জামায়াতের আল-বাদরী সমাচার
আবুল হোসেন খোকন
আর যাই হোক ইসিকে একটা কারণে ধন্যবাদ। ইসি নতুন করে ‘সৎ মানুষের দল’ জামায়াতে ইসলামীর মুখোশ টেনে খুলে দিয়েছে। আলখেল্লা-দাড়ি-টুপি-চশমা এবং ধর্ম দিয়ে এরা যতোই নিজেদের পঙ্কিল পাপদেহকে ঢাকবার চেষ্টা করুক না কেন ইসি সেটা উদোম করে দিয়েছে। ফলে জামায়াতের কুৎসিত আসল চেহারাটা বেরিয়ে পড়েছে।
ইসি এই কাজটা করতে পেরেছে তাদের রাজনৈতিক নিবন্ধন বিধান নামক ফর্মূলাটি দিয়ে। এই ফর্মূলার জালে জামায়াতকে ধরা হয়েছে এবং টোপ গিলিয়ে তাদের ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ফর্মূলায় পড়ে এরা ৩৮ বছর পর বাংলাদেশের মানব রচিত সংবিধানকে স্বীকার করেছে, আল্লাহ’র বিধান কায়েমের ওয়াদা থেকে সরে এসেছে এবং বাংলাদেশের সংবিধান মেনে কাজ করবে বলে ওয়াদা করতে বাধ্য হয়েছে। এইসঙ্গে এরা স্বীকার করে নিয়েছে যে এতোদিন তারা বাংলাদেশের সংবিধান মানেনি। আর এই না মানাটা মানেই মহা-অপরাধ করা, রাষ্ট্রদ্রোহীতা করা। এতোদিন তারা রাষ্ট্রদ্রোহীতা করেছে। এই মহা-অপরাধের জন্য এখন শাস্তি পাওয়াটাও এখানে উচিত ব্যাপার হিসেবে সামনে এসে গেছে। এছাড়া তারা দলের নামের আগে বাংলাদেশ শব্দ বসিয়েছে। নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দিতে গিয়ে জামায়াত নেতারা বলেছে, বাংলাদেশের সংবিধান-স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সার্বভৌমত্বকে মেনে নিয়ে তারা তাদের গঠনতন্ত্রে বড় ধরনের এই পরিবর্তন সাধন করেছে।
জামায়াতের আগের গঠনতন্ত্রের প্রচ্ছদে ছিল ‘আল্লাহ’ ও ‘আকিমুদ্দীন’ লেখা লোগো। এখন তারা এগুলো বাদ দিয়ে দিয়েছে। এই বাদ দেওয়াকে মুসুল্লীরা কী চোখে দেখেন, এটাকে মহা-অপরাধ মনে করেন কিনা, এতে তাদের মান-সম্মান খতম হয়েছে কিনা কিংবা ধর্মের চরম অবমাননা হয়েছে কিনা সেটাও এখন দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকা যেতে পারে। তবে সত্যিকারের মুসলমানদের জন্য এটা অবমাননাকর হলেও জামায়াত বা এদের ছায়াশক্তিগুলোর জন্য তা হবে বলে মনে হয় না। দেখা যাক এখন এরা কি বলে। আগের জামায়াতি গঠনতন্ত্রের ধারা ৩-এ ছিল ‘ইসলামী দ্বীন ও জীবনবিধান কায়েম’ করার কথা। এবার সেটাও বাদ দেওয়া হয়েছে। নতুন গঠনতন্ত্রে ‘আল্লাহর আইন’ ও ‘সৎ লোকের শাসন’ কায়েম করার কথাও বাদ হয়ে গেছে। ‘জাহিলিয়াতের যাবতীয় চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ’ করার বিষয়টিও বাদ দেওয়া হয়েছে। সত্যি! ইসি একটা কীর্তি করেছে বটে! এসব কারণে তো কথিত আল-জেহাদীদের ‘চরম অবমাননা’ বোধ করার কথা। এক রাজাকার-আলবদর আর জামায়াত ছাড়া তো সবারই চরম অপমান হবার কথা। দেখা যাক আমিনী আর লালন ভাস্কর্য ভাঙা ওয়ালারা কি বলেন! তবে বলবেন বলে মনে হয় না। কারণ এরা-ওরা তো আলাদা কিছু নয়।
আগে জামায়াত নামের এই দলে শুধুমাত্র মুসলমানদের যুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল। এবার গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ অন্য সকল ধর্মের লোকেরাও যুক্ত হতে পারবে, যদিও সহযোগী হিসেবে, তারপরেও তো তারা যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেলো। আগের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে ফেলায় এখন নারীরাও জামায়াত নামক দলে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে, পুরুষদের মতো সদস্য হতে পারবে।
