পাপনের আপন ভূবন
মণিকা রশীদ
কে কবে যেন পাপনকে বলেছিল শিশিরে ভেজা ঘাসে ঘন্টাখানেক হাঁটলে রাগ কমে। রাগ হচ্ছে, কঠিন রকম রাগে পা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত কাঁপছে। রাগ কমানোর অষুধ থাকলে খুব ভাল হত। শিশিরে হাঁটা ট্রাই করে দেখা যেতে পারে। সমস্যা হল শিশিরে ভেজা রাস্তা। গাছের পাতা পাওয়া গেলেও ঘাস পাওয়া যাচ্ছে না। শহরগুলো থেকে ঘাস পালিয়েছে! ঘাস খুঁজতে এখন কোনো পার্কে হানা দিতে হবে। এতো সকাল বেলা একা পার্কে যেতে মন সায় দেয় না। তা সে রাগের মাত্রা যতই উপরেই উঠুক না কেন। নিরাপত্তার কথা ভাবতে হয়। এই শহরে মেয়ে হয়ে জন্মাবার অনেক সমস্যার এ হচ্ছে একটা। শুধু এই শহর কেন, বাংলাদেশের কোন কোনায় মেয়েরা নিরাপদ এখন? এটা একটা গুরুতর ভাবনার বিষয় বটে। মেয়েরা নিরাপদ হবে না কেন? কথায় কথায় নেতারা, অভিনেতারা, সমাজকর্তারা এবং অবশ্যই পুলিশেরা ঢেরা পিটিয়ে যাচ্ছেন-নারীরা তাদের মা এবং বোন!
সেই মায়েদের এবং বোনেদের দেখে বাস্তবে তাদের অনেকেই ই তাদের শরীরের দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান অংশের কিরকম এক্সরে করেন তা মায়েরা এবং বোনেরা মাত্রেই জানে। পাপনও তা জানে। না জেনে উপায় নেই যে। মায়েদের এবং বোনেদের অংশ হয়ে রাস্তায় বের হওয়া সহজ বিষয় নয়। মাতা-ভগিনীর জীবন যাপনের কষ্ট এখানে-হয়ত সবখানেই অনেক। যে পুরুষের সাথে বাপ-মা বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন সে যদি পরিচয়ের চতুর্থ দিনেই দাবি করে বুকে হাত বোলাবার, তাকেও মেনে নিতে হবে। মা অন্তরালে ডেকে নিয়ে বলবেন--ওরকম সব ছেলেরাই চাইতে পারে। ওটা তার অধিকার এর মধ্যেই পরে। অধিকার! আমার বুকে আমি কাকে হাত রাখতে দেব, কখন দেব সেটা আমার অধিকার। আমার শরীরের ওপর আমার থেকে এদের বেশী অধিকার! আমি কি কারো সম্পত্তি নাকি?
রাস্তায় বের হবার পরিকল্পনা পাপনকে বাদ দিতে হল। একা মেয়ে এই ভোর রাতে রাস্তায় বেরনো নিরাপদ নয়। দিনের বেলা হলে অন্য কথা ছিল। এখনো তাও কিছুটা নিরুপদ্রবে রাস্তায় হাঁটা যায়; কিছুদিন পরে আর যাবে না। কিছুদিন পর ভোট হবে। নেতানেত্রীরা গলাবাজী করে পাবলিকের দিনের বিশ্রাম আর রাতের ঘুম হারাম করতে শুরু করবে। রাস্তার পাশের সবুজ গাছগুলো ভরে যাবে অমুক এবং তমুক ভাই এর কদর্য নির্বাচনী পোষ্টারে। সবথেকে বড় উপদ্রব হচ্ছে আর্মি নামবে। রাস্তাঘাট জুড়ে ভারি জুতোর আওয়াজ তুলে তারা জনগণের নিরাপত্তায় নিয়োজিত হবে। তাদের জুতোর আওয়াজে শিশু-জোয়ান-বৃদ্ধ সবার বুকের ভেতর ধক্ধক্ করতে থাকবে সারাক্ষণ। সেই ধুকধুকানি সহজে থামতে চাইবে না। কিছু কিছু হুজুর টাইপের আর্মি আবার নারী জাতির পিছনে লাগবে। রাস্তায় আটকে বোরখা পরার পরামর্শ প্রদান করবে। সব থেকে বেশী বিপদ হবে কবি টাইপের মানুষগুলোর। তাদের শখের চুল কেটে কদমছাঁট করা হবে! গতবারের নির্বাচনে মিলন নামের এক দুর্বোধ্য কবিকে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। পাপনকে রাস্তায় যে হুজুর আর্মি বোরখা পরতে বলেছিল, পাপন তাকে বিনয়ের সাথে বলেছিল-আমি তো হিন্দু ভাইয়া!বোরখা পরা নিষেধ!
হুজুর তাতে থামেনা। বিরক্তি নিয়ে তাকায় পাপনের দিকে। কেন যে মালাউনগুলা এখনও এই দেশে আছে!
গম্ভীর হয়ে বলে-তারপরও আদব লেহাজের ব্যাপার আছে না। মাথায় কাপড় দিবা।
এক হাত ঘোমটা টেনে হুজুরের দৃষ্টি সীমানা থেকে অপসারিত হয়েছিল সেদিন পাপন। বুকের মাঝে সেই ধক্ধক্ শব্দ!
আর্মির মাইর নাকি সহজে কেউ ভোলে না। বলেছিল আর্মির মার খেয়ে সারাজীবনের মত পঙ্গু হয়ে যাওয়া মন্টু ভাই। মহান জেনারেল এরশাদ সাহেবের স্বর্ণযুগে খাটের তলায় লেনিনের বই রাখার অপরাধে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বাঁশডলা দিয়ে দু পায়ের সব হাড়ই গুড়ো করে দিয়েছিল জেনারেল সাহেবের চেলারা। বেচারা মন্টু ভাই মাঝে মাঝে লাল পতাকা বহন আর উদীচীর রিহার্সেল রুমে গিয়ে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও‘ গাওয়া ছাড়া তৃতীয় কোন অপরাধের সাথে জড়িত ছিল বলে কেউ জানত না। মন্টু বেচারার স্বগতোক্তি এখনও মনে পড়ে- অগো মাইরের কোন মা বাপ নাইরে!
আর্মির মাইর না দেখলেও পুলিশের মাইর একবার দেখেছিল পাপন ওসির মেয়ে শাহীনের সাথে লুডু খেলতে গিয়ে। থানার সামনে লাল হাঁটার পথের দু ধারে নানান রকম ফুলের অসম্ভব সুন্দর বাগানও ওই তার প্রথম দেখা। কত রকমের ফুল-ডালিয়া, গাঁদা, গন্ধরাজ, স্থলপদ্ম, কত রকমের গোলাপ! থানা কে থানা নয়, স্বর্গপুরী মনে হয়েছিল প্রথম দর্শনে।
লুডু খেলা শুরু হবার কিছু পরেই ওসির মেয়ের সাজানো কক্ষের ওপাশ থেকে একটা তীব্র গোঙ্গানির মতন আওয়াজ। পাপনের হাত থেমে গিয়েছিল-
ওসির মেয়ে বলে-দান দেও, থামলা ক্যান?
--কী রকম একটা শব্দ, শুনলা তুমি?
-ওইটা কিছু না, চোর পিটায়। ওসির মেয়ে হাসতে হাসতে বলে।
-চোর পিটায়! পাপন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল।
-হা, ওইজন্য ওই জানলা আমরা খুলি না, আব্বায় রাগ করে। তুমি দেখবা?
শাহীন তাকে জানালার কাছে টেনে নিয়ে চোখ লাগিয়ে দেয়--ওই যে দেখ, ওইটারে আনছে আইজ।
পাপন আঠার মতন চোখ লাগিয়ে রাখে জানালার ফাঁকে। একটা যুবক বয়সী ছেলেকে দুহাত পিছনে বেঁধে উলটো করে ঝোলানো হয়েছে কড়ই গাছের ডালে। দুই সেপাই তার দুই পাশে বিশাল সাইজের লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে। ওসি কাছেই বাগানের ঘাস পরিষ্কার করছেন। গাছের ডালে ঝোলানো ছেলেটির মুখ দেখা যাচ্ছিল না।কিন্তু তার অসহায় গলার আওয়াজ শুনছিল পাপন
-ছার, আমারে ছাইড়া দেন গো, আমি চুরি করি নাই।
ওসি ঘাস বাছা বাদ দিয়ে মুখ তুলে সেপাইকে বলেন--এই কালাম, নাম্বার দুই দেও।
কালাম অনবরত একটার পর একটা লাথি মারতে থাকে গোঙ্গাতে থাকা ছেলেটির শরীরে।
ওসি বলেন-থাম, আবার জিগাও।
কালাম সেপাই শুরু করে--ক, আর কেডা আছিল তোর লগে!
--ছার, চুরি করি নাই-
ওসি হাসেন, অন্য সেপাইকে হাসতে হাসতেই বলেন--আফাজ, হারামজাদারে তিন নাম্বার ডোজ দেও।
আফাজ মাটিতে রাখা বাটিতে করে লেবু আর মরিচের গুড়ো মেশায়। আমোদিত মুখ নিয়ে তারপর তা লাগায় ছেলেটির দুচোখে। সেই হতভাগ্যের আর্তনাদ কোনদিন ভুলবে না পাপন। এখনো মনে হলে গা গুলিয়ে ওঠে ঘৃণায়-কষ্টে!
শাহীন বলে-এইবার হইছে দেখা? আসো দান দেও।
পাপন কোনভাবেই চোখ ফেরাতে পারছিল না। শাহীন অস্থির হয়--ওইটারে সারাদিন ঝুলাইয়া রাখবে; তুমি কি সারাদিন জানালার ফুটায় চোখ দিয়া দাড়াইয়া থাকবা নাকি? আসো, দান দেও।
পাপন জানতে চায়--তোমার খারাপ লাগে না শাহীন?
শাহীন মাটির দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলে-এখন আর লাগে না।
পাপন সেদিন আর লুডুর দান দিতে পারেনি। মানুষের উপর মানুষের বীভৎস অত্যাচারের দৃশ্য তার সমস্ত চেতনা অসাড় করে দিয়েছিল। অনেকগুলো রাত ঘুমাতে পারেনি তারপর। চোখ বুজলেই দেখত ওসির সেই ফুল বাগানে ঘাস তোলার দৃশ্য--পৃথিবীর কদর্যতম দৃশ্য!
ঘুম না আসা আরো অনেক এমন রাত কেটেছে পাপনের। যে রাতে দাদু মারা গেলেন, সারারাত চিৎকার করে কাঁদলেন দাদী; সেই রাত খুব কষ্টের ছিল। কি করে এক জীবন আর এক জীবনের সাথে এতটা জড়িয়ে যায়! পঁঞ্চাশ বছর একসাথে বসবাসের পর ও এত ভাললাগা-ভালবাসা কীভাবে বেঁচে থাকে, অবাক লাগে আজ ভাবতে গিয়ে! প্রায় ই মাঝ রাতে দাদুর সমাধি পাশে বসে দিনের যাবতীয় ঘটনা বয়ান করতেন বৃদ্ধা, যেন মানুষটি পাশেই বসে আছে! একাকীত্ব-নাকি সত্যি এমন কোনো প্রেম যা সবাই বোঝে না! ভালবাসা--শব্দটার সাথে এই দৃশ্যটা সবার আগে মনে ভাসে। পাপনের দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটা। পারবে ভালবাসতে কাউকে- এমন করে? অথবা রাধার মত করে? কারো জন্যে একশ বছর অপেক্ষা করতে পারবে-চাওয়া ভুলে, প্রাপ্তিকে শূন্য মেনে, নিজের যৌবনকে বিষণ্ণ করে দিয়ে? অনেক কঠিন হয়ত!
যেমন জীবন চায় সবাই কি তা পায়! কাউকে কাউকে হয়তো মেনে নিতেই হয় লোভী পুরুষের স্পর্শ জীবনভর! অথবা সেই মানুষটিই একদিন তার অন্য এক মাধুর্য দিয়ে ভুলিয়ে দিল সমস্ত স্পর্শের ব্যাকুলতা-এমন ও তো হয়! পাপনের জীবনেওতো এমন হতে পারে! পারে না?
পিছনে মৃদু একটি পায়ের শব্দ এগিয়ে আসে, পাপন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মা জানে সে তার একাকী সময় এখানে এসে দাঁড়ায়। মা কতকিছুইতো জানে। মেয়ের কিসে আনন্দ সেটুকু জানতে তার এত কিপ্টেমি কেন। মার হাত উঠে আসে কাঁধে। সারারাত আটকে থাকা জল এবার বন্যার মত গড়ায় দুচোখের কোল বেয়ে।
কান্নার কিছু হয়নাই; ওই বেশরম বান্দরের সাথে তোরে বিয়া দিবনা। মা পাপনের মাথা আগলে ধরে বলেন।
সেকথায় কান্নার বেগ বাড়ে। আবার একসময় থেমেও যায়। পাপন মনে মনে বলে,‘আমাকে পৃথিবীটা একটুখানি দেখতে দাও মা। দেখো, একদিন আমায় নিয়ে গর্ব করতে পারবে তুমি। প্রমিজ!’
মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বাইরের সিঁড়িতে বসেন। হয়ত না বলা কথাগুলোই শুনতে পান। কাছেই খোলা মাঠের অপর প্রান্তে নতুন সূর্য ধীরে ধীরে লাল হয়ে ওঠে।