অন্তর্ঘাত

(রাজনৈতিক উপন্যাস)

আবুল হোসেন খোকন 

[ সত্তর দশক বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সামরিক শাসনের পটভূমিকে ভিত্তি করে এই রাজনৈতিক উপন্যাসটির অবতারণা অপ্রকাশিত এ পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ ধারাবাহিকভাবে মুক্তমনায় তুলে ধরা হলো লেখক

পার্ট - ৯ 

(নয়) 

   অন্ধকার রাত গ্রামের মেঠোপথ ধরে আসছিল দুটো ছায়ামূর্তিথেমে দাঁড়ালো হঠাসতর্ক চোখে সবদিক খেয়াল করলোকান পেতে রইলো কিছুক্ষণতারপর শরীরের পেছন দিক থেকে একজন টেনে বের করলো রিভলবারবাড়িয়ে ধরলো অপরজনের দিকে, ‘তোমাকে আর আসতে হবে নাএকাই যেতে পারবোএটা নিরাপদে রাখবে

   অপরজন হাতে নিলো অস্ত্রটিতারপর পিছনের দিকে গুজে রাখলোবললো, ‘যেতে অসুবিধা হবে না তো?’

   ‘না, হবে না সাবধানে থেকো সবাইলাল সালামলং লীভ রেভ্যুলিউশনজবাব দিয়েই অন্ধকারে পা বাড়ালো ছায়ামূর্তিঅপরজন বিপরীত দিকে ঘুরতে ঘুরতে স্বগোতক্তি করলো, ‘লাল সালাম কমরেড, লং লীভ রেভ্যুলিউশন

   সঙ্গীকে অস্ত্র তুলে দিয়ে যে ছায়ামূর্তিটি হাঁটছে, তার নাম বিপ্লববিনুর সহকর্মীবিপ্লব অন্ধকারে গ্রামের ফসলী ক্ষেতে নেমে এসেছেহাঁটছে দূরের একটা বসতি এলাকা লক্ষ্য করেআসলে ও চলেছে নিরাপদ একটা সেল্টারেহাঁটতে হবে অনেক দূরপ্রায় ৫ মাইলএই পথের অনেকটাই জনবসতিহীন ফসলী ক্ষেতপরিচিত পথতাই নিশ্চিন্তে হাঁটছে বিপ্লব

   ও এই এলাকায় এসেছিল দিনের বেলায় মোটিভেশন ওয়ার্কসহ কয়েকটি পলিটিক্যাল ক্লাশ করিয়েছে এর মধ্যে সন্ধ্যার পর পার্টি ওয়ার্কারদের নিয়ে বসেছিলনতুন কিছু কর্মসূচি ঠিক করেছেতারপর গভীর রাতে রওনা দিয়েছে আরেক সেল্টারেএই গ্রামেই রাত কাটিয়ে দেওয়া যেতোকিন্তু আগামীকাল বিনু আসবে ঢাকা থেকেআজই মেসেজ পেয়েছেবিনু ভাইকে রিসিভ করতে হবেসেজন্য সামনের এলাকায় যেতে হচ্ছে

   ক্ষেতের আইল ছেড়ে মাঝে মাঝেই বিপ্লবকে মেটোপথে উঠতে হচ্ছিলোঅর্ধেক পথ পেরিয়েছেআর আড়াই-তিন মাইলতারপর এলাকায় ঢুকে পড়বেসামনের সেল্টার আসলে মুক্তএলাকাপার্টি এখানে প্রশাসন চালায় যৌথখামার ব্যবস্থায় কৃষি কাজ হয়এলাকায় কোন অশান্তি নেই ধনি-গরীব বলে ভেদাভেদ নেইসবাই কাজ করে, সবাই শ্রমের ফল ভোগ করেকেউ বসে থাকে নাকেউ অসচেতন অশিক্ষিতও নয় মুক্তএলাকা বলে মাঝে-মধ্যে এখানেও মিলিটারি বা পুলিশ হানা দেয়তবে তেমন কোন সুবিধা করতে পারে নাঅযথা কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এই যা বিপ্লবীদের জন্য সব এলাকাই অবশ্য মুক্তএলাকা ধাঁচেরকোন কোনটি পুরো সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিচালিত, আবার কোন কোনটি আধা বা সিকি পরিমাণ নিয়ন্ত্রিতআসলে ধনি আর গরীবের জটিলতা যায়নিতবে প্রক্রিয়া চলছে সেই লক্ষ্যেএই সমস্ত দ্বন্দ্বময় এলাকাগুলোতে ধনিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ভিতরে ভিতরে চলছে একটা যুদ্ধ ভীত-সন্ত্রস্ত ধনিরা অবশ্য প্রকাশ্যে কোন রকম বিরোধীতা করে নাগোপনে গোপনে শত্রুপক্ষের কাছে নানা তথ্য পাঠায়জটিল অবস্থাকে মেনে নিয়েই চলছে বিপ্লবীদের সামাজিক বিপ্লবের রাজনীতি 

   ক্ষেতের আইল ছেড়ে মেটোপথে পা দিলো বিপ্লবসামনে একটা অশ্বত্থ গাছ বহুকালের পুরনো কতোদিনের কে জানেওই গাছটার পাশ দিয়ে ডান দিকে চলে গেছে পথবিপ্লব পা বাড়ালোকিন্তু বাঁক ঘুরতেই চমকে উঠলো

   দুটো ছায়ামূর্তি সামনে এসে দাঁড়ালোহাতে অস্ত্রপিছন দিক থেকেও অস্ত্র চেপে ধরলো পিঠে ছায়ামূর্তির একজন বললো, ‘হাত তুলে দাঁড়াও বিপ্লবনড়াচড়া করো না

   বিপ্লব হাত তুললো ছায়ামূর্তির একজন ওর দেহ সার্চ করলো তন্নতন্ন করে খুঁজলো কিছুএক সময় বললো, ‘কিছু নেই কমরেড

   জবাব এলো, ‘নেই? অসম্ভব! উত্তরদাতা ছায়ামূর্তি নিজেই এগিয়ে এলো তন্নতন্ন করে আবার সার্চ করলো ওকেশেষে বললো, ‘জিনিস কোথায়?’ বিপ্লব জবাব দিলো নাএবার দুজন ছোট টর্চ লাইট জ্বালিয়ে মাটি হাতরাতে লাগলোকাছের ছায়ামূর্তিটি আবার বললো, ‘জিনিস কোথায় বিপ্লব?’

   বিপ্লব মুখ খুললো, ‘তোমরা কারা?’ জবাবে ছায়ামূর্তি বললো, ‘আমরা পার্টির লোকবিপ্লব আবার প্রশ্ন করলো, ‘কোন্ পার্টি?’ ‘ইপিসিপি, কমিউনিস্ট পার্টি অব ইস্ট  পাকিস্তানজবাব পাওয়া গেলবিপ্লব বললো, ‘কোন জিনিস নেই

   বিপ্লবের হাত বেঁধে ফেলা হলো পিছন দিকেচোখ বাঁধা হলোতারপর হাঁটতে বলা হলোপথ দেখতে পাচ্ছিলো না বলে মুখোশধারীদের দুজন দুপাশে ধরে রেখে সহযোগিতা করলোহাঁটছে ওরা মুখোশধারীরা সংখ্যায় ৬/৭ জনের কম নয়কোন্ দিকে হাঁটিয়ে নেওয়া হচ্ছিলো বুঝতে পারলো না বিপ্ল

  

   অনেকক্ষণ কথা বলেনি কেওবিপ্লব মাঝে মাঝে প্রশ্ন করার চেষ্টা করেছিলথামিয়ে দিয়েছে ওরাআধ ঘণ্টার বেশি হয়ে গেছেপায়ের নিচে মেঠোপথ বলেই মনে হচ্ছেএবার মুখোশধারীরা মাঝে মাঝে থামতে লাগলো নিজেদের মধ্যে কথা বললোবিপ্লব কিছু বুঝতে পারলো নাআবার চলতে থাকলো ওরামাঝে মাঝে বিপ্লব প্রশ্ন করতে থাকলোউত্তর দিচ্ছে মুখোশধারীদের একজনআরো আধ ঘণ্টা হাঁটলো সবাই এরমধ্যে কিছু কথা হয়েছে কথাগুলো এই রকম ঃ-

-        আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?

-        পরে জানতে পারবে

-        কি চাও তোমরা?

-        ওটাও পরে জানবে

-        জানো, এভাবে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরিণতি কি হতে পারে? তোমাদের কঠিন খেসারত দিতে হবে

-        জানি

-        সব কিছু জেনেও ঝুঁকি নিয়েছো?

-        হ্যাঁ, বিপ্লবীদের জন্য ঝুঁকিই জীবন

-        বিপ্লবী! থু! কীসের বিপ্লবী তোমরা

   কোন জবাব নেইআবার অনেকক্ষণ হাঁটতে হয়েছেখুব শক্ত করে চোখ এবং হাত বাঁধায় অসুবিধা হচ্ছেমাথা ঝিমঝিম করছেহাতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছেমাঝে মাঝেই হোঁচট খাচ্ছেকিন্তু হাত ধরে রাখা দুই মুখোশধারী পড়ে যেতে দিচ্ছে না

-        বিপ্লবী! তাহলে চোর-ডাকাতের মতো মুখোশ পরে থাকো কেন? ভয় পাও?

   জবাবে কয়েকজন একসঙ্গে হাসলোএকজন বললো, ‘তোমরা মনে হয় খুব সাহসী? তাহলে পালিয়ে বেড়াও কেন?’

   একটু ভেবে বিপ্লব বললো, ‘আমরা পুলিশ-মিলিটারি ছাড়া কাওকে দেখে পালিয়ে বেড়াই না

-        আমরাওতবে সাম্রাজ্যবাদের দালালরা পুলিশ-মিলিটারি থেকে কম নয়বরং বেশি

-        কে সাম্রাজ্যবাদের দালাল? আমরা?

-        তোমরা আধিপত্যবাদের দালালতোমরা সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দালালতোমরা প্রতিবিপ্লবীজনগণের প্রথম শ্রেণীর শত্র

-        অসম্ভব

-        সম্ভব, এবং সেটাই সত্য

-        এ জন্যই কি ধরে নিয়ে যাচ্ছো?

-        হয়তো! 

    আবার কিছুক্ষণ মুখ বন্ধ করে হাঁটলো সবাইবিপ্লব কথা বললো পূণরায়

-        আমাকে কি হত্যা করবে?

-        সময়েই জানতে পারবে 

আবার হাঁটলো ওরাপায়ে খিল ধরে যাচ্ছে প্রচণ্ড অসুবিধা হচ্ছে 

   অনেকক্ষণ পর ওরা নতুন একটা জায়গায় পৌঁছালোবিপ্লব পায়ের নিচে নরম বালিমাটির ছোঁয়া অনুভব করলোপা সামান্য বসে যাচ্ছেফাঁকা অথচ একটা গর্জন মতো শব্দ আসছেও বুঝতে পারলো ক্রমেই নদীর দিকে যাওয়া হচ্ছে ভবিষ্যত পরিণতি অনুভব করতে পারছেউদ্বেগ চাপা রাখার জন্য কথা বলে যাচ্ছে বিপ¬

-        তোমরা তো বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করো না

-        কেন এমন কথা মনে হলো?

-        তোমাদের দলের নামের সঙ্গে বাংলাদেশ নেই, আছে পূর্ব পাকিস্তান!

-        হ্যাঁ, ঠিক বলেছোআমরা কারো দয়ায় পাওয়া স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি নাআমরা আধিপত্যবাদী ভারতকে আমাদের শত্রমনে করি

-        তার মানে এদেশের লক্ষ লক্ষ তরুণ-যুবক-যুবতী যে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল তা মিথ্যা? তাঁদের যুদ্ধের কোন দামই নেই?

-        হয়তো আছে, তবে তারা সবাই ছিল আধিপত্যবাদের দালাল

-        রাজাকার-আলবদররাও তাই-ই বলে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক চক্রগুলোও এ কথা বলে তারমানে তোমরাও ওদের মতো?

-        কখনও নয়আমরা মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করিতারা বিপ¬বের চীর শত্র

-        হ্যাঁ, শত্রু বটে! তবে দর্শনে অমিল নেই

---- চলবে ----


আবুল হোসেন খোকন : লেখক-সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।