অন্তর্ঘাত
(রাজনৈতিক উপন্যাস)
আবুল হোসেন খোকন
[ সত্তর দশক বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সামরিক শাসনের পটভূমিকে ভিত্তি করে এই রাজনৈতিক উপন্যাসটির অবতারণা। অপ্রকাশিত এ পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ ধারাবাহিকভাবে মুক্তমনায় তুলে ধরা হলো। লেখক ]
পার্ট - ৮
অনেক গলি এবং ঘিঞ্জি পথ পাড়ি দিয়ে নিরাপদ এলাকায় পৌঁছুলো ওরা। দু’জনেই রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। এরমধ্যে একটা মেইনরোড পার হতে হয়েছে। তখন দেখেছে ওদের এলাকাটা ঘেরাও করে আছে সশস্ত্র আর্মি ট্রাক আর কনভয়। পথের বৈদ্যুতিক আলোয় স্পষ্ট দেখেছে ওগুলোতে মাথা বের করে আছে হালকা ও ভারী মেশিনগান।
‘ওরা জানলো কি করে যে আমরা ওখানে আছি?’ অসহিষ্ণুভাবে প্রশ্ন করলো বিনু। জবাবে মুনির ইতস্তত করে বললো, ‘কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘অন্য কোন কমরেড কি ওই এলাকায় থাকে?’ ফের প্রশ্ন করলো বিনু। মুনির মাথা নাড়লো, ‘নাহ্, আমার জানা মতে ওই এলাকায় আমি ছাড়া কেউ থাকে না। কিন্তু.........।’ আবার ইতস্তত করলো মুনির। বললো, ‘আমি যে থাকি, তা তো কারো জানার কথা নয়! এক পার্টি ছাড়া কেউ জানে না এটা।’ হঠাৎ শঙ্কিত হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো মুনির, ‘তাহলে কেউ কি ধরা পড়ে ফাঁস করে দিয়েছে?’ ইতস্তত স্বগোতক্তি করে বললো, ‘তা কি করে সম্ভব? যে কয়েকজন কমরেড আমার সেল্টার সম্পর্কে জানে, তারা তো অনেক নিরাপদ এলাকায়। তাছাড়া তাদের সঙ্গে রাতে আমরা অনেকক্ষণ কাটিয়েছিই। ওদের কেউ যদি ধরা পড়েও, এতো সহজে মুখ খুলবে না। মরে গেলেও মুখ খোলা অসম্ভব। অথচ এতো তাড়াতাড়ি........!’ ইতস্তত করতে থাকলো মুনির।
বেশ গম্ভীর হয়ে আরো কিছুদূর এগুতে থাকলো দু’জন। আকাশ ফর্সা হয়ে আসছে। আশপাশের কোন কোন বাড়িতে ছোট ছেলে-মেয়ের কান্না শোনা যাচ্ছে। ঘুম ভাঙছে সবার।
ঘণ্টা তিনেক পর। একটি নির্জন লেকের ধারে বসে আছে দুই কমরেড। মুখে জ্বলন্ত স্টার সিগারেট। কেউ কথা বলছে না। আক্রোশে শুধু যেন সিগারেটের আগুন রক্তচোখ মেলছে। নিভছে, আর জ্বলছে। তারপর ভেঙে পড়ছে ছাই হয়ে।
হঠাৎ নিরবতা ভাঙলো বিনু, ‘পার্টি এলাকায় থাকার সময় কয়েকবার সিক্রেসি আউট হয়েছিল। শেষবার ধরাও পড়েছিলাম। এবার এখানেও সিক্রেসি আউট হলো।’ সিগারেটে কড়া টান দিয়ে আবার বললো, ‘যাকগে, এ প্রসঙ্গ থাক। অন্য প্রশ্ন করি কমরেড?’
