অন্তর্ঘাত
(রাজনৈতিক উপন্যাস)
আবুল হোসেন খোকন
[ সত্তর দশক বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সামরিক শাসনের পটভূমিকে ভিত্তি করে এই রাজনৈতিক উপন্যাসটির অবতারণা। অপ্রকাশিত এ পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ ধারাবাহিকভাবে মুক্তমনায় তুলে ধরা হলো। লেখক ]
পার্ট - ১
(এক)
শরীরে একফোটা শক্তি নেই। বুকটা হাঁপরের মতো উঠানামা করছে। হাত-পা কাঁপছে রি রি করে। দেহটাকে কোন রকমে বিনু এলিয়ে দিলো। পড়ে রইলো লাশের মতো।
গাঢ় অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবতঃ এটা কোন জঙ্গল বা পাটক্ষেত হতে পারে। মরার মতো শুয়ে পড়েছে বিনু। চোখটা খুলে উপরের দিকে তাকালো। আকাশে তারাও দেখা যাচ্ছে না। গাছের আঁড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে হয়তো। রাত কতো হবে এখন? দুইটা? কিংবা তিনটা সাড়ে তিনটা হতে পারে। কারণ মিলিটারি কনভয় থেকে ও যখন লাফিয়ে পড়েছিল, তার ঘণ্টা খানেক আগে দেড়টা মতো বাজছিল। একজন অফিসারকে বলতে শুনেছিল। সুতরাং লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে আসার পর আধ ঘণ্টা কেটে গেছে বৈকী।
বিনুকে গ্রেফতারের পর মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে খানিকটা টর্চারের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। জানতে চাওয়া হয় আরসব সঙ্গীরা কোথায়, ওদের অস্ত্র-শস্ত্রগুলো কোথায়? বিনু এসবের সন্ধান দিতে রাজী হয়েছিল। সেই সূত্র ধরেই ওকে নিয়ে আসা হচ্ছিলো। মিলিটারি কনভয়ের মাঝখানে বসিয়ে চারদিক দিয়ে ঘিরে ছিল সৈন্যরা। তাদের হাতে চকচক করছিলো আধুনিক সব অস্ত্র-শস্ত্র। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক চলার পর লাফিয়ে পড়েছে ও। হাতে হাতকড়া পড়ানো ছিল। কিন্তু কায়দা করে মুক্ত হয়েছিল। সৈন্যরা টের পায়নি। তারপর সুযোগ বুঝে অন্ধকারে লাফিয়ে পড়েছে। পড়েই প্রাণপণে ছুটেছে। অবশ্য গুলি খেয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যাবার আশঙ্কা ছিল। সৈন্যদের সাব মেশিনগান গর্জেও উঠেছিল। কিন্তু ভাগ্য ভাল একটা গুলিও লাগেনি। আঁশপাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে বেরিয়ে গেছে গুলি।
ঠাঁ ঠাঁ ঠাঁ ঠাঁ। আবার গর্জে উঠলো সাব মেশিনগান। চমকে উঠলো বিনু। এক মুহূর্ত মতো কেটে গেল ঝিমমারা অবস্থায়। প্রাণপণে দৌঁড়ানোর আগে সবকিছু একবার বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেলো। সৈন্যরা কি ঘিরে ফেলেছে? ওর অবস্থান জেনে ফেলেছে? নাকি আন্দাজে গুলি চালিয়েছে? সামনের দিক দিয়ে কিছু ছুটে গেল। সৈন্য? না, সৈন্য হবে না। ওদের দৌঁড়ানোর শব্দ অন্যরকম। আবার কি যেন ছুটে গেল। বিট্কেলে গন্ধ ছড়িয়ে আরেকটা কিছু পালিয়ে গেল। বিনু নিশ্চিত হলো, শিয়াল-টিয়াল হবে। সৈন্যরা নিশ্চয়ই এগিয়ে আসছে। সার্চ করছে জঙ্গল। কতোদূর আছে ওরা? গুলির শব্দটা বেশ দূর থেকেই এসেছে। অন্তত: আধা মাইল দূরে তো হবেই। তারমানে পিছু ধাওয়া করে আসছে ওরা।
উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো বিনু। বন্ করে মাথাটা ঘুরে উঠলো। পায়ে প্রচণ্ড ব্যাথা। সম্ভবত: দৌঁড়ানোর সময় মচকে গেছে। শরীরের এখানে-ওখানে দপ্দপ্ করে জ্বলছে। জঙ্গলের আঘাতে কেটেছিঁড়ে গেছে হয়তো। দাঁড়াতে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে যাবার অবস্থা হলো। শরীর কাঁপছে। বুকের ধুপ্ ধুপ্ শব্দ এতো জোরে হচ্ছে যে, মনে হচ্ছে আশপাশ থেকেও শোনা যাবে। আতঙ্ক পেয়ে বসেছে বিনুকে। সৈন্যরা এসে পড়লো নাতো? ধরা পড়লে নির্ঘাৎ গুলি করে হত্যা করবে। কতোজনকে ওরা এভাবে হত্যা করেছে, তার ঠিক নেই। ভাগ্য ভাল বলে ও এখনও বেঁচে আছে। আর দেরী করা ঠিক হবে না। সৈন্যরা মরিয়া হয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে।
ঘন অন্ধকারে চোখটা বেশ সয়ে গেছে। তাছাড়া জোনাকির আলোও কাজ দিচ্ছে, এতোক্ষণ খেয়াল করেনি ও। এগুতে শুরু করলো বিনু। ঘন জঙ্গল। তবে শুকনো গাছপালাই বেশি। হাঁটতেই মচমচ শব্দ হয়। পায়ে ক্রেপসোলের জুতো আছে। কিন্তু শক্ত মাটির জমির ভেতর দিয়ে দৌঁড়াতে গিয়ে ফেঁটে গেছে। একেবারে লোহার মতো ওইসব জমির চাঁই। তাছাড়া কেটে ফেলা পাটগাছের গোড়া এবং কাঁটার আঘাতে জুতোর তলা মনে হয় আস্ত নেই। ডাল-পালার আঘাতেও পা কেটেকুটে রক্ত ঝরছে। জায়গাগুলোতে দগদগে ব্যাথা। তবু কোন রকমে সাবধানে পা ফেলে বিনু এগুলো। কিছুদূর যাবার পর বুঝতে পারলো এটা একটা গোরস্থান। গ্রামের গোরস্থানগুলো এরকমই হয়ে থাকে। বাঁধানো কবর থাকে না।
কবরস্থান ছাড়িয়ে আসার পর বড় বড় পাটক্ষেতের মধ্যে ঢুকলো ও। আকাশে এখন অসংখ্য তারা দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারটা পুরোপুরি সয়ে এসেছে। দেখতে পাচ্ছে বিনু। সারি সারি পাটের গাছ আর গাছ। খুব সাবধানে গাছের ভেতর দিয়ে শরীর ঢোকাতে থাকলো ও। কারণ জোরে চলতে গেলে গাছ নড়াচড়া করবে, আশে পাশে সৈন্যরা থাকলে টের পেয়ে যাবে। তাই খুব সাবধানে যেতে হবে। কোনক্রমেই ধরা পড়া চলবে না।
একটু দাঁড়ালো। কোন্ দিকে, কোথায় যাবে তা ঠিক করে নেওয়া দরকার। দিক ভুল হলে ফাঁদে আটকা পড়া বিচিত্র নয়। সুতরাং ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হবে। ভাবনার প্রথম বিষয় হলো, অন্ততঃ মাইল খানেক চলে এসেছে ও। সৈন্যরা সংখ্যায় শ’খানেকেরও বেশি হবে। তাই অন্ধকারে ওরা এতোদূর আসতে পারবে না। তাছাড়া ওদের সার্চ করতে হচ্ছে। ফলে বিনু ওদের থেকে অনেক এগিয়ে এসেছে। এভাবে এগুতে থাকলে ক্রমেই দূরে সরে আসতে পারবে। তবে সমস্য হলো যে, এই জায়গাটা সম্পর্কে ওর কোন ধারণা নেই। সৈন্যরা তাদের ক্যাম্প থেকে আরও সৈন্য আনিয়ে গোটা এলাকা ঘিরে ফেলতে পারে। তাই পালানোর পথ সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। অথচ সেটাই নেই। অবশ্য, এই রাতে ক্যাম্প থেকে আরও সৈন্য আসবে বলে মনে হয় না। তবে, দিনের বেলায় যে কম্বিং অপারেশন চালাবে তা নিশ্চিত। সুতরাং ভোর হবার আগেই নিরাপদে সরে যেতে হবে। কোথায়, কোন্দিকে যাবে ঠিক করতে পারা যাচ্ছে না। ভাগ্যের ওপর নিজেকে ছেড়ে দিলো বিনু। সামনের দিকে এগুতে থাকলো।
(দুই)
পূব আকাশটা ক্রমেই ফর্সা হচ্ছে। ভুতুরে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। পরিস্কার হয়ে উঠছে প্রকৃতি। সেইসঙ্গে এক অপূর্ব শিহরণ জাগিয়ে তুলছে হালকা বাতাস।
