নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে অশুভ তৎপরতা
আবুল হোসেন খোকন
জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আছে মাত্র আর মাস দেড়েক সময়। এই সময়ে সারাদেশে ব্যাপক নির্বাচনী প্রচারণা জমজমাট হয়ে ওঠার কথা। কিন্ত তা হয়নি। বলা যায় দৃশ্যমান নির্বাচনী তৎপরতাও শুরু হয়নি। এখন বাকি এই দেড় মাসে যে তৎপরতাগুলো খুব বেশী এগুবে এমনও মনে হচ্ছে না। কারণ ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচন হবে কি না তা নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আবার যদি এই নির্বাচন ১৮ তারিখে হয়ও তবে তা সুষ্ঠু হবে কিনা, বা নির্বাচনে সত্যিকার রাজনীতিবিদরা থাকবেন কিনা তা নিয়েও ঘোরতর সংশয় দেখা দিয়েছে। তিন মাসের জায়গায় পৌণে দুই বছর ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা বর্তমান অনির্বাচিত সরকার বলছে জরুরি আইন রেখেই তারা নির্বাচন হওয়াবে। বিশ্বের সকল মানবতাবাদী মহলসহ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন জরুরি আইন রেখে কখনই সুষ্ঠু-সঠিক-স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচন হতে পারে না। সেইসঙ্গে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোও বলে দিয়েছে, জরুরি আইন থাকলে তারা নির্বাচন করবে না।
এছাড়াও এমন একটি অবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যাতে মনে হচ্ছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রধানসহ প্রায় শ’দুয়েকের বেশী নেতাকে নির্বাচনে দাঁড়াতে দেওয়া হবে না। দুই নেত্রীকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখার জন্য জোর প্রচেষ্টা এবং এ লক্ষ্যে গভীর ষড়যন্ত্রও চলছে। দুই নেত্রী বিরত না হলে জরুরি আইনের বলে তাদের জেল দিয়ে দেওয়া হতে পারে। আর জেল দেওয়া হলে তারা তখন আর নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দুই নেত্রীকে নির্বাচনের বাইরে রেখে তাদের দল নির্বাচন করবে এমন বিশ্বাস করার কোন অবকাশ নেই। সুতরাং সবমিলে সত্যিকারের নির্বাচন হবে কিনা এ প্রশ্নই এখন সকলের কাছে মূখ্য হয়ে উঠেছে।
এদিকে আরওসব ব্যাপার রয়েছে। নির্বাচনী আইন নিয়ে বিধানগত সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে সীমানা নির্ধারণী আইন নিয়ে মামলাও রয়েছে। এই মামলা নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার মতো অবস্থায়ও যেতে পারে। আবার নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী প্রস্তুতিও উল্লেখযোগ্য নয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এই কমিশনের বিরুদ্ধে নানান ষড়যন্ত্রমূলক ভূমিকার অভিযোগ রয়েছে।
এরইমধ্যে হঠাৎ করেই দেশে আইন-শঙ্খলা পরিস্থিতে অবনতি ঘটা শুরু হয়েছে। অপ্রত্যাশিত ব্যাপার হলো গর্ত থেকে সিনেমা স্টাইলে বেরিয়ে আসা শুরু করেছে ইসলামী সন্ত্রাসবাদী বা জঙ্গি মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো। তারা রাতারাতি দেশে উত্তেজনা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমনিতে এই দেশে এসব গোষ্ঠীগুলোর জনসমর্থন নেই, ভোটও নেই উল্লেখযোগ্য। গত নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী জোটবদ্ধভাবে ভোট পাওয়া সত্ত্বেও এদের ভোটের হার শতকরা মাত্র ৪ ভাগ। এবারে এ হার আরও কমে যাবে বলে ধারণা পাওয়া যায়। সুতরাং নির্বাচনে এদের লাভ নেই। কিন্তু তারা গর্ত থেকে বেরিয়ে পড়ে মাঠে নেমেছে এবং বিনা