’ফিরিয়ে নাও, ঘাতক কাঁটা’
(স্বাধীনতার কবি প্রয়াত শামসুর রাহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে)এ জেড এম আবদুল আলী
বসেছিলাম, গতকালের (প্রথম আলো, ২০ আগস্ট ২০০৭) প্রথম আলো পত্রিকায় অধ্যাপক জাফর ইকবাল এবং পাকিস্তানের জি-ও টিভি চ্যানেলের নির্বাহী সম্পাদক হামিদ মীর এবং সংবাদ পত্রিকায় মুনীরুজ্জামানের লেখাগুলির উপর কিছু লিখব বলে। আমি এ কথা বলছি না যে এই তিনটি লেখার মধ্যে কোনও প্রত্যক্ষ যোগসূত্র রয়েছে। তবু লেখা তিনটিই উল্লেখযোগ্য এবং চমকপ্রদ। প্রথমেই জাফর ইকবালের লেখাটি সম্পর্কে কিছু বলব। জাফর ইকবাল এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে একজন। কাজেই তিনি কী বলেন, কী লেখেন এ নিয়ে আমি সব সময়ই চিন্তা ভাবনা করে থাকি। ’ভাই, দেশটা কোন দিকে যাচ্ছে?’ এই শিরোনামের লেখাটিতে নানা বিষয় নিয়ে লিখেছেন জাফর ইকবাল। লিখেছেন, এই সরকারকে বলা হয় সেনাবাহিনী-সমর্থিত সরকার। তার মানে অবশ্য এ নয় যে, অন্য নির্বাচিত সরকারগুলি ছিল সেনাবাহিনী অসমর্থিত সরকার। তবে, সেনাবাহিনীর ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর এই সরকারের অনেক ইচ্ছা-অনিচ্ছা নির্ভর করছে। এ টুকু পড়ে মনে হল, সরকার যদি দয়া করে একটি তালিকা করে জনসাধারণকে জানিয়ে দিত কোন কোন বিষয়ে তারা সেনাবাহিনীর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল, তা হলে ভালোই হতো। জনগণ জানতে পারতো এই সরকারের সীমাবদ্ধতা। যেমন মানুষের অল্পবিস্তর জানা আছে বিশ্বব্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের উপর উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলির নির্ভরশীলতার কথা। জাফর ইকবাল এরপরে একটি ঘটনার কথা লিখেছেন সেটি সবাইকে ভাবিয়ে তুলবে। তাঁর নিজের ভাষাতেই উদ্ধৃত করা যাক। তিনি লিখছেন, ”কিছুদিন আগে আমার কাছে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু কাগজপত্র এসেছে। সেখানে থেকে একটি অত্যন্ত বিচিত্র তথ্য জানতে পেরেছি। গত ২রা জুলাই স্থানীয় এরিয়া কমান্ডার হিসেবে সেনাবাহিনীর মেজর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে একটি বিভাগের পাঁচজন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়ার ’নির্দেশ’ দেন। উপাচার্য মহোদয় সেই নিয়োগপত্র ইস্যু করতে বাধ্য হন এবং রহস্যময় কারণে তিনি খুব গোপনে পদত্যাগ করে ফেলেন।” আমরা আশা করবো এই বিষয়টি নিয়ে অবিলম্বে একটি তদন্ত হবে এবং দোষী ব্যক্তি শাস্তি পাবে। নিয়োগগুলি নিয়মের বাইরে হলে সেগুলি অবশ্যই বাতিল হবে। জাফর ইকবাল আরও মত প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, এ দেশের মানুষ যখন নিজের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে তখন সে করতে পারেনা এমন কাজ খুব কমই আছে। কাজেই বর্তমান সরকার যেন এই মানুষগুলিকে তাদের ধৈর্যসীমার শেষ প্রান্তে ঠেলে না দেন। জাফর শেষ করেছেন, বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ টেনে। ওঁর মতে বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু এই দুটি শব্দ সমার্থক। আমাদের বর্তমান সেনাপ্রধান বলেছিলেন এ দেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধপরাধীদের বিচার হবে এবং বঙ্গবন্ধুকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে জাতির পিতা হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে বিষয়ে কোনও অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এর কারণটি ঠিক কী জানতে চেয়েছেন জাফর ইকবাল। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সেনাবাহিনী এরকম ঘোষণা দেবার কে? ঘোষণা তো দেবে সরকার। এখানেই বোধহয় সেই ’ইচ্ছা-অনিচ্ছার’ প্রসঙ্গটি সামনে এসে যায়। সম্ভবত এই বিষয়টিকে সরকার সেনা-ইচ্ছা নির্ভর।
পাকিস্তানি সাংবাদিক, একসময় ওসামা বিন লাদেন-য়ের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে পরিচিত এবং বর্তমানে ইসলামাবাদের জিও টিভি চ্যানেল-য়ের নির্বাহী সম্পাদক হামিদ মীরের লেখাটির শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ’নতুন পাকিস্তান জন্ম নি্েচ্ছ’। এই শিরোনামটি দেখেই এক সিনিক বন্ধু মন্তব্য করলেন, ’বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে কী? সেই শিশু তো যেদিন নিজামী-মুজাহিদ এ দেশের পতাকাবাহী গাড়িতে চড়েছেন সেদিনই জন্মেছে।’ হঠাৎ মনে পড়লো, দিন কয়েক আগে এক সাংবাদিক বন্ধু সাংবাদিক আলহজ্জ জহির, চট্টগ্রামে ক্রিকেট খেলার মাঠে যাঁর নাকে পুলিশ কর্মকর্তার ঘুষি মারার ছবি সারা দেশে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল, তিনি টেলিফোন করেছিলেন। উনি বললেন, জানেন, বর্তমানে জেলখানায় থাকা সা কা চৌধুরী মক্কায় গিয়ে নেওয়াজ শরিফকে বলে এসেছেন, একশ’ বছর পরে হলেও এ দেশকে তিনি আবার পাকিস্তান বানাবেন।
যাই হোক, এ সব আজে-বাজে কথায় সময় নষ্ট না করে দৃষ্টি দিই হামিদ মীরের লেখাটিতে। পাকিস্তানকে কী ভাবে একটির পর একটি সামরিক শাসন ধ্বংসের পথে নিয়ে গিয়েছে সে বিষয়ে বর্ণনা দিতে গিয়ে হামিদ মীর এক স্থানে বলেছেন, ”বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের ৩৬ বছর পর পাকিস্তানে এখন আর কেউ দাবি করে না যে, বাঙালিরা বিশ্বাসঘাতক ছিল। বরং আমরা বিশ্বাস করি, পাকিস্তানি সেনাশাসকরা হচ্ছেন আসল বিশ্বাস ঘাতক।”কতখানি সাহস থাকলে পাকিস্তানে বসেই আজ একজন সাংবাদিক এরকম কথা লিখতে পারেন। হামিদ মীর এখানেই থামেন নি, তিনি আরো লিখেছেন, ”৬০ বছর বয়সী এই দেশটি আরেকবার দৃঢ়তার সঙ্গে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত। পাকিস্তানিদের দৃঢ় বিশ্বাস, মোর্শারফই হবেন পাকিস্তানের সর্বশেষ সেনাশাসক। তাঁর পর আর কোনো জেনারেল পাকিস্তানের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার সাহস করবেন না। পাকিস্তানের সর্বশেষ সেনাশাসক দ্রুত তাঁর অন্তিম পরিণতির দিকে যাচ্ছেন।” এসব কথার মধ্যে সত্যতা কতখানি আছে কে জানে? কিন্তু যা এখানে উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে, এ ধরনের লেখালিখি পাকিস্তানে প্রকাশ্যে হচ্ছে, যা আগে কেউ কল্পনাও করতে পারতেন না। কদিন আগে পাকিস্তানে একটি বইয়ের উপর দি ইকনমিস্ট পত্রিকার সমালোচনা পড়েছি। বইটির নামই বলে দেবে কী তার বিষয়বস্তু। আয়েশা সিদ্দিকা রচিত এই বইটির নাম, ’দি মিলিটারি ইন্ক্ : ইনসাইড দি মিলিটারি ইকনমি অফ পাকিস্তান (The military Inc.: Inside the military economy of Pakistan)।’