আরেকটু পরিস্কার ভাব আসতেই প্রকৃতির দুয়ার উন্মুক্ত হলো। যতোদূর চোখ যায় শুধু ফসলের ক্ষেত। পাট, ধান, আখসহ নানান জাতের ফসল। মৃদুমন্দ বাতাসে এসবের মাথাগুলো দোল খাচ্ছে। কিচির মিচির শব্দ তুলে পাখিরা পাখা মেলছে আকাশে। উজ্জ্বল আলো না থাকায় ওগুলোর রং দেখাচ্ছে কালো। এখনও চকচকে শুকতারা নিভে যায়নি, তবে পূব আকাশ রাঙা হলেই নিভে যাবে।
মাঝারী সাইজের পাটক্ষেতের আইল দিয়ে এগিয়ে চলেছে বিনু। এ পর্যন্ত সৈন্যদের দেখা মেলেনি। তবে অনেক দূরে পিছনের দিক থেকে মাঝে মাঝে মেশিনগান এবং রাইফেল গর্জে ওঠার শব্দ শুনেছে। ওপর দিয়ে কয়েকটা বুলেটও ছুটে গেছে শিস কেটে। এতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ওগুলো ফাঁকা গুলি ছিল। কাওকে টার্গেট করে চালানো হয়নি। বেশ অনেকক্ষণ আর শব্দ শোনা যাচ্ছে না। হয়তো ওরা অনেক পিছনে পড়ে গেছে, অথবা আশা ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। কম করে ৫/৬ মাইল তো হেঁটেছেই বিনু। সেদিক থেকে এখন নিজেকে অনেকটাই নিরাপদ মনে করা যেতে পারে। অবশ্য সৈন্যরা যদি কম্বিং অপারেশন চালানোর জন্য গোটা এলাকা জুড়ে অভিযান চালায়, তাহলে ভিন্ন কথা।
কয়েকটি নালা এবং আখক্ষেত পেরিয়ে বিনু যখন একটি বড় আকারের গাছতলায় থামলো, তখন সূর্য উঠতে যাচ্ছে। দূরে বাড়ি-ঘর স্পষ্ট দেখা যায়। কৃষকেরা গরু-লাঙ্গল নিয়ে বেরুচ্ছে। শিশু-কিশোররা দাঁতে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ঘুরছে। বিনু এখন কি করবে? সামনের গ্রামে ঢুকবে কি?
না ঢুকে উপায়ও নেই। কারণ ক্ষুধায় নাড়ি-ভূরি জ্বলে যাচ্ছে। খেয়েছে সেই আগের দিন সন্ধ্যা রাতে। তারপর যতো ধকল গেছে তাতে করে পেটে সামান্য দানা-পানিও নেই। অবশ্য হেঁটে আসার সময় ডোবা থেকে আজলা ভড়ে পানি পান করেছিল। তাও এখন শেষ হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। সেখান থেকে প্রচুর রক্ত ঝড়েছে। ওষুধ না লাগালে গ্যাংগ্রিন ধরে যেতে পারে। কিন্তু গ্রামে ঢোকা অথবা কারও মুখোমুখি হওয়া উচিত হবে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন। বিনুর রক্তাক্ত এবং বিদ্ধস্ত অবস্থা দেখে অপরিচিত গ্রামের লোকজন নানান কিছু সন্দেহ করতে পারে। তাছাড়া ইতিমধ্যেই মিলিটারি বা তাদের সাদা পোশাকধারী লোকেরা ছড়িয়ে পড়েনি তাইবা কে বলবে? যদি তারা নাও এসে থাকে, তবু লোকজনের মুখোমুখি হলে ওর খবর পৌঁছে যেতে দেরী হবে না। সেক্ষেত্রে পূণরায় ধরা পড়তে হবে। সুতরাং গ্রামে প্রবেশ করা বা কোন মানুষের মুখোমুখি হওয়া মোটেও নিরাপদ হবে না। আরেকটি রাতের জন্য অপেক্ষা করাই যুক্তি সঙ্গত, তখন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়া যাবে। কিন্তু, অতোক্ষণ টিকে থাকবে কি করে বিনু? ক্ষুধার্ত এবং ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে টিকে থাকা অসম্ভব। তার চেয়েও বড় কথা ওর জানা প্রয়োজন, এই এলাকার নাম কি? ও কোথায় আছে? এটা জানার ওপরই নির্ভর করছে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার পথ বের করা। এজন্য গ্রামের কারও না কারও সঙ্গে কথা বলা দরকার। কোন্টা করা উচিত ঠিক করতে পারছে না বিনু।
-------- চলবে --------
আবুল হোসেন খোকন : লেখক-সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।