আবারও ‘এই দেশে এই বেশে’ .......
আবুল হোসেন খোকন
মঞ্চে এখন তাক লাগানো নানা নাটক। তবে সব নাটকের টার্গেট একটাই। তা হলো রাজনীতি। যদিও এখন পর্যন্ত রাজনীতি নিষিদ্ধ, গণতন্ত্র নিষিদ্ধ, জনগণের কাছে সরকার বা রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা বাদ। তাই রাষ্ট্র এবং সরকার এখন একনায়ক, একতন্ত্র, একপরিবার। এই একতন্ত্র নানা কায়দায় নানা ফর্মূলায় রাজনীতিকে ক্ষত-বিক্ষত এবং বহুধা বিভক্ত করে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করতে চাইছে। ফলে একদিকে জনগণ, অন্যদিকে শাসক বা ‘প্রভুরা’। যদিও রাষ্ট্র বা সরকারের মালিক জনগণ, সংবিধানমতো এমনটাই বিধান। কিন্তু সে সংবিধান এখন ‘জরুরি বন্দুকের’ মুখে। কাজেই সংবিধান আপাতত অকার্যকর। শাসকরা তাই ‘প্রভু’-এর মতো আচরণ করছে, তারা যা বলছে অতীতের একনায়ক-স্বৈরশাসকপরিবারতš এরা যেভাবে নিজেদের বলাকেই সঠিক এবং বাকিসবকে মিথ্যা-বেঠিক বলে দাবি করেছেÑ তেমন এখনও চলছে। এর প্রমাণ প্রচার মাধ্যমে, ইলেকট্রোনিক মিডিয়ায়। এসব জায়গায় এদের জয়জয়াকার, এদের মতো ফেরেস্তা স্বর্গেও নেই! এদের প্রশংসায় পঞ্চমুখেরও অভাব নেই। অতীতেও ছিল না, তাই এখন থাকবে কেন? সতরাং এরা বলছেন, মানুষকে নানাভাবে বশিভূত করার চেষ্টা করছেন। যারা বশিভূত হচ্ছেন ন তাদের জেলে পুরছেন নানা মামলা-মোকদ্দমা চাপিয়ে, অথবা গুলি চালানো হচ্ছে, হত্যা হচ্ছে, μসফায়ার হচ্ছে। দেশময় চলছে এসবেরই জমজমাট মহড়া। এখনকার ফেরেস্তারা কম্মিনকালেও গণতন্ত্র কাকে বলে জানেন না, মানেনও না। এরা মানুষকে বলেন ‘বাডি সিভিলিয়ান’। এদের মধ্যে তাই গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা, পরিবারতন্ত্রমুক্তি এবং দুর্নীতি নির্মূলের দাবি তুলেছিলেন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা বীরউত্তম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব:) আবু তাহের। ফলে সে তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। সুতরাং তারপর থেকে এখানকার বিষয় নিয়ে কেও আর কথা বলার চেষ্টা করেননি। পারলে তোয়াজ করে বেহেস্ত পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। যাইহোক, বর্তমান ফেরেস্তাদের বেশ কতোগুলো ভাঁড় আছে। এদের একজন অবার নিজের প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তিপরিবারতন্ত্র কায়েম রাখতে সাত সাতটি খুনের রক্তে সড়বান করা ব্যারিস্টারও। এরকম ব্যারিস্টাররা হয়তো ভাবছেন, ফেরেস্তাদের পদসেবা করে স্বর্গটা কব্জায় রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই তারা নিজের ঘরে, নিজের প্রতিষ্ঠানে, নিজের কারবারে পরিবারতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র বহালতবিয়ত রেখে অন্যদের ব্যাপারে নাক লম্বা করে ভালভালাই সাজার চেষ্টায় রত আছেন। মজার ব্যাপার হলো, এই ফেরেস্তাকূলের জন্যে মিডিয়ার কিছু ব্যারিস্টারমার্কা