অন্তর্ঘাত
(রাজনৈতিক উপন্যাস)
আবুল হোসেন খোকন
[ সত্তর দশক বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সামরিক শাসনের পটভূমিকে ভিত্তি করে এই রাজনৈতিক উপন্যাসটির অবতারণা। অপ্রকাশিত এ পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ ধারাবাহিকভাবে মুক্তমনায় তুলে ধরা হলো। লেখক ]
পার্ট - ৫
(পাঁচ)
জায়গাটা আগে ছিল তরুণ-তরুণীদের কলকাকলিতে মুখরিত। কিন্তু এখন চলছে সামরিক শাসন। তাই সব বন্ধ। এটা একটা কলেজ বাউন্ডারি। চারদিকে কাটাতারের বেড়া। ভিতরে অবস্থান নিয়েছে সৈন্যরা। কলেজ ক্যাম্পাসকে পরিণত করা হয়েছে সামরিক ব্যারাকে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা-পড়া এবং কলেজের প্রশাসনিক কার্যক্রমকে। তার বদলে এখানে চলছে সামিরক বাহিনীর প্রশাসনিক কার্যক্রম। ক্যাম্পাসের মাঠগুলোকে পরিণত করা হয়েছে প্যারেড গ্রাউন্ডে। ছাত্র-ছাত্রীদের হোস্টেলগুলোকে করা হয়েছে সেনা মেস-এ। বাউন্ডারির বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে গার্ডপোস্ট। মেইন গেটে মিলিটারি পুলিশ চেকপোস্ট। বেশ কয়েকটি ভবন এবং টিনশেড ঘরকে নিয়ে গড়ে উঠেছে আর্মারি ডিপো। সেখানে অবস্থান নিয়েছে ট্যাংক, আরমারড কার, কামান, মেশিনগান ইত্যাদি। বসানো হয়েছে ওয়্যারার গার্ড। অন্যান্য গার্ডপোস্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানগুলোতে রয়েছে একে-৪৭ ধারী সেনা গার্ড বা সেণ্ট্রি। ক্যাম্পাস এলাকার গাছ-পালার গোড়ায় ৩ থেকে ৫ ফুট পর্যন্ত চুনকাম করা হয়েছে। ফলে গোটা এলাকায় ফিরে এসেছে ক্যাণ্টনমেণ্টের গন্ধ। কলেজ প্রশাসকদের বাসভবনগুলোকে নিয়ে এখন গড়ে তোলা হয়েছে অফিসার্স কোয়ার্টার। ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসরুমগুলো পরিণত হয়েছে আর্মি অফিসার্স রুম, এক্সারসাইজ রুম, ডাটা বেইজ অথবা ইকুইপমেণ্ট রুমে। এর অনেকগুলোকে আবার কনসেনট্রেশন রুমেও পরিণত করা হয়েছে। কনসেনট্রেশন রুমগুলোর মধ্যেও আবার সেকশন আছে। কোনটি হয়েছে টর্চার চেম্বার, কোনটি কাস্টডি। এ ছাড়া কোনটি লাইট আর্মস ডিপো বা রেডিও রুম হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে।
একটি চারতলা ভবন। এর শেষ তলায় হল রুম। রুমের গেটে এবং আশপাশে কড়া সেণ্ট্রি। প্রত্যেক সেণ্ট্রির হাতে চকচকে চীনা মডেলের একে-৪৭ রাইফেল, কারবাইন ও ব্রেটাগান। রুমের ভেতরে বৈঠক চলছে। বৈঠকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এক ব্রিগেডিয়ার। বাকি যারা অংশ নিচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছে কর্নেল, বেশ কয়েকজন লেঃ কর্নেল, মেজর, ক্যাপ্টেন এবং এক ডজনেরও বেশি গ্র“প লিডার ও এনসিও। অনেক্ষণ ধরে বৈঠক চলেছে। এখন শেষ পর্ব। বক্তব্য রাখছেন ব্রিগেডিয়ার।
তিনি বলছেন, প্রত্যেকটি অপারেশনেরই একটা উদ্দেশ্য থাকে। আমরা যে অপারেশন পরিচালনা করছি, তাতে আসল কালপ্রিটরা ধরা না পড়ুক তবুও লাভ আছে। আসলে আমাদের এই অপারেশনগুলোকে সাইকোলজিক অপারেশন বলা যেতে পারে। সারা দেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে পর্যন্ত আমাদের এ অপারেশন চলছে। এরফলে আমাদের শত্রপক্ষের মনোবল ভেঙে যাবে। মানুষ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস রাখবে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো গেরিলারা শক্তিশালী হতে পারবে না। ওরা সব সময় ধরা পড়ার ভয়ে পালিয়ে থাকতে বাধ্য হবে। বাইরে বেরুতে পারবে না। ধীরে ধীরে ওরা একদিন শেষ হয়ে যাবে।
এইটুকু বলার পর ব্রিগেডিয়ারের সারা মুখমণ্ডল জুড়ে যে নির্ভেজাল বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠলো তাতে মনে হতে পারে লোকটি বোধহয় সহজ-সরল। তার হাতের ছড়িটি এসময় নিজের আরেক হাতের উপরই ওঠা-নামা করছিল। মুখের হাসি বোধহয় এরার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। এক পা দু’পা করে পাইচারি করলো ব্রিগেডিয়ার। কিন্তু হঠাৎ সব কিছুতে একটা পরিবর্তন আসতে শুরু করলো। কারণ উঠে দাঁড়িয়েছেন একজন লেঃ কর্নেল। মনে হয় বেচারা কিছু বলার জন্য অনেকক্ষণ ধরেই উসখুস করছিল। তার এক একটি কথা ব্রিগেডিয়ারের শরীরে তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটাতে থাকলো। তার শরীরের এক একটি সেলে ডজনখানেক করে বিস্ফোরন ঘটে চললো।
লেঃ কর্নেল বললো, স্যার আমরা তো পাকিস্তানি মিলিটারি নই। এই দেশটাও পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ করে এই দেশটা পাওয়া গেছে। তাছাড়া দেশের শাসনভার রাজনীতিকদের হাতে থাকবে, দেশে গণতন্ত্র থাকবে এটাই তো ছিল মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য। এতো আত্মত্যাগ, এতো রক্তক্ষয় করে এদেশের মানুষ যে স্বাধীনতা লাভ করেছে তাতো এদেশের মানুষের নির্ভয়ে বেঁচে থাকার জন্যই। কিন্তু আমরা এই দেশের সৈনিক হয়ে যদি ঠিক পাকিস্তানি সেনাদের মতো মানুষের উপর অপারেশন চালাই, তাঁদের উপর দমন-নির্যাতন-অগ্নিসংযোগ-গ্রেফতার-ফায়ারিং স্কোয়াড চালাই তাহলে পাকসেনাদের থেকে আমাদের পার্থক্য রইলো কোথায়? মানুষ যদি আমাদের দেখে ভয়-ই পায়, তাহলে আর মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা এসবের অর্থ থাকলো কোথায়? নিজেরা নিজের দেশের মানুষের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য সাইকোলজিক অপারেশন চালানোর ব্যাপারটি স্যার আমার কাছে ভাল লাগছে না।
একটু থামলো লেঃ কর্নেল। তার উদাস দৃষ্টি এখন সামনের দেয়ালে টাঙানো বিশাল আকৃতির বাঁধানো ছবিটির দিকে। ছবিটি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের। সেখান থেকে লেঃ কর্নেলের দৃষ্টি নেমে এলো ব্রিগেডিয়ারের দিকে। সে দেখতে পেলো ব্রিগেডিয়ারের মুখে ক্রুর হাসি। চোখে ফুটে উঠেছে এক ভয়ঙ্কর জিঘাংসা। লেঃ কর্নেল এর সবটাই স্পষ্ট দেখতে পেলো। কিন্তু সে একটি জিনিসই দেখতে পেলো না। সে জিনিসটি হলো ব্রিগেডিয়ার ইতিমধ্যেই বিদ্রোহ করা এবং সামরিক আইনবিরোধী ভূমিকা নেওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শালে রায় দিয়ে ফেলেছেন। রায় অনুযায়ী লেঃ কর্নেলের স্থান হবে ফায়ারিং স্কোয়াড।
(ছয়)
একটা হাতব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে হাঁটছে বিনু। গ্রামের মেটো পথ। আর একটু এগুলেই পাকা সড়ক। সেখানে মিনিবাস স্টপেজ। বাস ধরার জন্যই বিনু যাচ্ছে। গন্তব্য রাজধানী ঢাকা। ইচ্ছে করলে কোচ সার্ভিসে টিকেট কেটে যেতে পারতো ও । কিন্তু তা যাচ্ছে না। যাবে লোকাল বাসে। কারণ কোচগুলো ঘন ঘন সামরিক চেকপোস্টের মুখোমুখী হয়, যাত্রীদের উপর অনুসন্ধান চালানো হয়। সন্দেহ হলেই নামিয়ে নেওয়া হয়। তাছাড়া তল্লাাসী তো আছেই। মিলিটারি, গোয়েন্দা বিভাগ এবং পুলিশের চোখে তরুণ-যুবকরা দারুণ সন্দেহজনক। একটু কিছু মনে হলেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিনু এমনিতেই যুবক, তার উপর চেহারায় আছে একটা অন্যরকম আভা। তার চেয়েও বড় কথা ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সামরিক সরকারের লোকেরা। সুতরাং সাবধান না হয়ে উপায় নেই।
অনেকটা গ্রাম্য পোশাকে, তবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে চলেছে বিনু। ক্লিনসেভড হওয়ায় এখন আর খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো নেই। চেহারায় একটা সরল-সোজা, হাবা-গোবা ভাব এনেছে যাতে একজন সাধারণ কর্মজীবী যুবক বলে মনে হয়। হাতব্যাগটাও সেই অনুযায়ী বেছে নিয়েছে ও। লোকাল বাসে যেতে সুবিধা হলো যে কোন স্টপেজে নেমে যাওয়া যায়। কোন গোয়েন্দা পিছু নিলে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না তখন। তাছাড়া চেকপোস্টগুলোও এড়িয়ে চলা যায়। বিনুকে আপাততঃ লোকাল বাস হয়ে নগরবাড়ি ঘাটে পৌঁছাতে হবে। তারপর ঢাকার পথে কোন বাস ধরতে হবে।
স্টপেজটার আশ-পাশে অল্প কয়েকটি দোকান। কোনটি মুদিখানা, কোনটি শুধুমাত্র পান-বিড়ি-সিগারেটের। আর আছে একটা চায়ের দোকান। বিনু সাবধানে চারদিকটা দেখে নিলো। তারপর চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে বসে পড়লো। চায়ের অর্ডার দিলো।
চা পান করতে করতে সড়ক পথের দিকে লক্ষ্য রাখলো। যে কোন মুহূর্তে এসে যাবে বাস। আর কাউকে অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য পাশের পান-সিগারেটের দোকানে বয়সী ২/৩ জনকে বিড়ি ফুঁকতে দেখা যাচ্ছে। একজন পানও নিচ্ছে। সবাই কৃষক বা মজুর। হয়তো বাসে কোথাও যাবে।
আরো কিছুক্ষণ কেটে গেল। এরমধ্যে ভারী মেশিনগান ফিট করা দু’টি সামরিক কনভয় খুব দ্রুত সড়কপথ দিয়ে চলে গেছে। এটা এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। ফাঁকা জায়গায় কনভয়গুলো খুব দ্রুতই চলে যায়। হয়তো আস্তে যাওয়ার সাহস পায় না! কিংবা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, জনসাধারণকে বিশ্বাস করে না! আর এমন হবেই বা না কেন? দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের কনভয় এবং সামরিক বা পুলিশের ক্যাম্পগুলোতে গেরিলা হামলা হচ্ছে প্রায়ই। সুতরাং সাবধানে চলাফেরা করে ওগুলো।
আরো কিছুক্ষণ পর মুড়িরটিন জাতীয় একটা বাস এলো। লোকজনে ভর্তি। থামার পর যাত্রীরা নামতে শুরু করলো। বিনু ভাল করে খেয়াল করলো খাঁকি বা সামরিক পোশাকপড়া কোন লোক আছে কিনা। আরো খেয়াল করলো কোন লোক সন্দেহজনক কিনা। পুরো নিশ্চিত হবার পর বাসের দিকে এগুলো ও। এরমধ্যে বেশ কয়েকজন যাত্রী নেমে পড়েছে। কন্ডাক্টর ‘কাঁশিনাথপুর-নগরবাড়ি’ বলে চিৎকার করছিল। বিনু উঠে পড়লো। বাস ছেড়ে দিলো। তারপর কিছুদূর এসে আরেকটি অনির্ধারিত স্টপেজে থামলো। আরো কিছু লোক নামলো। এবার বসার ছিট পেলো বিনু। এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল।
ঘন ঘন যাত্রী ওঠা-নামা করার মধ্যদিয়ে চলছিল মুড়িরটিন। হঠাৎ ব্রেক কষে থেমে পড়লো। এবারে কোন কোলাহল নেই। ঝিমুনির অভিনয় করছিল বিনু। কিন্তু শক্ত ব্রেক কষাতে সচকিত হয়ে উঠলো। বাইরে তাকিয়ে দেখলো দোকান-পাটগুলোর ঠিকানায় কাঁশিনাথপুর লেখা। তারমানে নগরবাড়ি মাত্র ৪ মাইল দূরে। বাস থামলো কেন! স্টপেজ বলে? না, ভিতরে ভিতরে চমকে উঠলো ও। কারণ বাসে উঠছে কয়েকজন আর্মি এবং পুলিশ। শিরদাড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল বিনুর। তবে উপরে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক চোহারা বজায় রাখলো। পুরো এক মিনিট ব্যয় করলো ওরা। তারপর পুলিশগুলো সার্চ শুরু করলো। প্রত্যেক যাত্রীর ব্যাগ, পুটলি এবং দেহ সার্চ করা হলো। বিনুর ব্যাগ এবং দেহ সার্চ হলো। তারপর নেমে গেল ওরা। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো বিনু। বোঝা যায় এটা ওদের দায়সারা গোছের রুটিনওয়ার্ক। পাশেই হয়তো আর্মি চেকপোস্ট। অতকিছু দেখার প্রয়োজন মনে করলো না বিনু। বাস চলতে শুরু করলো। আগের মতো ঝিমুতে লাগলো ও।
---- চলবে ----
আবুল হোসেন খোকন : লেখক-সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।