বাঙালি জাতির তীর্থভূমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সোনা কান্তি বড়ুয়




ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের স্বর্গের দ্বার ও ভূমিপুত্র মহান শিক্ষকগণ ছাত্রদের জন্য জ্ঞানতত্ত্বের মর্মভেদী দেবদূত বা ফেরেশতা। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্মানিত ৪ জন মহান কুলপুত্র শিক্ষক সহ ১১ জন ছাত্র আদালতের রায়ে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। সরকারের প্রীতি ও জনসাধারণের দেশপ্রেমে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি আসবে। বাঙালি কবির ভাষায়, ”প্রীতি ও প্রেমের পুন্যবাঁধনে যদি মিলি পরস্পরে, স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় আমাদের কুঁড়েঘরে।” বাংলাদেশের মিলিটারি রাজনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শত্র“ রুপে মনে করার কোন কারন নেই। লেখার মাধ্যম কলম মিলিটারির অস্ত্রের চেয়ে ও শক্তিবান। বিশ্ববিদ্যালয় “জ্ঞানই শক্তি” প্রচার করে। জ্ঞানই শক্তির আলো, মিলিটারিদের শক্তির অহমিকা দেশ ও জাতির জন্য অন্ধকার। তবে গণতান্ত্রিক সরকার মিলিটারি শক্তির সদ্ব্যবহার করতে জানে। মিলিটারি মার্কা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অভিশাপে আজ আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। উসে লোভী মানুষ সেনানায়ক নয়, চাই উসে মনুষ্যত্ব। বাংলাদেশ সেনা ইউনিফরম ধারীদের রাজ্যপাট বা জমিদারি নয়। মৃত্যুর পর মৃত্যু পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ছাত্রগণের আত্মায় স্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি, ”জয় বাংলা।”


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়াঙ্গনে বা খেলার মাঠে সেনাসদস্যদের তো কাজ থাকে না। দাদাগিরির অকাজের অনর্থক জামেলা পাকাতে সেনাসদস্যগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে অমানবিক ব্যবহার করার কোন দরকার ছিল না। কারন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, আমাদের পূজনীয় তীর্থস্থান। প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রীদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোর ঝর্ণাধারায় বিগত ২২শে আগষ্ঠ ২০০৬ সালে বাংলাদেশের সেনা বাহিনী সুশীল সমাজের ছাত্র ছাত্রীদের উপর হামলা করে শিক্ষক ও ছাত্রদের ধরে নিয়ে ৫ মাস যাবত অকথ্য অত্যাচারের মাধ্যমে কারার ঐ লৌহকপাটে বন্দী করে রাখা কি আইন সম্মত ছিল? স্বাধীন বাংলাদেশে নজিরবিহীন ন্যক্করজনক ঘটনার জন্মদিল বিপ্লবি ফ্যাসিবাদী মিলিটারি মার্কা তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আমার তীর্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেবদূর্লভ শিক্ষকগণকে চোখ বেঁধে রিমান্ডে নিয়ে তাঁদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে শারীরিকভাবে অত্যাচার করেছে। অথচ সরকার আজ ও যুদ্ধাপরাধীদের কোন বিচার করেনি। যত দোষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক নন্দঘোষদের। জামাত তো বাংলাদেশ সরকারের জামাইবাবু। জনতা সহ আমরা সরকারের এহেন বর্বর আচরনের তীব্র নিন্দা জানাই। আগুন নিয়ে আর খেলবেন না।


বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সেনাসদস্যদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি স্বীকৃত রাজনৈতিক কর্মসূচী হলো হরতাল। সেই হরতালেও বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ছাত্র শিক্ষকদের নামতে দেয়না পুলিশ। জোট সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে মধ্যরাতে পুরুষ পুলিশ বর্বর নির্যাতন চালিয়েছে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি, ঘাতক, দালাল, নারী নির্যাতন কারী জামাতে কি সরকারের পথপ্রদর্শক? মিলিটারি শাসকগণ তো আজ পাকিস্তানের গোলাম নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বপ্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ বপন করেছে এবং রাজাকার শাহ মোয়াজ্জেম প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ধ্বংস করতে যুদ্ধাপরাধী ও জামাতকে নিযুক্ত করে চলে গেছে।


