অন্তর্ঘাত
(রাজনৈতিক উপন্যাস)
আবুল হোসেন খোকন
[ সত্তর দশক বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সামরিক শাসনের পটভূমিকে ভিত্তি করে এই রাজনৈতিক উপন্যাসটির অবতারণা। অপ্রকাশিত এ পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ ধারাবাহিকভাবে মুক্তমনায় তুলে ধরা হলো। লেখক ]
পার্ট - ২
(তিন)
দু’সপ্তাহ পরের কথা। বিনু এখন নৌকায়। নদী পার হচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে বকুল। বয়সে ছোট। দু’জনের কাছেই নিরাপত্তার জন্য রয়েছে দু’টি আগ্নেয়াস্ত্র। বিনুরটা পয়েণ্ট ৩৭ ক্যালিবারের চাইনিজ পিস্তল, বকুলেরটা পয়েণ্ট ৩২ ক্যালিবারের আমেরিকান রিভলবার। ওদের পরনে সাধারণ শার্ট আর লুঙ্গি। পায়ে ‘অক্ষয় কোম্পানির’ চটি জুতা। এটাই গ্রামাঞ্চলের মুটামুটি স্বাভাবিক পোশাক। তবে অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামের মানুষ শার্ট পড়ে না, চটি ছাড়া খালি পায়ে হাঁটে। বিনু আর বকুলের পোশাকে অস্বাভাবিকতা নেই। চেহারা দেখে অবশ্য বোঝা যায় ওরা অশিক্ষিত নয়।
সাবধানে ফাঁকাফাঁকি বসেছে দু’জন। নৌকায় আরও ক’জন যাত্রী। তবে সবাই মহিলা, একজন শুধু পুরুষ। কৃষক পরিবারের লোক। ওপারে নিশ্চয়ই কোন কাজে গিয়েছিল। বিনুদের ওরা চেনে না। নৌকার মাঝিও পরিচিত নয়। লগির খোঁচায় নৌকা প্রায় ঘাটে চলে এসেছে। বিনু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো। সন্দেজনক কেও আছে কিনা দেখলো। অবশ্য ঘাট ফাঁকা। এটা উল্লেখযোগ্য কোন ঘাট নয়। এপার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্য গ্রামের মধ্যে একটা অপ্রচলিত ঘাট। কাজেই বিনু সন্দেহজনক কিছু দেখতে পেলো না।
নৌকা ভিঁড়লো। পাঁচ পয়সা করে ভাড়া দিয়ে একে একে সবাই নামলো। বিনুরাও নেমে এলো। নামার সময় মাঝি জিজ্ঞেস করলো,‘ক-নে যাবেন মিঁ-ভাইরা?’ ‘ওই সামনে’ জবাব দিয়ে নেমে এলো বিনুরা। এক প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দিলে আরেকটা প্রশ্ন করবে, গ্রামের সাধারণ নিয়ম এটা। সুতরাং বেশি না বলে এড়িয়ে যেতে হলো ওদের।
ঘাট থেকে বেশ খানিকটা উপরে উঠতে হয় নদীর ঢাল বেয়ে। তারপর মোটামুটি সমতল। আসলে এটা একটা ছোট বাজার। হাঁটের মতো সপ্তাহে বাজার বসে। আজ বসেনি। তাই লোকজনও নেই। বিনুদের তবুও তীক্ষ্ণভাবে খেয়াল করতে হলো কেও অ্যাম্বুশ করেছে কিনা। কারণ পদে পদে শত্র“ আর বিপদ। একটু অসাবধান হলেই আঘাত আসবে। তখন হয় মৃত্যু নয় গ্রেফতার। এই অসতর্কতার জন্য অনেককেই বিপদে পড়তে হয়েছে। বিনু তাই সজাগ।
পেটের ভিতরে ক্ষুধা জানান দিয়ে উঠেছে। এরকম জীবনে ক্ষুধা হলো নিত্য সঙ্গী। বকুলকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ক্ষুধা লেগেছে বকুল?’ ‘তেমনভাবে লাগেনি এখনও। সবেতো সকাল ১০টার মতো’ লজ্জা পেয়ে জবাব দিলো বকুল।
- ‘এক কাজ করি। বাজারের কোন দোকান থেকে পাউন্ডরুটি কিনে নিয়ে আসা যাক। পথে কোথাও গিয়ে খেয়ে নেবো। টাকা আছে?’
- ‘জ্বি বিনু ভাই, বারো টাকার মতো আছে।’
- ‘ঠিক আছে। ওই সামনের দোকান থেকে দুটো পাউন্ড রুটি আর খাগড়াই জাতীয় (গুড়ের তৈরি স্থানীয় মিঠাই বিশেষ) কিছু পেলে নেবে। না পেলে কলা নিতে পারো। এক প্যাকেট বিঁড়িও নেবে। যাও। আমি নজর রাখছি।’ বিনুর নির্দেশ পেয়ে দোকানের দিকে গেল বকুল। তারপর বিস্কিট আর কলা নিয়ে ফিরে এলো।
- ‘বিনু ভাই, রুটি নাই। বিস্কিট পেলাম।’
- ‘ঠিক আছে ওতেই চলবে। চলো এখন।’
বিনুর কথা মতো হাঁটতে শুরু করলো। সামনে বিস্তৃত ফসলের মাঠ। আঁইলের মাঝদিয়ে চলছে ওরা। সামনে বিনু পিছনে বকুল। বিনু একটা বিঁড়ি ধরিয়েছে।
প্রায় মাইল খানেক হাঁটলো ওরা। পথে বিস্কিট আর কলা খেয়েছে। সামনেই একটা মেটো পথ। চলে গেছে আঁকাবাঁকা। পাটক্ষেতটা পেরুলেই পথ। ওটায় উঠবে ওরা। এবারের জনপদ আর অপরিচিত নয়। অনেকেই চেনে বিনুদের।
পথটাকে সামনে রেখে নিজেদের অস্ত্রগুলো জায়গা মতো ভাল করে গুঁজে নিলো। সবাই এধরণের অস্ত্র ডান বা বাম হাতের নিচের দিকে হোলস্টারে রাখে। হোলস্টার না হলে ফুলপ্যাণ্টের পকেটে থাকে। কিন্তু বিনুদের নিয়ম অন্যরকম। ওরা ওগুলো রেখেছে পিছন দিকে লুঙ্গিতে গুঁজে। নিচে আন্ডারপ্যাণ্ট পরা আছে। আরও আছে মোটা চামড়ার বেল্ট। গুঁজে রাখা অস্ত্রগুলো তাতে শক্ত হয়ে আটকে আছে।
বিনুরা যখন মেটো পথটাতে উঠে এলো, তার আগ দিয়ে ভাল করে দেখে নিয়েছে ভেঁদো (পুলিশ) বা ভেঁদোর দালাল জাতীয় কেও আছে কিনা। থাকার সম্ভাবনা নেই। থাকলে আগেই সতর্ক সংকেত পেয়ে যেতো। কারণ এলাকাটা বিনুদের নিয়ন্ত্রণাধীন।
ফসলী জমিন থেকে উঁচু এই মেটো পথটা ধরে খানিকটা এগুতেই একটা বাড়ি। তার সামনে মুদিখানা। বিনুরা মুদিখানার সামনে আসতেই হইহই করে বেরিয়ে এলো দোকানদার। সোজা ঝাঁপিয়ে পড়লো বিনুর বুকে।
- ‘অনেক দিন পর দেখা বিনু ভাই। কেমন আছেন? সব খবর ভাল তো?’ একেবারে এতোগুলো প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একজন মুরুব্বি। পিছনে কয়েকজন যুবক। মুরুব্বির পুত্র সবাই। বিনুদের সঙ্গে ওরাও বুকে বুক মেলালো। এরপর আশেপাশের বাড়ি থেকে আরও যুবক-তরুণ-কিশোর বেরিয়ে এলো। সবশেষে শিশুর দল ছুটে এলো। ওদের মধ্যে কেও বিনুদের সঙ্গে মোলাকাত করলো, কেও হাত মেলালো, আর পিচ্চিগুলো সোজা কোলে উঠে পড়লো। সামাল দিতে হিমশিম খেয়ে গেল বিনু আর বকুল।
সবাই শান্ত হবার পর বিনু বললো, ‘এখন কারও সঙ্গে কথা বলবো না। বসবোও না, জরুরি কাজ আছে। পরে এসে কথা বলবো।’ গ্রামবাসীরা বিনুদের স্বভাব জানে। তাই কেও কোন আপত্ত্বি করলো না। ছোটরা শুধু বললো, ‘কবে আসবেন বিনুদা?’
- ‘আসবো। এলেই দেখতে পাবে’ জবাব দিলো বিনু। তারপর বিদায় নিয়ে পথ ধরে এগুতে থাকলো। গ্রামবাসীরা গভীর আন্তরিকতায় পথ চেয়ে রইলো।
বিনুরা গ্রামবাসীর কবল থেকে ছাড়া পেলো না। যতোদূর যেতে থাকলো, আশপাশের বাড়ি-ঘর থেকে লোকজন বেরিয়ে এসে অভিনন্দন জানাতে থাকলো ওদের। যেন মহাপুরুষ এগিয়ে চলেছেন গ্রামকে ধন্য করে।
ঘণ্টা খানেক পর। ওরা এসে থামলো এক পাকা দালানের কাছে। ইউনিয়ন পরিষদের অফিস। সাদা দেয়ালে শোভা পাচ্ছে দুটো চাররঙা পোস্টার। দুটোতেই রয়েছে সামরিক পোশাক পরা জেনারেল জিয়াউর রহমানের ছবি। একটা পোস্টারে লেখা, ‘বে-আইনী অস্ত্রধারীরা দেশের শত্র“। ওদের ধরিয়ে দিন।’ আরেকটায় লেখা, ‘আমি সৈনিক। আমি রাজনীতি বুঝিনা। দেশের পরিস্থিতি স্বভাবিক হলেই আমি ব্যারাকে ফিরে যাবো জেনারেল জিয়া।’
ক্রুদ্ধ চোখে পোস্টার দুটোর দিকে তাকালো বিনু আর বকুল। তারপর দালানটাকে পাশ কাটিয়ে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেল। সামনেই একটি দো-চালা ঘর। সোজা ভিতরে ঢুকে পড়লো ওরা। এক বৃদ্ধা বারান্দায় বসেছিলেন। তিনি বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে। কয়েক সেকেন্ড পর সম্বিত ফিরে পেয়ে লাফিয়ে উঠলেন। তারপর ছুটে এলেন বিনুর দিকে। একেবারে জড়িয়ে ধরলেন ওকে। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ভাল আছো বাবা?’ বিনু ততোক্ষণে বৃদ্ধার বুকের ভিতর একাকার হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পর একগাল হেঁসে বিনু বললো, ‘কেমন আছেন খালাম্মা?’ তখনও বিনু আর বকুলের মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছেন খালাম্মা। নিজেকে সংযত করে এরপর বললেন, ‘ভাল আছি বাবা। আসো বাবা, ভিতরে আসো। বউমা, ও বউমা, দেখো কারা এসেছে।’ খালাম্মা ওদের হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তখনই লম্বা ঘোমটা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে এলো সুন্দর মেয়েটি। বিনুদের দেখে ঘোমটা পড়ে গেল। খুঁশিতে ডগমগ করে উঠলো তার মুখ। বললো, ‘ওমা! বিনু ভাই! এতোদিন পরে মনে পড়লো বুঝি?’
‘আগে বসতে দাও বউমা। হাত-মুখ ধোবার পানি দাও। আরাম করে বসতে দাও। তারপর কথা বলো। কতোদূর থেকেই না আসলো বাছারা। মুখ-চোখ শুকিয়ে গেছে। তুমি বউমা আগেই কথা শুরু করে দিয়েছো।’ খালাম্মা কৃত্রিম রাগ করলেন। বিনু বললো, ব্যস্ত হতে হবে না। আমরা ঠিকই আছি।’ আবার ধমকে উঠলেন খালাম্মা, ‘তোমরা চুপ করো বাপু! পথে পথে ঘুরে কী অবস্থা হয়েছে তোমরা তো তা দেখতে পাবে না! বউমা তাড়াতাড়ি করো তো। ওই বাড়ির ছোরাটাকে ডাকো। মুরগি দুইটা ধরতে বলো।’ বউমা হাঁসতে হাঁসতে ওদের দু’জনকে ঘরে নিয়ে গেল। তারপর হাতমুখ ধোবার জন্য এক বালতি পানি রাখলো কুয়োর ধারে। খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়ে দিলো একটি নতুন গামছা।
ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে খাবার আয়োজন হলো। মাছ-মুরগি মিলিয়ে দারুণ উপাদেয় খাবার। বউমা তালপাখার বাতাস করছে, আর খাবার তুলে দিচ্ছেন খালা। খাদক হলো বিনু আর বকুল। খেতে খেতে কথা হচ্ছিল টুকিটাকি। খালা জানতে চাইছিলেন, আর কতোদিন বিনুদেরকে পথে পথে ঘুরতে হবে? বিনু জানিয়েছে, খুব বেশিদিন নয়। শীঘ্রই নতুন দিন আসবে। বকুল জানতে চেয়েছিল, সালাম ভাইয়ের কোন খবর আছে কিনা? সালাম হলো খালার পুত্র এবং বউমার স্বামী। সামরিক বাহিনীতে চাকরী করেন। প্রশ্নের জবাবে বউমা বলেছে, একদিনের জন্য এসেছিল। খুব আতঙ্কিত এবং বিমর্ষ মনে হয়েছে। বেশি কথা বলেনি। শুধু বলেছে, বিনু ভাইরা যেন সাবধানে থাকে। পরিস্থিতি খুব খারাপ। চেষ্টা করছে তাড়াতাড়ি চাকরী ছেড়ে দিতে। কথায় কথায় খালা বিনুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা, তুমি নাকি ধরা পড়েছিলে?’ জবাবে ও বলেছে, ‘হ্যাঁ পড়েছিলাম। কিন্তু অনেক কষ্টে পালিয়ে এসেছি।’ খালা ভয় পেলেন। হাঁ-হুতাশ করে বললেন, ‘খুব সাবধানে থেকো বাবা, খবরদার আর যেন অসাবধান না হও।’
এক সময় খালা জিজ্ঞেস করলেন, এখন ওদের পরিকল্পনা কি? একগাল হেসে বিনু জানায়, আছে পরিকল্পনা আছে। এখানে বেশিক্ষণ থাকবে না। খাওয়া শেষ হলেই চলে যাবে।
খালা আর বউমা বারবার বললেন, আজকের দিনটা না হয় বিশ্রাম নিক ওরা। কিন্তু বিনুরা নাকচ করে দিলো সেই প্রস্তাব।
( চার )
জোনাব আলী তেমন একটা লেখা-পড়া জানে না। ছোট বেলায় প্রাইমারি পর্যন্ত পড়েছিল। তাও পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেনি। এখন জোনাব আলী নিজের কিছু জমিতে চাষবাস করে। বাগানের তরিতরকারি হাট-বাজারে বিক্রি করে সংসার চালায়। সংসার বলতে স্ত্রী আর তিন ছেলে-মেয়ে। পৈত্রিক ভিটায় চার-চালা টিনের দু’টি ঘর নিয়েই বসবাস। আজ আবার বউ-ছেলে-মেয়েরা নেই। ওরা গেছে মালঞ্চি। ওটা আফিজার বাপের বাড়ি। অনেক দিন পর গেছে, তাই থাকবে কিছুদিন। বাড়িতে একা জোনাব আলী। জমির কাজ সেরে লাঙ্গল-জোয়াল তুলে রেখে, হাঁড়িতে দু’টো চাল দিয়ে ভাত ফুটিয়ে সন্ধ্যা-সন্ধ্যায়ই খেয়ে নিয়েছে বেচারা। তারপর আরাম করে ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়েছিল।
গ্রামের এক কোণায় বাড়ি। আশ-পাশের প্রতিবেশিরা বেশ দূরে। ফাঁকাফাঁকা জায়গায় বাড়িটা বেশ সুনসান। দক্ষিণা বাতাসে মন-প্রাণ উজার হয়ে যায়। ইচ্ছে করলে জানালা-দরজা খুলেই ঘুমাতে পারতো। চোরের কোন উপদ্রব নেই। কিন্তু ভয় ভয় করে। একা থাকার এই এক দোষ। মনে হয় জ্বিন-পরী, ভুত-পেত্নী হঠাৎ হামলা করে বসবে। যদিও জোনাব আলী ওসবে বিশ্বাস করে না। তবু একা থাকতে গেলে নানান ভয় চেপে বসে। জানালা-দরজা তাই ভাল করে বন্ধ করে তারপর ঘুমিয়েছিল। আশেপাশের কয়েক বাড়িতে পোষা কুকুর আছে। ওরাই গোটা এলাকা পাহাড়া দেয়। কাজেই ভয়ের কিছু নেই। মোটামুটি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল জোনাব আলী।
ঘুমটা যখন সবচেয়ে বেশি জাঁকিয়ে বসেছিল তখন গভীর রাত। আসলে তখন ছিল রাতের শেষ প্রহর। চারদিকে এমন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল যে, বাতাসের একটানা শোঁ-শাঁ শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দেরই অস্তিত্ব ছিল না।
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল জোনাব আলীর। কীসের যেন শব্দ হচ্ছে! কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে। লাফিয়ে উঠে বসলো জোনাব আলী। মনে হলো বাড়ির পাশ দিয়ে ভয়াবহ কিছু যাচ্ছে। একটা দুইটা নয়, অনেক। ঝটপট, ধুপধাপ শব্দ আসছে। মচ মচ শব্দ হচ্ছে মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো ডাল-পালা বা লতা-পাতায়। ঝপাৎ করে শব্দ হলো। ভেঙে পড়লো কিছু। মনে হয় জোনাব আলীর বাগানী জমির ঘেরটা ভেঙেছে। ওটার পাশ দিয়ে আইল চলে গেছে। ওদিক দিয়ে কি কিছু যাচ্ছে? কিন্তু অতো ভারী আর তীক্ষè শব্দ হচ্ছে কেন? অতো সময় নিয়েই বা হচ্ছে কেন? কী যাচ্ছে? মনে হলো যেন হাতির পাল ছুটে চলেছে। ধরাশ্ করে শব্দ হলো। আবার কিছু উল্টে গেল। কুকুরের ডাক দূরে সরে যাচ্ছে। ওরা যেন ভয় পেয়েছে! পালাচ্ছে? শিউরে উঠলো জোনাব আলী। শব্দগুলো বাড়ির চারদিকে হচ্ছে। ক্রমেই বাড়ছে।
আতঙ্কে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল জোনাব। কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হলো। এখনও আগের মতোই অবিরাম শব্দ হচ্ছে। আস্তে করে চৌকি থেকে নামলো সে। জানালার কাছে ফুটোয় চোখ রাখলো। অন্ধকার। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলো না। তারপর তীব্র আতঙ্কের সঙ্গে দেখতে পেল, যুদ্ধাস্ত্র হাতে সারি সারি লোক যাচ্ছে সামনের গ্রামের দিকে। মিলিটারি? কিন্তু তা কী করে হয়! মিলিটারি তো দেশে একবারই নেমেছিল, সেই পাঁচ বছর আগে ১৯৭১ সালে। তখন পাকিস্তানি মিলিটারিরা এভাবে রাতের বেলায় গ্রামে গ্রামে হানা দিয়েছিল। কিন্তু এখন? এখন মিলিটারি আসবে কোত্থেকে! ভাল করে লক্ষ্য করলো জোনাব আলী। না, কোন ভুল নেই। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সামরিক পোশাক এবং সামরিক হেলমেট মাথায় যুদ্ধের সাজে সারি সারি মিলিটারি প্রায় ডবল মার্চ করে যাচ্ছে। চোখ রগড়ালো জোনাব আলী। এটা কী করে সম্ভব? ওকি সত্যিই এসব দেখছে? শরীরে চিমটি কাটলো। ব্যাথায় লাফিয়ে উঠলো। না, কোন সন্দেহ নেই। এটা স্বপ্ন নয়, রীতিমতো বাস্তব। তাহলে কি রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানিরা আবার এদেশে ঢুকে পড়েছে? দেশ দখল করে নিয়েছে? সব্বোনাশ! আবার দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল? আতঙ্কে হতভম্ব হয়ে গেল জোনাব আলী। তারপর ধপ্ করে মাটিতে বসে পড়লো।
---- চলবে ----
আবুল হোসেন খোকন : লেখক-সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।