বলা যায় ইসি জামায়াতকে গুরুতর সব জায়গায় হাত দিতে বাধ্য করেছে এবং এর মাধ্যমে তাদের মুখোশটা খুলে দিয়েছে। অর্থাৎ ইসি জামায়াতের ভণ্ডামি চরিত্রকে মানুষের সামনে উন্মোচন করে দিতে পেরেছে। শুধু এখানেই শেষ হয়নি। তারপরেও ইসি তাদের আরও অনেক জায়গায় হাত দিয়েছে। ইসি ধরে ফেলেছে তড়িঘড়ি করে আগের গঠনতন্ত্র কোনরকমে কাটাছেড়া করা হয়েছে, এর ফলে ভিতরের অনেক জায়গায়ই পরস্পরবিরোধী কথা রয়েই গিয়েছিল। যেমন জামায়াতের সংশোধিত গঠনতন্ত্রে ২ ধারার ৫ উপ-ধারায় আগের কথাই ছিল। অর্থাৎ এখানে বলা ছিল, ‘আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশাহ, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া লইবে না, কাহাকেও নিজস্বভাবে আদেশ করিবার অধিকারী মনে করিবে না, কাহাকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধানদাতা ও আইন প্রণেতা মানিয়া লইবে না এবং আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁহার দেওয়া আইন পালনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয় এমন সকল আনুগত্য মানিয়া লইতে অস্বীকার করিবে। কেননা সমগ্র রাজ্যের নিরঙ্কুশ মালিকানা ও সৃষ্টিলোকের সার্বভৌমত্বের অধিকারী আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহারো আসলেই নেই।’ ইসি এই জায়গা ধরে ফেলে এবং এটা বাংলাদেশের সংবিধান সম্মত নয় বলে উল্লেখ করে। কেননা বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং সকল আইন-বিধান এই জনগণের অনুকূলে সংবিধানের অধীনেই প্রণীত হতে হবে। ফলে জামায়াতের সংশোধিত গঠনতন্ত্রেও সংবিধান অমান্যের বিষয় রয়ে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে ইসি’র পর্যালোচনা কমিটি বলেছে, জামায়াতের এইসব ধারার মাধ্যমে জনগণের রায়ে নির্বাচিত সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। এছাড়া সংশোধিত গঠনতন্ত্রে জামায়াত আগের ৫ ধারার ৩ উপ-ধারা রেখে দলের দাওয়াত সম্পর্কে বলা ছিল, ‘সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামের সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম করিয়া সমাজ হইতে সকল প্রকার জুলুম, শোষণ, দুর্নীতি ও অবিচারের অবসান ঘটানো’র কথা। ইসি বলেছে, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী দেশ গণতান্ত্রিক রীতিতে পরিচালিত হবে, এখানে ‘সুবিচারপূর্ণ শাসনব্যবস্থা’ কায়েমের সুযোগ নেই। সংশোধিত গঠনতন্ত্রের ৩ ধারার ১ উপ-ধারায় জামায়াতের আদর্শ সম্পর্কে বলা ছিল, ‘ইসলামী মূল্যবোধের উজ্জীবন ও জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে সর্বপ্রকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক হুমকী এবং বিশৃঙ্খলা হইতে রক্ষা করিবার প্রচেষ্টা চালানো’র কথা। এটাও সংবিধান সম্মত নয়। ৬ ধারার ৪ উপ-ধারায় জামায়াতের কর্মসূচি সম্পর্কে, ‘ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠাকল্পে গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার বাঞ্ছিত সংশোধন আনয়নের উদ্দেশ্যে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তন এবং সমাজের সর্বস্তরে সৎ ও খোদাভীরু নেতৃত্ব কায়েম করা’র কথা বলা ছিল। যা বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী। অতএব নিবন্ধন পেতে হলে জামায়াতকে এগুলোও ঠিক করতে হবে। দেখা গেল ২৩ অক্টোবর রাতে ইসি’র কাছে গিয়ে জামায়াত সত্যি সত্যি এসব জায়গাগুলো ঠিক করে দিলো এবং ইসি যা যা করতে বললো, ওরা তাই করলো। তারপর যখন ইসি বললো, হ্যাঁ হয়েছে, তখন ওরা সন্তুষ্টচিত্ত হলো।
জামায়াতে ইসলামী যে কতো বড় ভণ্ড এবং প্রতারক দল তা এসব থেকে পরিস্কার হয়ে যায়। ভণ্ডামি করতে গিয়ে এবারে লেজে-গোবরে করে ফেলেছে। এমনিতেই তাদের কথা আর কাজে যে কতোটা মিলÑ তা ভাল করে নজর দিলেই দেখা যায়। যেমন তারা আগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ‘আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশাহ, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া লইবে না, কাহাকেও নিজস্বভাবে আদেশ করিবার অধিকারী মনে করিবে না, কাহাকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধানদাতা ও আইন প্রণেতা মানিয়া লইবে না’-এর কথা বলে আসলেও পাঁচটি বছর তারা আল্লাহর বদলে বেগম খালেদা জিয়াকে রাজাধিরাজ এবং সার্বভৌম হিসেবে মেনে চলেছে। খালেদার নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থার আইনকেই তারা অনুসরণ করেছে। ‘সমাজের সর্বস্তরে সৎ ও খোদাভীরু নেতৃত্ব কায়েম করা’র কথা বললেও তারা নিজেরাই অসৎ কাজ করেছে, মিথ্যা কথা বলেছে, আল্লাহর নামে প্রতারণা করেছে এবং নিজেরা দুর্নীতি করে মামলার আসামী পর্যন্ত হয়েছে। সেই জামায়াত এখন লিখিতভাবে ডিগবাজী দিয়ে ইসির বিধান পূরণ করছে। এর চেয়ে ‘বাদর খেলা’ আর কি হতে পারে? এরা যে নিজেদের হীন স্বার্থে কী-না পারে এটা তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।
এইসব ঘটনা থেকে নতুন প্রজন্ম কথিত মুসলমানদের পাক দল, কথিত সৎ মানুষের দল এবং কথিত আল্লাহর দল জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে পরিস্কার হতে পারে। পরিস্কার হতে পারে যে, রাজনীতি করা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য হেন কাজ নেই যা এরা করতে পারে না। স্বার্থের জন্য এরা তাদের গঠনতন্ত্র থেকে ‘আল্লাহ’ ও ‘আকিমুদ্দীন’ এক খোঁচায় বাতিল করে দিতে পারে। তারা পারে ‘সৎ মানুষের শাসন’ এবং ‘আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা’র বিষয় বাতিল করে দিতে। তারা পারে আল্লাহর বদলে মানব রচিত আইনে ফিরে যেতে, তারা পারে আল্লাহর বদলে অন্যদের সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে। তারা পারে ‘ইসলামী দ্বীন ও জীবনবিধান’ বাতিল করতে, ‘ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব’ প্রমাণ না করতে, ‘আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশাহ, রাজাধিরাজ’ মেনে নিতে। এরা সবই পারে। না পারে এমন বিষয় নেই-ই এদের কাছে। আসলে এদের কোন সৎ-নীতিই নেই, তাই কোন নীতির বালাইও নেই। নেই বলেই তো এদের অতীত কলঙ্কে, পঙ্কিলতায়, পৈশাচিকতায়, মিথ্যায়, নোংরামীতে পরিপূর্ণ। পরিপূর্ণ এই কারণে যে এরা আল-বাদর। এবার ইসি এদের আরেকবার আল-বাদরী চরিত্র টেনে বের করে আনলো এবং মানুষের সামনে উদোম করে দিলো। ইসিকে এজন্য সাধুবাদ দিয়ে একটা কথাই বলা, তা হলো দয়া করে এই আল-বাদরদের নিবন্ধন দেবেন না। আর না দেওয়ার কাজটি করে আপনাদের কৃতিত্বটাকে এক শ’ ভাগ পূর্ণ করুন। পূর্ণ করে জামায়াতের মহা-অপরাধ কর্মের জন্য শাস্তির পথ সুগম করুন। তাহলে আর যাই হোক এই ব্যাপারটার জন্য অন্তত জাতি চিরদিন আপনাদের ধন্য ধন্য করবেই।
আবুল হোসেন খোকন: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।