অন্তর্ঘাত

(রাজনৈতিক উপন্যাস)

আবুল হোসেন খোকন 

[ সত্তর দশক বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সামরিক শাসনের পটভূমিকে ভিত্তি করে এই রাজনৈতিক উপন্যাসটির অবতারণা অপ্রকাশিত এ পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ ধারাবাহিকভাবে মুক্তমনায় তুলে ধরা হলো লেখক

পার্ট - ১১ 

(দশ) 

   ....... প্রায় তিন বছর পর এরমধ্যে বিনুদের চোখের সামনে ঘটে গেছে অনেক ঘটনাওদের শ্রদ্ধেয় নেতা কমরেড তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছেঘটনা এখানেই থেমে থাকেনিআসলে সামরিক শাসন জারি করে এই স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মাটিতে রক্তের গঙ্গা বইয়ে দেওয়া হয়েছেএক ভয়ঙ্কর নির্মূলন অভিযান চালানো হয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর স্টাইলেনীল নকশামত চলেছে সব কাজ

   নির্মূল ও হত্যার মহোসব চলেছে সমাজবিপ¬বের সকল ক্ষেত্রসহ বেসামরিক পর্যায় এবং সামরিক বাহিনীর ভেতরেসামরিক বাহিনীতে একের পর এক অভ্যুত্থানহয়েছেআসলে এর প্রায় সবই ছিল সাজানো, পরিকল্পিত এবং এজেন্ডাভিত্তিকএই নাটকের মধ্যদিয়ে সেনাবাহিনীতে চালানো হয়েছে পৈশাচিক শুদ্ধি অভিযানআগে বাছাই করা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শের সদস্য এবং সত্যিকারের দেশপ্রেমিকদেরতারপর অভ্যুত্থানতৈরি করে তাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে এঁদের করা হয়েছে হত্যাএই যজ্ঞের শিকার হয়েছে সামরিক বাহিনীর হাজার হাজার সদস্যশুধু  হত্যাযজ্ঞই হয়নি হয়েছে গুম, জেল, চাকরিচ্যুতি এবং বিতাড়নযারাই একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের চিন্তাকে লালন করেছে এবং পাকিস্তানি আদল থেকে বেরিয়ে ৭১-এর জনগণমুখী মুক্তিবাহিনী বা গণবাহিনীর মতো একটি জনকল্যাণমূলক সামরিক বাহিনীর প্রত্যাশা করেছে তাদের সবাইকে ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছেহয়েছে জনযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সশস্ত্রবাহিনীকে গণবিমূখ, ক্যাণ্টনমেণ্টে আটকে থাকা জনবিচ্ছিন্ন এবং সাম্রাজ্যবাদের অনুগত করার করার কাজ পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের এই অভয়ারণ্য গড়ে তোলার কাজটি করা হয়েছে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে

   ঠিক একই এজেন্ডায় নির্মূলযজ্ঞ চলানো হয়েছে বেসামরিক পর্যায়েসন্ত্রাস নির্মূল’ ‘বে-আইনি অস্ত্র উদ্ধার এবং দুস্কৃতকারীদমনের নামে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা ছাড়াও কাটা দিয়ে কাটা তোলা বা লাল পতাকা দিয়ে লাল পতাকা নিধনের নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা হয়েছেচেষ্টা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে মুত্তিযুদ্ধের মতাদর্শকে সমূলে ধ্বংসেরতাই অবিরত রক্তের বন্যায় রঞ্জিত হয়েছে সবুজ-শ্যামল মাটিখতম হয়েছে হাজার হাজার দেশপ্রেমিক মানুষলক্ষ লক্ষ মানুষ হয়েছে জেল-জুলুম এবং পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার দমননীতির স্টিম রুলার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে স্বপ্নবান মানুষের সকল স্বপ্নসহ তাদের ভবিষ্যতএকই লক্ষ্যে জনপদ জুড়ে তৈরি করা হয়েছে বিভক্তি আর বিভক্তি বিস্তার ঘটানো হয়েছে দুর্নীতি-লোভ আর লালসার অবাধ রাজত্ব ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে মানুষের সং-বদ্ধতাকেজনগণের প¬াটফর্মকে করা হয়েছে ভয়ঙ্করভাবে বিদ্ধস্ত

   আর এই এজেন্ডার মধ্যদিয়ে সামরিক জান্তা সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে শোষক এবং সাম্রাজ্যবাদীদের আরেক দোসর মৌলবাদ, প্রতিক্রিয়াশীল আর ৭১-এর যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার-আলবদর-জামায়াতীচক্রকে জেনারেল জিয়া এজন্য ৭১-এর যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত দালাল আইন বাতিল করেছে, এদের ভোটাধিকার ও রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে, নিজে নতুল দল বানিয়ে তাতে এদের অন্তর্ভূক্ত করেছেকরেছে সমরজান্তার অংশীদারজিয়ার নতুন দলে ৭১-এর যুদ্ধপরাধী-মৌলবাদীচক্র ছাড়াও যুক্ত হয়েছে  মওলানা ভাসানীর অনুসারীসহ বামপন্থী বলে পরিচিত একশ্রেণীর রাজনীতিকরাও

   এছাড়া এই প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত ৭২-এর সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে, সংবিধান থেকে অসাম্প্রদায়িকতা এবং প্রগতিশীলতাকে বাতিল করা হয়েছেএরপরই বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর নামে এক নতুন লক্ষ্যকে সামনে রেখে সামরিক শাসন তুলে নেওয়া হয়েছে

   বিনুরা আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করেছেকর্নেল তাহেরসহ ওদের অন্তত ১০ হাজার কমরেডকে হত্যা করা হলেও মূল নেতা হিসেবে রহস্যময় দাদারহস্যই থেকে গেছেনতিনি আছেন বহাল তবিয়তে কিছুদিনের জন্য তাকে জেলের ভিতরে সুরক্ষায় রাখা হলেও ফের মুক্ত করে দেওয়া হয়েছেএখন তিনি এমনসব কাজ করছেন যাতে অনেক রহস্যই উন্মোচন হয়ে পড়ছে তারসঙ্গে আগে থেকেই যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সংযোগ ছিলÑ তা একেবারেই খোলাশা হয়ে গেছে বিনুদের বিপর্যয়ের কারণটা কি তাহলে এখানেই?

 

(এগারো)

   একটি মাটির বাড়ি দেওয়ালে মোটা বালিশে পিঠ রেখে আধা শোয়া বিনুউদাস চেয়ে আছেপা দুটো লম্বাঅনেকটা ছড়ানোডান পাশে ম্যাগজিন ভর্তি বুলেটসহ একটি স্টেনগানআরেক পাশে বুলেট ভর্তি আরো দুটো অতিরিক্ত ম্যাগজিন

   বিনু গুরুতর আহততাই শয্যাশায়ীরয়েছে একেবারেই নিজস্ব এবং পার্টিসহ সকলের  অজ্ঞাত এক গ্রামীণ সেল্টারেগত ৩ বছরে ও অনেকবার রেইড, অ্যাম্বুশ এবং গানফায়ারের মুখে পড়েছেএগুলো হয়েছে সামরিক বাহিনী, পুলিশ, প্রতিপক্ষ আন্ডারগ্রাউন্ড চরমপন্থী বিভিন্ন গ্রপ এবং নিজেদের উপদল থেকে এতোকিছুর পরে আজও প্রাণে বেঁচে আছে ও গুরুতর আহত হয়েপুলিশ এবং সরকারী বাহিনীর রেইডে পড়েছিল ওসঙ্গে আরো তিন কমরেড ছিল প্রত্যেকে সশস্ত্র থাকলেও পর্যাপ্ত বুলেট ছিল নাফলে গোলাগুলির এক পর্যায়ে এসএমজি এবং কাটারাইফেলের বুলেট শেষ হয়ে যায়তখন সরকারী বাহিনীর বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তিন কমরেডবিনুর শরীরে বিদ্ধ হয় আধা ডজন বুলেটরাতের বেলায় এক সেল্টারে এই রেইডের ঘটনা ঘটেছিল বলে বিনু অল্পের জন্য ধরা পড়েনিআহত হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলতখন গড়িয়ে সেল্টার থেকে পাশের এক খাঁদে পড়ে গিয়েছিলসেখান থেকে এক সেল্টারদাতা ওকে উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় রেখে আসে ওরসঙ্গে যে রিভলবারটা ছিল সেটা হারিয়ে গেছেপরে ওটা সরকারী বাহিনী পেয়ে যায়বিনু শুনেছে, ওর সঙ্গে যে কমরেডরা গুলিবিদ্ধ হয়েছিল তাদের দুজন সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়, একজন অজ্ঞান অবস্থায় মারা যায় হাসপাতালেওদের অস্ত্রগুলো সরকারী বাহিনীর কব্জায় চলে যায়এই অবস্থায় বিনু এখন সেল্টারে আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছেএ সেল্টারের কথা অন্য কেও জানে নাজানে শুধু একজনসে হলো রিতু

   এরমধ্যে বিনুর চোখের সামনে ঘটে গেছে আরো অনেক ঘটনাওর পার্টি হঠা বিপ¬বী গণবাহিনী এবং বিপ¬বী সৈনিক সংস্থা ভেঙে দিয়েছেবিনুর বিশ্বাস কাজটি আসলে পার্টি করেনিকরেছেন সেই রহস্যময় ব্যক্তি দাদাকাজটা করে পার্টিতে সবচেয়ে বড় ধসটি নামিয়ে দেওয়া হয়পার্টি ভেঙে কয়েক টুকরো হয়েছে পার্টির সামরিক শক্তি খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছেএই শক্তি এখন একে অপরের প্রতিপক্ষএই শক্তির কোনটা বিপথে চলে গেছে, কোনটা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে, কোনটা অন্য দলে চলে গেছে, কোনটা সরকারী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করেছে রহস্যময় ব্যক্তিটির মাধ্যম থেকে এখন পার্টির এই সামরিক শক্তিকে শোষক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্ষমতার উস সামরিক শাসকবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আকার-ইঙ্গিতে চাপ দেওয়া হচ্ছেতুলে না দিলে শাসকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে এরইমধ্যে পার্টির সকল সেল্টারসহ সামরিক শক্তির যাবতীয় তথ্য তুলে দেওয়া হয়েছে এই বাহিনীর গোয়েন্দা শাখায়ফলে এখন চলছে নতুন কায়দায় সরকারী অভিযানএতে করে পার্টি-সংগঠনের তাব নেটওয়ার্ক এবং সাংগঠনিক ভিত্তি একরকম ধ্বংস হয়ে গেছেভয়াবহ অন্তর্ঘাতের শিকার হয়েছে এবং এখনও হয়ে চলেছে পার্টি, পার্টি সংগঠন-গণসংগঠন, সামজিক বিপ¬বের শক্তিভিত এবং মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শের সংগ্রাম ও লড়াই রাষ্ট্রীয় বন্দুক পরিপূর্ণভাবে শত্রশক্তির কব্জায় চলে গেছে

   বিনু সরকারী বাহিনীর হাতে নিজেদের সামরিক শক্তি তুলে দেয়নি, দিতেও রাজী নয়ও ওর ঘনিষ্ঠ কমরেডদের মাধ্যমে এই নিষেধাজ্ঞা প্রচারও করে দিয়েছেফলে এখন বিনু পার্টির ভিতরেও অন্তর্ঘাতিদের টার্গেটেএ অবস্থায় বিনু নিজের প্রয়োজনে স্টেনগানটাকে সঙ্গে রেখেছে, আর ওর সাহায্য-সহযোগী হিসেবে রিতুকে দিয়েছে  পয়েণ্ট ৩৭ ক্যালিবারের চাইনিজ লামা পিস্তলটিযদিও কোনভাবেই ওটা নিতে চায়নি রিতু তারপরেও অনেক যুক্তি-তর্কের পর রাজী হয়েছে