লোক ছাড়াও ‘বাডি সিভিলিয়ান’ দের মধ্যে থেকে বাছাই করে ‘সুশীল’ নাম দিয়ে একজাতের সিভিলিয়ানও তৈরি করা হয়েছে সু-পরিকল্পনায়। এই ‘সুশীল’-রা ফেরেস্তা এবং ফেরেস্তার প্রভূ সাম্রাজ্যবাদী ইঙ্গ-মার্কিনীদের পক্ষে সাফাই গেয়ে চলেছেন অবিরত। ইতিহাস হয়তো এজন্য একদিন এদের মীরজাফর আলী খান, জগৎ শেঠদের সঙ্গে মিলিয়ে বিচার করবে। সে পরের কথা। এখন যেটা চলছে সেটা হলোÑ যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না তারাই বলছে গণতন্ত্রের কথা, গণতান্ত্রিক সংস্কারের কথা। যারা কখনই জবাবদিহিতা, সংবিধানের ধার ধারে না, আইন-আদালত মানে না তারাই বলছে আইনের কথা। পরিবারতন্ত্রই যাদের টিকে থাকার ভিত্তি, তারাই অন্যদের জন্য বলছে পরিবারতন্ত্রমুক্ত হতে। যেখানে আজ সত্যিকার রাজনৈতিক সংস্কার হওয়ার প্রয়োজন, সেখানে ভূমিকা রাখছে রাজনীতিক নয় ভূমিকা রাখছে অরাজনীতিকরা। কোন জটিল রোগে আμান্ত রোগীর অপারেশন কি কোন কামারনাপিত- কাঠুরে-কসাই দিয়ে হয়? অথচ এখানে এটাই করা হচ্ছে। সরকার, নির্বাচন কমিশন সবখানেই এই অবস্থা। কোথায়ও রাজনীতিক নেই, আছে অরাজনীতিক। সুতরাং এই অরাজনীতিকদের অকম্ম আড়াল করতে মানুষকে নানা নাটক দেখানো হচ্ছে। দেখিয়ে মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। হায়! বাংলাদেশের মানুষকে কি এতোই বোকা?
সত্যি অবস্থাটা কি একটু দেখা যাক না। মানুষের কাছে আজ যারা ফেরেস্তা এবং ভাল সাজার জন্য নানা মিশন নামিয়ে মাঠময় চষে বেড়াচ্ছেÑ সেই মাঠের অবস্থা একটু খতিয়ে দেখতে অতি সম্প্রতি প্রত্যন্ত এক গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে আসলে এক সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে মিলন ঘটেছিল গ্রামের বিভিনড়ব শ্রেণীর মানুষের। তাদের মধ্যে সচেতনরা সাধারণ মানুষকে নিয়ে একটা মতবিনিময় মতো অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছিলেন। আগেই বলে রাখি এখানে বর্তমান সরকার এবং তাদের খুঁটি সামরিক বাহিনীর চাটুকারগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত তথাকথিত সুশীল সমাজের কেও ছিলেন না। ছিলেন নেহায়েত গ্রামের সাধারণ শ্রেণীর মানুষ বা কারও ভাষায় ‘বাডি সিভিলিয়ান’-রা। এই গ্রাম্য অনুষ্ঠানটিতে খোলামেলা অনেকেই এমন অনেক মন্তব্য করেছেন, যা আজকের দোর্দণ্ড প্রতাপশালীদের সম্পর্কে আসল ভাবনাটা পরিস্কার করে দেয়।
এখানে একজন নারীর মন্তব্য ছিল, দুর্নীতির অভিযোগে আজ কতিপয় রাঘব বোয়াল ধরে আসলে চমক সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষকেই বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। আজকের জরুরি অবস্থা সম্পর্কে একজনের অভিমত, সৎ উদ্দেশ্যে কখনই এ অবস্থা আসে না, থাকেও না। কেও বলেন, বিদেশিরা যাতে বাংলাদেশর সম্পদ লুট করতে পারে তারজন্যই জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। একজনের