অন্তর্ঘাত
(রাজনৈতিক উপন্যাস)
আবুল হোসেন খোকন
[ সত্তর দশক বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সামরিক শাসনের পটভূমিকে ভিত্তি করে এই রাজনৈতিক উপন্যাসটির অবতারণা। অপ্রকাশিত এ পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ ধারাবাহিকভাবে মুক্তমনায় তুলে ধরা হলো। লেখক ]
পার্ট - ৭
লঞ্চ সম্ভবত ঘাটের কাছে পৌঁছে গেছে। যাত্রীরা সব আসন ছাড়ছে। বিনুও ব্যাগটা নিয়ে উঠে পড়লো। ডেকে ওঠার ছোট দরজায় ভীড়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। তারপর বেরিয়ে এলো ডেকে। হ্যাঁ, আর কয়েক শ’ গজ এগুলোই ঘাট। কিন্তু ও কি! ঘাট ভর্তি সশস্ত্র মিলিটারি। শুধু মিলিটারি নয়, ট্যাংকসহ হ্যাভী আর্মস পোস্ট দেখা যাচ্ছে। পানিতেও গানবোট। ব্যাপার কি? ভিতরে ভিতরে শুকিয়ে গেল বিনু। অন্যান্য যাত্রীরাও আতঙ্কিত চোখে দৃশ্য দেখছে। মনে হচ্ছে আস্ত একটা যুদ্ধ ক্ষেত্রে পা দিচ্ছে সবাই।
তীক্ষ্ণ চোখে সব খেয়াল করলো বিনু। ঘাটের কাছাকাছি অন্ততঃ গোটা পাঁচেক ট্যাংক দেখা যাচ্ছে। কামানও রয়েছে। আর্মারকার এবং ট্রাকগুলোতে শোভা পাচ্ছে মর্টার এবং ভারী মেশিনগান। অনেকগুলো বাঙ্কারও দেখা যাচ্ছে। ওগুলো ওয়ার্যার নেট দিয়ে ঢেকে রাখা। বাঙ্কারের পাশে আর্মি চেকপোস্ট। বেশ আগে থেকেই এভাবে রাখা হয়েছে বলে মনে হলো। নদীর গানবোটগুলোকে স্বাভাবিক টহল বোট বলেই মনে হচ্ছে। তবে ঘাট জুড়ে গিজ গিজ করা আর্মিদের মধ্যে শুধু সার্চ পার্টি সতর্ক ও তৎপর। ওরা লঞ্চ আর ফেরিগুলো ঘাটে ভেড়া মাত্রই এক একটা গাড়ি বা যানবাহন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। প্রত্যেক যাত্রীর দেহ এবং ব্যাগ সার্চ করা হচ্ছে। সম্ভবত জিজ্ঞাসাবাদও করা হচ্ছে। দূর থেকে সব স্পষ্ট চোখে পড়লো বিনুর। তারমানে বিপুল আর্মি মোতায়েনের অন্য কোন উদ্দেশ্য যদি নাও থাকেÑ বিনুকেও অনেক প্রশ্নে মুখোমুখী হতে হবে। ওকে সার্চ করে অবশ্য লাভ নেই। প্রশ্ন করেও কিছু জানতে পারবে না, যদি না সত্যি সত্যি আগে থেকে ওরা কোন ইনফরমেশন পেয়ে থাকে।
দুই ঘণ্টা পরের কথা। জেনারেল জিয়ার সকল নিরাপত্তা ব্যুহ ভেদ করে চলেছে বিনু। ও এখন একটা বাসে। আরিচা ঘাটের অনেকগুলো আর্মি চেকপোস্ট অতিক্রম করে এসেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবে রাজধানী ঢাকায়।
(সাত)
রাজধানীর সর্বত্র আর্মিদের সতর্ক আনাগোনা। সাদা পোশাকে গোয়েন্দারাও ঘোরাফেরা করছে। আতঙ্কিত জনসাধারণের মাঝে তারা খুঁজে বেড়াচ্ছে সামরিক বাহিনীর পলাতক সদস্যদের, বামপন্থী গেরিলা এবং সামরিক শাসনবিরোধী রাজনীতিকদের। সন্দেহ হলেই চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে এবং কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যদিয়ে দেশটা চলছে।
ফুটপাত ধরে হাঁটছিল বিনু। ওর মধ্যে কোন সতর্কতা নেই। গা-ছাড়া ভাব। তাই কারো সন্দেহের চোখে পড়ছে না। নির্বিকার শুধু হাঁটছে। পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে একে-৪৭ হাতে আর্মি। রাজপথ দিয়ে মাঝে মাঝেই গোঁ গোঁ করে ছুটে যাচ্ছে মেশিনগান সাজানো আর্মি ট্রাক আর কনভয়।
