অসভ্যতা দিয়ে কখনও সভ্যতা আসে না
আবুল হোসেন খোকন
পরিচয় নিয়ে সংকট তখনই তৈরি হয় যখন পিতাও অস্বীকার করে বসে। পিতা-মাতা সবাই অস্বীকার করে বসলে কি দাঁড়ায় তা বলে দিতে হয় না।
আমাদের এক ব্যারিস্টার উপদেষ্টা এরকম পরিচয় সংকটে ফেলে দিয়েছেন নিজেদের উপদেষ্টা পরিষদ বা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে’। এতোদিন সবাই জানতো এটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ব্যারিস্টার বললেন, না এটা ‘আর্মি ব্যাক্ড জাতীয় সরকার’। আর্মি তখন বললো, না এটা আর্মি ব্যাক্ড নয়, জাতীয় সরকারও নয়, এটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ব্যারিস্টার তখন নিজেদের ‘বৈধতা’ জায়েজ করতে বললেন, এটা জনগনের সরকার, তাই জাতীয় সরকার। অর্থাৎ তিনি এবার পিতা হিসেবে আর্মির জায়গার জনগণকে দেখালেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জনগণ কি তাদের পিতা? জনগণ কি এমন কোন বৈধতা দিয়েছে? জনগণ কি তাদের নির্বাচিত করেছে? তারা কি সাংবিধানিক সরকার? তাদের কি আইনগত সত্যি সত্যি কোন বৈধতা আছে? নেই, কোথাও বৈধতা মিলবে না। তবে হ্যাঁ, ব্যারিস্টার সাহেব একটা জায়গায় বৈধতা পেলেও পেতে পারেন। কে জানে সেই জায়গাটাই তাদের আসল পিতা কিনা?
এই ব্যারিস্টার উপদেষ্টা সরকারের পরিচয় নিয়ে যেভাবে একবার আর্মি একবার জনগণকে ‘ব্যাক্ড’ বলে পিতৃপরিচয় দিতে চাচ্ছেনÑ তার বদলে তিনি যদি ২০০৫ সালে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সন্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত জামাতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সদস্য সম্মেলনের কথাটি স্মরণ করে পরিচয়টা তুলে ধরেন, তাহলে হয়তো সঠিক পরিচয়টি পাওয়া যেতে পারে। ঐ সম্মেলনে একাত্তরের মূল ঘাতক দালালদের সঙ্গে এই ব্যারিস্টার উপদেষ্টাও মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন তাদেরই লোক হিসেবে। অতএব পিতৃ-মাতৃ পরিচয় যদি সেখান থেকে ধরা যায়Ñ তাহলে আজকের তাবৎ ভূমিকা থেকে পরিচয়ের যথার্থতা মিলে যেতে পারে। কারণ ওই একাত্তরের ঘাতক দালালরা এখন রাজকীয় মর্যাদায়। আর বাকিরা সব এখন হয় ‘অপশক্তি’ নয় ‘দেশ ধ্বংসকারী ঠিক যেমনটি ’৭১-এ ইয়াহিয়া খানরা মনে করতো। সুতরাং পরিচয় সংকটে ভোগার কোন কারণ নেই।
এখন টিভি মানে বিটিভি খুললেই কতগুলো নিউজ ফুটেজ দেখা যাচ্ছে। সেগুলো যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে দেখানো হচ্ছে তা পরিস্কার। বারবার দেখানো এবং একতরফাভাবে কতিপয় লোকের মন্তব্য বা ‘পাবলিক রিঅ্যাকশন’ তুলে ধরা থেকে এটাই বোঝা যায়। এই ফুটেজগুলোয় গত ২০ আগস্ট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সারাদেশে বিক্ষুব্ধ মানুষের ‘ধ্বংসাত্মক’ কার্যকলাপের দৃশ্য এবং এর বিরুদ্ধে কথিত পাবলিকদের ঘৃণা-ধিক্কার প্রচার করা হচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে এই একতরফা মোটিভভিত্তিক প্রচার তখনই, যখন ঐ ২০ আগস্টের ঘটনা নিয়ে একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত চলছে এবং