মুনির চেয়ে থাকলো। বিনু বললো, ‘আপাতত আমরা তো নিরাপদ। পুলিশ, মিলিটারি এবং পার্টি চ্যানেল থেকেও বিচ্ছিন্ন। সেল্টার থেকে বেরিয়ে আসার পর কারো চ্যানেলেই আমরা নেই।’
‘হ্যাঁ কমরেড, এখন আমরা সবার নাগালের বাইরে। নিজেরা পার্টি চ্যানেলে যোগাযোগ না করা পর্যন্ত বিচ্ছিন্নই থেকে যাবো।’ জবাব দিলো মুনির।
সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো বিনু, ‘অদ্ভুত জীবন, তাই না?’
পাল্টা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মুনির বললো, ‘হ্যাঁ, বিপ্লবীদের জীবনে এটাই নিয়ম। যতোদিন না বিপ্লব আসবে, ততোদিন এভাবেই চলবে। হয়তো গোটা জীবনটাই যাবে এভাবে। এমনও হতে পারে আমাদের জীবনে বিপ্লব এলো না, তখন প্রজন্মকে বিপ্লবের জন্য লড়তে হবে। তারপর একদিন বিপ্লব আসবেই। বিপ্লব অনিবার্য।’
বিনু হাসলো, ‘সে তো দীর্ঘ সময়ের কথা। কিন্তু আমাদের পার্টি কি বলে? পার্টি তো বলছে বিপ্লব আমাদের দোড়গোড়ায়। হাত বাড়ালেই ধরতে পারবো। সুতরাং অতো দীর্ঘকালের কথা ভাবছো কেন কমরেড?’
কপাল কুঞ্চিত হলো মুনিরের, ‘আমার তা বিশ্বাস হয় না। কিভাবে তা সম্ভব? রাশিয়ায় বিপ্লবের জন্য কতোকাল লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে। চীনে বিপ্লবের জন্য কতোকাল লড়তে হয়েছে। ভিয়েতনামে ৫০ বছর সশস্ত্র সংগ্রাম করতে হয়েছে। পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে আমাদের দেশের মতো মাত্র ৫/৬ বছরের সংগ্রামেই বিপ্লবের আশা করা হয়েছে। বিপ্লব অতো সহজ বলে আমি বিশ্বাস করি না। তা ছাড়া .........’
থামলো মুনির। নতুন সিগারেট জ্বালিয়ে ঠোঁটে রাখলো। বিনু চেয়ে আছে। আবার মুখ খুললো মুনির, ‘সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিপ্লবের জন্য যে বিপ্লবী ঐক্য এবং মানুষ দরকা তা দেখতে পাচ্ছি না। আমরা জাসদের লোক একাই বিপ¬ব করবো তা কি করে হয়? বিপ্লবের জন্য সমস্ত বামশক্তিগুলোর ঐক্য প্রয়োজন। কিন্তু আমরা বামপন্থীরা এক একটি দল একে অপরকে চরম শত্র“ হিসেবে দেখছি। নির্মূল করছি একে অপরকে। রণনীতি এবং রণকৌশলেও রয়েছে ব্যবধান। এই নীতি আর কৌশলগুলো যদি কারো কারো কাছাকাছি থাকেও, আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে রয়েছে ভিন্নতা। দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিকতা প্রশ্নে আমরা একে অপরের শত্র“ হয়ে দাঁড়াচ্ছি। কোনভাবেই ঐক্যের অবস্থা নেই। এমনকি কারো সেই ইচ্ছা বা চেষ্টাও আছে বলে মনে করি না। সুতরাং বিপ¬বীদের ঐক্যের চিন্তা বাতিল। থাকলাম প্রত্যেকে একা একা। আমরাও একা। বিপ্লবের চেষ্টাটাও তাই এককভাবে করতে হচ্ছে। কিন্তু এখানেও বিপ্লবী মানুষ, বিপ্লবের সংগঠন বা পার্টি থাকা প্রয়োজন তা নেই। জাসদকে বলা হচ্ছে বিপ¬বী পার্টি প্রক্রিয়ার সংগঠন। পার্টি না গড়া পর্যন্ত আমরা কিভাবে বিপ্লবের আশা করতে পারি? আবার বিপ্লবী পার্টি নেই, অথচ পার্টির সামরিক বাহিনী তা আছে। অর্থাৎ জাসদের মতো একটা পেটি-বুর্জোয়া পার্টি প্রক্রিয়ার সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে গণবাহিনী চলছে। এটা তো বিধি সম্মত নয়। কমিউনিস্ট রীতি-নীতির কোন নিয়মের মধ্যেই এটা পড়ে না। অথচ তাই-ই চলছে। এর পরিণাম কি হতে পারে ভেবেছো কমরেড?’