সম্রাট অশোক তিনি তাঁর মিলিটারি শক্তি দিয়ে উড়িষ্যা (কলিঙ্গ) দেশ জয় করার পর দেখলেন দেশ রক্তগঙ্গায় ডুবে গেছে। গৌতমবুদ্ধের অহিংস নীতিতে দীক্ষা নিয়ে সম্রাট অশোক মানবাধিকারের ঘোষণা ”অহিংসা পরম ধর্ম” শিলালিপিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ভাষায়, “জগতের মধ্যে শ্রেষ্ট সম্রাট অশোক আপনার যে কথাগুলিকে চিরকালের শ্র“তিগোচর করিতে চাহিয়া ছিলেন তাহাদিগকে পাহাড়ের গায়ে খুদিয়া দিয়াছিলেন। ভাবিয়া ছিলেন, পাহাড় কোনকালে মরিবে না, সরিবে না, অনন্তকালের পথের ধারে অচল হইয়া দাঁড়াইয়া নব নব যুগের পথিকদের কাছে এক কথা  প্রতিদিন ধরিয়া আবৃত্তি করিতেই থাকিবে। পাহাড়কে তিনি কথা কইবার ভার দিয়াছিলেন। তোমার কীর্তির চেযে তুমি যে মহ
, / তাই তব জীবনের রথ,/ পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমারে,/ বারম্বার। / তাই চিহ্ন তব পড়ে আছে,/ তুমি হেথা নাই।”


জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের রাষ্ঠ্রক্ষমতা হাতে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজকে পিস্তল দিয়ে রাজনৈতিক ফাযদা তুলতে আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মনের তাঁরা আজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, রমেশ মজুমদার, ও ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হয়ে বিরাজমান। এই বিশ্ববিদ্যালয় যে কোন সরকারের শত্র“ নয়। কিন্তু পাকিস্তানের আই এস আই চট্টগ্রামে অনেক অস্ত্র,গোলা বারুদ ট্রাকে নানা জায়গায় পাঠিয়েছে এবং নানাকথা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে ক্ষেপিয়ে তোলেছে। পাকিস্তানের পরম শত্র“ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৪ সালের মে মাসে খালেদা জিয়ার জোট সরকার তিন যুব মহিলা লীগ নেত্রীর উপর পাশবিক নির্যাকন চালিয়ে প্রমান করল তারা ওই পাকিস্তানী মিলিটারি আর পুলিশেরই উত্তারাধিকারী। ১৯৭৫ সালের পর থেকেই রাজাকার আলবদর ও তাদের দোসররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিগত জোট সরকার ও হাওয়াভবন দলীয় ক্যাডার দিয়ে এক নতুন ধরনের ভেলকি দেখিয়ে গেল।


১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ব দলীয় রাষ্ঠ্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র আবদুল মতিন ও গাজীউল হক উভয়ই ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রস্তাব করলে চতুর্দিকে গগন বিদারী শ্লোগান ওঠে, “১৪৪ ধারা মানি না।” পাকিস্তান আমলে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারীর পরও ( ১৯৬৯ বা ৭০ সালে লে: জিয়া কি করেছিল?) ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে ”সিপাহী আন্দোলন ” হয় নি কেন? কারন মীরজাফর বা জাতীয় বিশ্বসঘাতক ছিল ত
কালিন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। ১৮৫৭ সালে মঙ্গল পান্ডে সাধারণ সিপাই হয়ে “সিপাহী আন্দোলনে” নেতৃত্ব দিয়ে বৃটিশের ফাঁসিকাষ্ঠে জীবন উসর্গ করেছিলেন। বাংলা ভাষা রক্ষার জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী মহান ভাষা আন্দোলনে রফিক, সালাম, বরকত সহ অনেক ছাত্র জনতা জীবন দান করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববাঙালির তীর্থস্থান। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে শহীদ মিনারের স্মৃতির সাগর তীরে দাঁড়িয়ে আজ আমরা সগৌরবে উচ্চারণ করি আমার লেখা কবিতা:


