঁচটিভাগে বিভক্ত; এবং ওই পাঁচটি অবস্থার মধ্য দিয়ে যৌনতার যে রূপ প্রতিভাত হচ্ছে তাকে উভকামিতা বলাই শ্রেয়, যদিও উভকামিতার রকমফের আছে। নীচের ছকটি দেখলে এ সম্বন্ধে আরেকটু ভাল বোঝা যাবে :
রেটিং
বর্ণনা
০
পরিপুর্ণভাবে বিষমকামী
১
মূখ্যত বিষমকামী, কদাচিৎ সমকামী
২
মূখ্যত বিষমকামী, কিন্তু প্রায়শই সমকামী
৩
বিষমকামিতা এবং সমকামিতার প্রভাব সমান
৪
মূখ্যত সমকামী, কিন্তু প্রায়শই বিষমকামী
৫
মূখ্যত সমকামী, কদাচিৎ বিষমকামী
৬
পরিপুর্ণভাবে সমকামী
X
অযৌনপ্রজ (Asexual)
উপরের ছকটি কিন্সের স্কেলের সারমর্ম বলা যেতে পারে, যদিও কিন্সে বইটি লিখার সময় অযৌনপ্রজদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন নি। এটি স্কেলে অন্তর্ভুক্ত হয় পরে। আগেই বলা হয়েছে ‘০’ দাগাঙ্কিত কক্ষটি থাকে পরিপুর্ণভাবে বিষমকামীদের দখলে। এই কক্ষে থাকা লোকেরা কখনোই সমকামের সাথে যুক্ত হয় না। ‘১’ চিহ্নিত কক্ষে অবস্থানরত ব্যক্তিরা মূলতঃ বিষমকামী হওয়া সত্ত্বেও কালেভদ্রে সমকামিতার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। এরা পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে কিংবা কৌতুহলবশতঃ হঠাৎ করে সমকামী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেও এর সাথে কোন গভীর মানসিক সম্পর্ক গড়ে উঠে না। ‘২’ চিহ্নিত কক্ষের লোকেরা প্রবৃত্তিগত দিক দিয়ে এদের মতই, কিন্তু এদের সমকামী প্রবণতা আরেকটু বেশি ; কিন্তু তারপরও তা কখনোই বিষমকামীতাকে ছাপিয়ে যায় না। ‘৩’ নম্বর কক্ষের আধিবাসীরা হয়ত সত্যিকার উভকামী। এদের সম্পর্কে কিন্সে বলেন ১২, ‘তারা সমানভাবে দুই ধরণের সংশ্রবই গ্রহণ এবং উপভোগ করে থাকে। কোনটির উপরেই তাদের কোন নির্দিষ্ট পক্ষপাতিত্ব নেই।’ ‘৪’ নং কক্ষের সদস্যরা সমকামী হওয়া সত্ত্বেও প্রায়ই বিষমকামের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। একইভাবে ‘৫’ নং কক্ষে এমন কিছু মানুষের সন্ধান মিলবে যারা সমকামী হয়েও মাঝে মধ্যে কিংবা কদাচিৎ বিষমকামে জড়িয়ে পড়ে। ‘৬’ নং কক্ষের বাসিন্দারা পরিপূর্ণ সমাকামী। ছকটি ভালভাবে দেখলে বোঝা যায় যে, ০ এবং ৬ বিপরীত মেরুতে। তেমনিভাবে ১ এবং ৫ পরস্পরের বিপরীত। ঠিক একইভাবে ২ এর বিপরীতে ৪ এর অবস্থান। অর্থাৎ, ০ এবং ৬ –এই চরমসীমা বাদ দিলে বাকী পাঁচটি কক্ষের অধিবাসীরা কমবেশি উভকামী।
চিত্র : কিন্সে স্কেল থেকে বোঝা যায়, যৌনপ্রবৃত্তিকে কেবল হোমোসেক্সুয়াল আর হেটারোসেক্সুয়াল – এ দুই ভাগে ভাগ করা ভুল হবে ।
যৌনপ্রবৃত্তি নিয়ে কিন্সের যুগান্তকারী গবেষণা বই আকারে প্রকাশের পর পরই ড. কিন্সে তৎক্ষনাৎ সেলিব্রিটিতে পরিণত হয়ে গেলেন। ১৯৫৩ সালের অগাস্টের ২৪ তারিখে ড. কিন্সেকে নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন বের হল, এবং তাতে লেখা হল – ‘কিন্সে সেক্সের ক্ষেত্রে সেই কাজটিই করলেন যে কাজটি অনেকদিন আগে কোপার্নিকাস করেছিলেন পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে’। এমনকি তাকে নিয়ে একটি কমিক বই পর্যন্ত বাজারে বের হয়ে গেল – “ওহ! ড. কিন্সে’। মার্থা রে’র লেখা এই কমিক বই-এর বিক্রি সে সময়ই আধা মিলিয়নে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
কিন্সে তাঁর যুগান্তকারী গবেষণার মাধ্যমে নতুন ধারা তৈরি করার পর আরো বহু গবেষক এ ধরনের কাজে এগিয়ে এলেন। এর মধ্যে সান্ড্রা বেম, জ্যানেট স্পেন্সর, রবার্ট হেলম্রিখ প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। সারা পৃথিবী জুড়ে যৌণ মনোবিজ্ঞানীদের নানা পদের গবেষণায় নতুন নতুন তত্ত্বের আগমন ঘটতে লাগল। এর সাথে যোগ দিলেন জীববিজ্ঞানীরাও। মনঃস্তাত্বিক, আচরণগত, সমাজ-সাংস্কৃতিক, এবং যৌন অভিজ্ঞতার পাশাপাশি জেনেটিক, কগনিটিভ, হরমোনাল, শরীরবৃত্তিয়, মস্তিস্ককেন্দ্রিক এবং বিবর্তনীয় নানা রকমের গবেষনা যৌনপ্রবৃত্তির নানা আকর্ষণীয় দিক উন্মোচন করে চলল। প্রতিদিনই নতুন নতুন জ্ঞানের আলোকে আমরা ঝালাই করে নিতে থাকলাম আমাদের পরিপার্শ্বিকতাকে।
চিত্র : টাইম ম্যাগাজিনের (আগাস্ট ২৪, ১৯৫৩) প্রচ্ছদে ড. কিন্সে
১৯৮০ সালে ক্যানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল স্টর্মস এর একটি গবেষণা পত্রে মত প্রকাশ করলেন২৬, যৌন প্রবৃত্তি নির্ধারিত হওয়া উচিৎ কোন ব্যক্তির ফ্যান্টাসি এবং কামপ্রবণতার (eroticism) উপর নির্ভর করে, কারো দৈনন্দিন যৌনকর্মের উপর ভিত্তি করে নয়। তিনি দেখালেন, কোন কোন সময় উভকামীর ফ্যান্টাসির জগৎটা এমনভাবে আচ্ছন্ন থাকে যে, তা কেবলমাত্র পরিপূর্ণ বিষমকামের সাথেই তুলনীয়। আবার বিপরীত ছবিটাও কখনো সখনো প্রকট হয়ে উঠে। অর্থাৎ, উভকামীর মধ্যে দেখা দিতে পারে তীব্র সমকামিতার প্রকাশ।
এরপর ১৯৮৫ সালে ফ্রিৎস ক্লেইন তার সহযোগী সেপেকফ এবং উলফের সাথে মিলে যৌনতা পরিমাপের একটু ভিন্নধর্মী স্কেল উদ্ভাবন করেন; একে ‘Klein Sexual Orientation Grid’ নামে অভিহিত করা হয়। কিন্সের স্কেলটি ছিল সরল রৈখিক এবং একমাত্রার। ক্লেইন একে দ্বিমাত্রার ম্যাট্রিক্স আকারে প্রকাশ করেন। তিনি যৌনতাকে স্থবির নয়, বরং ‘গতিশীল’ এবং ‘বহু চলক সমৃদ্ধ’ জটিল ব্যাপার বলে মনে করেন। তিনি তার ক্লেইন-স্কেল নির্মাণের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যোগ করেন এবং মত প্রকাশ করেন - যৌনতার ব্যাপারটি পুরোপুরি বুঝতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন; এগুলো হল, যৌনপ্রবৃত্তি, যৌণ আচরণ, যৌন আকর্ষণ, যৌনতা সম্বন্ধে ফ্যান্টাসি, আবেগ, যৌন সঙ্গী, জীবন ধারা, সেলফ আইডেন্টিফিকেশন ইত্যাদি। এইভাবে নতুন-নতুন গবেষণায় প্রতিনিয়ত উন্মোচিত হতে থাকে যৌনতা বিষয়ক নানান দিক। তবে তারপরও কিন্সের গুরুত্ব কখনোই ম্লান হয়নি। বরং বলা যেতে পারে, যৌনতা বিষয়ে সমস্ত গবেষণার ভিত হিসেবে কিন্সের গবেষণাকে চিহ্নিত করা হয়। সেজন্য কিন্সের গবেষণার প্রায় ষাট বছর পরে আজও গবেষক রবার্ট এপস্টেইন সায়েণ্টিফিক আমেরিকান মাইন্ডের একটি প্রবন্ধে (২০০৬) লেখেন :
“Ever since the late 1940s, when biologist Alfred Kinsey published his extensive reports on sexual practices in the U.S., it has been clear, as Kinsey put it, that people “do not represent two discrete populations, heterosexual and homosexual....The living world is a continuum in each and every one of its aspects.” A recent position statement by the APA, the American Academy of Pediatrics and eight other national organizations agrees that “sexual orientation falls along a continuum.” In other words, sexual attraction is simply not a black-and-white matter, and the labels “straight” and “gay” do not capture the complexities.”
যৌনপ্রবৃত্তি যে কেবল সাদা- কালো এই দুই চরমসীমায় বিভক্ত নয় – মানব সমাজে এই চিন্তা-চেতনার ক্রমোত্তরণ ঘটানোর জন্য যে ব্যক্তিটির গবেষণা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে তিনি হলেন জীববিজ্ঞানী আলফ্রেড কিন্সে। মুলতঃ কিন্সের গবেষণাই ষাটের দশকে সূচিত করে যৌনতার বিপ্লবের (sexual revolution) এবং পরবর্তীতে উন্মোচন করে দেয় লেজবিয়ন, গে, বাইসেক্সুয়াল এবং ট্রান্সজেন্ডারদের মত সংখ্যালঘু মানুষের এলজিবিটি আন্দোলনের দুয়ার। এ নিয়ে ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছে রইল। তবে সেসমস্ত মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে ঢুকবার আগে আমাদের আধুনিক জীব বিজ্ঞান আর জেনেটিক্সের বইয়ের পাতায় একটু ভালমত চোখ রাখা দরকার। কারণ হরমোন, ব্রেন-অ্যানাটমি এবং জিন সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষনাই ধীরে ধীরে কাটাতে সাহায্য করেছে ধোঁয়াশার অস্বচ্ছ মেঘ। আগামী পর্বে আমরা সেগুলো নিয়ে আলোচনা করব। এ সংক্রান্ত আধুনিক গবেষণার ফলাফলে চোখ রাখলেই আমর উপলব্ধি করতে পারব সমকামিতার কতটুকু জেনেটিক, আর কতটুকুই বা পরিবেশগত।
৫ম পর্ব পড়ুন ...
ড. অভিজিৎ রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক। ইমেইল : [email protected]