তাদের মন্তব্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যর্থতার ফল
রিপন কুমার বিশ্বাস
সম্ভবত এর চেয়ে লজ্জার আর অপমানের কিছু হতে পারেনা যখন স্বাধীনতার তিন যুগ পর কেউ বলে, বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই এবং স্বাধীনতাবিরোধী ব্যাক্তিও নেই আর কোনোকালে ছিল না।
এই ভূল শুরু হয়েছে ৭২ সালে সাধারন ক্ষমা ঘোষনার মধ্য দিয়ে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান OIC সহ বিভিন্ন ইসলামি দেশের চাপে, অভ্যন্তরীন শান্তি শৃংখলা বজায় রাখতে, যুদ্ধবিদ্ধস্থ স্বাধীন বাংলাদেশে আর্ন্তজাতিক সাহায্য, সহযোগিতা এবং স্বীকৃতি অব্যাহত রাখতে, এবং মানবিকতার কথা চিন্তা করে সব যুদ্ধাপরাধীদের মাফ করেছিলেন।
গত ২৫শে অক্টোবরে নির্বাচনী সংস্কার প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠককালে সর্বজন নিন্দিত ৭১ এর আল-বদর এবং তৎকালীন জামায়েতে-ই-ইসলামি স্টুডেন্ট ফ্রন্ট এর নেতা ও সাবেক জোট সরকারের সমাজকল্যান মন্রী আলী আহসান মুজাহিদী বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রশ্নে যে ধৃষ্টতাপূর্ন মন্তব্য করেছে তা দেশের সমস্থ সাধারন মানুষ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত হেনেছে।
মাস কয়েক আগে একটা বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলে দেশের প্রথিতযশা লেখক এবং শিক্ষক ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল-এর একটা গল্প “আজব ছেলে”-এর নাট্যরূপ প্রচারিত হয়েছিল যেখানে আজব ছেলেটা সাথে অল্প কিছু শুকনা খাবার নিয়ে খালি পায়ে হেটে ঢাকা থেকে দেশের উত্তরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত অঞ্চল বিরামপুরে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।
আজব ছেলেটা বুঝতে চেয়েছিল তার মা কিভাবে ৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার সময় তাকে গর্ভে নিয়ে পায়ে হেটে, নাখেয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোষর রাজাকারদের খড়গ মাথায় নিয়ে ঢাকা-বিরামপুর ৩৬৫ কিঃ মিঃ পথ পাড়ি দিচ্ছিল। সে বুঝতে চেয়েছিল প্রখঢ় রৌদ্রে পিচঢালা রাস্তায় হাটতে হাটতে তার মায়ের পা দিয়ে কত রক্ত ঝরেছিল! আজকের বাংলাদেশ পেতে সেসময় কত মায়ের এরকম কষ্ট হয়েছিল! গল্পের কাহিনী অনুযায়ী আজব ছেলেটার মা শেষ পর্যন্ত বিরামপুরে তার জন্মের পর মারা যায়।
স্বাধীনতা পুর্ববর্তী সময়গুলোতে আমার বাবা বরিশাল ব্রজমোহন(বিএম)কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীকার আদায়ে সক্রিয় অবস্তান নিয়েছিলেন।ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনে আমার বাবা অন্যদের সাথে বাংলাদেশর মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করতে যেয়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাতে সবার অংশগ্রহনের প্রত্যাশা ছিল, কারন সে দাবি ছিল নিঃসন্দেহে যৌক্তিক।
৭১-এর মার্চ পরবর্তী সময়ে বাবা এবং তার বন্ধুদের একরকম পালিয়ে বেরাতে হোল শুধু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জন্য নয় বরং তাদের জন্য যাদের তারা চিন্তেন এবং যারা মনে করত বাংলাদেশ নামক একটা দেশের জন্ম হলে সে দেশটা হবে বাংলা সংস্ক্রিতির আবহে একটা গণতান্তিক দেশ যেখানে সাধারন মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হবে। তাদের ছিল ধর্মীয় উন্মাদনা, ছিল বাংলাদেশের চিরায়িত সংস্কিতির প্রতি চরম ক্ষোভ।
আমার গর্ভবতী মা-কেও সেসময় বাবার সাথে এখানে সেখানে পালিয়ে বেরাতে হলো। এপ্রিলের শেষের দিকে বাবা মা-কে নিয়ে ভারতের দিকে রওনা দিলেন, উদ্দেশ্য তাদের প্রথম সন্তানকে বাচানো আর বাবার মুক্তিবাহীনিতে যোগ দেওয়া। কখনও হেটে, কখনও নৌকায়, কখনও মাঝ রাতে হানাদের বাহিনীর বা রাজাকারদের ভয়ে লাফিয়ে ওঠা। প্রত্যক্ষ করেছেন অনেকের মৃত্যু।
ভারতে জীবন্ত পৌছঁতে পারলেও মা দীর্ঘদিন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন তাদের প্রথম সন্তান বাচেনি বলে। দেশে এসেও মা অনেকদিন সাভাবিক ছিলেন না।
এই পৃথিবীতে অনেক গণহত্যা হয়েছে, কিন্তূ ৭১-এর গণহত্যা, বিপর্যস্থতা, নির্যাতন, অথবা একটা জাতিকে চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা শুধু সুসংগঠিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে দিয়ে সম্ভব হয়নি, সম্ভব হয়েছে এদেশীয় তাদের ভাবাদর্শের মিত্রদের সাহায্যে।
বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকার দূর্নীতির বিরূদ্ধে কাজ করছে। অনেক বড় বড় কাজে হাত দিয়েছে যেগুলো তাদের অর্ন্তবর্তী সময়ে করার কথা ছিলনা। প্রতিদিন বিভিন্ন অনুষ্টানে, আলোচনায়, দেশে বিদেশে, সরকারের নীতিনির্ধারকরা সাধীনতা উত্তর সময়ের ছোট থেকে ছোট অপরাধ সম্পর্কে বলছেন এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট কাউকে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবেনা তা বারবার দৃড়ভাবে ব্যক্ত করছেন।
কিন্তু অব্যক্ত থেকে যাচ্ছে সেইসব অপরাধীদের কথা যাদের জন্য ত্রিশ লাখ মানুষ মারা গেছে, নির্যাতিত হয়েছে ৪৫০,০০০ নারী। দি নিউইর্য়ক টাইমস্-এর পহেলা এপ্রিল, ১৯৭১ এর সংখ্যা অনুযায়ী শুধু মার্চ ২৫-৩০, ৭১ এ ৩৫,০০০ সাধারন মানুস মারা গেছে এবং ৩০শে জুলাই এর সংখ্যা অনুযায়ী পাকিস্তানি সরকার দেশব্যপী ৩৫,০০০ এর মধ্যে ২২,০০০ রাজাকার নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুমোদন করেছিল।
গত ২৫শে জুলাই, ২০০৭-এ সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে যোগাযোগ উপদেষ্টা মেজর জেনারেল(অবঃ)এম এ মতিন বলেছেন যে সরকার দূর্নীতিবাজদের নির্বাচনে অংশগ্রহন ঠেকাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সাধারন মানুষও চায় দূর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ এবং সরকার। কিন্তু অপরাধ যদি হয় গণহত্যা, অপরাধ যদি হয় নারী নির্যাতন, অপরাধ যদি হয় কোনো একটা জাতিকে কিংবা তাদের সংস্ক্রিতিকে মুছে ফেলার চেষ্টা, অপরাধ যদি হয় ধর্মীয় উন্মাদনা কিংবা মানবতার বিরুদ্ধে, তাহলে কি তাদের জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত?
আইন করে শুরুতেই এই সমস্ত সাধীনতাবিরোধী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহন বা ভোটদানে বিরত রাখলে হয়ত তাদের ধবংসাত্নক মনোভাবকে উস্কে দেওয়া হবে এবং ধর্মীয় উন্মাদনা বৃদ্ধি পাবে। প্রয়োজন প্রতিটি যুদ্ধাপরাধীর তাদের ৭১ এর কৃতকর্মের জন্য স্বতন্ত্র বিচার প্রক্রিয়া আওতায় আনা যেমনটা বর্তমান সরকার করছে বিভিন্ন দুনীর্তিগ্রস্থ রাজনৈতিক
ব্যক্তিত্ব, আমলা ও অন্যান্য পেশাজীবিদের ক্ষেত্রে তাদের ছোট থেকে ছোট অপরাধের জন্য। ৭১ এর সাধারন ক্ষমার বিষয়টা একটা বিশেষ অবস্থা।
যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রসঙ্গে বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞ ডঃ এম জহির বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে ৭২ এর সাধারন ক্ষমার বিষয়টা কোনো আইনি বাধা নয়। রাষ্ট্র চাইলেই খুব সহজ়ে কমিশন বা বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এদের বিচার করতে পারে এবং যে কেউ যারা সেসময় বিভিন্ন নির্যাতন বা অত্যাচারের শিকার হয়েছেন তারা বর্তমান প্রচলিত আইনে মামলা করতে পারেন।
কিন্তু গত তিন যুগ ধরে এই যুদ্ধপরাধীরা এতটাই সুসংগঠিত হয়েছে যে সাধারন মানুষ কিংবা সেসময়ের নির্যাতিত বা অত্যাচারিতরা হয়ত মামলা করার ব্যপারে এগিয়ে আসতে চাইবে না। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় স্বদিচ্ছা বা পৃষ্টপোষকতা ছাড়া এ বিচারের বিষয়টা কখনই বেশিদুর আগাবে না। এর সবচেয়ে বড় প্রমান শহীদ জননী জ়াহানারা ঈমাম ও ৭১ এর ঘাতক দালাল নিমূল কমিটি’র ঐকান্তিক চেষ্টার বাস্তব পরিনতি না ঘটা।
যুদ্ধাপরাধীর বিচার এবং তাদের চলাচল ও অবস্থানের উপর প্রথিবীর প্রায় সব দেশ একটা শক্ত অবস্থানে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র "Denying Safe Havens to International and War Criminals Act of 1999" নামে একটা আইন করেছে যেখানে আন্তর্জতিক যুদ্ধাপরাধীদের হস্তান্তর ও বিচারের আওতায় আনা হয়। মার্কিন অভিবাষন কতৃপক্ষও এদায়ে অভিযুক্তদের সেদেশে প্রবেশ ও বহিষ্কারের অধিকার সংরক্ষন করে। বছর কয়েক আগে একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চাইলে ভারতের গুজরাট রাজ্যের মুখ্য মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কে ২০০২ সালে আহমেদাবাদে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় তার সংশ্লিষ্টতার জন্য বাধা দেওয়া হয়। আলোচিত ও সমালোচিত ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কে ১৯৮২ সালে দুজাইল শহরে ১৪৮ জন শিয়া মুসলিম কে হত্যায় সংশ্লিষ্টতার জন্য ফাঁসি দেওয়া হয়।
স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুধু এজন্য প্রোয়োজন নয় যে তারা ৭১-এ বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের বিপক্ষে সোচ্চার ছিল, বরং তারা আজও সোচ্চার।সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় উন্মাদনা, বোমা বিষ্ফোরন, মৌলবাদী তৎপরতার পিছনে ছিল সেই ৭১ এর পরাজিত শক্তি।
তিন যুগ পার হয়ে গেছে। রাষ্টীয়ভাবে কেউ এতটুকু প্রয়োজন বোধ করেনি সেই সব রাজাকারদের, পাকিস্তানি মিত্রদের কিছু বলতে যারা আজও বিভিন্নভাবে সোচ্চার তাদের সেই পুরোনো লক্ষ্যে পৌঁছতে। বরং তারা উল্টো পুরস্কৃত হয়েছে বারবার। যে পতাকাকে তারা কখনই শ্রদ্ধা করেনি তাকেই ব্যবহার করছে বিভিন্নভাবে। বাম অথবা ডান উভয়পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায় গিয়েছে দেশের সব্বোর্চ পর্যায়ে। কখনও হয়েছে মন্ত্রী, কখনও বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদুত।
বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকারের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মত রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা নেই অন্য কারো সাথে যেমনটা ছিল আওয়ামী লীগ-এর খেলাফত মজলিশের সাথে অথবা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিনপি)-এর সাথে জামায়াতে-ই-ইসলামি কিংবা ইসলামি ঐক্যজোট-এর। ৭৬ সালে জামায়াতে-ই-ইসলামির বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুর্নাগমন, গোলাম আজম এর নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া, এবং এর পর প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পৃষ্টপোষকতা ৭১-এর পরাজিত শক্তিকে শক্তিশালী এবং উৎসাহিত করেছে।
দেশে জঙ্গীবাদীদের উথথান, মৌলবাদী তৎপরতা, কিংবা ৭১-এর পরাজিতদের ধৃষ্ঠতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যর্থতার ফল। দীর্ঘদিন গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি ও সঠিক চর্চা না করা, রাজনৈতিক সদাচার ও সহনশীলতার অভাব, এবং যুদ্ধাপরাধী ও মৌলবাদীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতা ৭১-এর পরাজিতদের আজকের শক্ত অবস্থান তৈরী করেছে। এরকম অবস্থা চলতে থাকলে হয়ত অদূর ভবিষৎতে এও শোনা যাবে যে বাংলাদেশে কোনো স্বাধীনতা যুদ্ধই হয়নি, কোনো মানুষ মারা যায়নি, কিংবা কোনো অত্যাচার, নির্যাতন হয়নি।
২৯শে অক্টোবর, ২০০৭, নিউ ইয়র্ক
রিপন কুমার বিশাস ফ্রিল্যান্স লেখক