   ‘বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতা উ’Ñ কমরেড মাও সে তুংয়ের এই কথাটা স্মরণ করছিল ওনিজের মতো করে ভাবছিলÑ এই নল যার হাতে, ক্ষমতা থাকে তার হাতেএ নল যদি ধনিক শ্রেণী বা শোষকগোষ্ঠীর কব্জায়, অথবা পুঁজিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের কব্জায় থাকে তাহলে ক্ষমতাও থাকে তাদের হাতেএ ক্ষেত্রে জনগণ হয় তাদের টার্গেট, হয় ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের বন্দুক কার কব্জায়? জনগণের কব্জায় কি? নাএ বন্দুক জনগণের কব্জায় নেইসে কারণেই জনগণ এই বন্দুকেরই টার্গেটসুতরাং এখান থেকে মুক্তি প্রয়োজনএই মুক্তির জন্যই ১৯৭১-এ এদেশের জনগণ বন্দুক নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলতখন রাষ্ট্রীয় বন্দুক যাদের হাতে ছিল, তাদেরকে বিদ্রোহে সামীল করে জনগণের পক্ষে টেনে আনা হয়েছিলসবাই তখন জনগণ হয়ে গিয়েছিল বলেই রচিত হয়েছিল মহান জনযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধআর এই যুদ্ধই এনে দিয়েছিল মহান বিজয়, গৌরবের বাংলাদেশকিন্তু তারপর? তারপর যুদ্ধের কোন প্রত্যাশাই পূরণ হয়নিবন্দুক বা সকল ক্ষমতার উকে যে জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করার কথা ছিলÑ শেষ পর্যন্ত তা হয়নিহয়নি বলেই জায়গাটি সেই পুরনো পাকিস্তানি আদলেই থেকে গেছেসে কারণে এ বন্দুক হামলে পড়েছে জনগণের উপর, হামলে পড়েছে জাতিরজনকসহ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সকলের উপর, এবং হামলে পড়েছে জনযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শের উপরএজন্যই মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব:) তাহেরকে সিপাহী-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মতো আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিতে হয়েছিলবিনু বিশ্বাস করে, বাঙালি জাতির শোষণমুক্তি এবং তাঁদেরকে সত্যিকারের বিজয়ের গৌরবে অভিষিক্ত হবার জন্য এই বন্দুকের কব্জার বিষয়টি আগে ফয়সালা করতে হবেভেঙে দিতে হবে সাম্রাজ্যবাদ এবং পুঁজিবাদের শক্তিভিতনা হলে কখনই মুক্তি আসবে নাএ বন্দুক বারবার হামলে পড়বে গণমানুষের উপর, তাঁদের নেতৃত্বের উপর, এই মানুষের প¬াটফর্ম হিসেবে তাঁদের রাজনীতির উপর এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে পাওয়া সংবিধানের উপরহামলে পড়বে গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, শোষণমুক্তির চিন্তা-চেতনা এবং এই মতাদর্শের সমস্ত শক্তিভিতের উপরযদিও এ বন্দুক সিপাহীদের হাতে, তারপরেও তাদের কিছুই করার নেইকারণ তাদের শুধু হুকুমের দাসের মতোই চলতে হবে, তারা শুধু ব্যবহার হবে, কোন কথা বলার অধিকার থাকবে না তাদেরঅতএব এখানে ফয়সালা ছাড়া পথ নেই, মুক্তি নেই

   বিনু নড়ে-চড়ে ওঠার চেষ্টা করলোতীব্র যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গেগোটা শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা ব্যাথায় টনটনে অবস্থাজামবাক এবং এণ্টিসেপ্টিক লোশন ব্যবহার করেও কাজ হচ্ছে নাপ্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছেশরীর থেকে এখনও দুটো বুলেট বের করা সম্ভব হয়নিবাকি বুলেটগুলো এফোর-ওফোর হয়ে বেরিয়ে গেছেদুটি বুলেট ভেতরেই রয়ে গেছেএকটি পায়ে এবং আরেকটি বুকের বামে উপরের হাড়ে বিঁধেছেএগুলো বের করে ভাল চিকিসার জন্য অপারশেন থিয়েটার থাকা উন্নত কোন চিকিসা কেন্দ্রে যাওয়া প্রয়োজনকিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে সেটা সম্ভব হচ্ছে নাতাই শরীরের ভেতর ক্ষত বাড়ছে, হয়তো গ্যাংগ্রিন ছড়িয়ে পড়ছেকিন্তু কিছু করার নেইরিতু বার বার করে ওকে চিকিসার জন্য নিয়ে যেতে চেয়েছেকিন্তু রাজী হয়নিকারণ বেরুলেই ধরা পড়তে হবেবিনু নিশ্চিত, ওর মুত্যু ঘনিয়ে আসছেচিকিসার অভাবে এ মুত্যু ঘটবেরিতুর চেষ্টায় সাধারণ ওষুধ আর কবিরাজী পথ্য দিয়ে কোনরকমে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে ওকেরিতু হয়তো শেষ পর্যন্ত ওকে এভাবে মরতে দিতে চাইবে নাজোর করেই কোন আধুনিক চিকিসা কেন্দ্রে নিয়ে যাবেকিন্তু জীবিত অবস্থায় ধরা পড়ার কোন ঝুঁকি নিতে নারাজ বিনু