ফুটপাতের একটা পেপারস্টলে থেমে পড়লো। বিভিন্ন ধরনের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনসহ কিছু রাজনৈতিক পত্রিকা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দেশে রাজনীতি বা রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ। আকার-ইঙ্গিতে সামরিক সরকারের সমালোচনাও নিষিদ্ধ। সুতরাং রাজনৈতিক প্রচারণার প্রশ্নই ওঠে না। তা সত্ত্বেও হকারের কাছে তরতাজা রাজনৈতিক সাপ্তাহিকী দেখা যাচ্ছে। আরো কয়েকজন ক্রেতা ও দর্শকের মতো বিনুও হাতরাতে লাগলো ওগুলো। সাপ্তাহিকগুলোর বেশিরভাগই বামপন্থী হিসেবে পরিচিত কিছু নেতাদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। এর একটির সম্পাদনা করেছেন সাম্যবাদী দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা, একটির সম্পাদকের নাম কাজী জাফর আহমেদ, একটির সম্পাদক রাশেদ খান মেনন। মওলানা ভাসানী সমর্থক সাপ্তাহিকও রয়েছে। কী করে এটা সম্ভব? যেখানে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ, রাজনৈতিক নেতারা সবাই জেলেÑ সেখানে এইসব নেতারা কিভাবে বাইরে রয়েছেন? কিভাবেই বা রাজনৈতিক পত্রিকা বের করছেন? আর্মিরা কিছু বলছে না কেন? ব্যাপারটা সত্যিই রহস্যজনক। গণশক্তি, নয়াযুগ, নতুন কথাÑ এইসব হলো পত্রিকাগুলোর নাম।
একটা পত্রিকায় সাম্যবাদী দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহার বিবৃতি ছাপা হয়েছে। তাতে তিনি বলেছেন, ‘রুশ-ভারতের দালাল কর্নেল (অবঃ) তাহেরকে তিনিই ধরিয়ে দিয়েছেন।’ অন্যান্য পত্রিকাগুলোর বক্তব্য প্রায় একই। সামরিক সরকার নাকি রুশ-ভারতের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করেছেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছেন। পত্রিকাগুলোর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, চীনাপন্থী বাম ও মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তিসহ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সপক্ষে প্রচার-প্রপাগান্ডার জন্যই এসব পত্রিকা। সামরিক সরকারই এই প্রচারণার ব্যবস্থা করেছে। সুতরাং স্পষ্ট যে, কথিত বামপন্থীরাও বর্তমান সামরিক সরকারের দোসর হিসেবে ভূমিকা নিয়েছে। এ কারণেই সামরিক সরকারের আশে-পাশে দেখা যাচ্ছে চীনাপন্থী তথাকথিত বামপন্থী রাজনীতিকদের, মওলানা ভাসানীর ন্যাপ নেতাদের। আর একই কারণে জাসদ এবং গণবাহিনীর উপর দমননীতিতে সহায়তা করছে আন্ডারগ্রাউন্ড বামগোষ্ঠীগুলো। কিন্তু বামপন্থীদের নীতি তো এটা হতে পারে না! কে রাশিয়ার দালাল, কে ভারতের দালালÑ সেটাই বা ওরা বুঝলো কি করে? বিনু নিজেও তো রুশ-ভারত-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তারপরেও ওরা কিভাবে বিনুদের রুশ-ভারতের দালাল আখ্যা দিচ্ছে? ব্যাপারটাই রহস্যজনক। পত্রিকাগুলো ফেলে দিয়ে হাঁটতে থাকলো বিনু। বিক্রেতা হা করে তাকিয়ে থাকলো ওর দিকে।
রিতুর কতগুলো কথা মনে পড়লো বিনুর। রিতুর কথা হলো, লাল পতাকা দিয়ে লাল পতাকা ধ্বংসের চেষ্টা চলছে। কমিউনিস্টদের ধ্বংস করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এখন এই পথ বেছে নিয়েছে। সুতরাং কে সত্যিকারের কমিউনিস্ট বা বামপন্থী তা বোঝা খুব কঠিন। সাম্রাজ্যবাদের এজেণ্টরা এখন বিশ্বের সমস্ত দেশে লাল পতাকার ছদ্মবেশ নিয়ে বামপন্থী বা কমিউনিস্টদের ভিতরে ঢুকে পড়েছে।
বিনু এসব কথাগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। তাছাড়া রিতুর বাবা বিনুদের রাজনীতিকে পছন্দ করেন না। অথচ তিনি কমিউনিস্ট পার্টির একজন বিখ্যাত নেতা। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থী হিসেবে পরিচিত। বিনুরা সোভিয়েত ইউনিয়নকে স্বীকার করে না, বরং দেশটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘সংশোধনবাদী’ হিসেবে। অন্যান্য আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মতো বিনুরা অবশ্য রাশিয়াকে ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’ বলে না। সে যাই হোক, রিতু ওর বাবার অনুসারী। তাই বিনু সব সময় সব কথার গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু এখন দিতে ইচ্ছে করছে।
(আট)
গভীর রাত। কিছু একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। কান খাড়া করলো বিনু।
বেশ আয়েশ করেই ঘুমিয়েছিল। ঢাকা নগরীর ঘিঞ্জি এক বসতি এলাকায় এই সেল্টার। কমরেড মুনির নিয়ে এসেছে। সেও পাশের রুমে ঘুমিয়ে। গত ৩ দিন ধরে দাদা, পলিটব্যুরো এবং সিওসির সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা শেষে ওরা সেল্টারে এসেছিল। কালই চলে যাবার কথা ওয়ার্কিং এরিয়ায়। নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় অনেক বিষয়ে সন্তুষ্ট হতে পেরেছে বিনু, আবার অনেক বিষয়ে পারেনি। যে বিষয়ে দ্বি-মত থেকে গেছে সেগুলো কর্মক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ ও বিশে¬ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আবার ভারী শব্দ হলো। একটা নয়, একাধিক শব্দ। তীক্ষ্ণভাবে কান খাড়া করলো বিনু। আস্তে করে উঠে বসলো। আবার শব্দ। ধপা ধপ্ ধরনের ভোঁতা শব্দ। সন্তর্পণে কোন কিছুর চলার মতো। রেইড করা হচ্ছে কি? বিদ্যুৎ গতিতে উঠে পড়লো ও। কান খাড়া রেখে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। ছিটকিনি হাতড়াতে শুরু করলো। হঠাৎ পিছন দিকে খুট করে শব্দ হওয়ায় লাফিয়ে উঠলো ও। কমরেড মুনির দাঁড়িয়ে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় মুনির বললো, ‘কমরেড কাম অন, রেইড হয়ে গেছে। জলদি চলে আসো।’
হালকা একটা শার্ট গায়ে ছিল বিনুর। খালি পা, লুঙ্গি পরনে। ওই অবস্থায় সবকিছু ফেলে পিছু নিলো মুনিরের। নিঃশব্দে বিড়ালের মতো দেওয়াল টপকালো। অন্ধকারে ভালমতো কিছু ঠাঁহর করতে না পারায় অনেকগুলো হোঁচট খেলো। তবু দূরে বৈদ্যুতিক আলোর আভায় পিছু ছাড়লো না মুনিরের।
আশপাশের কোথাও অনেকগুলো বুটের শব্দ হলো। ‘হল্ট’ বলে চিৎকার করে কমান্ড করলো কেউ। বিনুর হাত চেপে ধরলো মুনির। বললো, ‘কোন ভয় নেই। আর্মি রেইড হয়েছে। তবে ধরা দেবো না।’ শব্দ না করে এগুতে চেষ্টা করলো ওরা। আশপাশে বুটের ভারী শব্দগুলো ক্রমেই জোড়ালো হতে থাকলো।
ঢাকার ঘুমটি এলাকাগুলোতে বেশ কিছু সুবিধা আছে। ছোট-বড় অসংখ্য গীজ-গীজে দালান। তার ভেতর দিয়ে একে-বেঁকে চলে গেছে বহু অলি-গলি। যা মুখস্ত রাখা অচেনা কারো জন্য অসম্ভব। কিন্তু মুনিরের সমস্ত কিছু নখদর্পণে। পার্টি-সংগঠন করতে গিয়ে এই গুণটা অর্জন করেছে। তাই বিভিন্ন পথ দিয়ে ওরা বেরিয়ে এলো। সাব-মেশিনগান হাতে আশপাশ দিয়ে আর্মিদের যেতেও দেখলো, কিন্তু ওদেরকে কেউ দেখতে পেলো না।
---- চলবে ----
আবুল হোসেন খোকন : লেখক-সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।