কোন্ মতলবে এবারের মৌলবাদী সন্ত্রাস?
আবুল হোসেন খোকন
গত ১০ এবং ১১ এপ্রিল ২০০৮ মুসলিম ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদীরা ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে তাণ্ডব চালিয়ে নতুন করে এই সরকারের আমলে উত্থিত হওয়ার কথা জানান দিয়েছে। আগেও অবশ্য তারা এমন করেছে। তাদের এবারের ইস্যু হলো, ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতি কোরানবিরোধী। এই ‘কোরানবিরোদী’ নীতির বিরুদ্ধে তারা জেহাদে নেমেছে।
প্রসঙ্গটি খতিয়ে দেখা যাক। বর্তমান অনির্বাচিত ‘আর্মি ব্যাকড’ সাময়িক সরকার গত ৮ মার্চ ২০০৮ একটি ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০০৮’ ঘোষণা করে। এর বিরুদ্ধে তখনই মাঠে নেমে পড়ে ওই সন্ত্রাসবাদীরা। অভিযোগ, এই নীতিতে ‘উত্তরাধিকার সূত্রে’ মা-বাবার সম্পদে মেয়ে সন্তানদের ছেলে সন্তানদের সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে, যা কোরানবিরোধী। এছাড়াও এই নীতিতে আরওসব কোরানবিরোধী নীতি রয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, ৮ মার্চ ঘোষণা করা ওই নারী নীতির কোথাও মুসলিম ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদীদের ভাষ্যমত ‘উত্তরাধিকার সূত্রে মা-বাবার সম্পদে মেয়ে সন্তানদের জন্য ছেলে সন্তানদের সমান অধিকারের’ কথা নেই, এ ধরনের কোন বিষয়ই নেই। নেই মানে একেবারেই কোথাও কোনভাবেই নেই। নেই অথচ সেই ‘নেই’ নিয়েই এখানে ইস্যু বানানো হয়েছে, কোরানকে টেনে আনা হয়েছে।
সরকারের ঘোষিত ওই উন্নয়ন নীতিতে ৫টি অধ্যায় হয়েছে। এই ৫ অধ্যায়ে রয়েছে ২৩টি ধারা। ধারাগুলোতে নারীদের সমঅধিকারের প্রশ্নে কতগুলি বিষয় রয়েছে। যেমন ধারা ৩.৭-এ বলা হয়েছে, ‘কর্মরত অবস্থায় স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায়, সামাজিক নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যায় নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা’। ধারা ৭.৬-এ বলা হয়েছে, ‘শিক্ষা ক্ষেত্রে নারী ও মেয়েশিশুর সমান অধিকার নিশ্চিত করা’। ধারা ৯.৫-এ বলা হয়েছে, ‘সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেওয়া’ ‘পরিবেশ সংরক্ষণের নীতি ও কর্মসূচিতে নারীর সমান অংশগ্রহণের সুযোগ ও নারী প্রেক্ষিত প্রতিফলিত করা’। সুতরাং প্রশ্ন হলো, এই ধারাগুলো কি কোরানবিরোধী? যারা কোরানকে এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং মানবিক ও সম্মাণীয় বিষয়গুলোর বিরোধী করতে চাইছে তারা কি আসলে কোরানকে বর্বর, নিষ্ঠুর, অমানবিক, যঘন্য হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে না? আসলে এরাই হলো সত্যিকারের কোরানবিরোধী এবং খাঁটি শয়তান। এদেরকে রুখে দাঁড়ানোই সত্যিকারের ধার্মিকদের মূখ্য কাজ হওয়া উচিত। কেননা যে ধারাগুলো রয়েছে সেগুলো না হলে নারীকে মানুষ হিসেবে স্বীকারই করা হয় না, মানবিক সমাজজীবনের কথা তো আসেই না। তাই ধিক্ ওইসব ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদীদের।
মনে রাখায় বিষয় যে, উল্লেখ করা ধারাগুলো এই সরকারের নারী নীতিতে নতুন করে উঠে এসেছে এমনটি মোটেই নয়। এগুলো আমাদের সংবিধানেই সুষ্পষ্টভাবে রয়েছে। সাংবিধানিকভাবেই এগুলো বাধ্যবাধকতামূলক। তাহলে প্রশ্ন হলো, সরকার হঠাৎ সংবিধানের বিধানগুলো অন্য জায়গায় এনে একটা বায়বীয় উত্তেজনার ক্ষেত্র তৈরি করলো কেন? এটা খতিয়ে দেখা জরুরি।
আরেকটা কথা হলো, আজ সরকার যে নারী নীতি ঘোষণা করেছে, তা বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে প্রণয়ন করা হয়েছিল এবং বিএনপি সরকার এসে তা স্থগিত করেছিল। এরপর এই বিএনপি-জামায়াত জোট একটি সাম্প্রদায়িক, বৈষম্যমূলক, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী নারী নীতিমালা তৈরি করেছিল। ২০০৪ সালের ওই ধর্মীয় প্রভাবিত বৈষম্যমূলক নারী নীতিমালা বাতিল করে আগের নীতিমালাটিই আজ ঘোষণা করেছে বর্তমান সরকার। এখানেও খতিয়ে দেখার বিষয় যে, কোন বদমতলব আছে কিনা?