প্রশড়ব ছিল, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে, কিন্তু বর্তমান অনির্বাচিত সরকার কার কাছে দায়বদ্ধ? তারা আসলে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-মার্কিনীদের কাছেই দায়বদ্ধ। তারমতে, সামরিক শাসকরাই বার বার এদেশে গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করেছে। আর একজনের মন্তব্য, বিদেশি কূটনীতিকরাই বাংলাদেশে জরুরি আইন জারি করতে কলকাঠি নেড়েছে। ফলে সাম্রাজ্যবাদ আজ বাংলাদেশের উপর নগড়ব হস্তক্ষেপ করেছে। মিলিটারিশক্তি তাদেরই স্বার্থরক্ষায় ব্যতিব্যস্ত। এক নারী বলেন, আমরা জনগণের দ্বারা জনগণের শাসন চাই, মিলিটারি শাসন চাই না। আরেক নারী বলেন, অস্ত্রশক্তি দিয়ে আজ রাষ্ট্র চালানো হচ্ছে, জনগণের শক্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা আবার বিপনড়ব হয়ে পড়েছে। একজন বলেন, জরুরি অবস্থা দিয়ে আধুনিক লাঠিয়ালদের নামানো হয়েছে। এরা জনগণের স্বার্থরক্ষায় দ্রব্যমুল্য কমানোর কাজে অংশ নেয় না, বন্ধ কলকারখানা চালু করতে পারে না, কিন্তু জনগণের মুখ বন্ধ করার জন্য সবই করে। অন্য একজনের মন্তব্য, বর্তমানে জরুরি অবস্থার ক্ষমতা দিয়ে বিদেশি লুটেরা গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে নানা অবৈধ চুক্তি করা হচ্ছে, দেশের কয়লাখনি-বন্দর বিদেশিদের দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আজ ‘মাইনাস আমেরিকা’ ¯োগাে ন সবাইকে এক হতে হবে। বর্তমান সরকারের বেপরোয়া বেসরকারিকরণ তৎপরতার তীব্র সমালোচনা করে বেশ কয়েকজন বলেন, এটা করা হচ্ছে বহুজাতিক লুটেরা গোষ্ঠীর স্বার্থে। রাজনৈতিক সচেতনদের মধ্যে কেও বলেন, পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা যখন বিপর্যয়ে পড়ে তখনই কেবল সামরিক বাহিনী পুঁজিবাদকে রক্ষায় এগিয়ে আসে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে। এজন্য তারা গণতন্ত্রের বিকাশকে রুদ্ধ করার চেষ্টা চালায়। একজন বলেন, তৃতীয় বিশ্বে গণতন্ত্র বিকাশের নামে সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। আসলে এর মাধ্যমে তারা জনগণের গণতন্ত্রকে নির্মূলের চেষ্টা করছে। আজ বাংলাদেশে যে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের নানা কথা বলা হচ্ছে, তার আসল উদ্দেশ্য হলোÑ সাম্রাজ্যবাদের হীন স্বার্থরক্ষা করা। দুর্নীতির ব্যাপারে একজন বলেন, বিশ্বব্যাংক হলো দুর্নীতির মূল। তারাই দুর্নীতির শর্তে গরীব দেশগুলোকে সাহায্য বা ঋণ দেয়। তারা দুর্নীতির বিস্তার না ঘটালে আজ গরীব দেশগুলোর কোথাও দুর্নীতির বিস্তার ঘটতো না। মজার ব্যাপার হলো, এরাই আবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলে। রাজনৈতিক সচেতন কারও কারও মন্তব্য, জনগণের কাছে সরকার ও রাষ্ট্রের জবাবদিহিতাই গণতন্ত্র। অথচ জরুরি অবস্থার কারণে এই গণতন্ত্রই অনুপস্থিত। বদ্ধঘরে যেমন কোন শিশু বড় হতে পারে না, তেমনই হয়েছে আজ দেশের অবস্থা। তাদের মতে, স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী এই দেশে জরুরি অবস্থার কোনই প্রয়োজনীয়তা ছিল না। এ অবস্থার কারণে আজ কারও কোন ধরনের জবাবদিহিতা নেই। কেও বলেন, কোন স্বাধীন দেশে যদি জরুরি অবস্থা হয় তাহলে সে দেশের শ্রমজীবী মানুষরাই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে আজ সেই অনাকাক্সিক্ষত অবস্থাই বিরাজ করছে। কেও বলেন, একটি রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অপরিহার্য। কিন্তু গণতন্ত্রই যদি না থাকে, জরুরি অবস্থা জারি থাকে তাহলে সেই রাষ্ট্রকে কখনই এগিয়ে নেওয়া যায় না। ’৭২-এর সংবিধানের কথা উলেখ করে কেও কেও বলেন, শাসকরা এই সংবিধানকে বারংবার পরিবর্তন করেছে তাদের কায়েমী স্বার্থেই। এটা কখনই গণতান্ত্রিকভাবে হয়নি। তাই এ পরিবর্তন গণতন্ত্রবিরোধী। সামরিক শাসকরা বেশীরভাগ সময়ই সামরিক শাসন দিয়ে গণতন্ত্রকে বিপনড়ব করেছে। তাই সামরিক শাসনও কাম্য নয়, জরুরি অবস্থাও কাম্য নয়। এসব ব্যবস্থা কখনই দেশ-জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না।
এই কথাগুলো থেকেই ধারণা পাওয়া যায় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের একটু সচেতন সাধারণ মানুষরাও কেমন ভাবছেন, কীভাবেই তারা আজকের বাস্তবতাকে বিচার করছেন। যদিও আজকের ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকে মানুষকে এরকম একটি ধারণায় দাঁড় করানোর জন্য মরিয়া চেষ্টা চালানো হচ্ছে যে, বর্তমান সেনাবাহিনী এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার খুব ভাল ভাল কাজ করছে। তারা রাজনীতিতে এমন একটা অবস্থা তৈরি করছেÑ যাতে ভবিষ্যতে কোন দুর্নীতিবাজ, কালোটাকার মালিক এবং অসৎ লোক রাজনীতি করার সাহস না পায়। এতে করে দেশ থেকে দুর্নীতি-কালোটাকা-অসৎ নীতি দূর হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সামরিক শাসক আইয়ূব-ইয়াহিয়ারাও এ ধরনের ধারণা বিস্তারের চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতার পর তাদেরই প্রেতাত্মা হিসেবে জেনারেল জিয়া-এরশাদরাও তাই-ই করেছে। তাদের কথা যে প্রথম প্রথম অনেকে বিশ্বাস করেননি, তা নয়। বিশ্বাস করে এক সময় বুঝেছেন যে, মানুষকে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করা হয়েছে।
বর্তমানেও নাটক মঞ্চানের মধ্যদিয়ে এমন তাবিজ-কবচীকরণ করার চেষ্টা হচ্ছে। যার ফলে তাদের হয়ে কেও বলছেন মাইনাস টু হোক, কেও বলছেন রাষ্ট্রপতিকে নির্বাহী ক্ষমতার মূল করা হোক, বাকিদের ক্ষমতা খর্ব করা হোক ইত্যাদি নানা কথা। যাতে করে কিনাÑ আগের মতো কোন জিয়া-এরশাদরা এসে বসে পড়তে পারেন এবং নিজেকে নির্বাহী ক্ষমতায় দেখতে পান। একেই বলে ‘কী চমৎকার দেখা গেল’! বিখ্যাত নাটক ‘এই দেশে এই বেশে’-এর মোদ্দা কথা ছিল এটাই, এবং এটাই এখন এই দেশে নতুন বেশে।
[ ৫ জুলাই ২০০৭ ]