চলে যাই বন্ধু মুনীরুজ্জামানের লেখাটিতে, ’বিএনপি জামাত থেকে বিএনপি জামাত’ শিরোনামে তাঁর এই লেখাটিতে বর্তমানে দেশের সরকারের অগ্রাধিকারগুলি দেখে তার মনে হয়েছে, বর্তমান সরকার আবার নতুন করে বিএনপি-জামায়াতকেই একটু সাফসুতরো করে ক্ষমতায় বসাতে বদ্ধপরিকর। লেখাটি মুনীরুজ্জামান শেষ করেছেন একটি বেশ ভালো রসিকতা (জোক) দিয়ে। ”সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অনেক জোক্স চালু হয়েছিল। এর মধ্যে একটি ছিল এ রকম। প্রশ্ন : সমাজতন্ত্র কাকে বলে? জবাব : সমাজতন্ত্র হলো পুঁজিবাদ থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের সবচেয়ে দীর্ঘ, কঠিন ও যন্ত্রণাদায়ক পথ। তেমনি এখন যদি বলা হয় সংস্কার কাকে বলে? উত্তরে বলতে হবে, সংস্কার হচ্ছে : বিএনপি-জামায়াত জোটের অপশাসন, দুর্নীতি আর লুটপাট থেকে পুনরায় বিএনপি-জামায়াত জোটের অপশাসন, দুর্নীতি আর লুটপাটের ক্ষেত্র তৈরি করার দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা Ñ তাহলে কি তাদের খুব দোষ দেয়া যাবে।”
এই তিনটি লেখা নিয়ে কিছু একটি লিখব ভাবতে ভাবতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খবরটি এল। ত্চ্ছু একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে অগ্ন্যুৎপাত কদিন ধরে ঘটে গেল টেলিভিশনে দু তিন দিন ধরে সেটি দেখতে দেখতে আমার মনে পড়লো আনওয়ার শাহাদাত বলে এক তরুণ ঔপন্যাসিকের ’সাঁজোয়া তলে মুরগা’ নামক একটি উপন্যাসের কথা। বাজারে এক ক্রেতার হাত থেকে ছুটে যাওয়া একটি মোরগের সেই সময় পথ দিয়ে যাওয়া একটি ট্যাঙ্কের নিচে পড়ে যাওয়ার ঘটনায় কী ভাবে গোটা শহরব্যাপী এক আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল সেটিই ছিল উপন্যাসটির মূল কথা। সেদিন সব স্লোগান ছাপিয়ে একটি স্লোগান উঠেছিল, ’ঢাকার রাস্তায় ট্যাঙ্ক কেন?’
এ লেখার প্রথমেই আমাদের মনে হয়েছিল, ওই তিনটি লেখার মধ্যে কোন যুগসূত্র নিশ্চয়ই নেই। কিন্তু লেখাটি শেষ করতে গিয়ে আবার নতুন করে ভাবনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সনের পর পনেরো বছর ছিল সেনাশাসন। ১৯৯০ সনের পর যে রাজনৈতিক দলগুলি প্রাধান্য সব চাইতে বেশি অনুভর করা গেল সে দুটি দলেরই জন্ম ক্যান্টনমেন্টে। অন্যদিকে সেনাবাহিনী তো রইলই। পাকিস্তানে যা ছিল প্রকৃতপক্ষে ১৯৫৮ সন থেকে, সেই মসজিদ ও মিলিটারির প্রাধান্য বাংলাদেশেও এসে গেল (এ বিষয়ে পাকিস্তানি লেখক হোসেন হাক্কানি’র ’পাকিস্তান বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি’ দ্রষ্টব্য)। একদিকে রইলো আওয়ামী লীগ অন্যদিকে রইল ধর্মাশ্রয়ী দুটি রাজনৈতিক দল। এই সেদিনও বেগম জিয়া তাঁর বিদ্রোহী মহাসচিব মান্নান ভুইঞা সম্পর্কে বলেছেন, ’উনি বিএনপি করবেন কী করে? উনি তো ধর্ম মানেন না।’ এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন।
এই মন্তব্যগুলি তাৎপর্য একটু ভেবে দেখা প্রয়োজন। বাংলাদেশেও কী আজ সেই অবস্থা? একদিকে সেনাবাহিনী। এবং সেই একই দিকে মসজিদ এবং মোল্লাদের প্রতিভূ জামাত-বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি। এদের সম্পূর্ন বিপরীত অবস্থানে আওয়ামী লীগ বা চৌদ্দদলীয় মহাজোট। তা না হলে, রাস্তায় মোরগের ট্যাঙ্কের তলে মৃত্যুকে কেন্দ্র করে, ’ঢাকার রাস্তায় ট্যাঙ্ক কেন?’ স্লোগান উঠে গেল কেন? সামান্য-তুচ্ছ কয়েকজনের কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে ’জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার কর?’ ’সেনাবাহিনী প্রত্যাহার কর?’ এই সব দাবি উঠে গেল কেন?
আমাদের বর্তমান সরকারের হাতে এখনো এক অসামান্য সুযোগ আছে। দেশকে একটি স্থায়ী গণতন্ত্র উপহার দেওয়ার সুযোগ। এই একটি বিষয়ে তাঁরা তাঁদের নিজেদের ’ইচ্ছা’ নির্ভর হয়ে থাকুন। এবং জনগণকে সে ব্যাপারে নিশ্চিত করুন। কী ভাবে করবেন তা জানতে হলে ওই রাস্তায় থাকা ছাত্র জনতার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন।