অন্তর্ঘাত
(রাজনৈতিক উপন্যাস)
আবুল হোসেন খোকন
[ সত্তর দশক বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সামরিক শাসনের পটভূমিকে ভিত্তি করে এই রাজনৈতিক উপন্যাসটির অবতারণা। অপ্রকাশিত এ পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ ধারাবাহিকভাবে মুক্তমনায় তুলে ধরা হলো। লেখক ]
পার্ট - ৬
নগরবাড়ি ঘাট। প্রবেশ মুখে বিরাট আকারের আর্মি চেকপোস্ট। বালুর বস্তা সাজিয়ে বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা পোস্ট বসানো হয়েছে। তাতে পাতা রয়েছে ভারী ও হালকা মেশিনগান। ব্যারিয়ারের সামনে বিনুদের বাস থেমে দাঁড়ালো। উঠে এলো হেলমেট পড়া টমিগান হাতে কয়েকজন আর্মি। সকল যাত্রীকে নামার ইঙ্গিত করা হলো। নিঃশব্দে আদেশ পালন করলো সবাই। বিনুও বাইরে এসে লাইন করে দাঁড়ালো। ভিতরে ভিতরে ঘামছে ও। আর্মিদের একটা দল জিজ্ঞাসাবাদসহ দেহতল্লাশী করলো। আর কয়েকজন বাসের ভিতরে যাত্রীদের ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিসিপত্র তন্নতন্ন করে হাতরালো। তেমন কোন কিছুই পেলো না ওরা। তবে লাইনে দাঁড়ানো এক তরুণ সমস্যা তৈরি করে ফেলেছে। ঢাকার কোন কলেজের ছাত্র। মাথার চুল বেশ বড়। গায়ে রঙচঙে সার্ট। হাতে বালা, গলায় চেন। আর্মিরা তরুণটিকে ছেঁকে ধরেছে। রাজনীতি করে কিনা, মাস্তান কিনা, গলায় মালা কেন, চুল বড় কেন ইত্যাদি নানান প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলেছে। ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠছে প্রশ্নকারীরা। এক পর্যায়ে চুলের মুঠি ধরলো এক আর্মি। আরেকজন সবুট লাথি হাঁকলো পাঁজর বরাবর। হ্যাঁক শব্দ করে কুকড়ে গেল তরুণ। তারপর ওকে চেকপোস্টের পাশে ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। বাকি যাত্রীদের বাসে উঠতে বলা হলো। বাস আবার চলতে থাকলো।
ঘাট পর্যন্ত এক কিলোমিটারের কম রাস্তা পেরুতে আরো তিন জায়গায় আর্মি চেক হলো। সবগুলো বাধা পেরিয়ে তবেই বাস ঘাটে ভিড়লো। ভিতরে ভিতরে শুকিয়ে আমচুর হয়ে গিয়েছিল বিনু। এখন খানিকটা হাঁপ ছাড়লো। বাস থেকে নেমে ফেরীর দিকে না গিয়ে লঞ্চের দিকে এগুলো। ফেরীতে আর্মি থাকার সম্ভাবনা আছে। একটা লঞ্চ এখনই ছেড়ে দেবে। হাঁকডাক করছে। বিনু উঠে পড়লো তাতে। কিন্তু যেখানেই বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। লঞ্চে আর্মি না থাকলেও সশস্ত্র পুলিশ ও আনসার রয়েছে। অবশ্য আর্মির মতো এরা অতো বিপদজনক নয়। বিনু ওপরতলার দিকে না গিয়ে নিচতলায় ঢুকে পড়লো। ফাঁকা একটা আসন দেখে এগিয়ে গেল। আসনটা পছন্দসই। জানালার ধারে। বিপদ দেখলে লাফিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেওয়া যাবে। বসে পড়লো বিনু। কিছুক্ষণ পর চলতে শুরু করলো লঞ্চ। ব্যাগটা কোলের উপর রেখে ঝিমুনির ভাব টেনে আনলো ও।
ঢাকায় অনেকগুলো কারণে যেতে হচ্ছে বিনুকে। পার্টিতে নানান প্রশ্ন জমে উঠেছে। একদিকে সরকারি বাহিনীর বর্বর দমননীতি, আরেকদিকে সিওসি (অর্গানাইজেশন অব সেণ্ট্রাল কমান্ড)-এর যোগসূত্রহীন সিদ্ধান্ত নিয়ে পার্টি-সংগঠনে এই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে আঞ্চলিক সমন্বয় কমিটির বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারেই সিওসি’র কাছে যাচ্ছে বিনু।
সমন্বয় কমিটির বৈঠকে অনেক প্রশ্ন উঠেছিল। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছে, বার বার সিওসি থেকে বলা হচ্ছে শীঘ্রই সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান শুরু হচ্ছে। অভ্যুত্থানটা শুরু হবে সামরিক বাহিনী থেকে। তার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে গণসংগঠনগুলোসহ গণবাহিনীকে। জিরো আওয়ারে ঘটনা ঘটবে। দিন-তারিখটা যে কোন সময় জানিয়ে দেওয়া হবে। এই মৌখিক সংকেতটাকে একইভাবে দেওয়া হচ্ছে মাসের পর মাস ধরে। কিন্তু সংকেতের দিন-তারিখ আসছে না। পার্টি সার্কুলারগুলোতে বলা হচ্ছে, দেশে বিপ¬বী পরিস্থিতি বিরাজ করছে, অকল্পনীয় গতিতে ভিতরে ভিতরে গুণগত পরিবর্তন ঘটছে। এখন শুধু বিস্ফোরনের অপেক্ষা। সেই অপেক্ষায়ই দিন গুনছে পার্টি-সংগঠকরা। এদিকে একটি সিপাহী-জনতার গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন মহান বিপ¬বী কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম)। সিওসি এবং পলিটব্যুরোর ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এই অবস্থা। প্রশ্ন উঠেছে, জিয়াউর রহমানের মতো একজন প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক অফিসারকে কেন বিশ্বাস করা হয়েছিল? কেন কর্নেল তাহের তার প্রাণ বাঁচালেন, তাকে নবজীবন দান করলেন? সেই জিয়াউর রহমান কি আজ কর্নেল তাহেরকে বাঁচাবে? যদি বাঁচাতোই, তাহলে অন্ধ কারা প্রকোষ্ঠে প্রহসনের বিচার শুরু করতো না। জিয়াউর রহমান যদি মানবপ্রেমিক ও দেশপ্রেমিক হতোÑ তাহলে প্রতিদিন সেনাবাহিনীতে শুদ্ধি অভিযানের নামে শত শত মুক্তিযোদ্ধা সৈনিককে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে অথবা রাতের আঁধারে কারাগারের ভেতর ফাঁসী দিয়ে হত্যা করতো না। জনগণ, গণবাহিনী এবং গণসংগঠনগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য সারাদেশে হত্যা ও দমননীতি চালাতো না। এই ধরনের এক গণবিরোধী সামরিক অফিসারের সঙ্গে পার্টি নেতৃত্ব কেন বন্ধুত্ব করতে সায় দিয়েছিল? কেনই বা কর্নেল তাহেরকে ৭ নভেম্বরে বেতার-টিভিতে সিপাহী বিপ¬বের নেতৃত্বদানের কথা বলতে দেওয়া হলো না? কেন তাঁর বদলে জিয়াউর রহমানকে কথা বলতে দেওয়া হলো? এখন বলা হচ্ছে, জিয়াউর রহমান সাম্রাজ্যবাদের দালাল ছিল। পার্টি নেতৃত্ব কেন এটা আগে জানেনি? তারপর আরো প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে ৭ নভেম্বর ভোরে সিপাহী-জনতার গণঅভ্যুত্থান ঘোষণা করা হলো, বেতার-টিভিতে গণবাহিনী, জাসদ আর বিপ¬বী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্ব দানের কথা বলা হলো। কিন্তু এই অভ্যুত্থান করার আগে কেন পার্টি চ্যানেলগুলোতে জানানো হলো না? কেন সময়মতো সারাদেশের সমন্বয় কমিটিগুলো কিছু জানলো না? এটা কি হটকারী নয়? কেন, কার স্বার্থে এই হটকারীতা?
আরো বহু প্রশ্ন উঠেছিল বৈঠকে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা এবং সিওসি’র অবস্থান সম্পর্কেও কথা উঠেছিল। বলা হয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ পেটি-বুর্জোয়া দল, সে কখনই সর্বহারা শ্রেণীর বিপ¬বের মিত্র হতে পারে না। তাই সে আমাদের শত্র“। কিন্তু যে শ্রেণী চরিত্রের কথা বলে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে চালানো হচ্ছে খতম অভিযান সেখানে আমাদের দলীয় চরিত্র কি? একদিকে পার্টি সার্কুলারগুলোতে বলা হচ্ছে আমাদের দল পেটি-বুর্জোয়াদের নিয়ে, আমরা একে সর্বহারা শ্রেণীর দলে পরিণত করার প্রক্রিয়ায় আছি। ভাল কথা, এটা তো অনেক দিন থেকেই বলা হচ্ছে। কিন্তু আজো পর্যন্ত সর্বহারা শ্রেণীর পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি গড়া হয়নি। অথচ আমরা কমিউনিস্ট পার্টির মতো সামরিক সংগঠন গড়েছি, পলিটব্যুরো করেছি, কিন্তু পেটি-বুর্জোয়া চরিত্রের বিলুপ্তি ঘটাইনি! এই প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ কতোটুকু যুক্তিযুক্ত? তাছাড়া একদিকে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, একইসঙ্গে রাজনৈতিক ভিত্তিধর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লড়াই কতোটুকু সঠিক? শুধু তাই-ই নয়, অন্যান্য সকল বামপন্থী নামধারীদলগুলোর সঙ্গেও আমাদের সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। যদিও সবাই আমরা সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার জন্য লড়ছি। মতাদর্শগত বিরোধ বা পার্টি লাইনগত মতভেদ আছে বলেই কিÑ এখানে সশস্ত্র লড়াই অনিবার্য? এখানে কি মতাদর্শগত সংগ্রাম কাম্য ছিল না? অথচ একা সমস্ত শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আমরা অবিরাম শক্তিক্ষয় করছি। দমননীতির মুখে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছি। পাল্টা কিছুই করতে পারছি না। অন্যদিকে এই সুযোগে বামপন্থীদের চরম শত্র“ মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক চক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। শক্তি বৃদ্ধি করছে।
বৈঠকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ব্যাপার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সাংগঠনিকভাবে আমাদের এই জায়গাটা একেবারেই অস্পষ্ট। কেন? প্রথমে আমরা বললাম, রুশ-ভারত আমাদের এক নম্বর শত্র“। পরে এই তালিকায় যোগ করলাম মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নাম। কেন এই বিলম্ব? আর কেনই বা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে এক নম্বর শত্র“ হিসেবে দেখছি না? প্রথমে আমরা বলেছিলাম চীন এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টি আমাদের মিত্র। এখন বলছি, ওরা স্ট্যালিনের আদর্শচ্যুত, সুতরাং ওরা আমাদের মিত্র নয়। কখনও বলছি, আলবেনীয় কমিউনিস্ট সরকার আমাদের মিত্র, আবার যোগাযোগ রক্ষা করছি ভারতের সোসালিস্ট ইউনিটি সেণ্টারের (এসইউসি) সঙ্গে। এসইউসি’র প্রধান কমরেড শিবদাস ঘোষের থিসিসের হুবহু অনুলিপি তৈরি করে আমাদের পার্টি থিসিস করেছি! কেন? আবার কখনও বলছি, উত্তর কোরিয়া আমাদের মিত্র, কিন্তু বাস্তবে এই মিত্রতার কোন প্রমাণ নেই। তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে কে আমাদের মিত্র, আর কে-ই বা শত্র“? এগুলো এতো অস্পষ্ট থাকার কারণ কি??
বিনুর কাছে অনেক সময় সবকিছু গোলমেলে মনে হয়। যদিও সব প্রশ্নের সঙ্গে ও একমত নয়। ওরও রয়েছে নতুন নতুন বহু প্রশ্ন। ভাবতে গিয়ে কখনও কখনও অবাক হয়ে যায় ও। যেদিন দেশের একমাত্র দল আওয়ামী লীগ ভেঙে ওদের দলটা তৈরি হলো, সেদিন থেকে দেশে এক নতুন অবস্থা তৈরি হলো। ক্ষমতাসীনদের বিকল্প হয়ে দাঁড়ালো ওর দল। কতো মানুষ যুক্ত হলো এই দলে! পল্টনের মাঠে যখন জনসমাবেশ ডাকা হতো, তখন লাখ লাখ লোক সমবেত হতো বক্তৃতা শোনার জন্য। ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর পল্টন ময়দানে আর এতো বড় সমাবেশ আওয়ামী লীগও করতে পারেনি। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই এতো জনপ্রিয় সংগঠনে পরিণত হয়েছিল বিনুদের গণসংগঠন। দেশবাসীর আশা-ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। নেতাদের বক্তৃতায় গণমানুষের মন-মানসিকতা যখন টগবগ করে ফুটছিল তখন দলে দলে যুবক-তরুণ-ছাত্র-ছাত্রী আর মুক্তিযোদ্ধারা এই দলে সমেবত হচ্ছিলো। সত্যিই একটা পরিবর্তনমুখী শক্তি হয়ে দাঁড়াচ্ছিল দল। কিন্তু তারপর এমন সব ঘটনা ঘটলো যা ভাবা যায়নি। দলের উপর এমন ভয়াবহ দমননীতি নেমে এলো যে, দলের সবাই আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে গেল। গণসংগঠনগুলোর তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেল। এরপর ১৫ আগস্টে হঠাৎ স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলো একদল সামরিক বাহিনীর লোক। ক্ষমতাচ্যুত হলো আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় এলো কট্টর ডানপন্থী চক্র। তারপর আরো কিছু ঘটনা ঘটলো। ক্ষমতায় এলো জিয়াউর রহমান। ইতিহাসের নজীরবিহীন দমননীতি নেমে এলো বিনুদের উপর। বিনুদের দলে বিপ¬বী মন্ত্রণায় দীক্ষিত হয়ে এতো তরতাজা তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, ছাত্র-ছাত্রী, কিশোর, শ্রমিক, কৃষক সমবেত হয়েছিল যে পৃথিবীর কোন বামপন্থী সংগঠনে এতো দ্রুত এতো শক্তিভিত কখনও গড়ে ওঠেনি। কিন্তু দমননীতির মুখে আজ পরিস্থিতি অন্যরকম। দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই এখন কঠিন। যদিও আন্ডারগ্রাউন্ড শক্তিভিত এখনও অকল্পনীয়। তবুও আগের মতো সেই গণভিত্তি আর আছে বলে মনে হয় না। হয়তো গণসংগঠনগুলোর অনুপস্থিতিই এর কারণ। হয়তো দমননীতির মুখে জনগণের ভিতরে আতঙ্ক ঢুকে যাওয়াও একটা কারণ। ফলে পার্টি-সংগঠনে প্রায়ই দেখা দিচ্ছে হতাশা। অবশ্য সিওসি’র গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত মেসেজ এখনও আশাবাদী করে রেখেছে অনেককে।
অতীতের অনেক ঘটনার জন্য কাকে দায়ী করা যেতে পারে ভেবে পাচ্ছে না বিনু। দলে একজন রহস্যময় ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। তিনি হলেন ‘দাদা’। পার্টি প্রক্রিয়া বা সাংগঠনিক দলিলপত্রে বার বার বলা হচ্ছে পার্টি চলবে যৌথ নেতৃত্বে এবং যৌথ সিদ্ধান্তে। কিন্তু বার বার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে সবকিছু চলছে এক ব্যক্তির ইচ্ছায়। সেই ব্যক্তি হচ্ছেন ‘দাদা’। পলিটব্যুরো বা সিওসি কিছুই জানে না, অথচ দাদার নির্দেশে অনেক কিছু ঘটছে। পলিটব্যুরো বা সিওসি’র বাইরে দাদাই সবকিছু দেখছেন, করছেন; এবং নির্দেশ দিচ্ছেন। দলের চেইন অব কমান্ডও তার হাতে। অথচ কাগজে-কলমে এসবের কোন অস্তিত্ব নেই। কাগজে-কলমে সিওসি বা পলিটব্যুরোই সব। মাঝে মাঝে বিনুর মনে হয় পার্টির কোন সিদ্ধান্তই যৌথ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত নয়। এসব সিদ্ধান্ত কোন না কোন ব্যক্তির। জটিল এইসব বিষয়ে প্রশ্ন করে কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না। শুধু অস্পষ্টতা তাই বাড়ে। সব মিলিয়ে অনেকের মতো বিনুর কাছেও মনে হয় ‘দাদা’ সত্যিই রহস্য পুরুষ! কিন্তু কোন বামপন্থী সংগঠনে এ ধরনের রহস্যময়তার অবকাশ আছে বলে বিনুর জানা নেই। শোনা যায় কর্নেল তাহেরকে নাকি তিনিই ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে বলেছিলেন। যে তাহের আজীবন একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য সেনাবাহিনীকে জনগণের বাহিনীতে পরিণত করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে এসেছেন, সেই তাহের আজ মৃত্যুর মুখোমুখী। হয়তো প্রহসনের বিচারে তাঁর মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে। কিন্তু এই মৃত্যুর জন্য কে হবে দায়ী? বিনুর কাছে এর উত্তর জানা নেই। পার্টি সমন্বয় কমিটির বৈঠকে পার্টি লাইন ও রণকৌশল নিয়েও ব্যাপক বিতর্ক হয়। আত্মসমালোচনার মধ্যদিয়ে উঠে আসে নানান প্রশ্ন।
অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। ঘড়ি দেখলো বিনু। হ্যাঁ, আর ১৫/২০ মিনিটের মধ্যেই ঘাটে পৌঁছে যাবে লঞ্চ। বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে ভাবতে ভাবতে খুব সহজেই সময় কেটে গেছে। ঢাকায় সিওসি এবং পলিটব্যুরো নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর পার্টি-এলাকায় পৌঁছে এবার বিনু আরো কঠিন উদ্যোমে কাজ করবে। মনে মনে শপথ নিলো বিনু। যে কোন মূল্যেই হোক দেশে বিপ¬ব ঘটাতে হবে। পাল্টে ফেলতেই হবে সমাজকে। না হলে শুধু বিনু বা বিনুর মতো বর্তমান সমাজের মানুষগুলোই নয়, তাদের প্রজন্মও দাসত্বের এক নিগূঢ় শৃঙ্খলে আটকে পড়বে। ব্যহত হবে তাদের স্বাভাবিক বিকাশ। তারা পরিণত হবে পঙ্কিল সমাজের নোংরা জীবে। সমাজটা হয়ে উঠবে আরো বিষময়, আরো অমানবিক। এটা মেনে নেওয়া যায় না। এর বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম চালাতেই হবে।
এবার এলাকায় ফিরে রিতুর সঙ্গে দেখা করবে বিনু। অনেকদিন হলো দেখা করতে পারেনি। কেমন আছে ভাল করে খোঁজও নিতে পারেনি। অথচ রিতু সব সময় খোঁজ রেখেছে। বিনুর জীবনে এটা একটা অস্বাভাবিক ঘটনা। পার্টি জীবনে প্রেমটা স্বাভাবিক নয়। কারণ জীবনটা সব সময় ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোন সময় মারা যেতে পারে। পারে গ্রেফতার হতে। গ্রেফতার হলে কি পরিণতি হবে সেটা পরিস্কার। আর একটা ব্যাপার হলো পার্টি শৃঙ্খলার স্বার্থে কোন ঘটনা গোপন রাখা নিষিদ্ধ। কারণ পার্টিজীবনে পার্টিই সব। বাবা-মা-ভাই-বোন বা আত্মীয়-স্বজনের চাইতেও বেশি বিশ্বাসযোগ্য হলো পার্টি। পার্টির কাছে তাই কোন কিছু গোপন রাখা চলবে না। এরকম গোপন রাখার পরিণাম হতে পারে চরম। একবার এক পার্টি কমরেড একটি সেল্টারে গিয়ে প্রেম করার চেষ্টা করেছিল সেই বাড়ির মেয়ের সঙ্গে। ব্যাপারটি সে পার্টিকে জানায়নি। পরে জানাজানি হয়ে গেলে কমরেডটির শাস্তি হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড। সুতরাং পার্টি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার কোন উপায় নেই। যেমন উপায় নেই পার্টি ত্যাগ করার। সে চেষ্টা করার শাস্তিও ফায়ারিং স্কোয়াড।
রিতুর ব্যাপারটা বিনু পার্টিকে জানায়নি। এ জন্য বিনুর মনে কোন অপরাধবোধ নেই। কারণ পার্টি কখনও ওর ব্যক্তিগত বিষয়ে জানতে চায়নি, প্রশ্নও তোলেনি। প্রশ্ন তুললে বা জানতে চাইলে অবশ্যই বিনু সব জানাতো। সুতরাং ব্যাপারটা গোপন থাকার যৌক্তিকতা রয়ে গেছে। বিনু সিদ্ধান্ত নিলো ঢাকা থেকে ফিরেই রিতুর সঙ্গে দেখা করবে।
---- চলবে ----
আবুল হোসেন খোকন : লেখক-সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।