   টেবিলে একটা ঘড়ি চলছেসময় সকাল ৯টা বেজে ২২ মিনিট সেল্টারদাতার স্ত্রী এরইমধ্যে বিনুকে তরল খাবার খাইয়ে গেছেগোটা শরীরে এমন ব্যাথা যে শক্ত কিছু খাবার মতো অবস্থা নেই ব্যান্ডেজ বাঁধা পা-টা একটু নড়ানোর চেষ্টা করলো সাহায্যের জন্য ডান হাত ব্যবহার করলোঅসহ্য যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত চেপে সামান্য একটু নড়ানো সম্ভব হলোনিচে একটা নরম বালিশসেটার ওপরই ফের আস্তে করে পা-টা রাখলোআসলে একভাবে থাকতে থাকতে ঝিম ধরে যাচ্ছেমাঝে মাঝে না নড়ালে কাজ হচ্ছে নাতাছাড়া পা এবং হাতচলনসই করতে না পারলে ওর পক্ষে দরকারের সময় স্টেনও ব্যবহার করা সম্ভব হবে না সাধ্যমত তাই চেষ্টা করছে এ দুটো অঙ্গকে ব্যবহার উপযোগী করার

   ১০টার মধ্যে রিতুর চলে আসার কথাওকেও এখন সেল্টারে সেল্টারে থাকতে হচ্ছে এরমধ্যে ওর বাবা মারা গেছেনজেলে ছিলেন তিনিএসময় অনেক রাজনীতিকের মতো তাক্ষণিক মুক্তির শর্তে তাঁকেও জেনারেল জিয়ার নতুন দল বিএনপিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলতাক্ষণিকই নাকচ করে দিয়েছিলেন রিতুর বাবাফলে আরো বেশী সময় জেলে থাকতে হয় তাঁকে অসুস্থতার ব্যাপারে তেমন কোন চিকিসা দেওয়া হয়নি সেখানেফলে বিপদ বেড়ে যায়অবশ্য তিনি শেষ মুহূর্তে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন, কিন্তু রোগ এবং বার্ধক্য তাঁকে ছড়েনিতাঁর মৃত্যুর পর পরই মা-ও মারা যান শোকে-দুঃখেসবচেয়ে বড় কথা রিতুদের পরিবারের উপর সামরিক সরকারের দমন-পীড়ন তো কম যায়নি একেবারে নিঃশেষ করে দেওয়া হয়েছে গোটা পরিবারকেতাই সব হারিয়ে রিতুরা এখন সর্বস্বহারাএ অবস্থায় পরিবারের আরেক সদস্য ছোট বোন ইতুর জন্য জীবনটা হয়ে দাঁড়ায় আরো ভয়াবহএকদিকে রিতুর খোঁজে পুলিশ-রাজাকার-আলবদর এবং জেনারেল জিয়ার নতুন দলের লোকজন যেভাবে পিছে লেগেছিলÑ তাতে ওকে রাজনৈতিক সেল্টারে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল নাফলে বাড়িতে একা ইতুর নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়বাধ্য হয়ে ওকে কলকাতায় আত্মীয় বাড়ি পাঠাতে হয়েছেআর রিতু স্বাভাবিকভাবেই বিনুর সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল

   রিতুকে নিয়ে এখন খুব বেশী চিন্তিত বিনুনিজের মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিলেও রিতুর ব্যাপারে এমনটি ভাবতে পারছে নাএর অবশ্য একটা বড় কারণ আছেকারণ, রিতুর গর্ভে বিনুর সন্তানদুচার দিনের মধ্যেই ও মা হবেসুতরাং সময়টা সন্ধীক্ষণের।  বিনু-রিতুর মধ্যে সামাজিক নিয়ম মেনে বিয়ে হয়নি রাজনৈতিক আদর্শকে সাক্ষী করে ওরা বিয়ে করেছেএই অবস্থায় নিজের চেয়ে রিতুর জন্য বেশী চিন্তিত বিনুযদিও বার বার করে রিতুকে সাবধানে চলতে বলেছেদুজন এক সেল্টারে থাকা ঠিক নয় ভেবে ওকে পাশের আরেক সেল্টারে রাত কাটাতে বলেছেওই সেল্টারে সেবা-যত্নেরর সুবিধা থাকায় অনেকটা স্বস্তিতে আছে বিনুকিন্তু প্রতিদিন বিনুকে দেখা এবং সেবা করার জন্য রিতু ঝুঁকি নিয়ে হলেও আসবেই, এখানে কোন কথা শোনানো যাচ্ছে না ওকেঅথচ সামরিক বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করছে কয়েকজন রাজাকার-আলবদর কমান্ডারএরা যে কোন সময় ওদের অবস্থান জেনে যেতে পারে

   গভীর চিন্তায় ডুবে আছে বিনুভাবছিল ওর জীবনের কথাএকদিন লেখা-পড়া, বাড়ি-ঘর সব ছেড়ে যোগ দিয়েছিল বিপ¬বের এই সংগ্রামে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবার সুবর্ণ সুযোগগুলো শুধু ও একা ত্যাগ করেনি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ থেকে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এই সংগ্রামে সামীল হয়েছিল ব্যক্তিগত সকল উচ্চাশা ত্যাগ করেপার্টি বলেছিল, ‘বুর্জোয়া শিক্ষার কোন প্রয়োজন নেই, আমরা খুব দ্রুত বিপ্লব করবো, নতুন সমাজব্যবস্থা কায়েম করবো, যেখানে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা থাকবেনতুন শিক্ষাব্যবস্থায় বুর্জোয়া শিক্ষার মতো শুধু সার্টিফিকেট আর চাকরির লক্ষ্যটি থাকবে নাসেখানে থাকবে মানুষ, দেশ এবং উভয় ক্ষেত্রের জন্যই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষ্য এবং কাজআমরা পালন করবো মহান দায়িত্ব, যা আমাদের অতীত ইতিহাস, ’৫২’-৬২’-’৬৮-৬৯-৭০ এবং ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশাকে পূরণ করবেএকটি জীবনের জন্য এরচাইতে বড় পাওয়া এবং অর্জন আর কী হতে পারে? কিছুই হতে পারে নাসুতরাং আমরা প্রচলিত সকল ধারা থেকে বেরিয়ে এসে এক নতুন জীবনব্যবস্থা তথা সমাজ বিনির্মাণ করবো, যেখানে আজকের মতো কোন শ্রেণীভেদ, শ্রেণীবৈষম্য থাকবে নাসমাজ বিকাশের ধারায় বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর নতুন আরেক মাইলফলকবিনু মনে ভেবেছে, সত্যিই তো সমস্যা আসলে রাজনৈতিকএখানে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-জজ-ব্যারিস্টার হয়ে লাভ নেইএগুলো ব্যক্তিগত সুবিধা দিতে পারে ঠিক, কিন্তু সমস্যার মূলে কিছুই করবে না, বরং মূলটাকে বাঁচিয়ে রেখে সমস্যাকে শুধু বাড়াবেই আর বাড়াবেসুতরাং চিকিসা প্রয়োজন গোড়ায়, যার চিকিসক হলো রাজনীতিএই রাজনীতিই পারে কেবল সমাজবিপ্লব করতে, পারে শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে গুড়িয়ে দিতে

---- চলবে ----


আবুল হোসেন খোকন : লেখক-সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।