যখন সমস্ত ইলেকট্রোনিক মিডিয়াসহ সংবাদ মাধ্যমগুলোর উপর নিরপেক্ষ বা প্রকৃত ঘটনার নিউজ ফুটেজ দেখানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি রাখা হয়েছে। সুতরাং ঘটনা কি দাঁড়াচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি কাজ করবে, অর্থাৎ তারা ঘটনার ব্যাপারে যে পক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলবে সেই পক্ষ হিসেবে ছাত্রদের শিক্ষালয় বন্ধ রাখা হয়েছে, সেই ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদের পলাতক থাকতে বাধ্য করা হয়েছে এবং তাদেরকে (তাদের বা তাদের পরিবারের উপর) আইনরক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে অনবরত হুমকী দিয়ে ‘ক্রসফায়ার’-এ হত্যা করার কথা বলা হচ্ছে (সূত্রঃ বিবিসি নিউজ ৩০ আগস্ট ২০০৭)। ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবারের উপর ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ থেকে। একইসঙ্গে সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের রিমাণ্ডে বা আটক রাখা হয়েছে, হুলিয়া জারি রাখা হয়েছে এবং এসব কারণে তারা বক্তব্য বা সাক্ষ্য দিতে পারছেন না। এমনকি জনসাধারণও বলছেন (বিবিসি নিউজ), তারা সরকারের মোটিভ বুঝেছেন এবং সরকার একপক্ষকে আগেই ‘অপশক্তি’ বলে ফেলেছেন। ফলে সঠিক সাক্ষ্য দেওয়া অসুবিধাজনক-বিপদজনক। তারা বলছেন, সরকারের পক্ষ হয়ে সাক্ষ্য না দিলে বিপদ নেমে আসতে পারে, তাই তারা সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী নন। এখানেও বিচার বিভাগীয় তদন্তের বাস্তবচিত্র-অবস্থা-পরিণতি সবই পরিস্কার হয়ে পড়েছে। তদন্তকারী বিচারপতিও এ ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছেন। আর ব্যারিস্টার উপদেষ্টা বলছেন, প্রয়োজনে তদন্ত কার্যক্রমের মেয়াদ বাড়ানো হবে। আসলে বাড়ানো হোক, বা যাই করা হোক এরকম তদন্ত কাজের ফলাফল যে কি হবে, বা এ ফলাফলের বিষয়টা আদৌ কোনদিন আলোর মুখ দেখবে কিনা তার জবার অতীতের অনেক তদন্ত রিপোর্টের ঘটনাই জলজ্যন্ত সাক্ষী হয়ে বলে দেবে। সুতরাং মন্তব্য নিস্প্রয়োজন।
এখানে শুধু এই কথাটি না বললেই নয় যে, যেখানে উচ্চশিক্ষিত ছাত্র-ছাত্রীদের উপর আইনের পোশাকধারীরা সদলবলে সর্বশক্তি নিয়ে হামলে পড়ে, পিটিয়ে মোরব্বা বানায় লাশ বানায় মানুষকে। আর যখন অসহ্য হয়ে ওঠা ছাত্র-জনতা এই মোরব্বা বা লাশ হওয়ার প্রতিবাদ করে, আত্মরক্ষার্থে হামলা প্রতিরোধ করে, রুখে দাঁড়ায় তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্বখ্যাত শিক্ষালয়ের সকল ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলা হয় সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে, জাতির বিবেক এবং সর্বজন মহাশ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও। এই শিক্ষকদের রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মতো ধরে নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত জায়গায়। ধরে নিয়ে যাবার সময় নির্লজ্জভাবে আবার বলা হয়, ‘আমরা পাকিস্তানি আর্মি না, কোন ভয় নেই, কিছুক্ষণ পরেই স্যারকে ফিরিয়ে দিয়ে যাবো।’ কিন্তু সেই স্যাররা ফেরত আসেন না। ৩৬ ঘণ্টারও বেশি সময় তাদের আটকে রাখা হয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ব্লাকহোল-এ। সেখানে পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের মানসিকভাবে নির্যাতন তো করা হয়ই, শারীরিকভাবেও করা নির্যাতন হয়। কী বীভৎস! সভ্যতার যুগে যা কল্পনারও অতীত।
