হতবুদ্ধি, হতবাক !
প্রশ্ন, প্রশ্ন, আর প্রশ্ন। এই যে এত প্রশ্নের ঝাঁক করে আসে মনে, এর উৎস কোথায় ? প্রশ্ন কি আল্লাহর ইচ্ছা, না শয়তানের ? শয়তানের ইচ্ছা কি আল্লাহর ইচ্ছা নয় ? তা যদি না হয় তাহলে এটা ধ্রুবসত্য হয় কেমন করে যে আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটে না সংসারে ?
অথচ পবিত্র কোরাণে পরিষ্কার লেখা আছে :
“All things are from God.” (4:78, Yusuf Ali)
(“সকল বস্তুর উৎস আল্লাহ।”)
আল্লাহই যদি সব বস্তুর উৎস হন, এবং আল্লাহর ইচ্ছাতেই যদি সব কিছু ঘটে, তাহলে পার্থিব যুক্তি অনুযায়ী শয়তানের ইচ্ছা এবং আমার তীক্ষ্ন মৌলিক প্রশ্নগুলোও আল্লাহরই ইচ্ছা। এখানেই একটা বিরাট ধাক্কা খাই মনে। মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা ব্যতিরেকে যদি কিছুই ঘটবার উপায় না থাকে তাহলে দয়া করে আমাকে বলে দিন আমার পাপপুণ্যের সকল দায়ভার আমাকেই বহন করতে হবে কেন।
উপরোক্ত আয়াতটির ঠিক পরপরই আছে :
“Whatever good (O Man!) happens to thee, is from God; but whatever evil happens to thee, is from thy (own) soul.” (4:79, Yusuf Ali)
(“(হে মানব), যা কিছু ভাল ঘটে তোমার জীবনে, সবই আল্লাহর দান; যা কিছু মন্দ তা তোমারই আত্মানিঃসৃত।”)
আমার ধাঁধাটা কোথায় বুঝতে পারছেন তো ? প্রথম আয়াতটির সঙ্গে দ্বিতীয়টিকে ঠিক মেলাতে পারছি না। এটা নিশ্চয়ই আমারই দোষ- আমার আত্মার কলুষনিঃসৃত দুষ্ট সংশয়। শয়তানের প্ররোচনাও হতে পারে। শয়তানই হোক আর যে’ই হোক, আমাকে কিন্তু বুঝিয়ে দিতে হবে সবকিছু যদি আল্লাহর কাছ থেকেই আসতে হয় তাহলে আমার মন্দটা তাঁর কাছ থেকে আসবে না কেন। আমার ভালটার কৃতিত্ব তাঁর, আর মন্দটার দায়িত্ব আমার, এটা কেমনতরো বিচার বলুন তো।
পবিত্র কোরাণের আরেক জায়গায় আছে :
“As to those who reject Faith, it is the same to them whether thou warn them or do not warn them; they will not believe, God had set a seal on their hearts and on their hearings, and on their eyes is a veil; great is the penalty they incur.” (2:6, Yusuf Ali). (“যারা বিশ্বাসের পথ বর্জন করে, তাদের সাবধান করা আর না করা একই কথা-তারা কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। আল্লাহকরিম তাদের আত্মায় এবং কর্ণেন্দ্রিয়তে তালা মেরে রেখেছেন, তাদের চোখে পরিয়েছেন ঠুলি। তাদের জন্যে ঘোর শাস্তি অপেক্ষা করছে।)”
“God leaves in error whom He will and guides whom He pleases.” (35:8, Dawood) (“আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে ভুলপথে ছেড়ে রাখেন, বা সৎপথে চালিত করেন।”)
প্রথমত, আমি বুঝি না তুচ্ছ মানুষের পক্ষে কিভাবে সম্ভব তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করা, কারণ সবই তো তাঁর ইচ্ছা। দ্বিতীয়ত, অবিশ্বাসীর আত্মায় আর কানে তালা মেরে রাখা, তার চোখে ঠুলি পরিয়ে রাখা, তা’ও যদি পরমাত্মার ইচ্ছাতেই সংঘটিত হয়ে থাকে, তাহলে বেচারির তো মহাবিপদ। কোন্ দিকে যাবে সে ? একদিকে ‘অবিশ্বাস’ যেহেতু সেটা একপ্রকার বস্তু সেহেতু আল্লাহর কাছ থেকেই পাওয়া, অন্যদিকে সেই অবিশ্বাসের শাস্তি থেকে পরিত্রাণের পথটাও তিনিই বন্ধ করে রেখেছেন (উপরোক্ত আয়াত অনুযায়ী)।
ছোটবেলায় শুনেছি যে আল্লাহতা’লা মানবজাতির হেদায়েতের জন্যে মোটমাট ১ লক্ষ ৯০ হাজার পয়গম্বর পাঠিয়েছিলেন। এবং তাঁদের মধ্যে আমাদের পরম প্রিয় নবীকরিম হজরত মোহম্মদ (দঃ) ছিলেন তাঁর সবচেয়ে পেয়ারা বান্দা, সকল নবীর সেরা নবী। এ-নিয়ে সেকালে কোন প্রশ্ন তুলবার অবকাশ ছিল না, কারণ একটা ধারণা আমাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করানো হয়েছিল জীবনের প্রত্যুষকালে যে ধর্মের প্রথম ও প্রধান ভিত্তি হল ঈমান অর্থাৎ বিশ্বাস। যার ঈমান পাকা নয় সে ভাল মুসলমান নয়। আমার সেই কচি বয়সে ‘ভাল মুসলমান’ না হবার মত ভয়ঙ্কর জিনিস আর ছিল না। সুতরাং ঈমানের প্রতিটি শর্ত আমি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করার চেষ্টা করতাম।
তাই যা শুনতাম ওস্তাদজীর মুখ থেকে, গুরুজনদের মুখ থেকে, তা’ই পরম শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করে নিতাম। আমার মগজে সম্ভবত শয়তানের আনাগোনা শুরু হয়েছিল স্কুলে থাকাকালেই। যদিও স্কুলটা ছিল কেবল মুসলমানদের জন্য, শিক্ষকদের মধ্যে দু’চারজন স্বাধীনচেতা বেয়াড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন যাঁরা ধর্মকর্মের ব্যাপারে খানিক উদাসীনই ছিলেন বলা চলে। তাঁরা আমার কানে আধুনিকতা ও স্বাধীন চিন্তার মন্ত্রসুধা বর্ষণ করতে শুরু করলেন। ইউরোপীয় যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচয় ঘটালেন। প্রশ্ন ও সংশয়সম্বলিত অনুসন্ধান দ্বারা জ্ঞানার্জনের অগতানুগতিক সাধনাতে উদ্বুদ্ধ করলেন। যুক্তি ও প্রমাণ-পরীক্ষা ছাড়া কোনকিছুই অন্ধভাবে গ্রহণের যোগ্য নয়, এই দুঃসাহসী মনোভাবটি তখন থেকেই আমার মনে কাজ করতে শুরু করল। অচিরেই আমার মনে সাহস জন্মাল মহান সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে দুর্বিনীত প্রশ্ন তোলার। তিনি কে, কোথায়, কেন ? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই যদি তাঁর সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে কি তিনি নিজেই নিজের স্রষ্টা ? পয়গম্বরদের ব্যাপারে যে-প্রশ্নটি পীড়া দিতে শুরু করল তা হল এই- প্রাচীন ইহুদী বিশ্বাস অনুযায়ী পৃথিবীর বয়স প্রায় ৬ হাজার বছর। আদম-হাওয়ার আগমনকাল যদি তা’ই হয়ে থাকে তাহলে সৃষ্টির প্রাতঃকালে নিশ্চয়ই ভূপৃষ্ঠের লোকসংখ্যা কয়েক লক্ষের বেশি ছিল না। তর্কের খাতিরে ধরা যাক ১ কোটি। ১ কোটি মানুষের জন্যে ১ লক্ষ ৯০ হাজার পয়গম্বর, একটু মাত্রাতিরিক্ত মনে হয় না ? গড়পড়তায় প্রতি পঞ্চাশ জনের জন্যে এক পয়গম্বর ! তার উপর পয়গম্বরদের অধিকাংশই ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের একটা অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ যেখানে জলবায়ু আবহাওয়া এতই কঠোর যে লোকবসতি এমনিতেই খুব হালকা। মনে হয় সেখানে প্রতি বাড়ি বাড়ি না হলেও প্রতি পাড়ায় পাড়ায় একজন করে পয়গম্বর ছিলেন। তার সঙ্গে বর্তমান পৃথিবীর ছবিটা মেলানোর চেষ্টা করে আরো দিশেহারা হয়ে পড়ি। আজকের লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয়শ’ কোটি। আজকের পৃথিবী অশান্তি আর অস্থিরতাময় পৃথিবী। শাসন শোষণ ও পেষণক্লিষ্ট পৃথিবী। আজকে আল্লাহর আরশ থেকে দু’চারজন মহৎ ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটলে মানবজাতির বড়ই উপকার হত। কিন্তু মহাপ্রভুর কি ইচ্ছা মনে তিনিই জানেন, আজকেই কোন পয়গম্বর নেই। চৌদ্দশ’ বছর আগে মহানবী নিজেই সে-পথ বন্ধ করে গেছেন-আর নয়, আল্লাহপাক আর পয়গম্বর পাঠাবেন না, তিনিই শেষ নবী। বিশ্বাসীরা তাঁর যৌক্তিকতা দেখতে পাচ্ছেন অনায়াসে। আমি পারছি না। হয়ত তিনি আমার কানে তালা মেরে রেখেছেন, চোখে দিয়েছেন ঠুলি।
পয়গম্বর বিষয়ে আমার আরেকটি প্রশ্ন : এতগুলো পয়গম্বরের মধ্যে আজ পর্যন্ত একজন মহিলা-নবীর নাম শুনিনি কেন ? মহিলারা নিশ্চয়ই আল্লাহরই সৃষ্টি, এবং তাদের প্রতি তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব পুরুষদের যতই থাকুক করুণাময় আল্লাহপাকেরও থাকবে তা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আমি অবাক হয়ে যাই যখন পবিত্র কোরাণেই পাই :
“Ask the unbelievers if it be true that God has daughters, while they themselves choose sons. Did We create the angels females?” (17:149, Dawood)
( “অবিশ্বাসীদের জিজ্ঞেস কর এটা কি সত্য হতে পারে যে তারা নিজেরা পছন্দ করে পুত্রসন্তান, আর আল্লাহর থাকবে কন্যা? আমরা কি কখনোই নারী ফেরেশতা সৃষ্টি করেছিলাম ?”)
কিম্বা :
“The apostles We sent before you were but men whom We inspired.” (21:7, Dawood).
(“তোমার আগে যাঁরা আমাদের বার্তা বয়ে এনেছিলেন তাঁদের সবাই ছিলেন আমাদের বাণী ও প্রেরণাপ্রাপ্ত পুরুষ।”)
এ-দু’টি পংক্তির মর্মার্থ আমি এখনো বুঝি না। প্রশ্ন জাগে মনে, তাহলে কি পুরুষজাতির চিরকালীন নারীবিদ্বেষ প্রাকৃতিক নিয়মেরই অন্তর্গত, যার মৌল প্রেরণার উৎস দৈবশক্তির অন্তঃপুরে ?
কোরাণবর্ণিত ঐশীবাণীর মর্মকথা নিয়ে দু’চারটে প্রশ্ন তুলেছিলাম আমি বছরচারেক আগেকার লেখা একটি নিবন্ধে। নিবন্ধটির নাম ছিল ‘আউট অব্ কন্টেক্সট’। একটা সাহসী অনলাইইন পত্রিকা (মুক্তমনা) ছাড়া আর কোথাও লেখাটি ছাপানো সম্ভব হয়নি- কোন সম্পাদক সাহস করেনি ছাপতে। এই যে সাহস না পাওয়া মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করে পরীক্ষানিরীক্ষা দ্বারা প্রচলিত ধর্মের মর্ম বোঝার চেষ্টা, এই যে প্রশ্নকারীর জবাব না দিয়ে তার কণ্ঠ রুদ্ধ করার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে আমাদের ধর্মকে ঘিরে, এ’ও এক নতুন প্রশ্নের সূচনা করেছে আমার মনে। প্রশ্নকে এত ভয় কেন ? কারণ ভয় থেকেই তো সৃষ্টি হয় ভয়ের অস্ত্র দিয়ে প্রশ্নের গলা টিপে ধরার প্রবৃত্তি।
আমার নিবন্ধের শালীনতম প্রতিক্রিয়া এসেছিল দু’চারজন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির কাছ থেকে। তাঁদের বক্তব্য, ধর্ম সম্বন্ধে আমার জ্ঞান অপ্রচুর ও অগভীর ; আমার বিশ্বাসের খুঁটি দুর্বল ; আমার উদ্ধৃতিগুলো ‘আউট অব্ কন্টেক্সট’, ইত্যাদি।
প্রতিক্রিয়াগুলোর সবক’টাই পূর্বপ্রত্যাশিত ছিল বলে কোনটাই আমাকে অবাক করেনি। যুগ যুগান্তর ধরে ধর্মের ধ্বজাধারীরা নিজেদের অন্ধ বিশ্বাসের ভিত্তিকে অক্ষত রাখবার চেষ্টায় এইরকম বাধার দেয়াল দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। তাঁরা আমাকে বলেন যে আমি কোরাণ ভাল করে পড়িনি, যা পড়েছি তা’ও বুঝিনি বা ভুল বুঝেছি। আমি কোরাণ বিশেষজ্ঞ নই, সেটা আমি অস্বীকার করছি না, কিন্তু আমার সমালোচকদের একজনও আমার উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর একটিরও জবাব দেয়া দূরে থাক, দেবার চেষ্টাও করেননি। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের রীতিটাই এমন যে ধর্মগ্রন্থের সত্যমিথ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাই দণ্ডনীয় অপরাধ। সুতরাং কেউ যদি কোন উদ্ধত প্রশ্ন তোলে তাহলে একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হল কখন এবং কিভাবে সে দণ্ড কার্যকরী করা হবে। তাৎক্ষণিক মুণ্ডচ্ছেদ, না, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ?
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজে প্রাত্যহিক কোরাণপাঠ তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মসজিদবহুল শহর ঢাকাতে আজকাল পাখিদের কলরব ততটা শোনা যায় না যতটা শোনা যায় আজানের শব্দ আর কোরাণপাঠের সুমধুর সুর। বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও তারা বাংলাতে তেলোয়াত করে না কোরাণ, করে আরবিতে, কারণ তাতেই নাকি বেশি সোয়াব, তাতেই নাকি বেহেশ্তের ফেরেশ্তারা সাড়া দেয়। তারা যদি আরবি বুঝত তাহলে কিছু বলার ছিল না, কিন্তু গুটিকয় পণ্ডিত ব্যক্তি ছাড়া কেউ একশব্দ আরবি বোঝে কিনা আমার সন্দেহ। শেখার প্রতি একটা কৌতূহল, সেটাও বেশি দেখিনি আমি। কৌতূহল জিনিসটাই যেন একটা নিষিদ্ধ বস্তু আমাদের ধর্মীয় কালচারে।
ব্যক্তিগতভাবে, আমি যে এক ভয়ানক অজ্ঞ মানুষ সেটা নতশিরে মেনে নিচ্ছি। আমি চেষ্টা করিনি তা নয়। কোরাণ পড়বার চেষ্টা করেছি বটে, একবার নয়, দু’বার। প্রথমবার অন্য সবার মত, তোতাপাখি যেমন পড়ে, ছোটবেলায় বাধ্যবাধকতায়। তখনকার পড়া ছিল ‘ভাল মুসলমান’ হবার জেন্য, সোয়াব অর্জনের আশায়। দ্বিতীয়বার পড়েছি পরিণত বয়সে, ইংরেজিতে, বুঝবার জন্যে, শেখার জন্যে, জ্ঞানের আকর্ষণে। শিখতে গিয়ে, বুঝতে গিয়ে, অনেক প্রশ্ন জেগেছে আমার মনে, যেমন করে প্রশ্ন জাগে আমার অঙ্কশাস্ত্রে। সেই প্রশ্ন, সেই শিক্ষার দু’চারটে অংশ আমাকে কিঞ্চিৎ বিচলিত করেছে, বিস্মিত করেছে। তারই মীমাংসা খুঁজে বেড়াচ্ছি নানাদিকে, নানাপথে।
কোরাণের ভাষা নিয়ে সবসময়ই একটা প্রশ্ন ছিল আমার মনে - ধর্মের মত একটি পবিত্র জিনিস, একটি ব্যক্তিগত জিনিস চর্চা করতে গিয়ে মাতৃভাষা ছেড়ে এমন একটি বিদেশী ভাষা কেন ব্যবহার করতে হয় আমাদের যার একটি বর্ণও কারো বোধগম্য নয় ? সে প্রশ্নের সমাধান শেষ পর্যন্ত আমি কোরাণেই পেয়েছি -কোরাণে কোথাও লেখা নেই যে আরবি যাদের মাতৃভাষা নয় তাদেরও কোরাণ পড়তে হবে আরবিতে। কয়েকটা পংক্তি আমি উল্লেখ করছি এখানে।
১। “Each apostle We have sent has spoken only in the language of his own people, so that he might make his precepts clear to them.” (14:1, Dawood)
(“যেসব নবীকে আমরা মর্ত্যে পাঠিয়েছি ধর্মপ্রচারের জন্যে তারা সকলেই নিজ নিজ সম্প্রদায়ের মাতৃভাষাতেই কথা বলেছেন, যাতে করে সেই বাণীগুলো তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে।”)
২। “We have revealed the Koran in the Arabic tongue so that you may grow in understanding.” (12:1, Yusuf Ali)
(“আমরা আরবি ভাষাতে কোরাণ নাজেল করেছি যাতে সেটা সবারই বোধগম্য হয়।”)
৩। “Had We revealed the Koran in a foreign language they would have said, ‘If only its verses were expounded! Why in a foreign tongue, and he an Arabian?’” (41:40, Dawood)
(“আমরা যদি কোনও বিদেশী ভাষাতে কোরাণ নাজেল করতাম তাহলে ওরা বলত, ‘এর ছত্রগুলো যদি বুঝবার উপায় থাকত কারো! যেখানে ওরা সবাই আরবিতে কথা বলে সেখানে বিদেশী ভাষা কেন ?’ ”)
৪। “We have revealed the Koran in the Arabic tongue that you may understand its meaning.” (43:1, Dawood)
(“আমরা আরবিতে কোরাণ পাঠিয়েছি যাতে তোমরা সবাই বুঝতে পার।”)
৫। “Thus have We revealed to you an Arabic Koran, that you may warn the mother-city (Mecca) and those who dwell around it; that you may forewarn them of the day which is sure to come.” (42:5, Dawood)
(“আমরা তোমার কাছে আরবি কোরাণ পাঠিয়েছি যাতে তুমি মক্কা এবং তার আশেপাশের জনগণকে সাবধান করে দিতে পার যে হাশরের দিন এক অনিবার্য বাস্তব যা থেকে কারুরই নিষ্কৃতি নাই।”)
এই পাঁচটি আয়াতের মধ্যে আমি তিনটি বাণী শুনতে পাই। এক, ধর্মশিক্ষা মাতৃভাষা ছাড়া আর কোন ভাষাতেই হওয়া উচিত নয়। দুই, কোরাণ নাজেল হয়েছিল শুধুমাত্র আরবিভাষী আরবজাতির জন্যে। তিন, কোরাণ নাজেলের মূল উদ্দেশ্য ছিল সহজবোধ্য আরবি ভাষাতে মক্কা নগর ও তৎসংলগ্ন জনপদসমূহে আল্লাহর বাণী প্রচার করা। সুতরাং বাংলাদেশ সহ অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশে যে আরবির প্রতি এত মোহ, আরবি ভাষাতে কোরাণপাঠের প্রতি এত যে অন্ধ আসক্তি তা সম্পূর্ণভাবে কোরাণের মূল আদর্শের পরিপন্থী। আজকে যে আরব-বহির্ভূত দেশসমূহে আরবির এত প্রভাব তার কারণ কোরাণে বর্ণিত আল্লাহর বাণী নয়, তার কারণ মধ্যযুগের ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদ। এটা আগাগোড়া রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যেরই পরিচায়ক মাত্র।
ভাষার ধাঁধাটা মোটামুটি মীমাংসা হয়ে গেলেও অন্যান্য ধাঁধা কিন্তু এখনো কাঁটার মত বিঁধে আছে মনে। যতই পড়ি কোরাণ ততই সৃষ্টি হয় নতুন নতুন প্রশ্ন। সৃষ্টি হয় নতুন নতুন বিস্ময়বিমূঢ়তা। এ কি করে সম্ভব ? এ কি করে হয় আল্লাহর বাণী ? কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক।