‘কি?’ চোখের ভাষায় বিনু প্রশ্ন করলো।
‘এমনও হয়ে যেতে পারে যে পার্টি গঠনের প্রক্রিয়ায় থেকেও পার্টি গঠন হলো না। জাসদ জাসদই থেকে গেল। কিংবা রণনীতি-রণকৌশল সঠিক প্রমাণিত হলো না। তখন গণবাহিনীর কি হবে? বাহিনীর সদস্যদের হাতে যে অস্ত্র আছে তা কার নিয়ন্ত্রণে কিভাবে ব্যবহার হবে? এমনও তো হতে পারে যে এই কারণে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলো। তখন নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে যাবে গণবাহিনী। এই অস্ত্র তখন আর পার্টি-সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। এই অস্ত্র তখন স্রেফ ডাকাতি করবে, ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার হবে, হত্যা করবে, অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়বে। তখন সামাজিক পরিস্থিতি কি হবে ভেবে দেখেছো? সেদিন পার্টি-সংগঠনকে রক্ষার এই শক্তিই হয়ে দাঁড়াতে পারে পার্টি-প্রক্রিয়াকে ধ্বংসের শক্তি, পারে বিপ্লবকে ধ্বংস করার শক্তি হয়ে দাঁড়াতে।’ বিনুর দিকে তাকালো মুনির। বললো, ‘কমরেড, আমার কথাগুলোকে ভিন্নভাবে নিয়ো না। এসব বলছি এই কারণে যে, আমাদের সংগঠন বিপ্লবের জন্য পরিপক্ক হয়নি। সংগঠনে বিপ্লবী ক্যাডার গড়ে ওঠেনি। যারা আছে তারা সবাই চলছে ভাবাবেগে। অন্ধ বিশ্বাসে। আর নেতৃত্বও অভ্যুত্থান-ক্যু ইত্যাদির ইঙ্গিত দিয়ে এই বিপ্লব হয়ে গেল বলে সংগঠকদের ভাবাবেগকে ধরে রাখছে। এটা তো রীতিমতো বিপদজনক অবস্থা। এই ভাবাবেগ আর অন্ধ অবস্থার পরিণাম ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে যে কোন সময়।’
চুপ করলো মুনির। বিনুও কথা বললো না কোন। নিরবে কাটলো কিছু সময়। যেন দু’জনেই কিছু ভাবছে। নিরবতা ভাঙলো বিনু, ‘৭ই নভেম্বর সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?’
‘পার্টির ব্যাখ্যা নিয়ে আমার কিছু দ্বি-মত আছে। এটা বিভ্রান্তিও হতে পারে।’ একটু থেমে আবার মুখ খুললো মুনির, ‘জাসদ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, ছাত্রলীগ, বিপ্লবী গণবাহিনীর পক্ষ থেকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সিপাহী-জনতার গণঅভ্যুত্থান শুরু করলো; অথচ এক বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ছাড়া আর কেউ জানলো না? আসলে জাসদ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, ছাত্রলীগ এবং বিপ্লবী গণবাহিনীকে ব্যাপারটা জানানোই হয়নি। না জানিয়ে এ রকম একটা ঘটনা ঘটানো রহস্যজনক নয় কি? কিছু নেতা বা কোন নেতা হয়তো কমরেড তাহেরকে কাজটা করতে বলেছেন, হয়তো তাঁকে এটা পার্টির পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত বলেই জানানো হয়েছে। কমরেড তাহের সরল বিশ্বাসে কাজটা করেছেন। তারপর সরে দাঁড়ানো হয়েছে। নইলে কমরেড তাহের যখন ক্ষমতা হাতে পেলেন, তখনও তাঁকে সিপাহী-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানের কথা বলতে দেওয়া হলো না কেন? ক্ষমতা গ্রহণ করতে দেওয়া হলো না কেন? কেন জিয়াউর রহমানের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হলো? ক্ষমতা দখলের জন্য অভ্যুত্থান করা হলো অথচ অভ্যুত্থান করার পর ক্ষমতা নেওয়া হলো না! সংগঠনকে অভ্যুত্থানের কথা প্রয়োজনের সময় জানানো হলো না! তাহলে কেন এটা করা হলো? কেন?? কার স্বার্থে??? যদি বলি এটা কোন বিপ¬বের জন্য করা হয়নি, অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল তাহলে কি ভুল হবে?’
‘তোমার কি মনে হয়? কার স্বার্থে এটা করা হলো?’ প্রশ্ন করলো বিনু।
‘এর পিছনে অনেক রহস্য থাকা বিচিত্র নয়। একে রহস্য না বলে আমার বলতে ইচ্ছে করে ষড়যন্ত্র। না হলে ৭ই নভেম্বরের এই অভ্যুত্থান ঘটানোর আগে ক্যাণ্টনমেণ্টে ক্যাণ্টনমেণ্টে যে প্রচারপত্র বিলি করা হচ্ছিলো, তার মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের প্রচারপত্র থাকলো কি করে? প্রায় একই ভাষায় একই লক্ষ্যে খন্দকার মোশতাক-রাজাকার-আলবদর-জামায়াত সমর্থকদের প্রচারপত্র বিলি হলো কেন? তাদের সমর্থক সৈন্যরাই বা আমাদের সৈনিক সংস্থার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল কেন? অভ্যুত্থানের আগে যখন সমান্তরালভাবে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র কাজ করছিল, তখন কি আমাদের হাইকমান্ড তা জানতে পারেনি? না জানাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঘটনাটা ঘটানোর স্বার্থে হয়তো সব জেনেও তারা চুপ করে ছিলেন। কমরেড তাহেরকেও এসব তথ্য জানতে দেওয়া হয়নি। জানলে তিনি কখনই অভ্যুত্থান করতেন না। আসলে গোটা ব্যাপারটাই রহস্যজনক। বিশেষ কোন লক্ষ্য নিয়েই এসব ঘটেছে বলে আমার মনে হয়। সৎ লক্ষ্য ছিল বলে আমার বিশ্বাস হয় না।’
‘তোমার কি মনে হয় যে কমরেড তাহেরকে আমরা আবার ফিরে পাবো?’
‘মনে হয় না। তাহেরকে ওরা হত্যা করবে। স্রেফ গুলি করে বা ফাঁসী দিয়ে হত্যা করবে। কারণ প্রতিক্রিয়াশীল জিয়াউর রহমানের সরকার কোন বিপ্লবীকে বাঁচিয়ে রাখবে না। বিপ্লবীদের নির্মূল করার জন্যই জিয়া ক্ষমতা নিয়েছে। দেখছো না সারা দেশে এই ক’মাসে কতো হাজার বিপ্লবীকে হত্যা করা হলো! কিভাবে সারাদেশে নির্মূল অভিযান চালানো হচ্ছে! জেলখানাগুলোতে তিল ধারনের জায়গা নেই।’
বিনু মুখ খুললো, ‘হুঁ, আমারও একই ধারণা। ৭ই নভেম্বরের ঘটনা থেকে যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে গোপানে যেসব বামপন্থীরা সমাজ বিপ্লবের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন, তারা প্রকাশ হয়ে পড়েছেন। কী সেনাবাহিনী, কী জনগণ সবখানেই এই প্রকাশটা ঘটে গেছে। আর এই প্রকাশ হয়ে পড়া বিপ্লবীদের এখন নির্মূল করা হচ্ছে। হাইকমান্ডের আরেকটি ব্যাখ্যা নিয়ে আমার খটকা কি জানো কমরেড?’
‘কি?’
‘৩রা নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলো, সেটাকে আওয়ামী-বাকশালী বা রুশ-ভারতের এজেণ্টদের অভ্যুত্থান বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। আমাদের হাইকমান্ডও তাই-ই বলে, প্রতিক্রিয়াশীল-রাজাকার-আলবদররাও তাই-ই বলে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফকে বলা হয়েছে ভারতপন্থী। কিন্তু বাস্তবে তো তা নয়। তিনি তো কট্টর ভারতবিরোধী ছিলেন। এমনকি তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থকও ছিলেন না। তার পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনরা হয়তো আওয়ামী লীগের লোক ছিলেন, কিন্তু তিনি তো ছিলেন না। খালেদ মোশারফ ছিলেন প্রকৃতপক্ষে চীনা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের একজন নির্ভেজাল সমর্থক। অথচ তাঁকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলো এবং হত্যা করা হলো। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এটাই কি তাঁর অপরাধ?’
‘ঠিক, আমার কথাটাই তুমি বলেছো কমরেড। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এগুলো। এসব মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু থামলো মুনির। বললো, ‘কিন্তু হাইকমান্ডের তত্ত্বের কাছে এগুলোকে দাঁড় করানো যায় না। আবার বেশি বলতে গেলে আমরাই খারাপ হয়ে যেতে পারি।’ হাসলো মুনির। বিনুও হাসলো ওর কথায় সমর্থন দিয়ে।
সূর্য্যরে তেজ বেড়েছে। লেকের ধারে বেশকিছু গরীব ধরনের মানুষ আসা-যাওয়া করছে। পিচ্চিদের একটা দল পানিতে নেমে লাফালাফি করছে। সেদিকে তাকিয়ে মুনির বললো, ‘মাঠ পর্যায়ের রাজনীতি যে চেইন অব কমান্ডে চলছে সেই কমান্ড ভুল করলে মহাবিপদ। একটা পরিবারের কর্তা ভুল করলে একটা পরিবারকে পস্তাতে হয়। কিন্তু এখানে ভুল হলে দেশের গোটা রাজনীতি এবং এর সঙ্গে যুক্ত সকলকে পস্তাতে হবে। সেটাই হচ্ছে কিনা কে বলবে!’
দু’জন আবার দুটো সিগারেট ধরালো। এই দফাই শেষ। আর নেই। খালি প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো মুনির, ‘জিয়াউর রহমান বিশ্বাসঘাতকতা করে ক্ষমতা দখল করেছে। তারপর তার জীবনদাতা এবং সেইসঙ্গে ক্ষমতাদানকারী কর্নেল (অবঃ) তাহেরকে গ্রেফতার করেছে। জাসদের প্রায় সব নেতাকেও জেলে পাঠানো হয়েছে। দেশের জেলখানাগুলো এখন রাজনৈতিক বন্দিতে ভর্তি। তিল ধারনেরও জায়গা নেই। যারাই গণতন্ত্রের দাবিতে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলছে তাদেরই জিয়াউর রহমান জেলে পুরছে। সারাদেশে চালানো হচ্ছে সামরিক সন্ত্রাস, হত্যা, গুম এবং ধ্বংসযজ্ঞ। কেউ যাতে আর গণতন্ত্রের দাবি করতে না পারে, কিংবা শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থার কথা বলতে না পারে সে জন্য সাম্রাজ্যবাদের পোষা কুকুর জিয়াউর রহমান সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। কিন্তু এই রাজনীতির খেলাটা কোথায় জানো কমরেড?’
‘কোথায়?’ প্রশ্ন করলো বিনু। মুনির বললো, ‘খেলাটা হলো এই গণতন্ত্রবিরোধী জিয়াউর রহমানকে একদিন গণতন্ত্রের মুক্তিদাতা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলে প্রতিষ্ঠা করা হতে পারে। আমরা যদি ব্যর্থ হই, তাহলে সাম্রাজ্যবাদ এবং তার দালালরা একদিন তাকে এভাবেই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবে। তুমি দেখে নিয়ো।’
‘অসম্ভব নয়। বুর্জোয়া রাজনীতি হলো প্রহসনের রাজনীতি। প্রহসন আর মিথ্যাচার করে জনগণকে কিছু সময়ের জন্য বিভ্রান্ত করা তো যেতেই পারে। যেহেতু প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাতে ক্ষমতা আছে, সেহেতু অনেক কিছুই সম্ভব’ বিনু বললো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলো দু’জনেই। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো একে একে। বিনু বললো, ‘অনেক বেলা হয়ে গেল। এখন কি চিন্তা করছো কমরেড?’
একটু ভেবে মুনির বললো, ‘তেমন কিছু চিন্তা করিনি। তবে ঠিক দুপুরের পর সেল্টারের খোঁজ নেবো। তারপর চলে যাবো জয়দেবপুর এলাকায়। সেখান থেকে পার্টি চ্যানেলে সংযোগ করবো, তার আগে নয়। তুমি আমার সঙ্গে জয়দেবপুর যাবে। সেখানে দু-একদিন থাকার পর সাংগঠনিক এলাকায় যেও। অসুবিধা হবে?’
বিনুও ভাবলো একটু, ‘না, অসুবিধা হবে না। তবে সেল্টারের খোঁজ নেবে কিভাবে? রেইড করা এলাকায় যোগাযোগ করা কি ঠিক হবে?’
‘এক পিচ্চিকে পাঠাবো। নাম পিনু। ওয়ার্কশপে কাজ করে। সেও আমাদের কমরেড। তবে কেউ তা জানে না। সামনেই ও থাকে।’
‘তাহলে আর দুপুর পর্যন্ত দেরী কেন? এখনই খোঁজ নাও।’
হাসলো মুনির, ‘রেইড করা এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক। তাছাড়া দুপুরের পর অবস্থাটা নিরাপদ হতে পারে।’
- পিনু গিয়ে আবার বিপদে পড়বে না তো?
- না, পড়বে না। খুব চালাক এবং সতর্ক। তাছাড়া পিনুর বয়স কতো জানো?
- কতো?
- ৭/৮ বছর হবে। কারো সন্দেহ করার উপায় নেই।
- ও। কিন্তু এতো সময় কি এখানেই বসে থাকবো?
- না, এখনই উঠবো। সিগারেটও ফুরিয়ে গেল। কিনতে হবে। আপাতত একটা চায়ের দোকানে গিয়ে চা খাবো। সিগারেট টেনে হাঁটতে থাকবো। তারপর পিনুর সঙ্গে যোগাযোগ করে অমরা খেয়ে নেবো। তারমধ্যে ও ঘুরে আসতে পারবে।
আরো কিছুক্ষণ বসে থাকলো দুই কমরেড। বাচ্চাদের ঝাঁপাঝাঁপি দেখলো। যে গাছটির নিচে বসেছিল, তার ওপর কয়েক ঝাঁক পাখির হরেক রকম গান শুনলো। তারপর এক সময় উঠে দাঁড়ালো দু’জন। নিঃশব্দে পা বাড়ালো পথে যে পথের সামনে কোন্ অবস্থা বিরাজ করছে, তার কিছুই জানে না ওরা। শুধু জানে সামনে আছে শুধু লড়াই আর লড়াই।
---- চলবে ----
আবুল হোসেন খোকন : লেখক-সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।