অবশেষে কোন্ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?

আবুল হোসেন খোকন 

এখন একজন সাধারণ মানুষও বলছেন বিএনপি-জামায়াত জোটকে ফের ক্ষমতায় আনার জন্য রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করা হচ্ছেকারণ এটা বাস্তবায়ন হলেই সরকার তার সব কাজের বৈধতা পাবে এবং কাওকে কোন অন্যায়ের শাস্তি পেতে হবে নামানুষ আরও বলছেন, গত ২০ মাস নাটক মঞ্চায়ন করা হয়েছেএই নাটক দেখিয়ে মানুষকে ভোলানোর চেষ্টা হয়েছেআর যে কাজটি হয়েছে সেটা হলো গণরোষ থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটের লুটপাটকারী-দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করা হয়েছেএই রক্ষার জন্যই ওয়ান ইলেভেন নাম দিয়ে একটা নাটক করার প্রয়োজন ছিল এবং সেটাই করা হয়েছেকেননা অবস্থা এমন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে, বিক্ষুব্ধ মানুষের সংঘবদ্ধতার মুখে বিএনপি-জামায়াত জোটের কোনভাবেই ক্ষমতায় থাকার উপায় ছিল নাতাদের নতুন করে নির্বাচিত হয়ে আসা তো দূরে থাক মানুষের সমাজে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে উঠেছিলথাকলে তাদের জন্য গণরোষের শিকার হয়ে চরম পরিণতি ভোগ করার সম্ভাবনাটাই অনিবার্য ছিলএই বাস্তবতা থেকে রক্ষা পেতে আপাদমস্তক দুর্নীতি-লুটপাটে নিমজ্জিত বিএনপি-জামায়াত জোট গোষ্ঠীর জন্য কিছু একটা প্রয়োজন বা উপায়ন্তর দরকার ছিলআর ঠিক সেই উপায়ন্তরটিই করে দিয়েছে কথিত এক-এগারোর উদ্যোক্তারাতারা এমন চমকারভাবে রোডম্যাপ বানিয়ে কাজ করেছে যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছেআজকের দৃশ্যপটকে দেখলেই নাকি অনেকের কাছে সেটা পরিস্কার হয়ে যায়অর্থা অনেকেই মনে করছেন মানুষকে বিভ্রান্ত করতে ক্ষমতায় পরিবর্তন আনা হয় রাষ্ট্রপ্রধানের জায়গাটিকে বাদ রেখেতারপর আরও বোকা বানাতে দুর্নীতির পিলে চমকানোদের জেলখানায় ঢুকিয়ে তাদেরকে গণরোষ থেকে রক্ষা করা হয়রক্ষা করে তাদের প্রতি ফের সিমপ্যাথি গড়ে তোলার কূটনীতি পরিচালিত হয়তারওপর তাদেরকে এখন বেকসুর জেলমুক্তি দিয়ে ফের আগের মতো ক্ষমতায় যাওয়ার পথ করে দেওয়া হচ্ছেবলা যায় এই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে এবারও রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে ৫ বছরে দুর্নীতি-লুটপাট-খুন-গুম-সন্ত্রাস-বোমাবাজী-গ্রেনেডবাজী-দেশকে ধ্বংসাবশেষে পরিণতকারী বিএনপি-জামায়াতআবার দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে খালেদা-নিজামীরা রাজত্বে বসার জিয়নকাঠি পেয়ে গেছে

অবশ্য এটাও মনে করা হচ্ছে যে নাটকের যবনিকাপাত ঘটেছে এমন বলার সময় এখনও আসেনিঅর্থা দেশের মানুষকে আরও বিভ্রান্ত করা এবং বোকা বানানোর জন্য এখনও কিছু কাজ বাকি আছেযে জন্য এখনও মাইনাস টু’ ‘ম্যানেজ টু’ ‘ম্যানেজ আদার্স’ ‘সংলাপ’ ‘সমঝোতা’ ‘উপজেলা নির্বাচন’ ‘ঢাকা সিটি নির্বাচন’ ‘নির্বাচনী আইন’ ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আইন’ ‘জরুরি আইন’ ‘দুদক’ ‘ট্রুথ কমিশন’ ‘সংবিধান সংশোধন’ ‘জাতীয় সরকার’ ‘ঐক্যমত ইত্যাদি নানা ইস্যুতে নাটকের শেষাংশ সাজানো রয়েছেতবে পুরো শেষ দৃশ্যটি কি হবে এখনও স্পষ্ট নয়

এখানে যে কথাটা না বললেই নয় যে, সচেতন মানুষ মাত্রই এখন আবার নানা আশঙ্কার দোলায় দুলতে শুরু করেছেনতারা যা চেয়েছিলেন বা যা চান অবস্থা সে দিকে যাচ্ছে নাকেন যেন সব গোলমাল করে দেওয়া হচ্ছেমানুষ চেয়েছিল সত্যিকার অর্থেই দুর্নীতিবাজরা সাজা পাবে দৃষ্টান্ত তৈরি হবে যে দুর্নীতি করলে শাস্তি পেতে হয়মানুষ চেয়েছিল একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবেকিন্তু এসব নিয়ে এখনও নানা সংশয়যখন সব রাজনৈতিক দলগুলো বলছে আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে নির্বাচন তখন কমিশন বলছে, না তা হবে না, আগে উপজেলা নির্বাচন হবেসেই অনুযায়ী সকল রাজনৈতিক দলের প্রত্যাশাকে প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন কমিশন একতরফাভাবে আগামী অক্টোবর-২০০৮-এ ২৫০ উপজেলায় উপজেলা নির্বাচন করার জন্য তপরআবার বেশ বড় গলায় বলা হয়েছিল পিলে চমকানো দুর্নীতির প্রমাণ রয়েছে এমন দুর্নীতিবাজদেরই জেলে ঢোকানো হয়েছেএরা এক-একজন হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করে হাতিয়ে নিয়েছেএদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবেকিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে কোন প্রমাণই কোর্টে দাখিল হলো নাউচ্চ আদালত এ কারণে আটকদের জামিন দিয়ে দিচ্ছে, এবং সত্যিকার অর্থেই যারা পিলে চমকানো দুর্নীতি করেছে তারা বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে আসছেপ্রশ্ন উঠতেই পারে যে তাহলে কি দায়িত্বশীলদের হাতে দুর্নীতির প্রমাণ নেই? নাকি প্রমাণগুলো ইচ্ছে করে দাখিল করা হয়নি? তাহলে কি বিশেষ উদ্দেশ্যেই চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ-সন্ত্রাসী-গডফাদার এবং দেশের শত্রদের মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে? সরকার যাদের সম্পর্কে বলেছিল যে এদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে এখন তাদের ব্যাপারে  মানবিক দৃষ্টির প্রশ্ন আনা হচ্ছে কেন সেটাও প্রশ্ন এতোগুলো দুর্নীতি মামলার আসামী হওয়া সত্ত্বেও দুর্নীতির বরপুত্র বলে পরিচিত তারেক রহমান মুক্ত হলোতার দুর্নীতির কোন প্রমাণ পেশ করা হলো নাএমনকি তার জামিন ঠেকাতে সরকারপক্ষ পর্যন্ত আদালতে মুভ করলো নাফলে একদিনে তার ৫ মামলার জামিন হয়ে গেলমুক্তি মিললোতার চ্যালা-চামুণ্ডারাও একে একে মুক্ত হচ্ছে সন্ত্রাসী সাকা চৌধুরীর মতো লোককেও মুক্ত করে দেওয়া হলোখালেদা জিয়ার মতো দুর্নীতির মাকেও মুক্ত করে দিতে সরকার মহাব্যস্ত

বিএনপির খালেদাপন্থী নেতারা কখনও  বলেছেন একমাত্র বিএনপিই পারে এই আর্মি ব্যাকড সরকারের বৈধতা দিতেকখনও বলেছেন খালেদা জিয়াই এই সরকারকে বাঁচাতে পারে, রক্ষা করতে পারেআবার কখনও বলেছেন, খালেদা-তারেক মুক্ত হলেই তারা সরকারের সবকিছুতে থাকবেপ্রশ্ন হলো ভিতরে তাহলে কি খেলা চলেছে? অবশ্য ওয়াকেবহালরা কিন্তু জানেন যে আর্মি ব্যাক্ডরা কেবলই আর্মি ব্যাক্ড রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিলতে পারে গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল কোন শক্তির সঙ্গে মিলতে পারে নাপ্রশ্ন উঠেছে, এখানে কি সেই খেলাটিই চলেছে? এবং চলার মধ্যদিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল শক্তির বিজয়কে প্রতিহত করার ষড়যন্ত্র চলছে? জেলখানার ভিতরে খালেদা জিয়ার সঙ্গেই-বা কেন জামায়াত নেতাসহ চারদলীয় জোট নেতাদের বৈঠক করতে দেওয়া হলো? এই সুযোগদানের রহস্য কোথায়? এ সমস্ত ঘটনা ও কর্মতপরতা মিলিয়ে মানুষের মধ্যে এখন এই ধারণাই বদ্ধমূল হতে শুরু করেছে যে, দেশী-বিদেশী অশুভ যে শক্তি কথিত এক-এগারোর মধ্যেদিয়ে বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করতে চেয়েছিল তাকে এখন নতুন রোডম্যাপে নেওয়া হচ্ছে আলামতগুলো সেই সংকেতই দিচ্ছেযা মোটেও দেশের মানুষের জন্য শুভ বলে মনে হচ্ছে না

একটা বিষয় পরিস্কার যে, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যকে যারা নির্মূল করতে চায় তারা বারবার ষড়যন্ত্র করেছে এবং লক্ষ্য অর্জনের শক্তিকে টার্গেট করে আঘাত হেনেছেএ কারণেই জাতিরজনক বঙ্গবন্থুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, জেলখানার ভিতরে ঢুকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে, সংবিধানবিরোধী সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দালাল আইন বাতিল করা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করাসহ ভোটাধিকার দেওয়া হয়েছে, তাদের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে, সংবিধানকে বারবার সংশোধন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, মুত্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের শত্রদেরকে সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, তাদের দিয়ে সন্ত্রাসবাদী বোমাবাজ-গ্রেনেডবাজ গোষ্ঠী তৈরি করা হয়েছে, বিএনপির সহযোগী হিসেবে তাদেরকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে, দেশে গণহারে গুপ্তহত্যা-বিচারবহির্ভূত হত্যা-ধর্ষণ-সংখ্যালঘু বিতারন-গ্রেনেড হামলা-সিরিজ বোমা হামলা-আইন আদালতে হামলা করা হয়েছেধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নেতৃত্বকে এক-এগারোর পরেও সে চেষ্টা হয়েছে বা হচ্ছেসুতরাং সব মিলিয়ে চলমান রোডম্যাপ বা আলামত মোটেই শুভ নয়

বলা হয় ট্রেন নাকি লাইনচ্যুত হয়েছিলতাই সেই লাইনচ্যুত ট্রেনকে লাইনে ওঠানোর জন্য এক-এগারোর দরকার ছিল, এবং সেকারণেই এক-এগারো এসেছিলএই এক-এগারো আসলে কেন এসেছিল তা এখন মানুষের কাছে অনেকটাই পরিস্কারযখন ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার অজুহাত দেখানো হচ্ছিল, তখনই সচেতন মানুষ মাত্রই বুঝেছিলেন যে ট্রেন এমনি এমনি লাইনচ্যুত হয়নি, লাইনচ্যুত করানোর জন্য লাইনের নাটবল্টু খুলে রাখা হয়েছিলএখন এটাও পরিস্কার

সার্বিক বিষয় মিলিয়ে এখন সবার কাছেই একটা প্রশ্ন মুখ্য হয়ে উঠছে যে, অবশেষে দেশকে কোন্ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অথবা ঠেলে দেওয়া হচ্ছে? তাহলে কি এক-এগারোর আগের মতো দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে আবার সংঘাত বাধিয়ে নতুন কোন পরিস্থিতি তৈরির প্রক্রিয়া চলছে? তৃতীয় কোন পক্ষকে সামনে আনার চেষ্টা হচ্ছে? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে বাইরে রেখে নির্বাচনের পথে যাওয়া হচ্ছে, যাতে পুরনোপক্ষকে আবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করানো যায়? নাকি আরেকটি নতুন ওয়ান-ইলেভেন নাটক মঞ্চায়ন করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে? দেশকে আরও বড় ধরনের বিপর্যয়ে ফেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা হচ্ছে? কিংবা নির্বাচন বন্ধ করে নতুন জটিলতার পথ খোঁজা হচ্ছে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার চেষ্টা চলছে? এসব নানা প্রশ্ন এখন জট বেঁধে চলেছেযা মোটেও শান্তির পথ দেখাচ্ছে নাঅথচ মাটি ও মানুষের জন্য শান্তি ও স্বস্তির পথটাই প্রয়োজন ছিলসেই পথ না এলে মানুষই-বা আর কতো সহ্য করবে!  হয়তো তারা বারবার অশান্তির খেলা সহ্য করতে চাইবে না, এবং তখন তাদেরকে দেশের মালিক হিসেবে ভূমিকা নিতে বাধ্য হতেই হবেবলার অপেক্ষা রাখে না যে, যেখানে মুক্তি ও শান্তি সেখানেই হবে মানুষের নিজস্ব গন্তব্য


আবুল হোসেন খোকন: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী