কার সরকার কার স্বার্থে

আবুল হোসেন খোকন

বাংলাদেশে আজকের বাস্তবতার সঙ্গে একটুখানি অতীত মিলিয়ে দেখা যাক। বহুল আলোচিত ১৫ ফেব্র“য়ারির (১৯৯৬) নির্বাচনের কথা সবারই জানা। এই প্রহসনের নির্বাচনের বিরুদ্ধে তখন গোটা জাতি একজোট হয়েছিল এবং মানুষ দেশময় বিক্ষোভে ফেঁটে পড়েছিল। কিন্তু সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার সৃষ্ট দল বিএনপি এই নির্বাচনের পক্ষে ছিল এবং তারা যে কোন মূল্যে এই নির্বাচন সম্পন্ন করে ফেলার ব্যবস্থা নিয়েছিল। আর সম্পন্নের জন্য নামানো হয়েছিল তাদের প্রধান অবলম্বন সামরিক বাহিনীকে। সে অনুযায়ী এই বাহিনী কোন রকম ন্যায়-নীতির তোয়াক্কা না করে (জনগন বা ভোটাররা ভোট দিতে না এলেও) ১৫ ফেব্র“য়ারির কথিত নির্বাচন করে দিয়েছিল। কীভাবে করে দিয়েছিল তার বিবরণ শুনছিলাম ওই বাহিনীর অনেকের কাছ থেকেই। তাদের ওপর নির্দেশ ছিল ৯৮ ভাগ ভোট বিএনপির মার্কায় সিল মেরে বাক্স বোঝাই করে রাখতে। ফলে সেই সেনা সদস্যরা ভোটের দিনের অপেক্ষা না করে আগের রাতে ঘরে বসে নির্দেশমতো ভোটের বাক্স বোঝাই করে পরের দিন তা ভোট কেন্দ্রে রেখেছিল এবং তারপর তার পাহাড়াদার হিসেবে অবস্থান নিয়েছিল। সব জায়গায়ই প্রায় একইভাবে ভোটের বাক্স ভরার কাজ করা হয়েছিল। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এভাবেই সামরিক বাহিনীকে ‘দায়িত্ব’ পালনে বাধ্য করা হয়েছিল। (আসলে তাদের জন্য এমন উদাহরণ শুধু ১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচনই নয়। জেনারেল এরশাদ-জিয়ার হাঁ/না ভোটের বেলায়ও এমনটিই হয়েছিল। এমনকি ২০০১ সালের যে অক্টোবর নির্বাচন তাতেও তারা বিভিন্ন জায়গায় এ রকম ‘দায়িত্বই’ পালন করেছিল। এক কথায় ভোট চুরি বা প্রহসনের নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে এভাবেই অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে)। ১৫ ফেব্র“য়ারির ঘটনা থেকে লক্ষ্য করা বিষয় হলো, ভোটারদের বাদ দিয়ে ভোট করা হলেও জনগণের কাছে তা টিকে থাকতে পারেনি। এই নির্বাচনের কার্যকারিতাকে বানচাল করে দিয়েছিল দেশের সাধারণ মানুষ। এবং এই মানুষ তা বানচাল করেছিল আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে।

সুতরাং আজ যারা বলেন, ‘সামরিক বাহিনী বা তথাকথিত এক-এগারোর উদ্যোক্তারা বিগত ২২ জানুয়ারির (২০০৭) প্রহসনের নির্বাচন থেকে দেশবাসীকে বাঁচিয়েছে, তাই তারা রক্ষাকর্তা’ এটা তাদের ডাহা মিথ্যাচার এবং প্রতারণা। আসলে বিএনপি-জামায়াত জোটের ২২ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন রুখে দেওয়ার জন্য আন্দোলনরত রাজনৈতিক জোটের নেতৃত্বে গোটা দেশের মানুষ সংঘবদ্ধ হয়েছিল, তাঁরা প্রতিবাদে রাজপথধ কাঁপিয়ে তুলেছিল, টলটলায়মান করে তুলেছিল শাসকদের গদি। আর সামরিক বাহিনী ঠিক আগের মতোই ১৫ ফেব্র“য়ারিমার্কা এই নির্বাচন সম্পন্ন করতে সকল আয়োজন শেষ করে মাঠে নেমেছিল। তাদেরকে ভোটের জন্য সারা দেশে মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু জনগণের গণআন্দোলনের মুখে তাদের উদ্যোক্তাদের বোধদ্বয় হয়েছিল যে এভাবে সফল হওয়া যাবে না, এভাবে বিএনপি-জামায়াত জোটকে বাঁচানো যাবে না। তখন কথিত উদ্যোক্তারা নতুন কৌশলে, নতুন মুখোশে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সামরিক বাহিনী বা এক-এগারোর উদ্যোক্তাদের দ্বারা নয় জনগণের আন্দোলনের ফলে ২২ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন বানচাল হয়েছে, এবং এই সুযোগে সুকৌশলে এক-এগারোতে ক্ষমতা দখল করেছে জনগণের বদলে জনগণবিরোধী শক্তি। তাদের ক্ষমতা দখল এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে একটি তাবেদার গোষ্ঠীকে রাবারস্ট্যাম্প হিসেবে সামনে রাখার সবই যে শঠ এবং প্রতারণামূলক তা আজ এখন আর কারও বুঝতেই বাকি নেই। এখানে তাই এদের মূল লক্ষ্য হলো মুক্তিযুদ্ধের শক্তি হিসেবে পরিচিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতায় যেতে না পারে সে ব্যবস্থা করা এবং তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করা। ঠিক এই এজেন্ডাই ছিল বিগত ২২ জানুয়ারির নির্বাচনী ছকেও। যে ছক ’৯৬-এর ১৫ ফেব্র“য়ারির প্রহসনের নির্বাচনেও ছিল। ঠিক একইভাবে এ এজেন্ডা ছিল ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় সামরিক শক্তির তৎপরতায়।

আজ যেমন এজেন্ডামতো প্রহসনের মামলা সাজিয়ে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তিকে লক্ষে টার্গেট করা হয়েছে, ঠিক সেই টার্গেটেই ১৭ আগস্ট দেশময় ৫শ’ রিমোট কন্ট্রোল বোমা ফাঁটানো হয়েছে, জননেতা কিবরিয়া হত্যা করা হয়েছে, আহসাউল্লাহ মাস্টারসহ আওয়ামী লীগের শত শত নেতা-সংগঠককে হত্যা করা হয়েছে, ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তাকেসহ সকল নেতাকে একযোগে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এরও আগের ঘটনাও পরিচালিত হয়েছে একই এজেন্ডায়। জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসন, ’৭৫-এ সামরিক বাহিনীর সদস্যদে দ্বারা জেলখানার ভিতরে মুক্তিযুদ্ধের মূল চার নেতাকে হত্যা, ১৫ আগস্ট জাতিরজনককে সপিরবারে হত্যা সবই একই ছকে গাঁথা। এসব ঘটনার মূল কথা হলো ’৭১-এর ঘাতক দালালদের সুরক্ষা করা, তাদের ক্ষমতায়ন ঘটানো ও পাকিস্তান-সৌদিআরব চক্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, এবং সেইসঙ্গে বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদের শিকার বানিয়ে ফেলা। আজকের ফখরুদ্দিন-মঈন-মাসুদ-ইয়াজউদ্দিন-মশহুদ-হুদা গংদের কব্জায় থাকা বাংলাদেশের দিকে লক্ষ্য করলেই এটা পরিস্কার দেখা যাবে, এবং বোঝা যাবে এরা কার সরকার এবং কার স্বার্থরক্ষার জন্য তৎপর।

এদের মূল লক্ষ্য হলো
১. বাংলাদেশকে আর্থ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক-ঐতিহ্য-গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসগতভাবে ধ্বংস বা পঙ্গু করে দেওয়া।
২. গণতন্ত্র, সংবিধান, আইনের শাসন, মানবাধিকার ইত্যাদিকে অমান্য এবং অকার্যকর করে এগুলোর সব মেরুদণ্ডহীন করে ফেলা।
৩. রাজাকার-আলবদর-আলশামস-জামায়াতি-মৌলবাদী-যুদ্ধাপরাধীদের সুরক্ষা দেওয়া এবং তাদের ক্ষমতায়নের পথ নিষ্কণ্টক করা।
৪. দেশটিকে লুটে-পুটে খাওয়ার জন্য সকল রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান বা সম্পদসমূহকে বহুজাতিক লুটেরা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া।
৫. জনগণকে কোন কথা বলতে না দেওয়া, তাদের প্লাটফর্ম রাজনীতিকে নিষিদ্ধ রাখা, তাদের ক্ষমতায়নের ব্যবস্থা নির্বাচনকে আটকে রাখা।
৬. ভবিষ্যৎ ক্ষমতার স্বার্থে রাজনীতির মুখোশে নিজেদের অনুগত দল বানানো।

লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে এই কাজগুলোই এখন করা হচ্ছে। কারণ ১৯৭৫ বা ১৯৭১-এর এজেন্ডাই এটা। এটাই এখানে রোডম্যাপ।

[ ১২ আগস্ট ২০০৭]

আবুল হোসেন খোকন : লেখক-সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।