জয় বাংলায় যুদ্ধাপরাধীদের হত্যাযজ্ঞের বিচার চাই
সোনা কান্তি বড়ুয়াআজকের শুভ সংবাদ ”ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচন নিষিদ্ধে ইলেকশন কমিশন একমত” (ইত্তেফাক, অক্টোবর ৩১, ২০০৭)। কারন ধর্ম ও রাজনীতি দুটো আলাদা জিনিষ। ধর্মকে রাজনীতি নামে হালাল করে আমাদের জাতীয় জীবনে দু:খের মহাসমুদ্র রচনা করা হল। স্বার্থবাদী সমাজ সৃষ্ঠির শুরুতে ধর্ম গ্রন্থে রাজনীতিকে সনাতন জাতিভেদ প্রথায় স্বীকৃতি দেওয়া গেল। পরে ধর্মকে শাসক শ্রেণীরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সাধারণ জনগণমনের মানবিক অধিকার সমূহ কেড়ে নিয়ে যাবার নানা ঘটনা ইতিহাসে বিরাজমান। ধর্মের রসের হাঁড়িতে রাজনীতি কত মজাদার তা জেনে শুনে একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের কুখ্যাত নায়ক গোলাম আযম ”পাকিস্তান বিভক্তি ও বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের বিষাদময় কাহিনী” শীর্ষক ধূর্তামিনামা রচনা করে সে পাকি মার্কা ধর্মকে বাঙালি জাতি ও সংস্কৃতি বলার মিথ্যা রচনার সূত্রপাত করল ২০০২ সালে। এমন কি নানা ষড়যন্ত্র ও বিকৃতির কবলে গত বছরের ২৮শে অক্টোবরের সংঘটিত হত্যাকান্ড খুনের দায় এড়িয়ে সব দোষ ১৪ দলে উপর মিথ্যা আরোপ করে এখন ভিকটিম হতে চাচেছ জামায়াত (ইনকিলাব, ২৭ অক্টোবর, ২০০৭)।
জামাতের সাম্প্রদায়িক কার্ড বিপাকে এবং সম্প্রতি তাদের অন্যতম নেতা কুখ্যাত আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় বহে গেছে। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে দেশের জনতা সহ আমরা ” মানবতার দুই কানকাটা নির্লজ্জ যুদ্ধাপরাধীদের দুর্নীতি ও একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের বিচার চাই।” কারন পবিত্র ইসলাম ধর্মকে হাইজাক করে জামাতের জঙ্গিরা পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর বন্ধু হয়ে একাত্তরের হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল। দিনের পর দিন অঘটন - ঘঁটন পটীয়সীর দাবাখেলায় মনে হচ্ছে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশ আকণ্ঠ নিমজ্জিত। অনেকদিন থেকে আমাদের ইতিহাসের পাতা রক্তে ডুবে আছে। আজও মনে পড়ছে একাত্তরের পাকিস্তানের ধর্মমার্কা অন্ধকার রাজনীতির জোয়ারে পাকবাহিনী ও তার দোসর স্বদেশী রাজাকার সহ আলবদর চক্র সংখ্যালঘু নির্মূলকরণ অপরাধেও অপরাধী। বাংলাদেশের রাষ্ঠ্রক্ষমতা ও গণতন্ত্র নষ্ট রাজনীতির দুষ্ট জামায়েতের অধীনে নয়। কারন যে কোন ধর্মের পুরোহিত বা মোল্লা - মাফিয়ার ষড়যন্ত্র থেকে আজকের বাংলাদেশ মুক্ত নয়। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সহ গণতন্ত্রের বুক গ্রেনেডে বিধ্বস্ত। দিনের পর দিন আমাদের বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান মহিলাদের জীবন নিয়ে তথাকথিত ধর্মের ঠিকাদারেরা অমানবিক নির্যাতিন চালাচ্ছে। আর গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে রাষ্ট্রপতি নিয়ন্ত্রিত দেশে সংবাদ মাধ্যমে ঢাক বাজিয়ে কোনো লাভ নেই। খালেদা-সাঈদী ও নিযামীর শাসন কালের অনাচার, অবিচার ও বঞ্চনার বিচার কবে শুরু করবেন? আসল বিচারের ব্যবস্থা না করে দুর্নীতির মাফিয়া - চক্রে রাজনীতির মস্তক বিক্রয় করলেন মাসের পর মাস। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্টের আগে পাকিস্তান নামে কোন দেশের নাম পৃথিবীতে ছিল না। পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়দে আযম মোহাম্মদ আলি জিন্নার দৃষ্ঠিতে আমাদের হাজার হাজার বছরের বাপ দাদার পুরানো মাতৃভাষা ’বাংলা ভাষা’ ইসলামিক ভাষা নয়। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশকে হালাল করা হল কিন্তু পূর্ব বাংলাকে ধর্মান্তকরনে নামান্তর করে পূর্ব পাকিস্তান করে বাংলা সভ্যতা ও সংস্কৃতির দু:খের দিন রচনা কালে ধ্বনিত হল, ” যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী / সে সব কাহার জন্ম নির্নয় ন জানি।” ধর্মের জাদুমন্ত্র দিয়ে জামাতি তস্করগণ ধর্মভীরু বাঙালি মুসল্লীদেরকে কাবু করে রেখে হত্যাযজ্ঞের পাপ গোপন করে রাজনীতির সিংহাসন দখল করার স্বপ্নভঙ্গ হল কি? পাকি-পšী’ জামাতিরা পাকিস্তানের লাল মসজিদে কারবালার বিষাদ সিন্ধু রচনার কান্ড দেখে বুঝতে পেরেছে ”পাপ বাপকে ও ছাড়ে না।” আমাদের জাতীয় মনস্তত্বের গভীরে জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বের অন্ধকার দার্শনিক আল্লামা ইকবাল ও মহাত্মা গাšধীর অহিংসা, মৌলানা আজাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মানবতাবাদে পুরোপুরি আলোকিত হয়ে ওঠেছে। কারন ধর্ম নামক সাম্প্রদায়িক (জামাত, বি জে পি, মুসলিম লীগ, শিবসেনা) শক্তিসমুহের বিষদাঁত সমূলে উপরে ফেলতে হবে।
বাংলাদেশকে গায়ের জোরে জোট সরকার ও আই. এস. আই পাকিস্তানের ( ভোরের কাগজ, জুন ২৯, ২০০৭, ”কলকাঠি নাড়ে পাকিস্তান), অধীনে রাখার ষড়যন্ত্র বানানোর পরও একাত্তরের ওয়ারক্রাইমের বিচার নিস্পত্তি না করে অগুন্তি প্রশ্ন জিঁয়ে দিয়েছে আই.এস. আই-এর মনোনিত ইসলামিক জঙ্গী গুষ্ঠির সদস্যগণ। অথচ আমেরিকার প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি রামস্ ফিল্ড্ পদত্যাগ করতে না করতেই জার্মানের আদালতে তার বিরুদ্ধে ইরাকে ওয়ারক্রাইমের জন্য বিচারের দাবী করা হয়েছে। সরকার খোঁজ নিলেই দেখতে পেতেন, উক্ত আই.এস. আই-এ মনোনিত জোট সরকারের সদস্যগণ কেউ নিজ গুণে সদস্যপদ পান নি, কোনো না কোনো ভাবে ইসলামিক জঙ্গী ও রাজাকারদের গিভ্ এন্ড টেক্ নীতির পৃষ্ঠপোষনা করে পেয়েছেন। এইসব প্রাপকদের চেহারাগুলো কিন্তু নানা ধরণের। এমনকী বাইরে থেকে দেখেও বোঝার কোনো উপায় নেই, রাজাকার সহ পাকিস্থানের গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস. আই-এর কাছে কার শীরদাড়া কোথায় কতটা বিকিয়ে গিয়েছিল। কার টুপি কোথায় বাঁধা ছিল। ধর্মের নাম দিয়ে অনেক বছর ধরে হাজার হাজার ইসলামিক জঙ্গীরা নানা উপায়ে টাকা কামাচ্ছে, খালেদা-সাঈদী ও নিযামী মাফিয়া আমাদের সংবিধান এবং হাইকোর্টের দন্ডাদেশ না মানার সাহস করেছিল কেমন করে?