এখানে পরিস্কার কথা হলো যে শিক্ষকে সম্মান দেয় না, সে কখনও মানুষ হতে পারে না। আবার যে সরকার শিক্ষকদের সম্মান দেয় না, সেও কখনও মানুষের সরকার হতে পারে না। আর এ রকম অবস্থায় সরকারের বিচারের ভার তখন সরকারের মালিক জনগণেরই উপরই বর্তায় (কারণ সাংবিধানিকভাবে জনগণই রাষ্ট্রের মালিক, আর সরকার হলো এই মালিকের নিয়োগকৃত কর্মচারী বা তত্ত্বাবধায়ক মাত্র)।
ঢাবির ঘটনার ব্যাপারে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সেনাবাহিনীর কতিপর সদস্যের সঙ্গে ছাত্রদের মারপিটের ঘটনাটি খুব সহজেই সমাধান করা যেতো যদিনা সরকার গোটা ছাত্রসমাজের উপর পাকিস্তানি হায়েনাদের মতো পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীকে বর্বর হামালা চালানোর জন্য লেলিয়ে না দিতো। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষ আজ কোন্ সভ্যতায় বাস করছেন তা এখন আর বলে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। এখানে দুর্নীতিবাজ-ঘুষদাতাদেরকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হয়। ঘুষ দেওয়ার মাধ্যমে কাজ হাসিল করার কারণে পুরস্কৃত করা হয়। ঘুষদাতার ঘুষ দেওয়ার স্বীকারোক্তির জন্য রাষ্ট্রীয় গানম্যান দিয়ে প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়। এক কথায় দেওয়া হয় ভিআইপি সুবিধা। আর অন্যদিকে যিনি ঘুষ নেননি, কোন স্বীকারোক্তি দেননি, ঘুষের প্রতিবাদ করেছেন তাকে আটক করা হয়, জেলে পাঠানো হয়। শেখ হাসিনা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। রাষ্ট্র স্বয়ং তার বিরুদ্ধে নির্যাতনের সব ধরনের শক্তি নিয়ে মাঠে নেমে আছে।
আসলে অসভ্যতা দিয়ে কখনও সভ্যতা আসে না। তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের সাংবিধানিক অঙ্গীকার করে, নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা কখনও সভ্যতা হতে পারে না। এদিকে জরুরি আইনের মেযাদও সংবিধান অনুযায়ী বেআইনি হয়ে গেছে। এরকম অনেক বেআইনিই রয়েছে। বেআইনি কেবল বেআইনিরই জন্ম দেয় যা কখনই সু-সভ্যতা দিতে পারে না।
আজ ‘অপশক্তি’র কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু অপশক্তি তারাই যারা কখনই জনগণকে দেশের মালিক হিসেবে গণ্য করে না, শ্রদ্ধা করে না, বরং জনগণকে ‘অপশক্তি’ হিসেবে বিবেচনা করতেই পছন্দ করে। অপশক্তিই কেবল সংবিধান মানে না, আইন-কানুন মানে না, মানবাধিকার মানে না, মানুষের দাবি বা কথা বলার অধিকারকে মানে না। অতএব অপশক্তি খোঁজার জন্য অনুবীক্ষণ প্রয়োজন হয় না, হবে না।
তারিখঃ ৩০ আগস্ট ২০০৭
আবুল হোসেন খোকনঃ সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী