মানবতার মর্মভেদী দৃষ্টিপাত
সোনা কান্তি বড়ুয়া

ধর্মভিত্তিক রাজনীতির রক্তাক্ত কাহিনী ইতিহাসের আয়নায় বিরাজমান যুদ্ধাপরাধীরা আমাদের স্বাধীনতাকে নিয়ে তীব্র শ্লেষ, ব্যঙ্গবিদ্রুপ করার সাহস পায় কেমন করে? যুদ্ধাপরাধীরা জামাতি হয়ে সামন্তবাদী, মৌলবাদী সমাজের অসম নিষ্ঠুর সমাজব্যবস্থার প্রচারক এবং যে ব্যবস্থায় দুর্বল (আদিবাসী ও সংখ্যালঘু) শ্রেণীগুলিকে রাষ্ঠ্রক্ষমতার বৃত্তের বাইরে রেখে দেয় এবং শোষণ করার জন্যে ধর্মের বুলি ছাড়ে ধর্মভত্তিক রাজনীতি মানব জাতির কাছে অভিশাপ এবং ইহা মানবতাকে দু:খের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে ক্ষয় করেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়জনতার আদালতে যুদ্ধাপরাধীরা মানবতার দুশমন, রাষ্ঠ্রদ্রোহী, রক্তপিপাসু হায়না, রাষ্ঠ্রক্ষমতার অপব্যবহারে অভিযুক্তনারী, গরীব জুম্মা, সংখ্যালঘু,আদিবাসীরা দুর্বৃত্ত জামাতদের শিকার জামাতের ধর্মমার্কা চিত্রটি ধুলিসা করে দিল পাকি মিলিটারী নেতাদের বন্ধু হয়ে বাঙালিজাতিকে হত্যা ও ধর্ষণ করেধর্মের নামে লুন্ঠন হত্যা নারী পাচার ও মনুষ্যত্বের অবমাননা দুর্নীতি দাঙ্গা সন্ত্রাসবাদ এবং যুদ্ধ পাপ কর্মসমূহ অমানবিক ও দু:খদায়ক মানুষই মানুষের ঘাতক প্রাচীন ভারতে ও শাসকগোষ্ঠি বিশ্বমানবতাবাদ না মেনে বৈদিক ব্রাহ্মনদের জাতিভেদ প্রথায় সমাজ প্রতিষ্ঠা করার ফল ভয়াবহ ছিলউক্ত ভয় ও দু:খ থেকে মুক্তি পেতে মানবকন্ঠ থেকে আজ ও উচ্চারিত হয়, ”শান্ত হে, মুক্ত হে অনন্ত পুণ্য, করুণাঘন ধরণীতল করহ কলংক শুন্য” 

 পাকিস্তানের সামরিক নেতাগণ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের আম জনতাকে তিলে তিলে হত্যা করতে করতে বাংলাদেশে ত্রিশ লক্ষ জনতা হত্যা করেছে এবং  দুইলক্ষ মা-বোনের ইজ্জত নষ্ঠ করেছে প্রসঙ্গত: উক্ত ভয়াবহ চিত্র আমাদেরকে বৈদিক বাহিনীর প্রধান ইন্দ্র রাজা বৈদিকধর্মের নাম দিয়ে প্রাগৈতিহাসিক বৌদ্ধধর্মময় মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সহ সিন্ধুসভ্যতা ধ্বংসের প্রাচীন ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়।  ১৯৭২ সালে অত্যাচারীদের বিচার না করে তকালিন ভারত সরকার পাকিস্তানি ৯৩ হাজারের অধিক সৈন্যদেরকে মুক্তি দেবার কারন সমূহ আজকের বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান সরকারগণ ব্যাখ্যা করবেন কিউক্ত তিন সরকারগণই বাংলাদেশের জেনোসাইড বা গণহত্যাকারী পাকিস্তানী সৈন্যদের বিচার না করার জন্য দায়ী এবং আমরা আগামি বিশ্ব জেনোসাইড মহাসম্মেলন সহ আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে উক্ত তিন সরকারের বিরুদ্ধে (মানবতার বিরুদ্ধে) অপরাধের জন্য বিচার চেয়ে বাংলাদেশের জাগ্রত জনতা আবেদন করবেন

লক্ষ্যনীয় যে, বিগত ২য় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সৈন্যবাহিনী ও জাপান সৈন্যবাহিনী উক্ত একই ধরনের অপরাধের জন্য বিচারের সম্মুখীন হয়েছে এবং কৃতপাপকর্মের জন্যে ক্ষমা চেয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাষ্ঠ্র পাকিস্তান আজ ও উক্ত কৃতকর্মের জন্য সরকারীভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইনিঅসভ্য রাষ্ঠ্রের পরিনাম ফল খুবই ভয়ঙ্কর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কারনে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সৌদী আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে, জুলফিকর আলি ভুট্টোর মৃত্যুর পরে জিয়াউল হকের ইসলামি মৌলবাদ তুঙ্গে উঠে এবং শিখ মৌলবাদীরা ইন্দিরা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করে খালিস্তান দাবী করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কারনে মানবতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছেপাপ বাপকে ও ক্ষমা করে না বাংলাদেশের গণহত্যাযজ্ঞের  পাপরাশি মাথায় নিয়ে পাকসেনাদের সাথে দেশের জামাতী যুদ্ধাপরাধীরা ও মনে মনে খোদার আদালতে বিরাজমান এবং দিনে দিনে বাড়িতেছে পাপের দেনা, শুধিতে হবে পাপের প্রায়শ্চিত্তের বিপুল ঋণআজকের পাকিস্তানের সামরিক শাসক সুপ্রীম কোর্টের বিচারে দোষী এবং উক্ত দেশ অগ্নিগর্ভ।  ধর্মের নামে বাংলা ভাষা ও বাঙালিকে হত্যা এবং অপমান করার ফল পাকিস্তানকে পেতে হবে

জন্ম থেকে হিন্দু, মুসলমান, চাকমা, রাজাকার, জামাত নেতা, পাহাড়ী  বা দলিত আর ধনী  ব্রাহ্মণের মস্তিস্ক আলাদা নয়।  তবুও সামাজিক মিথ্যা জাতিভেদ প্রথার বেড়াজালে তৈরী হয় অধম মানুষ এবং উত্তম মানুষ বা ব্রাহ্মণ তৈরী করার অভিযান ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে মানুষের অধিকার প্রসঙ্গে রাষ্ঠ্রক্ষমতার সঙ্গে জনতার কেন যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক, কেন যে আবিস্কারের সঙ্গে এ্যাজেন্ডার সংঘাত বাঁধে ঘন ঘন, তার প্রমাণ হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার সায়ত্রিশ বছর (১৯৭১ - ২০০৭) পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন না করে দেশের প্রাক্তন সামরিক শাসকগণ রাষ্ঠ্রক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতির রসাতল রচনা করে গেল। 

 যুগ যুগ ধরে বৈষম্য আর বঞ্চনার শিকার বলে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের জুম্মা,পাহাড়ী, আদিবাসী সহ কোটি কোটি জনগোষ্ঠিজামাত মাফিয়া এবং সামরিক শাসক সহ কতিপয় রাজনীতিবীদগণ সম্মিলিতভাবে আদিবাসীদের বুদ্ধি বিকাশের সকল পথ বন্ধ করে দিয়ে কক্সবাজার ও বান্দরবানে চলেছে ইসলামি জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ জনশূন্য পাহাড়ে অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসা ঘিরে গড়ে উঠেছে জামাতী সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রআমার দেশের পাহাড় ঘিরে সবুজ ঝোপঝাড়রামু থানাধীন রাজারকুল ইউনিয়নের নারকেল বাগান হয়ে কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে গহিন অরণ্যের এক গ্রামের মাদ্রাসাটির মতোই কক্সবাজার জেলায় পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় অসংখ্য মাদ্রাসাঅনেক জায়গায় মাত্র ৫০ থেকে ১০০ গজের ব্যবধানে গড়ে ওঠেছে একাধিক মাদ্রাসাএসব মাদ্রাসার কোনটির -ই সরকারী স্বীকৃতি নেইএমনকি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশের বৌদ্ধধ্যান শিক্ষার বৌদ্ধ বিহারসমূহ ভেঙে ভেঙে গড়ে ওটা বিভিন্ন মসজিদে ধর্মীয় শিক্ষার নামে জিহাদী মার্কা সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।  সমান সুযোগ নিয়ে আদিবাসী সন্তানেরা বড় হতে পারলে জামাত বা সামরিক শাসকগণের সন্তানদের সমান স্কুলের পরীক্ষায় ভালো ফল করতোসোজা কথা, শারিরীক গঠনে হিন্দু, মুসলমান এবং আদিবাসীদের কোনো ভেদাভেদ নেই