এই পরিবেশ একদিনে তৈরী হয়নি। এর পিছনে এক গভীর ষড়যন্ত্রের দ্বিজাতি তত্ত্বের ইতিহাস রচিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের গোড়ার দিকে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের একটি উপ অনুচ্ছেদ ১২২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা হয়েছিল, যার ফলে পাকিস্থানের দালালরা ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। এই প্রসঙ্গে ইহা উল্লেখ্য যে, একাত্তর সালে মতিউর রহমান নিজামী ও জামায়েতে ইসলামী দ্বারা সংখ্যালঘু ও মুক্তিবাহিনী হত্যার প্ররোচনার বহু সংবাদ ও দলীয় মুখপাত্র আছে। জেনারেল জিয়ার রাজত্বকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, বোমাং সহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে হত্যা, ধর্ষণ, অত্যাচারে মুসলমান বানানো হয়েছিল ছলে, বলে, কলে ও কৌশলে। দিনের পর দিন গভীর অরণ্যের চাকমা মেয়েদেরকে ধরে ধর্ষণ করেছে এবং মুসলমান ধর্ম অবলম্বনের জন্য বাধ্য করা হয়েছে। অনেক সংখ্যালঘু অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ভারতবর্ষে পালিয়ে গেছে।
তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্থানে সংখ্যালঘু নির্মূল করার লক্ষ্যে হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্ত করণ ইত্যাদি কাজ জামাতিরা করেছে দীর্ঘ নয় মাস। মুসলমান না হওয়া হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টান হওয়া ছিল অনেক মৃত্যুর কারণ। যেখানে সেখানে পুরুষের বস্ত্র উন্মোচন করে খাঁটি মুসলমান পরীক্ষা করো হতো এবং মুসলমান না হলে একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড। মুনতাসীর মামুন ” রাজাকারের মন” নামক বইয়ের একানব্বই পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘প্রায় সাত-আটশো লোককে আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলমান করা হয় এবং গরু জবাই করে মেজবানী বা প্রীতিভোজের ব্যবস্থা করার জন্য নবমুসলমানদের বাধ্য করা হয়, শুধু প্রীতিভোজের মধ্যে ফতোয়া সীমবিদ্ধ থাকে না। পিস কমিটির ইচ্ছানুযায়ী বিবাহযোগ্য মুসলিম কন্যাদের একটি অংশ কমিটির অনুগত যুবকদের বাড়িতে তুলে দেবরা ব্যবস্থা করা হয়। সমগ্র দেশে এ রকম ঘটনার প্রচুর প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রসঙ্গত; ১৯০৫ সালে ঢাকার বুকে মুসলিম লীগের জন্ম এবং শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেব ঐতিহাসিক লাহোর বৈঠকে পাকিস্থান প্রস্তাব করেছিলেন এবং পাশ করা হলো ২৩ শে মার্চ ১৯৪০ সালে যে দিনটি আজও “পাকিস্থান দিবস” নামে অভিহিত করা হয়। বাঙালিরা পাকিস্তানী নেতাদেরকে বিশ্বাস করে খাল কেটে কুমির এনেছে বাংলাদেশে।
প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা চলছে, বাংলাদেশকে পিছনে ঠেলে নিয়ে আরেক একটা পাকিস্থান বানানোর গভীর ষড়যন্ত্র। কিন্তু সত্য সর্বদা জয়ী। সত্য ও বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের কাছে উগ্রবাদী মোল্লাদের পরাজয় সুনিশ্চিত। মইত্যা রাজাকার সরল ধর্মভীরু বাঙালির চোখে মওদুদির পাকিস্থান মার্কা ইসলামের ধোকা দিয়ে মন্ত্রী হয়েছিল বলে কি খালেদার সাথে বাঙালিদের জীবন কিনে নিয়েছিল? জনতার দরবারে জনতার সরকার আসবে। জোট সরকার প্রধান বেগম খালেদা জিয়াই ছিল দুর্নীতির প্রধান কারণ ও নাটের গুরু। আবার রাজনীতির শতরঞ্জিতে ”সংবিধান বধ” কাব্যের মহড়ায় আসল দুর্নীতি ও হত্যাযজ্ঞকারী একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদেরকে গ্রেফতার না করে কদম কদম রাজনীতির পাঁচালী রচনা কেন? প্রশ্ন হচ্ছে, আজ ছত্রিশ বছর ব্যাপী রাজাকারতোষণে বাংলাদেশ কি সত্যিই কোনোভাবে লাভবান হয়েছে? না শুধুমাত্র লাভবান হয়েছে অন্ধকারমার্কা রাজাকারদের শক্তি? ফলে পরিচয় হবে, কে কা’র? উল্টো বাঁকের রাজনীতির রূপরেখায় রাষ্ট্রপতি শাসিত ষড়যন্ত্রের ডান্ডাবাজিতে আজকের তদারকি সরকার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার কবে শুরু করবেন?
লেখক এস বড়ুয়া কথাশিল্পী ও আন্তর্জাতিক গ্রন্থকার।