আসুন, সংস্কারের স্বরূপ সন্ধান করি
আবুল হোসেন খোকন
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সম্পর্কে সম্প্রতি লন্ডন থেকে একটি গবেষণামূলক বই বেরিয়েছে। বইটি লিখেছেন পাকিস্তানের স্বনামধন্য সামরিক বিশ্লেষক ও লেখিকা আয়েশা সিদ্দিকা। বইটির নাম “মিলিটারি ইনকর্পোরেটেড-ইনসাইড পাকিস্তানস্ মিলিটারি ইকোনমি”। এতে দেখানো হয়েছে দেশরক্ষার নামে সেনাবাহিনী আসলে কী সাংঘাতিক অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। এতে যা দেখানো হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত চিত্র হলো
· পাকিস্তান দেশটির যাবতীয় ভারী শিল্প-কারখানার এক-তৃতীয়াংশ এখন সেনাবাহিনীর মালিকানাধীনে।
· ১ কোটি ২০ লাখ একর সরকারি জমি এবং শতকরা ৭ ভাগ বেসরকারি সম্পদের মালিকও এই সেনাবাহিনী।
· সেনাবহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যবসায় সম্পদের পরিমাণও হাজার হাজার কোটি ডলার।
· কল্যাণ ফাউন্ডেশন হিসেবে পরিচিত সামরিক বাহিনীর ৫টি সুবিশাল কনগ্লোমারেট রাস্তার পাশের পেট্রোল পাম্প থেকে শুরু করে অতিকায় শিল্প, সিমেন্ট থেকে শুরু করে কর্নফ্লেক্স তৈরির কারখানা পর্যন্ত হাজার হাজার ব্যবসায় ও শিল্প-প্রতিষ্ঠান চালিয়ে আসছে।
· শুধু চুলকাটার সেলুন বাদে পাকিস্তানের প্রায় প্রত্যেকটি ব্যবসা-কারবারের সঙ্গেই সেনাবাহিনী যুক্ত।
· পাকিস্তানের কোম্পানিসমূহ এবং সেগুলোর মূল সম্পদ এখন ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সিনিয়র আর্মি অফিসারদের হাতে।
“মিলিটারি ইনকর্পোরেটেড-ইনসাইড পাকিস্তানস্ মিলিটারি ইকোনমি” তে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের ৬০ বছরের ইতিহাসের ৩২ বছরই সরাসরি দেশ শাসন করেছে সেনাবাহিনী। শাসনক্ষমতার কারণে এরা রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃত্ব দখল করতে পেরেছে। ফলে তাদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছে সর্বগ্রাসী। পাকিস্তান রাষ্ট্রে এখন তাই সেনাবাহিনী নিজেই আরেক রাষ্ট্র। তাদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের মুনাফাই এখন রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের চালিকাশক্তি। আর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে সামরিক বাহিনী এখন স্বতন্ত্র, স্বাধীন এবং সর্বগ্রাসী ক্ষমতাধর শ্রেণী। লক্ষ্য করার মতো আরও কয়েকটি বিষয় হলো, অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের মূলধন ও মুনাফা শুধুই সামরিক বাহিনী তথা সংখ্যালঘু অফিসারদের কল্যাণে নিয়োজিত। এই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য এবং মুনাফাই সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের জন্য দায়ী। এই সাম্রাজ্যের কারণেই সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিত্যাগ করে ব্যারাকে ফিরে যেতে রাজী করানো যায় না। এই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যই সামরিক বাহিনীকে বার বার ক্ষমতার কেন্দ্রে টেনে আনে। গবেষণা থেকে দেখানো হয়েছে, সুদীর্ঘকাল দেশ শাসনের জায়গায় থাকার ফলেই তাদের পক্ষে এই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়া সম্ভব হয়েছে।
বইটিতে তুলে ধরা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সামরিক বাহিনীর এই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের সবটাই দেশের মালিক জনগণের কাছে গোপন রাখা হয়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মূলধন এখন কতো তা কেও জানে না। বিপূল সম্পদের উৎস কোথায় কোথায় জনগণ জানে না। মজার ব্যাপার হলো, সামরিক বাহিনীর এই মূলধনের রেকর্ড প্রতিরক্ষা বজেটেও দেখানো হয় না। এই মূলধনকে ঘিরে যেসব ক্রিয়াকলাপ চলেÑ তারও কোন উল্লেখ থাকে না বাজেটে। এই মূলধন এবং ক্রিয়াকলাপের জন্য রাষ্ট্রের কাছে জবাবদিহিতার প্রচলিত পদ্ধতিও অনুসরণ করা হয় না। এককথায় রাষ্ট্রের কারও কাছেই সামরিক বাহিনীকে দায়বদ্ধ থাকতে হয় না। আর এ জন্যই তাদের মূলধন বা পুঁজির ব্যাপারে দেশের মালিক জনগণকে কিছুই জানতে দেওয়া হয় না।
“মিলিটারি ইনকর্পোরেটেড-ইনসাইড পাকিস্তানস্ মিলিটারি ইকোনমি”-এর তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর জবাবদিহিতাহীন এই বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য মানেই হলো ভয়াবহ রকমের দুর্নীতি। এই যাবতীয় কর্মকাণ্ড’র মানেই হলো আইন-বিধান-সংবিধান-জনগণ-রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড। এ সবই নীতি-নৈতিকতা বহির্ভূত। কাজগুলো শতভাগ দুর্নীতি এবং অবৈধ বলেই সামরিক বাহিনী তাদের মূলধনের বিষয় গোপন রাখে, দেশের মালিক জনগণকে কিছু জানতে দেয় না। অর্থ এবং বন্দুক দুইয়ে মিলে তাদের যে দুর্নীতির দোর্দণ্ড প্রতাপ, তা গোটা সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত করেছে। সুতরাং এককথায় বলা যায় দুর্নীতির মূল হলো পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বা তাদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য এবং তাদের বন্দুকশক্তি।
এই অপতৎপরতার জন্য নিশ্চয় পাকিস্তানের জনসাধারণ সামরিক বাহিনীকে অপরাধী হিসেবে সনাক্ত করতেই পারে। জনগণই যেহেতু দেশের প্রকৃত মালিক, আর সরকার বা সরকারের অংশ সামরিক বাহিনী যেহেতু জনগণের কর্মচারি বা বেতনভূক চাকুরে মাত্র সেহেতু তারা সামরিক বাহিনীর অপরাধের জন্য প্রয়োজনীয় শাস্তি প্রদানের পরিপূর্ণ অধিকার রাখে। কেননা জনগণের চাকুরে হয়ে কেও জনগণের উপর খবরদারি করতে পারে না, জনগণের মাথার উপর ছড়ি ঘোরাতে পারে না, জনগণের মালিক হয়ে বসতে পারে না, আলাদা অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারে না, ক্ষমতায়ও বসতে পারে না, শাসক হবার তো প্রশ্ন ওঠেই না। সুতরাং এখন যদি প্রশ্ন করা হয় পাকিস্তানে সুষ্ঠু অবস্থা ফিরাতে, গণতন্ত্র ফিরাতে, পাকিস্তানকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে কোথায় সংস্কার প্রয়োজন? নিশ্চয় একটাই জবাব হবে। আর তা হলো সংস্কার করতে হলে করতে হবে সামরিক বাহিনীতে। তাদের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে, তাদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য ভেঙে দিতে হবে, তাদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার উচ্চাকাক্সক্ষা নস্যাৎ করে দিতে হবে। এই উচ্চাকাঙক্ষার সকল ক্ষেত্র গুড়িয়ে দিতে হবে। তাদেরকে প্রকৃত অর্থেই জনগণের চাকুরে-সেবক-প্রতিরক্ষক বা নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে দাঁড় করাতে হবে। না হলে, এই সামরিক বাহিনী রাখার কোন মানেই হয় না। সুতরাং সংস্কারের আসল জায়গা হলো সামরিক বাহিনী। এখানে সংস্কার করলেই রাষ্ট্র ও সমাজের অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের দুর্নীতি-অনিয়ম বা খারাপ দিকগুলো দূর করা সম্ভব।
পাকিস্তানের চিত্র থেকে আমাদের বাংলাদেশ আলাদা কিনা বা আলাদা হলে কতোটুকু আলাদাÑ তা একটু নজর দিলেই পরিস্কার হয়ে যায়। ৩৬ বছর বয়সের এই দেশে ২৮ বছরই ক্ষমতা দখল করে দেশ শাসন করেছে হয় সরাসারি সামরিক বাহিনী, অথবা তাদের তৈরি করা তথাকথিত দল। আজও কি কোন ব্যতিক্রম অবস্থা চলছে? দেশের মালিক জনগণের কোন কর্মচারী নিশ্চয় জনগণকে জ্ঞানদান করতে পারে না। অথচ এখন এটা হচ্ছে অযাচিতভাবেই। হেলিকপ্টারে দেশময় চষে বেরিয়ে পর্যন্ত এই ‘মহান’ দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে। হাসিনা-খালেদাকে মাইনাস দায়িত্ব নিশ্চয় কে দিয়েছে এদের? কেন কোন্ উদ্দেশ্যে কোন্ স্বার্থে এ তৎপরতা? কেনই বা যুদ্ধাপরাধীদের সুরক্ষা দিয়ে আজও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিকে ক্ষত-বিক্ষত করা, নেতৃত্বশুন্য করা? এবং এটা কোন্ স্বার্থে কার স্বার্থে? জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রহরণ করতে কেনই বা সাদা পোশাকের লোকেরা ব্যতিব্যস্ত এবং কেনইবা তারা কোন দুর্নীতিবাজ ধরে নিয়ে আটকে রাখার পর ছেড়ে দেয় এবং ছেড়ে দেওয়ার পর রাষ্ট্রীয় গানম্যান নিরাপত্তা-সুযোগ-সুবিধা দেয়, সেই সুবাদে ওই দুর্নীতিবাজরা রাজনীতিকদের নামে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ তোলে? আর কাল বিলম্ব না করে সেই সূত্র ধরে অপরাধ প্রমাণ হবার আগেই রাজনীতিকদের অপরাধী বানিয়ে জেলে পুরে দেওয়া হয়? এইসব প্রশ্নের জবাব খুঁজলে খুব সহজেই অনেক উত্তর বেরিয়ে আসে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের ভিতরে নিজস্ব রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে, অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, তারা তাদের এইসব অবৈধ সম্পদের হিসাব দেয় না দেশের মালিক জনগণের কাছে। বাংলাদেশের জনগণও কি হিসাব পায়? জবাবদিহিতা পায়? এই দেশের মালিক জনগণকে কি কখনও ‘স্যার’ সম্বোধন করা হয়? নাকি ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ বলতে পছন্দ করা হয়? সংবিধান অনুযায়ী জনগণকে যদি মালিক হিসেবে মানাই না হয়, যদি চাকুরে হয়ে মালিক হয়ে বসা হয় তাহলে কি চরমতমভাবে আইন এবং বিধান লঙ্ঘন হয় না? যা নীতি-নৈতিকতাবিরোধী তো বটেই, মহাদুর্নীতিও। আর সেটাই হচ্ছে কী ভয়ঙ্করভাবে তা বোঝার জন্য পাকিস্তানের গবেষণামূলক বইটিই যতেষ্ট।
[৩ অক্টোবর ২০০৭]
আবুল হোসেন খোকন: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।