দুই নেত্রীকে এক টেবিলে বসানোর চেষ্টা কেন?
আবুল হোসেন খোকন
আগে বলা হয়েছিল দুই নেত্রীই যতো নষ্টের মূল। তারা দেশকে ধ্বংস করেছেন। তাই তাদেরকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করাটাই জরুরি এবং এটাই একমাত্র সমাধান। কথিত এক-এগারো ঠিক এই ফর্মূলাই বাস্তবায়ন শুরু করেছিল এবং এর সঙ্গে সায় মিলিয়ে যুক্ত হয়েছিল সিভিল সমাজের মাথা হিসেবে কথিত একদল চিহ্নিত মানুষ। এরা সবাই এক সুরে বলেছিলেন, ওই দুই নেত্রীকে সরিয়ে রাজনীতি থেকে পরিবারতন্ত্র নির্মূল করতে হবে এবং ‘সৎ ও যোগ্যদের’ রাজনীতিতে আনতে হবে। এই ‘সৎ-যোগ্যদের’ ক্ষমতায় বসাতে হবে। এই বিষয়গুলো নিয়ে, অর্থাৎ কথিত সৎ-যোগ্যদের পক্ষে বিস্তর আলোচনা-বৈঠক-গোলটেবিল-টকশো- এবং দেশময় একটা প্রপাগান্ডা পরিচালনা করা হয়েছিল। এমনকি এজন্য নোবেল পুরস্কারকেও কাজে লাগানো হয়েছিল। কেও কেও অযাচিতভাবে এই ‘সৎ-যোগ্যদের’ নিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ার রোডম্যাপ-প্রবন্ধও উপস্থাপনা করে বসেছিলেন গোলটেবিলে, বিশেষ অনুষ্ঠানাদিতে। এই আলোকে দুই নেত্রীকে মাইনাস করার পক্ষে প্রচুর লেখা হয়েছে, প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়েছে। সবই হয়েছে বিশেষ আনুকূল্যে। এমনকি সাদা চামড়ার বিদেশিরাও এই উদ্যোগে প্রকাশ্যেই ভূমিকা রেখেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের ভাষ্যে এটাই মনে হয়েছিল যে দুই নেত্রী থাকলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে, বাংলাদেশের উন্নয়ন পুরো ব্যহত হবে। সুতরাং বাংলাদেশকে দুই নেত্রী মুক্ত হতে হবে, তাদেরকে যে কোন মূল্যে মাইনাস করতেই হবে।
মজার ব্যাপার হলো যারা এইসব কথা বলেছিলেন তারা সহসাই ভোল পাল্টে ফেলেছেন, এবং এখন বলছেন দুই নেত্রীই সব, তাদের এক টেবিলে বসালেই শান্তি। আর এই কথিত শান্তির জন্য দুই নেত্রী তো বটেই, তাবৎ দুর্নীতির গডফাদারদের ইতিমধ্যেই স্ব-সম্মানে কারামুক্তি দিয়ে দেওয়া হয়েছে বা বাকি যারা আছে তাদেরও দেওয়া হচ্ছে। ভোল পাল্টানোরা এখন বলছেন হাসিনা-খালেদা এক টেবিলে বসলেই দেশের তাবৎ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কেও কেও এমনভাবে বলছেন যে, দু’জন দু’জনের দিকে তাকালেই, কিংবা একটু হাসলেই দেশময় বেহেস্তের শান্তি চলে আসবে। আর সাদা চামড়ার একজন বলেছেন, এই দুই নেত্রী এক টেবিলে বসলেই আসবে ‘মহা-কল্যাণ’। অথচ এর অল্প ক’মাস আগে পর্যন্তও এই সাদা চামড়ারা কি বলেছেন! আর নিজ দেশের ‘সৎ-যোগ্য’র লোকেরা এখন ঘুম হারাম করে দুই নেত্রীকে এক টেবিলে বসানোর জন্য প্রচার করে চলেছেন। তারা নানামুখী চাপ সৃষ্টির বুদ্ধি দিচ্ছেন। লক্ষ্য করার বিষয় যে, এরাই কিন্তু অল্প ক’মাস আগেও এই একই মুখে মাইনাস করা এবং রাজনীতিতে ‘মাইনাস দুই নেত্রী সংস্কার’ করার প্রপাগান্ডায় যুক্ত ছিলেন। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দুই নেত্রীকে মাইনাস করার বক্তব্য যেমন সৎ উদ্দেশ্যের ছিল না, তেমন আজ তারাই আবার যেমন উল্টো কথা বলছেন এরমধ্যেই সৎ উদ্দেশ্য থাকা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ দুই নেত্রীই সব সমস্যার সমাধান হতে পারেন না। তারা দু’জন আন্তরিক হলে একটা সুস্থ রাজনীতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারেন বটে, তবে এ জন্য তাদের নিজেদেরই আগে ঠিক হতে হবে। এটা দু’জন বসে হতে পারে না। তাছাড়া দেশে কিন্তু দুই নেত্রীই সব নয়। দুইনেত্রী এক টেবিলে বসলে, একটু হাসলে, একটু একে-অপরের দিকে তাকালে মহাশান্তি নেমে আসতে পারে না। তাদেরকে যারা মহাশান্তির দূত হিসেবে দেখছেন তারা কি বলতে পারবেন যে যদি কিনা দুই নেত্রী এক টেবিলে বসেন, একটু হাসেন, একে অপরের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করেন তাহলে দেশের বৃহত্তর মানুষের ভাগ্য ফিরবে? বৃহত্তর মানুষের গরিবি দূর হয়ে যাবে? দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘণ্টা এবং ভয়ঙ্কর বেকারত্ব দূর হয়ে যাবে? তাহলে কি দেশের উপর বিদেশিদের খবরদারি বন্ধ হবে, দেশ বিক্রির অভিযোগ নিশ্চিহ্ন হবে, দেশের তেল-গ্যাস-প্রাকৃতিক সম্পদ-বন্দর-দেশী কল-কারখানা-উৎপাদন রক্ষা পাবে? কিংবা দুই নেত্রীর এক টেবিল থেকে যুদ্ধাপরাধীদের, রাজাকার-আলবদর-আলশামস-জামায়ত-শিবির চক্রের শাস্তি নিশ্চিত হয়ে যাবে? নাকি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ১৭ আগস্টের সিরিজ বোমা হামলা, তার আগে-পরে দেশময় গুপ্তহত্যা-সংখ্যালঘু নির্যাতন, কিংবা তারও আগের ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, অবৈধ ক্ষমতা দখল ইত্যাদির বিচার-শাস্তির সুরাহা হয়ে যাবে? পিলে চমকানো দুর্নীতির ফয়সালা কি এক-টেবিলেই হয়ে যাবে? কেমন করে?
যেহেতু বিষয়টি প্রশ্নবোধকই শুধু নয় রীতিমতো সন্দেহমূলক। আসলে এক-টেবিলে বসিয়ে তাদের সব অপরাধ ভুলে যাওয়ানোর এবং দেশের মানুষকেও তাদের সব অপরাধকর্ম সম্পর্কে বিচার দাবি তোলার বিষয়টিও ভুলিয়ে দেবার জন্য একটা মোক্ষম উপায় বের করা হয়েছে কিনা সেটাই প্রশ্ন। না হলে বিভীষণ দুর্নীতিবাজরা জেল থেকে বেরিয়ে আসে কি করে? তাদের সঙ্গে গোলটেবিল হবার কথা উঠে কেমন করে? সাধু আর অসাধু কি এক করা যায়? অন্যায় আর ন্যায় কি মিশতে পারে? পাপ আর পূণ্য কি চাল-ডালে খিচুরি হতে পারে? যদি হয় তাহলে তো কোন অপরাধেরই কোন দোষ দেওয়া যায় না, এগুলো আপনা-আপনিই বৈধ হয়ে যায়, অনুমোদন পেয়ে যায়। এজন্যই কি যুদ্ধাপরাধী, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী, স্বৈরশাসন, পিলে চমকানো দুর্নীতি, ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব অপরাধ থেকে অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য আজকের এই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে? এক টেবিলে বসার নতুন স্লোগান তুলে জাতিকে আবার কি ধোকা দেওয়ার, বোকা বানানোর এবং এই বোকা বানানোর মাধ্যমে ‘মহাদাগীদের রক্ষা’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে?
হ্যাঁ, দুই নেত্রীকে এক টেবিলে বসানোর বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় যদি কিনা কতগুলো শর্ত পূরণ হয়। যেমন কোন কোন রাজনৈতিক পক্ষ বলেছে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় খুনীদের পক্ষ নেওয়াসহ অতীত অন্যায় কর্মকাণ্ডের জন্য বেগম জিয়াকে ক্ষমা চাইতে হবে। তাহলে শেখ হাসিনা বসতে পারেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে। কিন্তু ক্ষমা চাইলেই কি ক্ষমা করা হবে? সম্ভব তা? ক্ষমা চাইলে যদি গ্রেনেড হামলাসহ বহু নারকীয় অপরাধের ক্ষমা মেলে তাহলে ফল কি শুভ হবে? কিংবা যে গ্রেনেড হামলায় প্রায় ডজন দুয়েক মানুষ মারা গেছেন তাদের পরিবার কি সত্যিই ক্ষমা করতে পারবেন? কিংবা যে শত শত জন গ্রেনেডের আঘাতে এখনও কাতরাচ্ছেন তারা কি ক্ষমা করতে পারবেন? দেশময় এতো হত্যা, লুটপাট, দুর্নীতি এবং নির্যাতনের শিকাররা কি ক্ষমা করতে পারবেন? পারবেন কি দেশবাসীও এইসব অপরাধীকে ক্ষমা করতে? পারবেন না।
সুতরাং ক্ষমা চাওয়া বা ক্ষমা করে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এ ধরণের প্রচেষ্টা মেনে নেওয়া যেতে পারে না। হ্যাঁ দুই নেত্রী এক টেবিলে বসতে পারেন, সমঝোতাও করতে পারেন। এজন্য উভয় উভয়কে কিছু কিছু ছাড় দিতে হবে তাও সত্যি। কিন্তু এখানে স্পষ্ট কথা হলো দুই নেত্রীকেই আন্তরিকভাবে নিজেদের ভুল স্বীকার করতে হবে তো বটেই, এবং যে যে-অপরাধ করেছেন তার শাস্তিও তাদেরকে পেতে হবে। তাদেরকে এই শাস্তি গ্রহণ করে নিতে হবে, এখানে কোন কৌশল গ্রহণ চলবে না। দুই নেত্রীর মধ্যে একজনের শাসনকাল অনেক বেশী সময়ের। আর এই বেশী সময়েই ঘটেছে অপরাধের ৯৫ ভাগ। সুতরাং এই সময়ের দুর্নীতি, হত্যা, গুম, খুন, দমন-পীড়ন-নির্যাতন, সংখ্যালঘু বিতাড়ন-হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠন-অগ্নিসংযোগ, ২১ আগস্ট ১৭ আগস্ট গ্রেনেড-বোমা হামলার মতো নানা ভয়াবহ বর্বর ঘটনার দায় স্বীকার করতে হবে। এ দায়ের জন্য ক্ষমা চাওয়া বা ক্ষমা প্রাপ্তির প্রশ্নই ওঠে না। এরজন্য শাস্তি প্রাপ্য তা স্বীকার করতে হবে এবং শাস্তির রায় মাথা পেতে নিতে হবে। এছাড়া দেশের মানুষকে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ইতিহাসগতভাবে নানা কৌশলে বিভ্রান্ত করা হয়েছে, এবং এর দায়ও স্বীকার করতে হবে। এরজন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। সকল অন্যায়-অবিচারের দায় কাঁধে নিতে হবে এবং শাস্তি গ্রহণ করতে হবে। এটা হলেই না আসে আত্মশুদ্ধির প্রশ্ন। আর আত্মশুদ্ধির মধ্যদিয়েই কেবল হতে পারে দুই নেত্রীর সংলাপ, সমঝোতা এবং এক্যমত। এ ছাড়া এক-টেবিল বৈঠক, আলোচনা-সমঝোতা মেনে নেওয়া যায় না। কোন সুস্থ চিন্তার মানুষই এটা মেনে নিতে পারেন না। মেনে নিতে পারেন কেবল তারাই যারা শঠ, যারা অসৎ কোন উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইছেন বা কারও উদ্দেশ্য সফল করে দিতে চাইছেন, সেইসঙ্গে যারা দেশের এবং দেশের মানুষের মঙ্গল চান না। সুতরাং এ রকম মেনে নেওয়া, চাওয়া বা উদ্দেশ্যর সঙ্গে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কোনই সায় থাকতে পারে না। তাছাড়া এ রকম সমঝোতায় এই জনগোষ্ঠীর একরত্তি লাভ নেই। লাভ থাকতে পারে না। বরং এটা হলে ওই দুর্নীতিবাজ, ওই বিদেশি প্রভু-লুটেরা শক্তি, তাদের দেশীয় দালাল এবং জাতীয় আরেক শত্র“ ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদেরই লাভ। লাভ হবে অরাজনৈতিক অপশক্তির। এদেরই স্বার্থ হাসিল হবে তাহলে।
অনেকেই মনে করেন বা কোন কোন রাজনৈতিক নেতারা সুস্পষ্টভাবেই বলছেনও যে, দুই নেত্রীকে এক টেবিলে বসানোর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে। কেও কেও মনে করেন, বিএনপি-জামায়াত জোটকে রক্ষা করার প্রয়োজনেই কথিত এক-এগারোর সৃষ্টি করা হয়েছিল। এটা হয়েছিল জনগণের রায় বানচাল করতে। কেননা ওই সময় সুষ্ঠু ভোট হলে এই জোটের ভয়াবহ পতনে আশঙ্কা ছিল, গণপিটুনিতে বদমাস নেতাদের ইহলোক ত্যাগ করার সম্ভাবনা ছিল। ফলে তাদের নিরাপত্তা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আর সে জন্যেই একটা নাটক মঞ্চায়ন করা হয়েছে। এই নাটকের মাধ্যমে জেলখানায় ঢুকিয়ে তাদের রক্ষা করে, তাদের প্রতি মানুষের করুণা বা সফ্ট কর্নার তৈরি করে অবশেষে আসল কাজটা এখন করা হচ্ছে। তাদেরকে আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার কৌশল হিসেবেই নাটকের শেষ অঙ্ক সফলে চেষ্টা হচ্ছে। সুতরাং এ রকম নাটকে এক নেত্রীর সায় থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অন্য নেত্রীর ব্যাপারটি আলাদা। কারণ মনে রাখার ব্যাপার হলো কোন গণবিরোধী বিশেষ স্বার্থে সমঝোতা বা বৈঠক বা ঐক্য এর কোনটাই কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। এতে করে কেবল মতলববাজদের উদ্দেশ্য হাসিলের বিষয়টিই সফল হতে পারে।
২১ সেপ্টেম্বর ২০০৮
আবুল হোসেন খোকন: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।