দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা সবার জন্য প্রযোজ্য
বীরেন্দ্র নাথ অধিকারী


১/১১’র পর বাংলাদেশে দু’টি তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে, (১) দুর্নীতি বিরোধী অভিযান এবং (২) সংস্কার করণ। বিষয় দু’টি একে অপরের পরিপূরক বিধায় এদের সমান্তরাল প্রবাহ ব্যতীত কাঙ্খিত ফল অর্জন সম্ভব নয়। তাই একদিকে দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে প্রতিনিয়ত বেড়িয়ে আসছে নিত্য নতুন চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক সব বাস্তব তথ্য, অন্যদিকে সংস্কার নিয়ে চলছে নানামুখী দৌড়ঝাপ, প্রস্তাব ও প্রক্রিয়া। সাধারণ মানুষ আগে যা জানতে বা অনুমান করতে পেরেছে এখন দেখা যাচ্ছে তা প্রকৃত সব ঘটনার নগণ্য চিত্র মাত্র। এ দেশের দুর্নীতিবাজদের পারফরমেন্স তাবৎ দুনিয়ার যে কোন দুর্নীতিবাজ, এমন কি এ বিষয়ে গোয়েন্দা কাহিনী বা সিনেমা/নাটকের চরিত্রকেও হার মানায়। আমাদের দুর্নীতিবাজদের জীবন কাহিনী নিয়ে হলিউড ও বলিউডে একাধিক হিট চলচ্চিত্র হতে পারে, সন্দেহ নেই।

দুর্নীতি বিষয়ে সর্বশেষ যে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়ে আসছে তা লন্ডন ভিত্তিক ফার্স্ট সলিউশন মানি ট্রান্সফার লিমিটেড নামক একটি কোম্পানির জালিয়াতি। এই কোম্পানির কর্ণধাররা বিগত চার দলীয় জোট সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের ঘনিষ্ট বন্ধু, এমন কি ব্যবসায়িক অংশীদারও বলে জানা যায়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে আরো জানা যায় একদিকে ঢাকায় সরকারের ঐ সব কর্তা ব্যক্তিদের সহায়তায় চট করে ফার্স্ট সলিউশন তাদের অর্থিক লেনদেনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি পেয়ে যায়, অন্যদিকে তারা লন্ডনে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে রাতারাতি ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়ে যায়। ভালোই চলছিলো তাদের ব্যবসা। কিন্তু কি কারণে কিছু দিন আগে কোম্পানিটি লাপাত্তা হয়ে যায়। সঙ্গে নিয়ে যায় লন্ডন প্রবাসিদের কষ্টার্জিত দেশে পাঠানো প্রায় দু’শ কোটি টাকা। বিবিসি টেলিভিশন প্রথম খবরটি প্রচার করে। এর পর দেশি-বিদেশি সকল মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত নানান ধরণের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সঙ্গত কারণে দেশের সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্তাব্যক্তি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরই এখন এ ব্যাপারে মিডিয়ার টার্গেট হয়ে পড়েন। তিনি ঐ সময় প্রায় প্রতি দিনই বিভিন্ন মতামত দিয়ে যাচ্ছিলেন। মিডিয়ায় প্রচারিত ও প্রকাশিত তার এসব বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে তিনি বিষয়টি অনেকটা হালকাভাবে নিয়েছেন। ভাবখানা এমন যেন এটি বিরাট কোন ব্যাপার নয়, দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই, যারা ফার্স্ট সলিউশনের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠিয়েছেন তাদের টাকা উদ্ধার করার তিনি সর্বাত্বক চেষ্টা চালাবেন, যে সব ব্যাংকের মাধ্যমে ফার্স্ট সলিউশন এ দেশে টাকা পাঠাতো সে সব ব্যাংকের নথিপত্র দেখে এটা করা সম্ভব, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তার কথাবার্তার মাধ্যমে ফার্স্ট সলিশনকে দোষী সাব্যস্ততা এবং কিছু ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ পেলেও, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীলতা বা সেখানকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যোগসাযশতার ব্যাপারে তিনি তেমন কিছুই বলননি। তাই সঙ্গত কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নরের নিকট সবিনয় কতিপয় প্রশ্ন রাখা অসমীচিন হবে না, যেমন; (১) ফার্স্ট সলিউশন মানি ট্রান্সফার লিমিটেড নামক কোম্পানিটিকে কবে বাংলাদেশ ব্যাংক লেনদেনের অনুমতি প্রদান করে?, (২) কোন প্রক্রিয়ায় বা আইনে মাত্র ১০০ পাউন্ড শেয়ার মূল্যমানের একটি কোম্পানিকে এরকম কোটি কোটি টাকার লেনদেনের অনুমতি দেয়া হয়েছিল?, (৩) ফার্স্ট সলিউশনকে অনুমতি প্রদানের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন কোন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন?, (৪) যারা জড়িত ছিলেন তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে?, (৫) বিবিসি কর্তৃক সংবাদ প্রকাশিত হবার পূর্ব পর্যন্ত এরকম একটি চরম আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি পরায়ণতাপূর্ণ বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংক কেন গোপন রেখেছিল?, (৬) এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান হিসেবে গভর্নর নিজে দায়িত্ব এড়াতে পারেন কিনা? এবং (৭) গভর্নর দায়িত্ব এড়াতে না পারলে তার কি করা উচিৎ বলে তিনি মনে করেন? এসব প্রশ্নের উত্তর তিনি তার কার্যক্রমের মাধ্যমে এবং গণমাধ্যমে যত তাড়াতাড়ি প্রকাশ করেন ততই মঙ্গল। কারণ বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার অনুযায়ী দেশে চলমান শুদ্ধি অভিযানের আওতায় কারুরই আইনের উর্দ্ধে থাকার অবকাশ নেই। আর যেখানে অপরাধের মাত্রা বিচারে মানুষ হত্যার পরবর্তী জঘন্য অপরাধ হচ্ছে আর্থিক আনাচার ও অনিয়মন সেখানে দেশের আর্থিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতার অস্বচ্ছতার কোন অবকাশ নেই। তাই দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রেখে জাতির নিকট তার জবাবদিহিতা প্রকাশ এবং সে মোতাবেক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এটাই এ মূহুর্তে তার নিকট সকলের প্রত্যাশা।

বীরেন্দ্র নাথ অধিকারী / সমাজকর্মী
এফ-৬ নিপসম স্টাফ কোয়ার্টার
মহাখালী, ঢাকা-১২১২
ফোন: ৯৬৭০৯৫৫-৫৬ (অফিস), ৯৮৮৬৮০৬ (বাসা), ০১৯১২০২৩০৫৩ (মোবাইল)

Email: [email protected]

১১ জুলাই ২০০৭