যুদ্ধাপরাধিদের গোড়ার কথা
আবুল হোসেন খোকন
বাংলাদেশ এখন ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধিদের বিচারে একাট্টা। শুধু যুদ্ধাপরাধ নয়, এরসঙ্গে যুক্ত তাবৎ নেটওয়ার্ক অর্থাৎ জঙ্গি মৌলবাদ বা ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও জাতি একাট্টা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে মানুষ এসব অপক্ষেত্রের অবসান চায়। আর ঠিক এ কারণেই আজ মুক্তিযুদ্ধের ৩৬ বছর পরেও তখনকার সেক্টর কমান্ডারদেরকে এক কাতারে দাঁড়াতে হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বা প্রধান কাজটি করার ডাক দিতে হয়েছে। কারণ এই কাজগুলো না হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য তো ব্যর্থ হয়েছেই, সেইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের অগ্রগতির মূল শত্রুদের দোর্দণ্ড উত্থান ঘটেছে।
প্রশ্ন হলো বাংলাদেশকে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে, এবং এজন্য শত্রুদের নির্মূল বা বিতাড়ন করতে হবে। কীভাবে হবে এই বিতাড়ন? বলা হচ্ছে, এজন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে, তাদের শাস্তি দিতে হবে। যুদ্ধাপরাধী কারা? যুদ্ধাপরাধী হলো গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, কামরুজ্জামান প্রমূখরা। সেইসঙ্গে এদের নেটওয়ার্ক হলো জামায়াতে ইসলামীসহ জঙ্গি মৌলবাদ বা ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী অনেকগুলো সংগঠন। সুতরাং প্রশ্ন হলো, এই গো.আযম-নিজামী-মুজাহিদ-কাদের-সাঈদী-কামরুজ্জামানদের বিচার ও শাস্তি প্রদান এবং মৌলবাদী সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ করে দিলেই কি প্রত্যাশা পূরণ হবে? উত্তর নিঃসন্দেহ না। কেননা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ার জন্য শুরু থেকেই অনেক কাজ ছিল, সেগুলো বাকি পড়ে জমা হয়েছে। তারপর গণতন্ত্রের শত্র“দের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুবাদে যুদ্ধাপরাধী ও মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের উত্থান ঘটায় ওই কাজ বহুগুনে বেড়ে গেছে। সুতরাং আজ যে দাবিগুলো আসছে সেগুলোর প্রাপ্তিই সমাধান নয়। দাবি আদায় হলেই শত্র“ যাবে না, প্রত্যাশা পূরণ হবে না, কাজও শেষ হবে না।
এখানে একটি কথা না বললেই নয়। তাহলো আজ যখন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গো.আযম-নিজামী-মুজাহিদ-কাদের-সাঈদী-কামরুজ্জামানদের নাম উল্লেখ করে তাদের বিচার দাবি করা হচ্ছে, তখন কিন্তু ওই নামের লোকগুলোকে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে অন্যদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার চিন্তা করা হচ্ছে। কারণ এটা করা হলে জামায়াতে ইসলামী দলটি যে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের দল নয় সেই দাবিটি করা যাবে। এভাবে দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটিয়ে দায় এড়ানোর কৌশল নেওয়া হতেই পারে। আরেকটি ব্যাপার যদি কথার কথা হিসেবে ধরা যায় যে কোনভাবে এদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো, শাস্তি হলো এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে গেল। তাহলেই কি কাজ হবে? মৌলবাদ বা ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হবে? যুদ্ধাপরাধীদের শেষ করা যাবে? উত্তর নিঃসন্দেহে না। কারণ ওরা তো শুধু ব্যক্তি বা দলের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে নেই। ওদের দাঁড়ানোর মূল জায়গা অন্যখানে।
আদতে আমরা মুসলিম ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী বা জঙ্গি মৌলবাদী, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার-আলবদর-আলশামস, জামায়াতে ইসলামী বলে যাদেরকে জানি তাদেরকে ব্যক্তিভিত্তিক দেখলে বড় ভুল করা হবে। অর্থাৎ আমরা যদি রাজাকার-আলবদর-আলশামস-জামায়াতি বা ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী বলতে গো.আযম-নিজামী-মুজাহিদ-কাদের-সাঈদী-কামরুজ্জামানকে বুঝি, তাহলে ওই ব্যক্তিরাই শুধু অপরাধী বলে চিহ্নিত হয়। এতে করে এই অপরাধ থেকে বাদ পরে যায় তাদের পরবর্তী প্রজন্ম যারা কিনা ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলই না, বা জন্মই হয়নি। এককথায় অপরাধ থেকে বাদ পড়ে যায় আজকের নতুন প্রজন্মের জামায়াতে ইসলামী, ছাত্র শিবির সদস্যসহ অন্যান্য জঙ্গি মৌলবাদী ক্যাডাররা। অথচ এরাও নিঃসন্দেহে গো.আযম-নিজামী-মুজাহিদ-সাঈদীদের মতোই মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির গৌরবময় সংগ্রাম-ইতিহাস-ঐতিহ্যের শত্র“। সুতরাং এখানে পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন যে, কেন এরাও নিজামীদের মতো যুদ্ধাপরাধী, মৌলবাদী এবং অপরাধী। আসলে গো.আযম-নিজামী গংরা তো ব্যক্তিচিন্তায় যুদ্ধাপরাধ করেনি, তাদের যুদ্ধাপরাধের ভিত্তি ছিল তাদের আদর্শ। ওই আদর্শটিই হলো ওদের মূল। ওই আদর্শের জন্যই ওরা যুদ্ধাপরাধ করেছে, গণহত্যায় ভূমিকা রেখেছে, মা-বোনদের ধর্ষণ-নির্যাতন করেছে, লুণ্ঠন চালিয়েছে, অগ্নিসংযোগ করে ধবংসযজ্ঞ চালিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় দালাল বলেছে। ওই আদর্শের জন্যই ওরা পাকিস্তানি শাসন-শোষণের পক্ষে ২৩ বছর সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-প্রতিক্রিয়াশীল তৎপরতা চালিয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সামরিক শাসনকে সমর্থন করেছে, মৌলবাদের বিস্তার ঘটিয়েছে, হাতকাটা-রগকাটার মহোৎসব চালিয়েছে। ওই আদর্শের জন্যই দেশব্যাপী একযোগে ৫শ’ বোমা হামলা, আদালত-প্রতিষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে ওরা হত্যা-ধবংশযজ্ঞ চালিয়েছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন-দমন-নির্মূলন চালিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদেরকে হত্যার মাতম চালিয়েছে। সুতরাং ওই আদর্শটাই হলো মূল। ওটাই যুদ্ধাপরাধী আদর্শ, গণহত্যার আদর্শ, নারী নির্যাতন-ধর্ষণ-লুণ্ঠনের আদর্শ। ওটাই মানবতাবিরোধী-মৌলবাদী-সন্ত্রাসবাদী আদর্শ। ওটার নেতৃত্বেই গো.আযম-নিজামী গংরা অতীত থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক-মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাচ্ছে। ওটার ওপরই দাঁড়িয়ে আছে ওদের আজকের প্রজন্ম। ওটার নেতৃত্বেই চলছে জামায়াত-শিবির-মৌলবাদীরা। তাই ব্যক্তি নয়, অপরাধের মূল হলো তাদের আদর্শ। আর এই সূত্রেই আজকের নতুন প্রজন্মের জামায়াত-শিবির সদস্য বা তাদের অনুসারীরা অপরাধী, যুদ্ধাপরাধী এবং মুসলিম ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসী।
এ গেল একটা দিক। আরেকটা দিক হলো, ওই যুদ্ধাপরাধী বা মুসলিম ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী দর্শনের টিকে থাকার ভিত্তিটি কোথায় সেটি এড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে না। কারণ ব্যক্তি যুদ্ধাপরাধী এবং দর্শন যুদ্ধাপরাধী নির্মূল করতে হলে এর টিকে থাকার ভিত্তিটাকে ধবংস করতে হবে। তা না পারলে কখনই ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গি মৌলবাদের মূলোৎপাটন করা যাবে না। প্রায় বছর তিনেক আগে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছিলেন যে বাংলাদেশে মৌলবাদীদের যে ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক গড়ে তেলা হয়েছে, তা থেকে তারা বাৎসরিক নিট মুনাফা বা আয় করছে ১২শ’ কোটি টাকা। নিঃসন্দেহে তারপর থেকে এখন পর্যন্ত আরও অনুকূল পরিবেশে তাদের এ আয় বা লাভের অঙ্ক আরও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং আজ যদি নিজামী-গো.আযমদের বিচার হয়, শাস্তি হয় এবং জামায়াত বা জঙ্গি মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো নিষিদ্ধ হয়, কিংবা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বে-আইনী করাও হয়, কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি বা উৎসকে বন্ধ না করা হয়Ñ তাহলে কোন ফলই হবে না। অর্থনৈতিক ভিত্তি থাকা মানেই বাকি সব বহাল তবিয়ত থাকা। সে কারণে বন্ধ বা ধবংস করে দিতে হবে যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদী ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদীদের সকল ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক-রাজনৈতিক কার্যক্রম ও নেটওয়ার্ক। বন্ধ করে দিতে হবে তাদের বৈদেশিক অর্থপ্রাপ্তির জায়গাগুলো। এটা যদি করা হয়, তাহলেই বাংলাদেশ মৌলবাদের ম-ও থাকবে না। অর্থনৈতিক ভিত্তি না থাকলে কেও কোনভাবেই ওই জায়গায় যাওয়ার জন্য আগ্রহী হবে না। কিন্তু যতোদিন এটা না করা হবে, ততোদিন কিছুই হবে না। লতা-পাতা ছেটে মৌলবাদী বৃক্ষ ধবংস করা যাবে না।
তাই আজ বাংলাদেশ যখন ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে একাট্টা, এরসঙ্গে যুক্ত তাবৎ নেটওয়ার্ক অর্থাৎ জঙ্গি মৌলবাদ বা ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একাট্টা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে মানুষ যখন এসব অপক্ষেত্রের অবসান চাচ্ছে তখন গোড়ায় নজর দেওয়ার কথাটি ভুলে গেলে চলবে না।
আবুল হোসেন খোকন: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।