অন্তর্ঘাত

(রাজনৈতিক উপন্যাস)

আবুল হোসেন খোকন 

[ সত্তর দশক বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সামরিক শাসনের পটভূমিকে ভিত্তি করে এই রাজনৈতিক উপন্যাসটির অবতারণা অপ্রকাশিত এ পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ ধারাবাহিকভাবে মুক্তমনায় তুলে ধরা হলো লেখক

পার্ট - ১০ 

আবার কিছু সময় চুপচাপ থাকলো ওরা হাঁটছেইবেশ কিছু পরে বিপ্লব বললো, ‘অনেক দূর চলে এলামচোখটা খুলে দিলে কি অসুবিধা হবে? হাত তো বাঁধাই আছে অপরিচিত জায়গায় পালাতে পারবো নাএতো ভয় পাচ্ছো কেন?’

   বিপ্লবের কথা শুনে মুখোশধারীরা নিজেদের মধ্যে সংকেত বিনিময় করলোএখন অবশ্য মুখোশ পরা নেই কারোখুলে ফেলেছে অনেক আগেইওদের মধ্যে যিনি কমান্ডার ছিলেন, তিনি ইঙ্গিত করতেই একজন এগিয়ে এলোবললো, ‘খুব কি অসুবিধা হচ্ছে?’

   ‘শক্ত করে বেঁধেছোমাথায় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে জবাব দিলো বিপ্লবএরপর বাঁধন খুলে গেলপ্রথমে কিছুই দেখতে পেলো না ওবেশ কিছুক্ষণ পর সবকিছু সয়ে এলো অন্ধকার রাততারার আলোয়ই যতোটুকু দেখা যাচ্ছেতা ছাড়া সামনে ধু ধু অন্ধকারনদীর গর্জন ভেসে আসছে

   কথা বললো বিপ¬, ‘জানি আমাকে হত্যা করবেভারতের দালা এটাই কি শুধু আমার অপরাধ?’

   জবাবে একজন বললো, ‘না, শুধু একটা অপরাধ নয়তুমি এবং তোমার দল শ্রেণীশত্র শ্রেণীশত্রদের ক্ষমা নেই

   ‘আমি তো ক্ষমা চাইনিকিন্তু আমরা শ্রেণীশত্র তা কিভাবে ঠিক করলে?’

   ‘এ দেশে বিপ্লবের স্তর হলো জনগণতান্ত্রিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক এই সমাজ ব্যবস্থায় শ্রেণী-সংগ্রাম এবং জনযুদ্ধই হলো বিপ¬বের উপায়তোমরা তা মানো নাতোমরা বিপ্লবের নামে ভুল ব্যাখ্য দিয়েছে, শ্রেণীশত্রদের হাতকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছো

   ‘যেমন?’

   ‘যেমন তোমরা বলেছো, বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিকপ্রকৃত স্তরকে ডিঙিয়ে তোমরা ভ্রান্ত তত্ত্ব দিয়েছো তোমাদের তত্ত্ব, বিপ্লবকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে প্রতিবিপ্লবী হিসেবে তোমরা কাজ করছোকাজেই তোমরা শ্রেণীশত্র

   ‘এটা ব্যাপক অনুশীলন প্রক্রিয়ার বিষয়কার পার্টি-লাইন সঠিক, আর কার বেঠিক সেটা এই অনুশীলন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে প্রমাণ হবেআমাদের লাইনও ভুল হতে পারে, তোমাদের লাইনও ভুল হতে পারেআবার আরো যারা বিপ্লবের নামে কাজ করছে, তাদেরও ভুল হতে পারেএটা কোন অস্বাভাবিক বিষয় নয়আবার কারো না কারো লাইন ঠিকও হতে পারেএটা নির্ভর করবে ব্যাপক অনুশীলনের মাধ্যমে দেখার মধ্যদিয়েসুতরাং তোমরা আগেই কি করে তোমাদের লাইনকে সঠিক মনে করছো? তাছাড়া সব বামপন্থী দলই যদি তাদের নিজেদের আলাদা আলাদা লাইনকেই সঠিক মনে করে এবং অন্যদেরটা ভুল মনে করে, তাহলে বিপ¬বী ঐক্য হবে কিভাবে? বিপ¬বীরা নিজেরাই যদি নিজেদের দ্বন্দ্বে খতম হতে থাকে তাহলে বিপ্লব কোনদিন হবে কি?’

   সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো না কেউ কিছুক্ষণ পর একজন বললো, ‘তোমার কথায় হয়তো যুক্তি আছেকিন্তু আমরা নিশ্চিত যে আমরাই সঠিকতাছাড়া পার্টি-সিদ্ধান্তে আমরা বিশ্বাসীসুতরাং আমরা কোন ভুল করছি না’ 

   পাশে গর্জনমুখর নদীতীরের ঠাণ্ডা আর নরম বালি মাটির উপর দিয়ে হাঁটছেঢেউয়ের ছলা ছলা শব্দ, গাঢ় অথচ শক্তিশালী বাতাসকে ঠেলে চলছেবিপ্লব নিশ্চিত হয়ে গেছে নিজের ভাগ্য সম্পর্কেতবু মাঝে মাঝে কথা বলছে

   একজন বললো, ‘তোমরা আমাদের কয়েকজন কমরেডকে হত্যা করেছোঠিক তুমি নও, তোমার দলের লোকেরা করেছেতুমি হত্যাকারী দলের একজনসুতরাং এখানেও তুমি অপরাধী

   সঙ্গে সঙ্গে কিছু বললো না বিপ্লবএকটু ভেবে বললো, ‘তোমরাই আগে হত্যার রাজনীতি শুরু করেছোআমরা যখন রাজনীতি শুরু করি তখন আমাদের প্রধান টার্গেট ছিল সরকার, তোমরা নয়অথচ তোমরা একে একে হত্যা করতে থাকলে আমাদেরকয়েকশ কমরেডকে হত্যা করেছো তোমরাসে তুলনায় আমরা কিছুই করিনি তোমাদের লোক হারানোর জন্য তোমরাই দায়ি, আমরা নই

   জবাব দিলো না কেউ বিপ্লবকে ধরে নিয়ে যাওয়া দলটি এখন নদীর একেবারে কাছে দিয়ে হাঁটছেওদের নেতা সবার আগেদলের লোকদের হাতে ছোট-বড় নানান অস্ত্র চোখে পড়ছেবড় অস্ত্রের মধ্যে ব্রেটাগান, কারবাইন রয়েছে বিপ্লবের চোখ-সওয়া হয়ে গেছেএখন সব দেখতে পাচ্ছেহাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো ওরতবু ভাবছিল কি করে পালানো যায়হাত বাঁধা না থাকলে ভাল হতোদুটো হাতই রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে ভারী বস্তুর মতো লটকে আছে যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে সংযোগ স্থলগুলোকথা বলে সুযোগের সন্ধান করছে বিপ্লব

-        আমি যে ওই পথ দিয়ে আসবো তোমরা জানলে কি করে?

   জবাবে হাসলো একজনবললো, ‘আমরা শুধু তোমাকে নয়, তোমার সঙ্গে আরো দুজনকে আশা করেছিলামসঙ্গে হাতিয়ারও আশা করেছিলামকি করেছো?’

   বিপ্লবও হাসলো, ‘ছেড়ে এসেছি

-        সঙ্গের দুজন কোথায়?

-        ওরাও একে একে ছেড়ে গেছে

-        হাতিয়ার কার কাছে রেখেছো?

-        এ জবাব কোন যুক্তিতে আশা করছো

    জবাব পাওয়া গেল না প্রশ্নের কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবার কথা বললো বিপ্লব, ‘হাত জোড়া অচল হয়ে গেলখুলে দেওয়া যায় না?’

-        ওটা আর সচল হতে দিয়ে লাভ কি? সময় তো শেষ

-        মানে?

-        মানে বুঝবে এক্ষুণিএকটু অপেক্ষা করো 

   মরিয়া হয়ে চিন্তা করতে লাগলো ওডান দিকে অথৈ নদী সামনে-পিছনে-বামে ধু ধু মাঠকোথাও কোন জনবসতি নেইনদীতে কোন নৌকাও নেইচিকার করলেও শুনবে না কেওভুল করে ফেলেছে ও মনে মনে ভাবলোআরো আগে সুযোগের চেষ্টা করা উচিত ছিল 

   অকস্মা থেমে পড়লো দলটিএমন একটা জায়গায় থামলো, যেখানে আরো প্রতিকূল অবস্থানদীটা বাঁক নেওয়ায় তৈরি হয়েছে বড় একটা ভাঙনক্ষেত্রপাড়টাও অনেক উঁচুতেঅর্থা বামদিকে যাবার পথ বন্ধআর সামনের দিকটা ভাঙনে ভাঙনে বিশৃঙ্খলওটাও সুবিধজনক পথ নয়তার ওপর পড়ে আছে একটা বিরাট আকারের কাঠের গুড়ি বিপ্লবকে সেই গুড়িতে বসানো হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে পা জোড়া একসঙ্গে বেঁধে ফেলা হলো পালানোর যেটুকু উপায় ছিল তাও শেষ হয়ে গেলচোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো বিপ্লবেরভয় পাওয়া চলবে না কিছুতেই

   হঠা প্রশ্ন করলো একজন, ‘ভয় পেয়েছো বিপ্লব?’

   জবাবে দুঢ়ভাবে বললো, ‘কোন বিপ্লবী কখনও ভয় পায় নাসাহসই তাঁদের জীবনধর্ম

   ‘থ্যাঙ্কু, সেটাই আশা করেছিলাম’ 

   এবার ওদের কমান্ডার এগিয়ে এলোমুখটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে নাতবে বেশ দৃঢ় এবং কঠোর মনে হলোলোকটা পকেট থেকে সিগারেট বের করলোম্যাচ জ্বেলে ধরালোমুখের হাড়গুলো বেরিয়ে আসা, গোঁফ আছে ম্যাচের আলোয় ওইটুকুই দেখতে পেলো বিপ্লবএকটা সিগারেট এগিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘সিগারেট নাওঠোঁটে গুঁজে দিতে চাইলোবিপ্লব ফেলে দিলোবললো, ‘হাত-পা বাঁধা অবস্থায় টানতে পারবো নাদুঃখিত কমান্ডার লোকটিও পাল্টা দুঃখ প্রকাশ করলোবললো, ‘সরি, বাঁধন খুলতে পারছি না

   লোকটা পাইচারি করলোহাত উঁচিয়ে ঘড়ি দেখলোতারপর শুরু করলো

-        বিপ্লব?