বিশ্বহিন্দু পরিষদ সহ বিভিন্ন হিন্দু জঙ্গীবাদী সংগঠন সমূহ হিন্দু মন্দিরে বুদ্ধ পূজা না করে ও বুদ্ধকে হিন্দুর নবম অবতার বলেন এবং সম্রাট আকবরের আমলে মহানবী হযরত মুহম্মদের প্রচারিত একেশ্বরবাদনিয়ে আল্লাহ উপনিষদ রচনা করার পর  ও বাবরি মসজিদ ভাঙা হল কেন? রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মধর্মের মহিমার অনেক খবর গুরু জনদের আজ ও মনে আছে সম্প্রতি অনন্তকালের অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে ভারতের মুম্বাই মহানগরীর শিবাজী পার্কে স্বর্গীয় ড: আম্বেদকরের  পবিত্র সমাধি প্রাঙ্গনে লক্ষ লক্ষ জনতা (হিন্দু পত্রিকার ম্যাগাজিন ফ্রন্ট লাইন, জুন ১৫, ২০০৭) বুদ্ধ জয়ন্তির পবিত্র বুদ্ধ পূণিমা তিথিতে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন নির্যাতীত নিপীড়িত  দলিতদের নিরাপত্তার স্বার্থে ডঃ আম্বেদকর ১৯৫৬ সালের ১৪ই এপ্রিল ভারতের নাগপুর শহরে পাঁচলক্ষ দলিত নিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেনতারপর থেকে দলে দলে বীর জনতা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পর ভারতে ডঃ আম্বেদকর (ভারতের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী ও সংবিধান প্রণেতা) ক্রমে গড়তে চেয়েছিলেন পরস্পরকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার সমাজ, বিশ্বমৈত্রী ও ভালোবাসায় এক দেশকাল

বৈজ্ঞানিক ডারউইন এর বক্তব্যের সঙ্গে মনস্তত্ব মিশিয়ে তৈরী হয়েছে বিবর্তন বাদী সাইকোলজি, গবেষণার এক বড় শাখা ব্রাহ্মণ দলিতে মানসিকতার ফারাক এখানে নেই ব্রাহ্মণ সমাজে দলিতগণ পণ্য ছাড়া আর কিছুই নয়! এখন পণ্য অবশ্য সবাই, কিন্তু ভারতীয় সমাজে দলিত বড্ড সস্তা পণ্য বলে উঁচু জাতের লোকেরা আজও মনে করে থাকেতাই যখন তখন যে কোনো অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উঁচু জাতের হিন্দু জনগণ দলিতদেরকে অত্যাচার হত্যা ধর্ষণ এবং সম্পত্তি লুটে নেয় সম্প্রতি জাতিসংঘের একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে, সারা পৃথিবীতে নষ্ট সমাজের ঘৃণ্য নারী পাচারের কেন্দ্র হিসাবে ভারত এখন এক নম্বরে পোঁছার পর মানবতার প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কোথায় হারিয়ে গেল?

অথচ ভারতের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ মানবতার খাতিরে দলিত জনগোষ্ঠির কাছে কি ক্ষমা চেয়েছেন? ভারতবর্ষ তো আদ্ভুতুড়ে দেশযে সমাজে চূড়ান্ত দারিদ্র্য অশিক্ষা এবং দলিত জনগণমনের অবমাননা রয়েছে, সেখানে মানবধিকার আসবে কি করে? লোক দেখানো দূর্গা পূজা সহ দলিত সমাজ এবং নারীজাতিকে দৈনন্দিন জীবনে শ্রদ্ধা করতে শিখলে তবেই সমাজে মানুষের অধিকার ফিরে আসবে


লেখক সোনা কান্তি বড়ুয়া কথাশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও খ্যাতিমান বিবিধ গ্রন্থপ্রনেতা।