এখানে একটি কথা না বললেই নয় যে, উত্তরাধিকার সুত্রে পিতা-মাতার সম্পদে ছেলে-মেয়ের সমান অধিকারের বিধান করে মুসলিম দেশ জর্দান, তিউনিসিয়া, মরক্কো, সোমালিয়া নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন করে নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান ও অধিকার দিয়েছে। মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ এবং আরও কয়েকটি দেশ আজ এই অধিকারকে সত্যিকারের উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে নারী নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে চলেছে। এই সমঅধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশও ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘের ‘সিডও’ সনদে স্বাক্ষর করে, ২০০০ সালে মিলেনিয়াম সামিটে ‘অপশনাল প্রটোকল অন সিডও’ তে স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ এ প্রশ্নে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশনেও অঙ্গীকারবদ্ধ দেশ।
সুতরাং জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে উত্তরাধিকার সূত্রে ছেলে-মেয়ে উভয় সন্তানের জন্য সম্পত্তির সমান অধিকারের বিধানটি থাকা উচিত ছিল, কিন্তু সরকার সে বিধান রাখেনি। এখানে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক কনভেনশনের অঙ্গীকার তো বটেই বাংলাদেশের সংবিধানের বিধানগুলি অবশ্যই থাকা বা রাখা উচিত ছিল, কিন্তু সরকার তা রাখেনি। অথচ যা রাখেনি তা ‘রাখা হয়েছে’ বলে ‘চিলে কান নিয়ে গেল’ ধরনের বায়বীয় প্রচারটা কেন করা হলো, আর চিলের পেছনে কেনই বা ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসীদের নামিয়ে দেওয়া হলো? ব্যাপারটা রীতিমতো রহস্যজনক এবং মতলববাজীর তো বটেই। তবে এখানে প্রশ্ন মতলবটা আসলে কার? অর্থাৎ এই মতলবের পেছনে শুধু কি মুসলিম ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী চক্রই রয়েছে, না আরও কেও আছে? কারণ কথিত এক এগারোর ক্ষমতা দখলকারীরা এদেশের জনগণের প্লাটফর্ম হিসেবে তার রাজনীতিকে টার্র্গেট করেছে, দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সত্যিকারের অনেক দুর্নীতিবাজকে টার্গেট না করে নিজেদের বাছাই করা কিছু রাজনীতিককে টার্গেট করেছে, তাদের জেলে নিয়েছে, জরুরি আইনের জবরদস্তি প্রয়োগ করে অনেককে আটক রেখেছে, এক তরফা শায়েস্তামূলক কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছে কিন্তু আসল শয়তানের বেশীরভাগকেই টার্গেট করা হয়নি। বরং এদেরকে নিজেদের লোক হিসেবে সঙ্গে রাখা হয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, দেশ-জাতি-জনগণের আসল শত্র“ ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী বা মৌলবাদীদের বেলায় ক্ষমতা দখলকারীরা একেবারেই চোখকান বুঁজে থেকে তাদেরকে সুরক্ষা এবং তাদের ষড়যন্ত্রমূলক সকল কাজে সহায়তা দিয়েছে অতীতের সামরিক ও স্বৈরাচারি সরকারগুলোর মতোই। কার্যত এ সরকারের এই সময়কাল পর্যন্ত এদের নানা কায়দায় যেমনÑ জরুরি আইনে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলাতে তাদের কু-রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে দিয়েছে, ইসলামী জালসার নামে দেশময় সভা-সমাবেশ করতে দিয়েছে এবং অন্য রাজনৈতিক দলের তৎপরতাকে বন্ধ রেখে এদের তাবৎ রাজনৈতিক তৎপরতাকে পরিচালিত করতে দিয়েছে ধর্মের নামে। একটা রাজাকার-আলবদর-আলশামসকেও এ সরকার টার্গেট না করে তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে চলতে দিয়েছে। অবশ্য অনেক কিছুই পর্দার আড়ালে হলেও এখনকার মতো রাজপথ পর্যন্ত এরা দৃশ্যমান হয়নি ঠিক। তবে সময়ের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছিল সেটা পরিস্কার। যার প্রতিফলন এখন দেখা দেওয়া শুরু হয়েছে, এবং এর আগেও কিছু প্রতিফলন দেখানো হয়েছে।
লক্ষ্য করা বিষয় যে, ৮ মার্চ যখন এই নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করা হলো এবং তারপর মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা এর বিরুদ্ধে জানান দিয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে মিছিল-সমাবেশ করার ঘোষণা দিলো, তারপর সেইমতো তারা জরুরি আইন ভেঙে মিছিল-সমাবেশ করলো কিভাবে? সরকারইবা পুলিশ প্রটেকশন কেন দিলো তাদের জন্য? কেন ওদের বাধা দেওয়া হলো না, বা আইন ভাঙার দায়ে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? উপরোন্ত সরকারের পক্ষে এই উপদেষ্টাইবা কেন তাদের নিয়ে সভা করলেন এবং নতজানু হয়ে বললেন যে, ‘কোরানবিরোধী (!) কোন আইন প্রণয়ন করা হবে না।’ ঘটনার এখানেই শেষ নয়। এরপরও দেশময় এই সন্ত্রাসীদেরকে প্রপাগান্ডা চালাতে দেওয়া হয়েছে, সন্ত্রাস করার জন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে মোটিভেশনমূলক তৎপরতা চালাতে দেওয়া হয়েছে, সন্ত্রাসের জন্য তাদের প্রস্তুত হতে দেওয়া হয়েছে। শেষ এখানেই নয়। এরপর সরকার এই সন্ত্রাসী নেতাদের নিয়ে ওই ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০০৮’ পর্যালোচনার জন্য একটি পর্যালোচনা কমিটিও করে (যেন ওরা ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেই অনুগত সরকার নারী নীতি প্রণয়ন করে ফেলবে। সেই অনুযায়ী ওরা গত ১৭ এপ্রিল একটি অনুমোদন রিপোর্ট জমাও দিয়েছে সরকারের কাছে। যাতে বলা হয়েছে নারী নীতি থেকে ‘নারীদের সমঅধিকার’ শব্দটি বাদদিতে হবে।)। এই যদি হয় তাহলে ঘটনা কী দাঁড়ায়? লক্ষ্য করলে আরও দেখা যাবে, ওরা যখন বায়তুল মোকাররম মসজিদকে ঘাঁটি বানিয়ে ১০ এপ্রিল সন্ত্রাস করলো, পুলিশের উপর হামলা চালালো, জ্বালাও-পোড়াও করলো, ওপরের নির্দেশে পুলিশ তখন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলো। পরের দিন পুলিশকে খানিকটা অ্যাকশনমুখি মনে হলেও তা অতীতের বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের উপর যেভাবে পৈশাচিক অবস্থান দেখা গেছে এখানে তা দেখা যায়নি। এমনকি এই সন্ত্রাসীরা থানায় হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুট করলেও সরকার একে ‘তেমন গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ’ বলে মনেই করলো না। এদের অপকর্মের কোন সচিত্র প্রতিবেদনও দেখানো হলো না বিটিভিতে। সুতরাং এই অবস্থায় আসল মতলবের গোড়া কোথায় সে প্রশ্নটিই বড়।
যদি বলা হয় যে, দেশ পরিচালনায় বর্তমান অনির্বাচিত সরকার এবং তাদের ‘ব্যাক্ড এক-এগারোর উদ্যেক্তারা’ যখন সর্বাত্মকভাবে ব্যর্থ, চাল-ডালসহ নিত্য পণ্যের দাম সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে, বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডসেডিংয়ে দেশ বিপর্যস্ত, দেশ যখন ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে একাট্টা, আর দারুণ ক্ষুব্ধ মানুষ যখন ‘হিডেন’ থেকে ‘ওপেন’ হতে শুরু করেছে ঠিক তখনই আত্মরক্ষার জন্য অন্য একটা পরিস্থিতি তৈরি করা প্রয়োজন। এই প্রয়োজনের তাগিদেই নারী নীতি’র অজুহাতে একটি বায়বীয় ইস্যু তুলে দেওয়া হয়েছে জঙ্গি মৌলবাদী তথা মুসলিম ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদীদের হাতে একথা বললে ভুল হবে বলে মনে হয় না।
আবুল হোসেন খোকন: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।