বাধায় সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। গত সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই অনেকগুলো ঘটনা তারা ঘটিয়েছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে, ভিসির বাসভবনে হামলা করেছে। বিশ্বদ্যিালয় কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতো গত ৮৭ বছরের ইতিহাসে কখনও কেউ এরকম কর্মকাণ্ডের স্পর্ধা দেখায়নি। অথচ আইনরক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা নিরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থেকে সন্ত্রাসীদের উৎসাহ যুগিয়েছে। তার ক’দিন আগে সন্ত্রাস চালিয়েছে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সামনে জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক লালন ভার্স্কয স্থাপনকালে। তারা সেখানে হামলা চালিয়েছে এবং ভাস্কর্য স্থাপন করতে দেয়নি। তারা দাবি করেছিল, ভাস্কর্য সরিয়ে নিতে। সরকার তাদের দাবি বাস্তবায়ন করেছে তড়িৎ গতিতে। এরপর সন্ত্রাসী মওলানা আমিনী সংবাদ সম্মেলন করে হুমকী দিয়েছে তারা এভাবে দেশের সব ভাস্কর্যে হামলা চালাবে এবং ভেঙে ফেলবে। তাদের জেহাদ বা লড়াই নাকি শুরু হয়ে গেছে। এভাবে ঘোষণা দিয়ে তারা রাষ্ট্রদ্রোহীতায় নেমে পড়েছে। রহস্যজনক ব্যাপার হলো এরা এতোকিছু করছে, অথচ সরকার এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাদের কথা শোনা হচ্ছে। অর্থাৎ উৎসাহ যোগানো হচ্ছে। এমনকি অল্প কিছুদিন আগে যেসব জঙ্গি মৌলবাদীদের গ্রেফতার করা হয়েছিল রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্থানে, তাদেরও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে অতীতের মতো এখনও এই ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদীদের বেলায় সরকারীভাবে একই ভূমিকা নেওয়া হচ্ছে। তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালালেও, রাষ্ট্রদ্রোহীতা করলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এমনকি যুদ্ধাপরাধী এবং ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী দলের এক গডফাদার মুজাহিদী পলাতক আসামী হওয়া সত্ত্বেও তাকে সংলাপে ডেকে তার সঙ্গে সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্যান্য উপদেষ্টারা হাত মিলিয়েছেন। মিডিয়াকে সামনে রেখে আসামীর সঙ্গে তারা সংলাপ করেছেন। অথচ পুলিশের ভাষায়ই ওই মুজাহিদী পলাতক আসামী। তাকে সরকারের পুলিশ খুঁজে পাচ্ছিল না। আসলে দেখা যাচ্ছে এই জঙ্গি সন্ত্রাসীরা যা চাচ্ছে সরকার তাই-ই করছে। এসব ঘটনা থেকেই থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়ে। বোঝাই যায় এইসব সন্ত্রাসীদের পেছনে শক্ত শক্তি আছে। যে কারণে সরকারও এদের ভয় পায়, এরা যা বলে তাই শোনে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এদের পেছনে যে শক্তির শক্তি রয়েছে তারা কখনই গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করে না, জনগণের ক্ষমতাকে মানে না, গণমানুষের রাজনীতিকে এরা দুই চোখে দেখতে পারে না। এরা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে না, শান্তির পথকেও মানে না। এটা অতীত ঘাটলেই দেখা যাবে। অতএব পেছনের শক্ত শক্তির প্রটেকশনে জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাসবাদীরা গর্ত থেকে বেরিয়ে পড়েছে। আর এর পেছনে যে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য আছে তা সহজেই বোঝা যায়। লক্ষ্য-উদ্দেশ্যটা যে সুষ্ঠু ও প্রত্যাশিত নির্বাচনের পক্ষে নয় সেটা কিন্তু পরিস্কার।
তারপরেও এ ব্যাপারে কতগুলো প্রশ্ন-উত্তর মেলানো যেতে পারে। যেমন এখনও একটি নাম-পরিচয় বিহীন টিভি চ্যানেলে নিয়মিত বিশেষ একটি মহলের গুন-কীর্তন প্রচার করা হচ্ছে এবং যাবতীয় অপকর্মের জন্য রাজনীতিকে দোষানো হচ্ছে। প্রচারণায় এই বিশেষ মহলটি (সাংবিধানিকভাবে যাদের এসব করা রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহীতা) নিজেদেরকে ‘ফেরেস্তা’ হিসেবে দেখাচ্ছে। প্রশ্ন হলো দায়িত্বশীলদের সৎ উদ্দেশ্য থাকলে এ ধরনের তৎপরতা বা প্রচারণা চলবে কেন? মেয়াদ এবং সংবিধানগত বৈধতা শেষ হয়ে গেলেও রাষ্টপ্রধানসহ বর্তমান সরকার লজ্জিত নয় কেন? কেনই বা এখানে জরুরি অবস্থা জারি রাখার মরিয়া প্রচেষ্টা? কোন সৎ উদ্দেশ্য থাকলে বিধানগতভাবে তিন মাসের জরুরি আইন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার কখনই পৌণে দুই বছর ক্ষমতায় থাকতো না এবং তারা তাদের সাংবিধানিক (যা শুধুমাত্র নির্বাচন সম্পন্ন করার মধ্যে সীমাবদ্ধ) দায়িত্বের বাইরে অন্যসব কাজে তৎপর হতে পারতো না। সেই সঙ্গে নিজেরা ‘জ্বি হুজুর মার্কা’ দল গঠনের কাজেও ব্যস্ত হতে পারতো না। প্রশাসনসহ খোদ নির্বাচন কমিশনকে কুক্ষিগত করা হতো না। এগুলো না হলে এদেশে আজ থেকে দেড় বছর আগে নির্বাচন হয়ে যেতো এবং দেশ সাংবিধানিকভাবের রাজনৈতিক কর্তৃত্বে পরিচালিত হতো। নিঃসন্দেহে যারা এর বিপরীতে কাজ করেছেন তারা ষড়যন্ত্রকারী এবং তারা সাংবিধানিক ব্যবস্থার অনুগত হিসেবে থাকতে চান না। আর এখন যে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদীদের নিরাপদ বিচরণ তার পিছনেও এজন্যই ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে।
সন্দেহ নেই যে আমাদের দেশের মানুষ সংগ্রামী, প্রতিবাদী এবং লড়াকু। কিন্তু দায়িত্বশীলদের বিভিন্ন অনৈতিক কাজের কারণে আজ তারা অনেকটাই নিরব। শাসনক্ষমতায় যাদের দেখেছেন বা আছেনÑ তাদের অনৈতিকতার জন্য মানুষ হতাশ, ত্যক্ত-বিরক্ত। মানুষের পেটে আগুন কিন্তু তারা কিছু বলছেন না। ভিতরে ভিতরে পেটের আগুন বিস্ফোরণমুখী কিন্তু এখনও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন না। তবে এ বিস্ফোরণ যে ঘটাবেন না তা কিন্তু মোটেও নয়। এখন পর্যন্ত শুধু তারা সব দেখছেন। আর এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, মানুষের এই নিরব দর্শকের ভূমিকাকে গণতন্ত্রের শত্র“রা নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখছে এবং নিরব দর্শকের সুযোগেই একের পর এক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে চলেছে। তারা রাজনীতি, নির্বাচন, গণতন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আরও ক্ষত-বিক্ষত করতে চাইছে। সুতরাং এখানে মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ার অপেক্ষা। যতোক্ষণ বাঁধটি ভেঙে না পড়বে ততোক্ষণ হয়তো শত্র“রা তাদের অপতৎপরতা চালিয়ে যেতেই থাকবে। বাঁধ ভেঙে পড়লে তখনই কেবল হবে নতুন ইতিহাস। হয়তো সে সময়ও এখন একবোরেই দোড়গোড়ায়। কোন কায়দায় যদি প্রত্যাশিত নির্বাচন ব্যহত হওয়ার অবস্থা হয়, তাহলে তখনই যে মানুষের বাঁধ ভেঙে পড়বে তা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সচেতন মানুষ মাত্রই এখানে গণপ্রতিরোধকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। আর সেটাই এখন সংকটমুক্তির পথ।
[তারিখ : ২০ অক্টোবর ২০০৮]
আবুল হোসেন খোকন: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।