সৃষ্টিবাদ না বিবর্তনবাদ, বর্তমান জগতে এ নিয়ে মহাবিতর্ক। আধুনিক বিজ্ঞানের যুক্তিপ্রমাণের তোপে সৃষ্টিবাদীদের অনেক দাবিই টিকতে পারছে না বলে তাঁরা নতুন ভাষা আবিষ্কার করেছেন একই কথা বলার জন্যে : Intelligent Design, বা বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনা। সে যাই হোক, কোরাণের ভাষা তো কেউ খণ্ডাতে পারবে না (খণ্ডাবার চেষ্টা করলেই তো মুণ্ডটা হারাতে হবে)।
“... Yet your Lord is God, who in six days created the heavens and then ascended the throne, ordained all things.” (10:1, Dawood)
(“... অথচ তোমার প্রভুই (মহান) সৃষ্টিকর্তা, যিনি ছয় দিনের মধ্যে স্বর্গমর্ত্য সৃষ্টি করে আসন গ্রহণ করেছেন স্বর্গীয় সিংহাসনে, যেখান থেকে পরিচালনা করে চলেছেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল কর্মকাণ্ড।”)
“It was He that gave the sun his brightness and the moon her light, ordaining her phases that you may compute the seasons and the years.” (10:1, Dawood)
(“তিনিই ছিলেন সেই মহাশক্তি যিনি সূর্যকে দিয়েছিলেন তার উজ্জ্বলতা, চন্দ্রকে তার আলো। চন্দ্রকলার হিসেব দিয়েই তো তোমরা হিসেব করতে পার বৎসর, বুঝতে পার ঋতুর গতি।”)
“It was He who created the heavens and the earth in all truth. On the day when He says: ‘Be’, it shall be, His word is the truth.” (6:72, Dawood)
(“এ এক অকাট্য সত্য যে স্বর্গমর্ত্য তাঁরই সৃষ্টি। যে মুহূর্তে তিনি বলবেন : ‘হও’, তা হবে। তাঁর উচ্চারিত বাণীই সত্য।”)
“It was He who ordains life and death. If He decrees a thing, He need only say: ‘Be’, and it is.” (40:66, Dawood)
(“একমাত্র তিনিই জীবনমৃত্যুর মালিক। যখনই তিনি কোনকিছু সৃষ্টি করতে চান, তাঁকে শুধু বলতে হয় : ‘হও’, তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়।”)
“Are the disbelievers unaware that the heavens and the earth were but one solid mass which We tore asunder, and that We made every living thing from water?” (21:25, Dawood)
(“অবিশ্বাসীরা কি অবগত নয় যে একসময় স্বর্গ এবং মর্ত্যের আলাদা কোনও অস্তিত্ব ছিল না, তারা ছিল এক সংযুক্ত প্রস্তরখণ্ড যাকে আমরা ভেঙে টুকরো টুকরো করেছি ? তারা কি অবগত নয় যে সকল সজীব বস্তুকে আমরা সৃষ্টি করেছি জলীয় উপাদান দিয়ে ?”)
উপরোক্ত পাঁচটি আয়াতের মূল সুর একটিই-মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিরহস্য। অন্ধ বিশ্বাসীদের চোখে এর প্রতিটি শব্দ বর্ণে বর্ণে সত্য, কোনও বিতর্কেরই অবকাশ নেই কোথাও। কিন্তু অন্ধ বিশ্বাসের ভাগ্য থেকে হয়ত সৃষ্টিকর্তা নিজেই আমাকে বঞ্চিত করে রেখেছেন - সেই ‘চোখের ঠুলি’ আর ‘কানের তালা’ লাগানোর মত করে। তৃতীয় ও চতুর্থ পংক্তি অনুযায়ী সৃষ্টির জন্যে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাই যথেষ্ট, শ্রমের দরকার নেই। তিনি যা ইচ্ছা করবেন, তা বিনা বাক্যব্যয়ে, বিনা কালাতিপাতে, তাৎক্ষণিকভাবে ঘটে যাবে। তাই যদি হয় তাহলে প্রথম পংক্তিতে কেন বলা হল যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করতে তাঁর ছয়দিন লেগে গেছে ? (ছয়দিন অবশ্য ছয়হাজার বছরও হতে পারে মানবিক মাপকাঠিতে, কোরাণেরই অন্য এক আয়াত অনুসারে)। ইহুদীদের তোরা এবং খ্রীষ্টানদের বাইবেল তো তার চেয়েও এককাঠি অগ্রসর হয়ে যায় : সৃষ্টির ছয়দিনব্যাপী পরিশ্রমের পর মহাপ্রভু একদিন অবসর নিয়েছিলেন, যার সূত্র ধরে মানবজগতে প্রবর্তিত হয়েছিল সাব্বাথ বা বিশ্রামের দিন, ছুটির দিন। সে-অনুযায়ী ইহুদীরা শনিবারকে ধার্য করে নিলেন তাদের ছুটির দিন হিসেবে, আর খ্রীষ্টানরা নিলেন রবিবারকে। পশ্চিম জগতে এদু’টি দিনকে ছুটির দিন হিসেবে গ্রহণ করবার পেছনের কাহিনীটা এখানে। মুসলমানদের সৃষ্টিকর্তার হয়ত বিশ্রামের প্রয়োজন হয়নি, কিন্তু বিশেষ প্রার্থনা ও বন্দনার প্রয়োজন হয়েছিল, তাই সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর মধ্যে তাঁরা বাছাই করে নিলেন পবিত্র শুক্রবারকে। মাঝে মাঝে মনে হয়, ভালই হল, ইসলামের পর আর কোন নবী পাঠানো হয়নি মানবজাতির জন্যে। তাহলে হয়ত সপ্তাহের বাকি দিনগুলোও একে একে দখল হয়ে যেত বিভিনড়ব ধর্মের উপাসকদের দ্বারা- কেবল আল্লাহ আল্লাহ করা ছাড়া আর কোন কাজই থাকত না মনুষ্যজাতির !
দ্বিতীয় পংক্তিটি নিয়ে আমার সমস্যা হল যে চাঁদের চলাফেরাতে রদবদল হয় এবং বাৎসরিক সময়চক্র নির্ধারিত হয়, এই তথ্যটি। চান্দ্রমাস বা চান্দ্রবৎসরের প্রচলন এককালে ছিল কোন কোন দেশে, তা সত্য, কিন্তু চন্দ্রসূর্যের পারস্পরিক সম্পর্ক মধ্যযুগের বৈজ্ঞানিকদের কাছে যতই পরিষ্কার হতে শুরু করে ততই মানুষ চান্দ্রবৎসরকে বর্জন করে সৌরবৎসরের হিসেবে জীবন পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়। চন্দ্রের নিজস্ব কোন আলো নেই, সূর্যের আলো দিয়েই সে আলোকিত, এই জ্ঞানটি দু’হাজার বছর আগেও মানুষের জানা ছিল। অথচ কোরাণের যে আয়াতটি উল্লেখ করা হল এখানে তাতে মনে হয় চন্দ্রের আলো কোনভাবেই সূর্যের ওপর নির্ভরশীল নয়। নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা জানতেন কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা। তাহলে তথ্যের এই আপাত-অসামঞ্জস্য কেন ?
পঞ্চম পংক্তিটি আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক বিশ্বাসীদের ভীষণ প্রিয়। তাঁরা মনে করেন, এই আয়াতটির মধ্যে নিহিত আছে বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত Big Bang -এর পূর্বাভাষ। তাই নাকি ? আমার ‘তালামারা’ মন সন্দিহান হয়ে ওঠে, ‘ঠুলিলাগানো’ চোখ কুঞ্চিত হয়ে আসে। ‘একটি বিশাল কুণ্ডলিত জড়বস্তুর তুমুল বিস্ফোরণ থেকে স্বর্গমর্ত্যরে আবির্ভাব’, তাই যদি হয়ে থাকে এই পংক্তির বক্তব্য তাহলে প্রশ্ন করতে হয় সেই ‘জড়বস্তু’টি কি সৃষ্টির অংশ ছিল না ? সেটা কখন এবং কিভাবে গঠিত হল ? বিজ্ঞানমনস্ক
বিশ্বাসীদের কাছে আমার প্রশ্ন : Big Bang বলতে তাঁরা কি বস্তুর সংঘর্ষ বোঝেন ? আসলে Big Bang -এর সঙ্গে বস্তুর কোন সম্পর্ক নেই। ঐ মুহূর্তে বস্তু দূরে থাক, কাল ও স্থান, তা’ও ছিল না। সুতরাং সেই মহাপ্রলয়ের মুহূর্তটি ছিল কাল এবং স্থান সৃষ্টির (Time and Space) মুহূর্ত। অর্থাৎ ‘অস্তিত্ব’ শব্দটির প্রারম্ভিক সূচনা। কাল, স্থান এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বা আপেক্ষিকতার কোনও উল্লেখ আমি কোরাণের কোন ছত্রে খুঁজে পাইনি।
বর্তমানে বিশ্বের বহু-আলোচিত ও সর্বনিন্দিত ‘ইসলামিক জঙ্গিবাদ’, ‘উগ্রবাদ’ বা ‘মৌলবাদ’-এর মোকাবেলা করতে গিয়ে ধর্মপ্রাণ ও শান্তিপ্রিয় মুসলমানরা ইসলামের শান্তি ও সহনশীলতার ভাবমূর্তিকে বড় করে প্রচার করার চেষ্টায় যে পংক্তিটি বারবার উল্লেখ করে থাকেন তা হল :
“You have your own religion, and I have mine.” (109:6, Dawood)
(“তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার।”)
বাহ্, কি চমৎকার বাণী ! প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। অপর ধর্মাবলম্বীদের প্রতি এর চেয়ে বড় সম্মান আর কোন্ ধর্মে আছে ? কিন্তু মনটা চুপসে যায় যখন একই গ্রন্থের ভেতর দেখতে পাই :
“Believers, make war on the infidels who dwell around you. Deal with them firmly.” (9:12, Dawood)
(“বিশ্বাসীগণ, যেসব কাফের তোমার পরিপার্শে¦ বসবাস করে তাদের ওপর যুদ্ধ ঘোষণা কর। দৃঢ়মুষ্টি ব্যবহার কর তাদের সঙ্গে।”)
“When the sacred months are over slay the idolators wherever you find them. Arrest them, besiege them, and lie in ambush everywhere for them.” (9:5, Dawood)
(“পবিত্র মাসগুলি পার হয়ে গেলে মূর্তিপূজকদের যেখানে পাও সেখানেই তাদের সংহার কর। তাদের আটক কর, ঘেরাও কর, ফাঁদ পেতে থাক তাদের ধরার জন্যে।”)
এ দু’টি পংক্তি পড়ে কি মনে হয় অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ইসলামের সহিষ্ণুতা সত্যি সত্যি আদর্শস্থানীয় ?
অসহিষ্ণুতার উদাহরণ অজস্র। যেমন :
“Garments of fire have been prepared for the unbelievers. Scalding water shall be poured upon their heads, melting their skins and that which is in their bellies. They shall be lashed with rods of iron. Whenever, in their anguish, they try to escape from Hell, back they shall be dragged, and will he told : ‘Taste the torment of the conflagration .’” (22:19, Dawood)
(“অবিশ্বাসীদের জন্যে তৈরি করা হয়েছে আগুনের পরিধেয়। ফুটন্ত জল বর্ষণ করা হবে তাদের মাথার ওপর যাতে বিগলিত হবে তাদের চমর্, বিগলিত হবে তাদের নাড়িভূঁি ড়। লৌহদণ্ড দিয়ে পহ্র ার করা হবে তাদের। সেই অগিড়বদাহের যন্ত্রণায় যখনই তারা নরককুণ্ড থেকে পালাবার চেষ্টা করবে তখনই তাদের টেনেহিঁচড়ে ফিরিয়ে আনা হবে সেখানে। বলা হবে, ‘এবার বুঝলে তো বাছা দাবালনের তাপ কেমন লাগে গায়ে।’ ”)
এ কি শান্তিপ্রিয় সহনশীলতার বাণী, না, প্রচণ্ড ক্রোধ, ঘৃণা আর প্রতিহিংসার হিংস্র নিনাদ ? এ কি কোনও করুণাময় বিশ্ববিধাতার ক্ষমাসুন্দর কৃপার ধ্বনি বলে মনে হয় আপনার কাছে ? মূর্তিপূজকরা পথভ্রান্ত হতে পারে, কিন্তু তারা কি এতটাই ঐশ্বরিক রোষ আর নিষ্ঠুরতার পাত্র ? বিশেষ করে যেখানে আল্লাহতা’লা নিজেই বলছেন যে বিপথে যাওয়া বা সুপথে থাকা কোনটাই মানুষের নিজস্ব ইচ্ছায় ঘটে না, ঘটে তাঁরই ইচ্ছায় ? আমি কেমন করে সেই বিধাতৃর কাছে মাথা নত করি যে বিধাতৃর বর্ণিত উক্তিতে এত অসঙ্গতি, এত স্ববিরোধিতা ?
আরো শুনতে চান ? শুনুন তাহলে।
“We have bound their necks with chains of iron reaching up to their chins, so that they cannot bow their heads. We have put a barrier before them and a barrier behind them and cover them over, so that they cannot see.” (36:7, Dawood)
(“আমরা লোহার শেকল দিয়ে তাদের ঘাড় বেঁধে দিয়েছি থুতনি পর্যন্ত যাতে মাথা নোয়াতে না পারে। আমরা তাদের সামনে পেছনে দু’দিকেই প্রাকার সৃষ্টি করেছি, তারপর আচ্ছাদিত করেছি তাদের আপাদমস্তক, যাতে তাদের দৃষ্টিপথ রুদ্ধ হয়ে যায়।”)
এই পংক্তিটি আমি সংগ্রহ করেছি সুরা ‘ইয়াসিন’ থেকে যা পুণ্যবান মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত উঁচুমানের সুরা, এবং যার নিয়মিত পঠন দ্বারা তারা অধিকতর পুণ্যার্জন করেন।
সহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে আমার শেষ উদ্ধৃতিটি হল :
“You shall not pray for any of their dead, nor shall you attend their burial.” (9:82, Dawood)
(“তোমরা তাদের মৃতদের আত্মার শান্তিকামনা করবে না। তাদের শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে না।”)
অর্থাৎ জীবিতাবস্থাতে ওদের ক্ষমা নেই শুধু নয়, মৃতাবস্থাতেও নেই। মৃতদেহের প্রতি যে বিশ্বাসমালাতে এত অসম্মান সে-বিশ্বাসকে সসম্মানে গ্রহণ করবার প্রবৃত্তি কি স্বাভাবিক ? সে-বিশ্বাসকে কি সহনশীল ও ক্ষমাশীল বিশ্বাস বলে মেনে নেওয়া সহজ ?
ছোটবেলায় বড় বড় আলেমদের মুখে শুনেছি, পবিত্র কোরাণ যে নিঃসন্দেহভাবে আল্লাহর বাণী এবং কোনও মরণশীল মানুষের পক্ষে এমন নিখুঁত রচনা সম্ভব নয় তার অন্যতম প্রমাণ হল কোরাণের ভাষা। এত নিপুণ ছন্দ, শব্দপ্রয়োগের এমন আশ্চর্য জাদুকরী শক্তি, এটা মানুষের সাধ্যাতীত। কোরাণ এক বিশাল মহাকাব্য, সব মহাকাব্যের সেরা মহাকাব্য। সব কবির সেরা কবি হলেন আল্লাহ স্বয়ং। ছোটবেলার অবোধ বিশ্বাসের আবহাওয়াতে এগুলো শুনতে খুব ভাল লাগত, যদিও আরবি বুঝি না বলে এর কাব্যিক গুণাগুণ বিচার করবার কোন উপায়ই ছিল না আমার, এখনো নেই। তবে কবিতা ও কবির প্রতি কোরাণের কি দৃষ্টিভঙ্গি তা যাচাই করবার সুযোগ এসেছে পরবর্তীকালে, ইংরেজি অনুবাদ পড়বার সময়। তাতে আমার মনে হল, আল্লাহপাক নিজে শ্রেষ্ঠ কবি হতে পারেন, কিন্তু কবিজাতিটাকে তিনি হয়ত খুব সুনজরে দেখেন না। দু’টি উদাহরণ দিই।
“Poets are followed by erring men. Behold how aimlessly they rove in every valley, preaching what they never practice. Not so the true believers, who do good works and remember God with fervour and defend themselves only when wronged.” (26:227, Dawood)
(“কেবল পথভ্রান্ত লোকেরাই অনুসরণ করে কবিদের। খেয়াল করে দেখ কেমন উদ্দেশ্যবিহীনভাবে তারা পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, আর বুলি ছড়ায় যার একটি বর্ণও তারা নিজেরা পালন করে না। সত্যিকারের বিশ্বাসী যারা তারা কখনোই তা করবে না। তারা সবসময় সৎকর্মে লিপ্ত থাকে, আল্লাহকে স্মরণ করে পরম ভক্তির সাথে এবং অন্যায় আচরণের সম্মুখীন হলেই আত্মরক্ষার জন্যে উদ্যত হয়, নইলে নয়।”)
অথবা,
“We have taught him (the Holy Prophet) no poetry, nor does it become of him to be a poet. This is but an admonition; an eloquent Koran to exhort the living and to pass judgment on the unbelievers.” (36:69, Dawood)
(“আমরা মোহম্মদকে (দঃ) কাব্য শেখাইনি। কাব্য করা তাঁকে মানায়ও না। কোরাণের যে সাবলীল ছান্দিক ভাষা তার উদ্দেশ্য জীবিত মানুষদের সুপথের নির্দেশদান ও পথহারা অবিশ্বাসীদের প্রতি সাবধানবাণী প্রচার করা।”)
পবিত্র কোরাণে নারীর মর্যাদা কতখানি তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। আমি সেই বিতর্কে যেতে চাই না, কেবল কোরাণ থেকে দু’চারটে উদ্ধৃতি তুলে পাঠকের বিবেক-বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেব।
“Men have authority over women because God has made the one superior to the other, and because they spend their wealth to maintain them. Good women are obedient ... As for those from whom you fear disobedience, admonish them, forsake them in beds apart, and beat them. Then if they obey you, take no further action against them.” (4:34, Dawood)
(“নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য স্বাভাবিক, কারণ একের চেয়ে অন্যের স্থান ঊর্ধ্বে, এবং নারীর ভরণপোষণের জন্যে পুরুষকে অর্থব্যয় করতে হয়। ভাল নারী বলতে বোঝায় বাধ্য নারী। ... যেসব নারী অবাধ্য হতে পারে বলে তুমি মনে কর তাদের তুমি ভর্ৎসনা কর, পৃথক শয্যাতে নির্বাসিত কর, এবং প্রহার কর। তারপর যদি তারা বাধ্যতায় ফিরে আসে, তাহলে আর কোনও ব্যবস্থা নিও না তাদের বিরুদ্ধে।”)
এরপরও কি জোর দিয়ে বলা যায় যে ইসলামে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা ? আমি বুঝি না, বুঝতে চাই।
“Forbidden to you are your mothers, your daughters, your sisters, ... Also married women, except those whom you own as slaves.” (4:24, Dawood) (“তোমাদের জন্যে নিষিদ্ধ হল তোমাদের মায়েরা, কন্যারা, বোনেরা ...। এবং নিষিদ্ধ বিবাহিত মহিলাগণ, কেবল তোমাদের ক্রীততদাসীরা ছাড়া।”)
অর্থাৎ, ক্রীতদাসী হলে তাদের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক অবশ্যই হতে পারে। তাহলে কি বলা যায় যে ক্রীতদাসীদের প্রতি নারীজাতির স্বাভাবিক সম্মান প্রদর্শনের কোনও প্রচেষ্টা ছিল পবিত্র কোরাণে ?
“Not so the worshippers, who are steadfast in their prayer, who set aside a due portion of their wealth for the beggar and for the deprived; who truly believe in the Day of Reckoning, ..., who restrain their carnal desire (save with their wives and slave-girls, for those are lawful for them); transgressors are those who lust after other than these; ...” (70:22, Dawood)
(“ব্যতিক্রম হল তারা যারা উপাসনায় নিষ্ঠাবান ; যারা তাদের অর্জিত সম্পদের একটা ন্যায্য অংশ পৃথক করে রাখে ভিক্ষুক ও অভাবীদের জন্যে ; যারা হাশরের দিনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ; যারা তাদের কামলিপ্সা সংবরণ করতে সক্ষম (শুধু তাদের বিবাহিত স্ত্রী ও ক্রীতদাসীগণ ছাড়া যারা আইনতই তাদের যৌনসঙ্গী হতে পারে) ; যারা তার বাইরে লোভাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তারা লম্পট; ...)
দেড় হাজার বছর আগে আরব সমাজে যৌন ব্যভিচার ছিল প্রচণ্ডরকম সেটা জানি, দাসপ্রথাও ছিল তুমুল বিক্রমে, কিন্তু পবিত্র কোরাণে আল্লাহমালিক স্বয়ং তার সমর্থনে বাণী প্রেরণ করবেন সাত আসমানের ওপর থেকে, সেটা আমার কাছে কেমন অবিশ্বাস্য মনে হয়।
অবশ্য আমার চোখে তো তিনিই ঠুলি পরিয়ে রেখেছেন !
কোরাণ পড়ার ফলে ইসলামের একটা সুন্দর দিক অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে আমার কাছে-সারল্য। এর নিরেট নিখাদ সারল্য। কোন জটিলতা নেই, কোন পণ্ডিতিপণা নেই, কোন সূক্ষ্ম দার্শনিক তত্ত্ব নিয়ে উচ্চমার্গের তর্কবিতর্ক নেই, নেই কোনও কুয়াশাঘেরা আবছা আধ্যাত্মিকতা। সত্যিকার অর্থেই সাধারণ মানুষের ধর্ম। নামাজ রোজা কর, সৎপথে চল, সরল জীবনযাপন কর, আল্লাহর আদেশ পালন কর, ঈমান ঠিক রাখ, ব্যস, তোমার আর কোন চিন্তা নেই। এজীবনে যত কষ্টই পাও তুমি, পরলোকে তোমার কোন ভয়-ভাবনা থাকবে না, হাশরের দিন আল্লাহতা’লার পেয়ারা বান্দা হবে তুমিই। এইটুকু আমি মোটামুটি বুঝি। এইটুকু আমি বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে পারি।
কিন্তু। হ্যাঁ, এই কিন্তুগুলোই আমাকে যন্ত্রণা দেয়, ভাবায়, বিচলিত করে। এটা কেমন করে হয় ? ওটা কিভাবে আল্লাহর বাণী হতে পারে ? এর তাৎপর্য কি ? ওটার মর্ম আমাকে কে বোঝাবে ? ইত্যাদি। অন্তহীন।
“We have decked the lower heaven with constellations. They guard it against rebellious devils, so that they may not listen in to those on high. Meteors are hurled at them from every side; then, driven away, they are consigned to an eternal scourage. Eavesdroppers are pursued by fiery comets.” (37:8, Dawood)
(“স্বর্গলোকের নিচের তলাটি আমরা গহ্র নক্ষত্র দিয়ে আচ্ছন ড়ব করে রেখেছি যাতে করে দুরভিসন্ধিমূলক দুর্বৃত্তরা ঊর্ধ্বলোকের দিকে কান পেতে না থাকতে পারে। উল্কারা তাদের উত্যক্ত করতে থাকবে চারদিক থেকে, এবং বিতাড়িত হবার পর তাদের নির্বাসিত করা হবে এক অন্তহীন অভিশপ্ততায়। কানপাতা দুষ্কৃতিকারীদের ধাবিত করার কাজ অগিড়ববাহী ধূমকেতুদের।”)
এর অর্থ কি ? স্বর্গলোক কি তাহলে গ্রহনক্ষত্রদের রাজ্য থেকেই শুরু হয় ? এর উপরতলা আর নিচের তলা বলতে কি বোঝায় ? উল্কাদের কাজ কি তাহলে উপরতলার বাসিন্দাদের সিকিউরিটি গার্ডের মত ? ধূমকেতুগুলোও তো দেখছি কেবল আজেবাজে মানুষগুলোকে ধাওয়া করে বেড়ায়। এগুলো কি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় আপনার কাছে ? জানি, কি বলবেন আপনি। আমার ঈমান নেই, আল্লাহপাক আমার আত্মা ও কানে তালা দিয়ে রেখেছেন, চোখে দিয়েছিন ঠুলি। তাই আমি কথাগুলোর ভাবার্থ বুঝতে পারছি না।
কি করব বলুন। কোরাণে তো আল্লাহতা’লা নিজেই বলছেন :
“Some of its verses are precise in meaning⎯they are the foundation of the Book⎯and others ambiguous. ... No one knows its meaning (the ambiguous parts) except God.” (3:7, Dawood)
(“এর কিছু কিছু ছত্র একেবারেই দ্ব্যর্থহীন, পরিষ্কার - এগুলোই হল এই গ্রন্থের স্তম্ভ। বাকিগুলো দ্ব্যর্থমূলক, অস্পষ্ট, যার অর্থ এক আল্লাহ ছাড়া কারো বোঝার সাধ্য নেই।”)
অর্থাৎ পবিত্র কোরাণের বেশির ভাগ ছত্রই জলের মত পরিষ্কার যা সকলেরই বোধগম্য। বাকিগুলো কারুরই বোধগম্য নয়, আল্লাহমালিক ছাড়া। সুতরাং দয়া করে এ-কথা বলবেন না যে কোরাণের কোন বাণী আমি না বুঝলেও আপনি বোঝেন।
স্বর্গমর্ত্য প্রসঙ্গে আরো দু’টি উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
“They shall dwell in the garden of eden, where rivers will roll at their feet. Reclining there upon soft couches, they shall be decked with bracelets of gold, and arrayed in garments of fine green silk and rich brocade : blissful their reward and happy their resting-place!” (18:30, Dawood)
(“স্বর্গের উদ্যান হবে তাদের বসতিস্থান, যেখানে তাদের পায়ের নিচে দিয়ে বয়ে যাবে নদীর সলিলধারা। সেখানে, সুকোমল কেদারাতে সমাসীন হয়ে তারা সুসজ্জিত হবে উৎকৃষ্ট স্বর্ণালঙ্কারে, ভূষিত হবে মিহিন সবুজ রেশমি ভূষণ আর ঝলকভরা মখমল পরিধানে। জীবন হবে তাদের অনন্ত সুখের সায়র, চিরপ্রসনড়ব হবে তাদের চিরবিশ্রাম।)”
“They shall recline on jewelled couches face to face, and there shall wait on them immortal youths with bowl and ewers and a cup of purest wine (that will neither pain their heads nor take away their reason); with fruits of their own choice and flesh of fowls that they relish. And theirs shall be the dark-eyed houris, chaste as virgin pearls : a guerdon for their deeds.” (56:7, Dawood)
(“তারা যখন মণিমুক্তখচিত আরামকেদারাতে হেলান দিয়ে সুখভাবনায় নিমগড়ব থাকবে তখন তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকবে চিরতরুণ যুবাদল। তারা সুদৃশ্য পাত্রে করে নিয়ে আসবে বিশুদ্ধতম মদিরা (যা তাদের মস্তিষ্কে আনবে না স্বস্তিহীনতা, বোধবুদ্ধিতে আনবে না বৈকল্য)। তাদের সকাশে আসবে তাদেরই পছন্দমাফিক সুস্বাদু ফল, তাদেরই শখের পাখির মাংস। তাদের আমোদপ্রমোদ আর ভোগবিলাসের জন্যে নিয়োজিত থাকবে কৃষ্ণনয়না স্বর্গীয় পরীগণ, কুমারী হীরকের মত অঘ্রাতা ও অস্পৃশ্যা পরী।”)
এরকম পংক্তি আরো কিছু আছে পবিত্র কোরাণে। এগুলো পড়ে আপনার কি মনে হয় জানি না, কিন্তু এগুলো আমাকে লজ্জায় ফেলেছে, বিব্রত ও বিমূঢ় করেছে। কেন ? ইহজগতে যেসব দ্রব্য বা আচার-আচরণ সাধ্বী মুসলমানদের জন্যে কঠোরভাবে বারণ, ঠিক সেই জিনিসগুলোরই লোভ দেখানো হয়েছে পরলোকে। পরলোক সত্যি সত্যি আছে কিনা তার কোন বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ কেউ দাঁড় করাতে পারেনি এখনো, কিন্তু সেই কাল্পনিক বা বাস্তব পরলোকের বিলাসবহুল ও যৌনতা পূর্ণ জীবনের একটা স্থুলরকম রঙিন চিত্র দাঁড় করিয়ে মানবজাতিকে আদেশ করা হয়েছে বর্তমান জগতের আনন্দভোগ থেকে বিরত থাকার জন্যে। সত্যি কথা বলতে কি ‘কৃষ্ণনয়না ও অঘ্রাতা কুমারী’র কথা শুনে আমার গা ঘিন ঘিন করে। বারবার মনে হয় আমার নিষ্পাপ নিষ্কলুষ দৌহিত্রীটির কথা। মনে পড়ে প্রতিদিন স্কুলের পথে দেখা কৃষ্ণনয়না মেয়ে গুলোর কথা। ইহজগতের সৎকর্মের পুরস্কার কি তাহলে পরপারের লাম্পট্যময় জীবন ? এ আমি কেমন করে বিশ্বাস করি বলুন তো ? এ-জীবনের প্রতি আমি কেমন করে আকৃষ্ট হব ? তবু মানা যাক, তর্কের খাতিরে মানা যাক যে, স্বর্গে গিয়ে পুণ্যবান পুরুষের গোপন যৌনক্ষুধা নিবৃত্ত হয়। কিন্তু পুণ্যবান মেয়েদের জন্যে কি ব্যবস্থা ? ওদের জন্যে কোনও পুরস্কারের কথা কি আল্লাহপাক ভুলে গিয়েছিলেন ? তা কি করে হয় ? আল্লাহ আবার ভোলেন কি করে ? কিন্তু তাহলে কোরাণে তার উল্লেখ নেই কেন ?
সবশেষে আমি কয়েকটি আয়াত পেশ করব যেগুলো আমাকে অনেকদিন থেকেই অত্যন্ত বিচলিত ও হতবাক করে রেখেছে।
“You (Muhammad) said to the man (adopted son Zayd) whom God and yourself have favoured : ‘Keep your wife and have fear of God.’ You sought to hide in your heart what God was to reveal (your intention to marry Zayd’s wife). You were afraid of man, although it would have been more proper to fear God. And when Zayd divorced his wife, We gave her to you in marriage, so that it should become legitimate for true believers to wed the wives of their adopted sons if they divorced them. God’s will must needs be done. No blame shall be attached to the Prophet for doing what is sanctioned for him by God.” 33.37, 33.38, Dawood)
(“যে লোকটা (মোহাম্মদের পালকপুত্র জাইয়িদ) তোমার এবং আল্লাহতা’লা উভয়েরই প্রিয়পাত্র তাকে উদ্দেশ্য করে তুমি (মোহাম্মদ) বললে : ‘তোমার স্ত্রী তোমার কাছেই থাক। এবং আল্লাহকে ভয় করো।’ কিন্তু এই বলার মধ্য দিয়ে তোমার মনের ইচ্ছাটি (জাইয়িদের স্ত্রীকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পাওয়া) তুমি গোপন রাখবার চেষ্টা করেছিলে যা আল্লাহতা’লা নিজেই প্রকাশ করতে যাচ্ছিলেন। তোমার মধ্যে লোকভয় আশ্রয় নিয়েছিল, যেখানে তোমার উচিত ছিল শুধু আল্লাহকেই ভয় করা। তারপর যখন জাইয়িদ তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ফেলল, আমরা মেয়েটিকে তোমার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে দিলাম। এতে করে তালাকের পর পালকপুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করার রীতিটি বৈধ করে দেওয়া হল। আল্লাহর ইচ্ছা অবশ্যই পালিত হবে সর্বপ্রকারে। আল্লাহ নিজে যা মন্জুর করে দিয়েছেন নবীর জন্যে তার জন্যে তাঁকে কোনভাবেই দোষারোপ করা চলবে না।” )
আমার জানামতে, পালকপুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করা আরবসমাজে নিষিদ্ধ ছিল এবং নবীজী নিজেও সেই নিষেধের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু জাইয়িদের স্ত্রীর ব্যাপারে সব ওলটপালট হয়ে যাওয়াতেই এই আয়াতটিতে ‘দোষারোপ’-এর প্রশ্নটি দাঁড়িয়ে গেল।
“Prophet, We have made lawful for you the wives to whom you have granted dowries and the slave-girls whom God has given you as booty; the daughters of your paternal and maternal uncles and of your paternal and maternal aunts who fled with you; and any believing woman who gives herself to the Prophet and whom the Prophet wishes to take in marriage. This privilege is yours alone, being granted to no other believer.” (33:50, Dawood)
(“হে নবী, আমরা তোমার জন্যে বৈধ করেছি যথাযথ দীনমোহরপ্রাপ্ত স্ত্রীদের, আর বৈধ করেছি যুদ্ধক্ষেত্রে বিজিত ও আল্লাহপ্রদত্ত দাসীদের ; বৈধ করেছি তোমার মামাতু চাচাতু ও খালাতু ফুফাতু বোনেদের ; বৈধ করেছি সেইসব বিশ্বাসী রমণীদের যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের সমর্পণ করে দেয় নবীর কাছে, নবী নিজে যাদের জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক, এবং যারা তোমার সঙ্গে দেশত্যাগ করেছিল। এই বিশেষ সুবিধাটুকু সংসারে আর কারো জন্যে নয়, শুধু তোমার জন্যই কবুল করা হয়েছে।”)
বিশেষ সুবিধা ? মহানবীর কি এতই প্রয়োজন ছিল এরকম সুবিধার ? না ভাই, আমার এ-ধাঁধা জীবনেও কাটবে না।
সুরা আল্-তাহরিমে একটি ঘটনার উল্লেখ আছে মৌলানা দাউদের অনূদিত কোরাণে (মৌলানা ইউসুফ আলীর অনুবাদেও)। কথিত আছে যে বিবি হাফসা (হজরতের অন্যতম স্ত্রী) একবার স্বামীকে একটি কপ্টিক দাসীর সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলেন। তখন হজরত তাঁর সেই বিবিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ভবিষ্যতে আর কখনো এরকম দৃশ্য তাঁকে দেখতে হবে না। ঘটনাটি বিবি হাফসা বিবি আয়োশার কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলেন। সেই সূত্র ধরেই আল্লাহর আরশ থেকে এই সুরাটি নাজেল হয়।
“Prophet, why do you prohibit that which God has made lawful for you, in seeking to please your wives? ... God has given you absolution from such oaths.” (66:1, Dawood)
(“হে নবী, যে জিনিস আল্লাহ নিজেই তোমার জন্যে বৈধ করে দিয়েছেন সে-জিনিসকে তুমি কেন স্ত্রীদের খুশি করার জন্যে অস্বীকার করতে চাও ? ... এধরনের প্রতিশ্রুতি থেকে আল্লাহতা’লা তোমাকে পূর্ণ মুক্তি দান করেছেন।”)
আমার আর কিছু বলবার নেই। পাঠকের বিচারবুদ্ধি আমার চেয়ে কম নয়।
কলাম্বাস, মেরিল্যাণ্ড
১৫ই জুলাই, ২০০৮
মুক্তিসন ৩৭
ড. মীজান রহমান, কানাডার অটোয়ায় বসবাসরত গণিতের অধ্যাপক। পঞ্চাশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেছেন বেশ ক’বছর। বিশ্লেষনধর্মী প্রবন্ধকার হিসেবেও সুপরিচিত। প্রকাশিত গ্রন্থ সাতটি, সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ 'দুর্যোগের পূর্বাভাস' (২০০৭)। উপরের লেখাটি মেরিল্যান্ড থেকে মুক্তমনায় প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছেন।
লেখাটি আমাদের মুক্তমনার পরবর্তী বই -‘বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়?’– প্রকাশিতব্য সংকলন-গ্রন্থের জন্য নির্বাচিত হল - মুক্তমনা সম্পাদক।