-        বলুন

-        এখানে কেন নিয়ে আসা হলো, তোমার জানা দরকার 

   পাইচারির সঙ্গে কয়েকটান সিগারেট পান করলো কমান্ডারতারপর আবার শুরু করলো

-        তোমরা এই অঞ্চলে আমাদের ৪ জন কমরেডকে হত্যা করেছোআমাদের পার্টির বিরুদ্ধে তপরতা চালাচ্ছোতোমরা মুসুদ্দি দালাল বুর্জোয়া এবং সামন্তবাদের স্বার্থরক্ষা করছো জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিরোধীতা করছোতোমরা প্রতিবিপ্লবী ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দালালতোমরা বিপ্লব ও জনগণের শত্রতাই 

   আবার সিগারেটে টান দিলো কমান্ডারতীক্ষè দৃষ্টিতে বিপ¬বকে পর্যবেক্ষণ করলোতারপর বললো, ‘পার্টি তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেএই মৃত্যুদণ্ড এখন আমরা কার্যকর করতে যাচ্ছিতোমার কোন বক্তব্য থাকলে বলতে পারো

   হো হো করে হাসলো বিপ্লববললো, ‘আমরাইতো তোমাদেরকে বিপ্লব ও জনগণের শত্রবলে মনে করি তোমাদের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল মনে করি পাকিস্তান তোমাদের অস্ত্র আর প্রশিক্ষণ দেয়তোমরা লাল পতাকা দিয়ে লাল পতাকা ধ্বংস করছো শ্রেণীশত্র এবং প্রতিবিপ্লবী তো তোমরাইউল্টো আমাদেরই প্রতিবিপ্লবী বলতে শুরু করেছো! চমকার, অতি চমকার!

   কঠোর হয়ে উঠলো কমান্ডারসহ বাকি সকলের মুখ কমান্ডার সিগারেটে পরপর কয়েকটি টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলোতারপর পাইচারি শুরু করলোহঠা ঝুঁকে এলো বিপ্লবের দিকে

-        বিপ্লব

-        শুনছি

-        তুমি কি বাঁচতে চাও?

  ভিতরে ভিতরে চমকে উঠে জবাব দিলো

- কিভাবে?

-        যদি সব তথ্য জানাও এবং আমাদের দলে যোগ দাও.......

-        তথ্য? কিসের তথ্য?

-        তোমাদের অস্ত্রগুলোর সন্ধান দিতে হবে, পার্টি-পরিকল্পনা বলতে হবে এবং সেল্টার ও ক্যাডারদের পরিচয় জানাতে হবেজানাবে

আবার হাসলো বিপ্লবললো, ‘এসব জানালে কি ছেড়ে দেবে আমাকে?’

-        সত্যি কথা বললে ছেড়ে দিতে পারি

-        কী করে বুঝবে যে সত্যি কথা বলছি?

-        বুঝবোকারণ আমাদের কাছেও অনেক তথ্য আছেমেলাতে গেলেই সত্য-মিথ্যা ধরে ফেলবো 

   চুপ করে থাকলো ও কমান্ডার তাকিয়ে থেকে বললো, ‘কী ভাবছো? বলবে? বলে দাও এবং আমাদের সদস্য হয়ে যাও সত্যিকারের বিপ্লব করতে পারবে জনগণের জন্যকি? বলবে?’

   হাসলো বিপ্লব, ‘না, আমাদের কারো কাছ থেকে কোন অবস্থাতেই তথ্য পাবে না পার্টির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার লোক আমরা নইভুল করছো তোমরা

   গম্ভীর হলো কমান্ডার, ‘হুমশেষ সুযোগটা হাতছাড়া করা ঠিক হচ্ছে নাদুই মিনিট সময় দিলামভেবে দেখোবলে দাও আর্মসগুলো কোন্ কোন্ সেল্টারে আছে এবং কোথায় কোথায় সেল্টার?’

   আবার হাসলো বিপ্লব, ‘দুই মিনিট কেন, অনন্তকাল সময় দিলেও  লাভ হবে না বিপ্লবীরা কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে না, মুত্যুকে ভয় পায় নাআমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত’ 

…………………………………………. 

   দৃশ্য পরিস্কারপরের দিন উত্তাল নদীতে একটা গলাকাটা লাশ ভেসে যাচ্ছিলোলাশটা জাসদের নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক বিপ্লবের

---- চলবে ----


আবুল হোসেন খোকন : লেখক-সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।