হে মোর চিত্ত গণতীর্থে জাগানো ধীরে
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের শহীদ মিনারের স্মৃতির সাগর তীরে।
বাঙালীর অন্তর জগতে সালাম-জব্বার-রফিকের কবর, কল্পবৃক্ষের তলে-
পঞ্চাশটি বছর ভিজিয়ে রেখেছে কোটি নয়নের জলে।
হেথায় দাঁড়িয়ে দু’বাহু বাড়ায়ে নমি ভাষা সৈনিকদের সুর্বণ জয়ন্তি।
বাংলা ভাষার অর্ঘ্যে পরমানন্দের বন্দন করি তাঁদের নীতি বিশ্বশান্তি।
ব্রহ্মপুত্র পদ্মা মেঘনা নদ-নদী ভরা বাংলাদেশ আমার,
সুরমা কর্ণফুলির বঙ্গোপসাগর
আনন্দ বেদনা সুখ দুঃখের স্মৃতিঘেরা এদেশ আমার।
সালাম বরকত রফিক জব্বারের ইহলোক কেড়ে নিল।
পাকিস্তানের রাক্ষুসী বুলেট রাত্রি অন্ধকার।
চলেছে শহীদদের জীবনদান যজ্ঞ, যুগ হতে যুগান্তর পানে-
শত্র“র সকল বন্ধন মাঝে ধরিয়া সাবধানে বাংলা ভাষার মশাল।
শুনিয়াছি মাতৃভাষার জন্য কত যে শহীদ অকাতরে দান করে গেল,
সাধ অহ্লাদ দুর্লভ মানব জীবন। শহীদ প্রাণ যুদ্ধক্ষেত্রে ও সহিয়াছে;
পলে পলে শক্রর আক্রমন বিষাদের জ্বালা-
নাম না জানা শহীদের অলিখিত স্মৃতিতে বিদ্যমান শহীদ মিনারে।
মসজিদ মন্দিরে যাবার আগে
বাঙালী মন হঠা
করে চলে যায় শহীদ মিনারে।
শহীদের আত্মদান দেখিয়াছি আমি, তাই কোরবানির মর্মার্থ
বিশ্লেষণ করতে চাই না আর। অগ্নিগিরী জেগে ওঠে শহীদ মিনারের পাশে।
আটই ফাল্গুনে দেখি কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে আগুন, যেন বাঙালী মনের অগ্নিগর্ভ।
কবি সরহপাদ বাংলাভাষা ও সাহিত্যের আদি পুরুষ চর্যাপদ যুগের
অশোকের শিলালিপির মত ইতিহাস বিজয়ী আমাদের শহীদ মিনার।
শহীদের কাফনের মত পবিত্র জাতীয় পতাকা ও সঙ্গীত আমাদের
বাঙালী অস্তিত্বের সর্বকালের অভিব্যক্তি একমাত্র মাতৃকণ্ঠস্বর।
যে কবিতাখানি সযতেœ করেছি রচনা আজ -
তার মাঝে হেরি আমি একুশের ভাষা সৈনিকদের বায়ান্নোর লাশ।
গালাম জব্বার রফিক বরকত জয় করে গেল পাকসেনার প্রেত
অট্টহাসি।
বাংলা বর্ণমালার ও জাতীয় অস্তিত্বের প্রতিসূত্রে উঠিছে উচ্ছসি।
হে মোর চিত্ত গণতীর্থে জাগোরে ধীরে-
শহীদ মিনারের স্মৃতির সাগরে তীরে।

জয় বাংলা। জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।