অন্তর্ঘাত
(রাজনৈতিক উপন্যাস)
আবুল হোসেন খোকন
[ সত্তর দশক বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সামরিক শাসনের পটভূমিকে ভিত্তি করে এই রাজনৈতিক উপন্যাসটির অবতারণা। অপ্রকাশিত এ পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ ধারাবাহিকভাবে মুক্তমনায় তুলে ধরা হলো। লেখক ]
পার্ট - ১১
(দশ)
....... প্রায় তিন বছর পর। এরমধ্যে বিনুদের চোখের সামনে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। ওদের শ্রদ্ধেয় নেতা কমরেড তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। আসলে সামরিক শাসন জারি করে এই স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মাটিতে রক্তের গঙ্গা বইয়ে দেওয়া হয়েছে। এক ভয়ঙ্কর নির্মূলন অভিযান চালানো হয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর স্টাইলে। নীল নকশামত চলেছে সব কাজ।
নির্মূল ও হত্যার মহোৎসব চলেছে সমাজবিপ¬বের সকল ক্ষেত্রসহ বেসামরিক পর্যায় এবং সামরিক বাহিনীর ভেতরে। সামরিক বাহিনীতে একের পর এক ‘অভ্যুত্থান’ হয়েছে। আসলে এর প্রায় সবই ছিল সাজানো, পরিকল্পিত এবং এজেন্ডাভিত্তিক। এই নাটকের মধ্যদিয়ে সেনাবাহিনীতে চালানো হয়েছে পৈশাচিক শুদ্ধি অভিযান। আগে বাছাই করা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শের সদস্য এবং সত্যিকারের দেশপ্রেমিকদের। তারপর ‘অভ্যুত্থান’ তৈরি করে তাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে এঁদের করা হয়েছে হত্যা। এই যজ্ঞের শিকার হয়েছে সামরিক বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য। শুধু হত্যাযজ্ঞই হয়নি হয়েছে গুম, জেল, চাকরিচ্যুতি এবং বিতাড়ন। যারাই একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের চিন্তাকে লালন করেছে এবং পাকিস্তানি আদল থেকে বেরিয়ে ’৭১-এর জনগণমুখী মুক্তিবাহিনী বা গণবাহিনীর মতো একটি জনকল্যাণমূলক সামরিক বাহিনীর প্রত্যাশা করেছে তাদের সবাইকে ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে। হয়েছে জনযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সশস্ত্রবাহিনীকে গণবিমূখ, ক্যাণ্টনমেণ্টে আটকে থাকা জনবিচ্ছিন্ন এবং সাম্রাজ্যবাদের অনুগত করার করার কাজ। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের এই অভয়ারণ্য গড়ে তোলার কাজটি করা হয়েছে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে।
ঠিক একই এজেন্ডায় নির্মূলযজ্ঞ চলানো হয়েছে বেসামরিক পর্যায়ে। ‘সন্ত্রাস নির্মূল’ ‘বে-আইনি অস্ত্র উদ্ধার’ এবং ‘দুস্কৃতকারী’ দমনের নামে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা ছাড়াও কাটা দিয়ে কাটা তোলা বা লাল পতাকা দিয়ে লাল পতাকা নিধনের নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা হয়েছে। চেষ্টা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে মুত্তিযুদ্ধের মতাদর্শকে সমূলে ধ্বংসের। তাই অবিরত রক্তের বন্যায় রঞ্জিত হয়েছে সবুজ-শ্যামল মাটি। খতম হয়েছে হাজার হাজার দেশপ্রেমিক মানুষ। লক্ষ লক্ষ মানুষ হয়েছে জেল-জুলুম এবং পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার। দমননীতির স্টিম রুলার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে স্বপ্নবান মানুষের সকল স্বপ্নসহ তাদের ভবিষ্যত। একই লক্ষ্যে জনপদ জুড়ে তৈরি করা হয়েছে বিভক্তি আর বিভক্তি। বিস্তার ঘটানো হয়েছে দুর্নীতি-লোভ আর লালসার অবাধ রাজত্ব। ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে মানুষের সং-বদ্ধতাকে। জনগণের প¬াটফর্মকে করা হয়েছে ভয়ঙ্করভাবে বিদ্ধস্ত।
আর এই এজেন্ডার মধ্যদিয়ে সামরিক জান্তা সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে শোষক এবং সাম্রাজ্যবাদীদের আরেক দোসর মৌলবাদ, প্রতিক্রিয়াশীল আর ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার-আলবদর-জামায়াতীচক্রকে। জেনারেল জিয়া এজন্য ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত দালাল আইন বাতিল করেছে, এদের ভোটাধিকার ও রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে, নিজে নতুল দল বানিয়ে তাতে এদের অন্তর্ভূক্ত করেছে। করেছে সমরজান্তার অংশীদার। জিয়ার নতুন দলে ’৭১-এর যুদ্ধপরাধী-মৌলবাদীচক্র ছাড়াও যুক্ত হয়েছে মওলানা ভাসানীর অনুসারীসহ বামপন্থী বলে পরিচিত একশ্রেণীর রাজনীতিকরাও।
এছাড়া এই প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত ’৭২-এর সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে, সংবিধান থেকে অসাম্প্রদায়িকতা এবং প্রগতিশীলতাকে বাতিল করা হয়েছে। এরপরই বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর নামে এক নতুন লক্ষ্যকে সামনে রেখে সামরিক শাসন তুলে নেওয়া হয়েছে।
বিনুরা আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করেছে। কর্নেল তাহেরসহ ওদের অন্তত ১০ হাজার কমরেডকে হত্যা করা হলেও মূল নেতা হিসেবে রহস্যময় ‘দাদা’ রহস্যই থেকে গেছেন। তিনি আছেন বহাল তবিয়তে। কিছুদিনের জন্য তাকে জেলের ভিতরে সুরক্ষায় রাখা হলেও ফের মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি এমনসব কাজ করছেন যাতে অনেক রহস্যই উন্মোচন হয়ে পড়ছে। তারসঙ্গে আগে থেকেই যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সংযোগ ছিলÑ তা একেবারেই খোলাশা হয়ে গেছে। বিনুদের বিপর্যয়ের কারণটা কি তাহলে এখানেই?
(এগারো)
একটি মাটির বাড়ি। দেওয়ালে মোটা বালিশে পিঠ রেখে আধা শোয়া বিনু। উদাস চেয়ে আছে। পা দুটো লম্বা। অনেকটা ছড়ানো। ডান পাশে ম্যাগজিন ভর্তি বুলেটসহ একটি স্টেনগান। আরেক পাশে বুলেট ভর্তি আরো দুটো অতিরিক্ত ম্যাগজিন।
বিনু গুরুতর আহত। তাই শয্যাশায়ী। রয়েছে একেবারেই নিজস্ব এবং পার্টিসহ সকলের অজ্ঞাত এক গ্রামীণ সেল্টারে। গত ৩ বছরে ও অনেকবার রেইড, অ্যাম্বুশ এবং গানফায়ারের মুখে পড়েছে। এগুলো হয়েছে সামরিক বাহিনী, পুলিশ, প্রতিপক্ষ আন্ডারগ্রাউন্ড চরমপন্থী বিভিন্ন গ্র“প এবং নিজেদের উপদল থেকে। এতোকিছুর পরে আজও প্রাণে বেঁচে আছে ও গুরুতর আহত হয়ে। পুলিশ এবং সরকারী বাহিনীর রেইডে পড়েছিল ও। সঙ্গে আরো তিন কমরেড ছিল। প্রত্যেকে সশস্ত্র থাকলেও পর্যাপ্ত বুলেট ছিল না। ফলে গোলাগুলির এক পর্যায়ে এসএমজি এবং কাটারাইফেলের বুলেট শেষ হয়ে যায়। তখন সরকারী বাহিনীর বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তিন কমরেড। বিনু’র শরীরে বিদ্ধ হয় আধা ডজন বুলেট। রাতের বেলায় এক সেল্টারে এই রেইডের ঘটনা ঘটেছিল বলে বিনু অল্পের জন্য ধরা পড়েনি। আহত হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল। তখন গড়িয়ে সেল্টার থেকে পাশের এক খাঁদে পড়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে এক সেল্টারদাতা ওকে উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় রেখে আসে। ওরসঙ্গে যে রিভলবারটা ছিল সেটা হারিয়ে গেছে। পরে ওটা সরকারী বাহিনী পেয়ে যায়। বিনু শুনেছে, ওর সঙ্গে যে কমরেডরা গুলিবিদ্ধ হয়েছিল তাদের দু’জন সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়, একজন অজ্ঞান অবস্থায় মারা যায় হাসপাতালে। ওদের অস্ত্রগুলো সরকারী বাহিনীর কব্জায় চলে যায়। এই অবস্থায় বিনু এখন সেল্টারে আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছে। এ সেল্টারের কথা অন্য কেও জানে না। জানে শুধু একজন। সে হলো রিতু।
এরমধ্যে বিনুর চোখের সামনে ঘটে গেছে আরো অনেক ঘটনা। ওর পার্টি হঠাৎ বিপ¬বী গণবাহিনী এবং বিপ¬বী সৈনিক সংস্থা ভেঙে দিয়েছে। বিনুর বিশ্বাস কাজটি আসলে পার্টি করেনি। করেছেন সেই রহস্যময় ব্যক্তি ‘দাদা’। কাজটা করে পার্টিতে সবচেয়ে বড় ধসটি নামিয়ে দেওয়া হয়। পার্টি ভেঙে কয়েক টুকরো হয়েছে। পার্টির সামরিক শক্তি খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে। এই শক্তি এখন একে অপরের প্রতিপক্ষ। এই শক্তির কোনটা বিপথে চলে গেছে, কোনটা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে, কোনটা অন্য দলে চলে গেছে, কোনটা সরকারী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করেছে। রহস্যময় ব্যক্তিটির মাধ্যম থেকে এখন পার্টির এই সামরিক শক্তিকে শোষক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্ষমতার উৎস সামরিক শাসকবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আকার-ইঙ্গিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তুলে না দিলে শাসকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এরইমধ্যে পার্টির সকল সেল্টারসহ সামরিক শক্তির যাবতীয় তথ্য তুলে দেওয়া হয়েছে এই বাহিনীর গোয়েন্দা শাখায়। ফলে এখন চলছে নতুন কায়দায় সরকারী অভিযান। এতে করে পার্টি-সংগঠনের তাবৎ নেটওয়ার্ক এবং সাংগঠনিক ভিত্তি একরকম ধ্বংস হয়ে গেছে। ভয়াবহ অন্তর্ঘাতের শিকার হয়েছে এবং এখনও হয়ে চলেছে পার্টি, পার্টি সংগঠন-গণসংগঠন, সামজিক বিপ¬বের শক্তিভিত এবং মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শের সংগ্রাম ও লড়াই। রাষ্ট্রীয় বন্দুক পরিপূর্ণভাবে শত্র“শক্তির কব্জায় চলে গেছে।
বিনু সরকারী বাহিনীর হাতে নিজেদের সামরিক শক্তি তুলে দেয়নি, দিতেও রাজী নয়। ও ওর ঘনিষ্ঠ কমরেডদের মাধ্যমে এই নিষেধাজ্ঞা প্রচারও করে দিয়েছে। ফলে এখন বিনু পার্টির ভিতরেও অন্তর্ঘাতিদের টার্গেটে। এ অবস্থায় বিনু নিজের প্রয়োজনে স্টেনগানটাকে সঙ্গে রেখেছে, আর ওর সাহায্য-সহযোগী হিসেবে রিতুকে দিয়েছে পয়েণ্ট ৩৭ ক্যালিবারের চাইনিজ লামা পিস্তলটি। যদিও কোনভাবেই ওটা নিতে চায়নি রিতু। তারপরেও অনেক যুক্তি-তর্কের পর রাজী হয়েছে।
‘বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতা উৎস’Ñ কমরেড মাও সে তুংয়ের এই কথাটা স্মরণ করছিল ও। নিজের মতো করে ভাবছিলÑ এই নল যার হাতে, ক্ষমতা থাকে তার হাতে। এ নল যদি ধনিক শ্রেণী বা শোষকগোষ্ঠীর কব্জায়, অথবা পুঁজিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের কব্জায় থাকে তাহলে ক্ষমতাও থাকে তাদের হাতে। এ ক্ষেত্রে জনগণ হয় তাদের টার্গেট, হয় ক্ষমতাহীন। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের বন্দুক কার কব্জায়? জনগণের কব্জায় কি? না। এ বন্দুক জনগণের কব্জায় নেই। সে কারণেই জনগণ এই বন্দুকেরই টার্গেট। সুতরাং এখান থেকে মুক্তি প্রয়োজন। এই মুক্তির জন্যই ১৯৭১-এ এদেশের জনগণ বন্দুক নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। তখন রাষ্ট্রীয় বন্দুক যাদের হাতে ছিল, তাদেরকে বিদ্রোহে সামীল করে জনগণের পক্ষে টেনে আনা হয়েছিল। সবাই তখন জনগণ হয়ে গিয়েছিল বলেই রচিত হয়েছিল মহান জনযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ। আর এই যুদ্ধই এনে দিয়েছিল মহান বিজয়, গৌরবের বাংলাদেশ। কিন্তু তারপর? তারপর যুদ্ধের কোন প্রত্যাশাই পূরণ হয়নি। বন্দুক বা ‘সকল ক্ষমতার উৎস’কে যে জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করার কথা ছিলÑ শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। হয়নি বলেই জায়গাটি সেই পুরনো পাকিস্তানি আদলেই থেকে গেছে। সে কারণে এ বন্দুক হামলে পড়েছে জনগণের উপর, হামলে পড়েছে জাতিরজনকসহ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সকলের উপর, এবং হামলে পড়েছে জনযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শের উপর। এজন্যই মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব:) তাহেরকে সিপাহী-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মতো আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিতে হয়েছিল। বিনু বিশ্বাস করে, বাঙালি জাতির শোষণমুক্তি এবং তাঁদেরকে সত্যিকারের বিজয়ের গৌরবে অভিষিক্ত হবার জন্য এই বন্দুকের কব্জার বিষয়টি আগে ফয়সালা করতে হবে। ভেঙে দিতে হবে সাম্রাজ্যবাদ এবং পুঁজিবাদের শক্তিভিত। না হলে কখনই মুক্তি আসবে না। এ বন্দুক বারবার হামলে পড়বে গণমানুষের উপর, তাঁদের নেতৃত্বের উপর, এই মানুষের প¬াটফর্ম হিসেবে তাঁদের রাজনীতির উপর এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে পাওয়া সংবিধানের উপর। হামলে পড়বে গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, শোষণমুক্তির চিন্তা-চেতনা এবং এই মতাদর্শের সমস্ত শক্তিভিতের উপর। যদিও এ বন্দুক সিপাহীদের হাতে, তারপরেও তাদের কিছুই করার নেই। কারণ তাদের শুধু হুকুমের দাসের মতোই চলতে হবে, তারা শুধু ব্যবহার হবে, কোন কথা বলার অধিকার থাকবে না তাদের। অতএব এখানে ফয়সালা ছাড়া পথ নেই, মুক্তি নেই।
বিনু নড়ে-চড়ে ওঠার চেষ্টা করলো। তীব্র যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে। গোটা শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা। ব্যাথায় টনটনে অবস্থা। জামবাক এবং এণ্টিসেপ্টিক লোশন ব্যবহার করেও কাজ হচ্ছে না। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। শরীর থেকে এখনও দুটো বুলেট বের করা সম্ভব হয়নি। বাকি বুলেটগুলো এফোর-ওফোর হয়ে বেরিয়ে গেছে। দুটি বুলেট ভেতরেই রয়ে গেছে। একটি পায়ে এবং আরেকটি বুকের বামে উপরের হাড়ে বিঁধেছে। এগুলো বের করে ভাল চিকিৎসার জন্য অপারশেন থিয়েটার থাকা উন্নত কোন চিকিৎসা কেন্দ্রে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তাই শরীরের ভেতর ক্ষত বাড়ছে, হয়তো গ্যাংগ্রিন ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। রিতু বার বার করে ওকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু রাজী হয়নি। কারণ বেরুলেই ধরা পড়তে হবে। বিনু নিশ্চিত, ওর মুত্যু ঘনিয়ে আসছে। চিকিৎসার অভাবে এ মুত্যু ঘটবে। রিতুর চেষ্টায় সাধারণ ওষুধ আর কবিরাজী পথ্য দিয়ে কোনরকমে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে ওকে। রিতু হয়তো শেষ পর্যন্ত ওকে এভাবে মরতে দিতে চাইবে না। জোর করেই কোন আধুনিক চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাবে। কিন্তু জীবিত অবস্থায় ধরা পড়ার কোন ঝুঁকি নিতে নারাজ বিনু।
টেবিলে একটা ঘড়ি চলছে। সময় সকাল ৯টা বেজে ২২ মিনিট। সেল্টারদাতার স্ত্রী এরইমধ্যে বিনুকে তরল খাবার খাইয়ে গেছে। গোটা শরীরে এমন ব্যাথা যে শক্ত কিছু খাবার মতো অবস্থা নেই। ব্যান্ডেজ বাঁধা পা-টা একটু নড়ানোর চেষ্টা করলো। সাহায্যের জন্য ডান হাত ব্যবহার করলো। অসহ্য যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত চেপে সামান্য একটু নড়ানো সম্ভব হলো। নিচে একটা নরম বালিশ। সেটার ওপরই ফের আস্তে করে পা-টা রাখলো। আসলে একভাবে থাকতে থাকতে ঝিম ধরে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে না নড়ালে কাজ হচ্ছে না। তাছাড়া পা এবং হাতচলনসই করতে না পারলে ওর পক্ষে দরকারের সময় স্টেনও ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। সাধ্যমত তাই চেষ্টা করছে এ দুটো অঙ্গকে ব্যবহার উপযোগী করার।
১০টার মধ্যে রিতুর চলে আসার কথা। ওকেও এখন সেল্টারে সেল্টারে থাকতে হচ্ছে। এরমধ্যে ওর বাবা মারা গেছেন। জেলে ছিলেন তিনি। এসময় অনেক রাজনীতিকের মতো তাৎক্ষণিক মুক্তির শর্তে তাঁকেও জেনারেল জিয়ার নতুন দল বিএনপিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তাৎক্ষণিকই নাকচ করে দিয়েছিলেন রিতুর বাবা। ফলে আরো বেশী সময় জেলে থাকতে হয় তাঁকে। অসুস্থতার ব্যাপারে তেমন কোন চিকিৎসা দেওয়া হয়নি সেখানে। ফলে বিপদ বেড়ে যায়। অবশ্য তিনি শেষ মুহূর্তে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন, কিন্তু রোগ এবং বার্ধক্য তাঁকে ছড়েনি। তাঁর মৃত্যুর পর পরই মা-ও মারা যান শোকে-দুঃখে। সবচেয়ে বড় কথা রিতুদের পরিবারের উপর সামরিক সরকারের দমন-পীড়ন তো কম যায়নি। একেবারে নিঃশেষ করে দেওয়া হয়েছে গোটা পরিবারকে। তাই সব হারিয়ে রিতুরা এখন সর্বস্বহারা। এ অবস্থায় পরিবারের আরেক সদস্য ছোট বোন ইতু’র জন্য জীবনটা হয়ে দাঁড়ায় আরো ভয়াবহ। একদিকে রিতুর খোঁজে পুলিশ-রাজাকার-আলবদর এবং জেনারেল জিয়ার নতুন দলের লোকজন যেভাবে পিছে লেগেছিলÑ তাতে ওকে রাজনৈতিক সেল্টারে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ফলে বাড়িতে একা ইতু’র নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়। বাধ্য হয়ে ওকে কলকাতায় আত্মীয় বাড়ি পাঠাতে হয়েছে। আর রিতু স্বাভাবিকভাবেই বিনুর সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল।
রিতুকে নিয়ে এখন খুব বেশী চিন্তিত বিনু। নিজের মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিলেও রিতুর ব্যাপারে এমনটি ভাবতে পারছে না। এর অবশ্য একটা বড় কারণ আছে। কারণ, রিতুর গর্ভে বিনু’র সন্তান। দু’চার দিনের মধ্যেই ও মা হবে। সুতরাং সময়টা সন্ধীক্ষণের। বিনু-রিতু’র মধ্যে সামাজিক নিয়ম মেনে বিয়ে হয়নি। রাজনৈতিক আদর্শকে সাক্ষী করে ওরা বিয়ে করেছে। এই অবস্থায় নিজের চেয়ে রিতুর জন্য বেশী চিন্তিত বিনু। যদিও বার বার করে রিতুকে সাবধানে চলতে বলেছে। দু’জন এক সেল্টারে থাকা ঠিক নয় ভেবে ওকে পাশের আরেক সেল্টারে রাত কাটাতে বলেছে। ওই সেল্টারে সেবা-যত্নেরর সুবিধা থাকায় অনেকটা স্বস্তিতে আছে বিনু। কিন্তু প্রতিদিন বিনুকে দেখা এবং সেবা করার জন্য রিতু ঝুঁকি নিয়ে হলেও আসবেই, এখানে কোন কথা শোনানো যাচ্ছে না ওকে। অথচ সামরিক বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করছে কয়েকজন রাজাকার-আলবদর কমান্ডার। এরা যে কোন সময় ওদের অবস্থান জেনে যেতে পারে।
গভীর চিন্তায় ডুবে আছে বিনু। ভাবছিল ওর জীবনের কথা। একদিন লেখা-পড়া, বাড়ি-ঘর সব ছেড়ে যোগ দিয়েছিল বিপ¬বের এই সংগ্রামে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবার সুবর্ণ সুযোগগুলো শুধু ও একা ত্যাগ করেনি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ থেকে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এই সংগ্রামে সামীল হয়েছিল ব্যক্তিগত সকল উচ্চাশা ত্যাগ করে। পার্টি বলেছিল, ‘বুর্জোয়া শিক্ষার কোন প্রয়োজন নেই, আমরা খুব দ্রুত বিপ্লব করবো, নতুন সমাজব্যবস্থা কায়েম করবো, যেখানে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে। নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় বুর্জোয়া শিক্ষার মতো শুধু সার্টিফিকেট আর চাকরি’র লক্ষ্যটি থাকবে না। সেখানে থাকবে মানুষ, দেশ এবং উভয় ক্ষেত্রের জন্যই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষ্য এবং কাজ। আমরা পালন করবো মহান দায়িত্ব, যা আমাদের অতীত ইতিহাস, ’৫২’-৬২’-’৬৮-’৬৯-’৭০ এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশাকে পূরণ করবে। একটি জীবনের জন্য এরচাইতে বড় পাওয়া এবং অর্জন আর কী হতে পারে? কিছুই হতে পারে না। সুতরাং আমরা প্রচলিত সকল ধারা থেকে বেরিয়ে এসে এক নতুন জীবনব্যবস্থা তথা সমাজ বিনির্মাণ করবো, যেখানে আজকের মতো কোন শ্রেণীভেদ, শ্রেণীবৈষম্য থাকবে না। সমাজ বিকাশের ধারায় বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর নতুন আরেক মাইলফলক।’ বিনু মনে ভেবেছে, সত্যিই তো সমস্যা আসলে রাজনৈতিক। এখানে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-জজ-ব্যারিস্টার হয়ে লাভ নেই। এগুলো ব্যক্তিগত সুবিধা দিতে পারে ঠিক, কিন্তু সমস্যার মূলে কিছুই করবে না, বরং মূলটাকে বাঁচিয়ে রেখে সমস্যাকে শুধু বাড়াবেই আর বাড়াবে। সুতরাং চিকিৎসা প্রয়োজন গোড়ায়, যার চিকিৎসক হলো রাজনীতি। এই রাজনীতিই পারে কেবল সমাজবিপ্লব করতে, পারে শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে গুড়িয়ে দিতে।
---- চলবে ----
আবুল হোসেন খোকন : লেখক-সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।