এক মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়?
এ জেড এম আবদুল আলীহাতে একটি বই এসেছে। ২০০০ সনে আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে বাংলায় লেখা বইটির শিরোনাম হচ্ছে, ’আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’। বইটির তিনটি সংস্করণ হয়েছে। শেষ সংস্করণটি হয়েছিল ২০০৩ সালে। এ রকম বই খুব বেশি না পড়লেও বইটির বক্তব্যের সাথে মোটামুটি পরিচয় আছে। খবরের কাগজের কলামে, বিদেশ থেকে পাঠানো ইংরেজি কাগজের চিঠিপত্রের কলামে এ ধরনের বক্তব্য ইদানীং, বিশেষ করে ১৯৭৫ সনের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর, অনেক লেখালিখি হয়েছে। বিএনপি, জামাত, রাজাকার, আলবদর ইত্যাদি সংস্থার আদর্শের সাথে মিল রেখে এ ধরনের লেখার আজকাল খুব কমতি নেই। এঁদের লেখায় বঙ্গবন্ধুকে শুধু মাত্র শেখ মুজিব বলা হয়, কিন্তু মিস্টার জিন্নাহ্কে যথা সম্ভব কায়দ-ই-আযম হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এদের চোখে জিয়াউর রহমান সবসময়ই শহীদ জিয়া। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কেবল মাত্র মৃত, বা বড়জোর প্রয়াত শেখ মুজিব। যাই হোক, কয়েকটি পাতা উল্টেপাল্টে দেখে হয়তো বইটি ছুঁড়ে ফেলতাম হয়তো। বই ছুঁড়ে ফেলা সম্পর্কে ডরোথি পার্কারের একটি বক্তব্য আমার খুব পছন্দ। একটি বইয়ের সমালোচনা লিখতে গিয়ে উনি লিখেছিলেন, “This is not a novel (book) to be tossed aside lightly. It should be thrown with great force.” (এটি হাল্কা ভাবে নেড়ে চেড়ে ছুঁড়ে ফেলার মতো একটি বই নয়। এটিকে খুব জোরে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া উচিৎ)। আমিও মিজ পার্কারের ওই দ্বিতীয় পরামর্শ মতো কাজটি করতাম। ঠিক ওই সময়েই একটি জায়গায় এসে চোখ আটকে গেল। মনে হল, এ তো একটি অত্যন্ত মূল্যবান চিন্তা ধারা! এ রকম কথা তো বিএনপি, জামাত, রাজাকার বা আলবদর সমর্থকদের কোনও লেখাতেও পড়িনি। পড়তে শুরু করলাম। পাঠকদের অবগতির জন্য সম্পূর্ণ অংশটিই উদ্ধৃত করা গেল। লেখকের বক্তব্য, ”উল্লেখ্য, ২০০০ ইং সালে জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারীকে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের ফলে কথিত বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের নাচা-নাচি ও হৈ-হুল্লোরেরর মাত্রা অনেকাংশে বেড়ে যায় উলুধ্বনিসহকারে এবং রাধাকৃষ্ণের সাজে সজ্জিত হয়ে এ দেশের মুসলমান তরুণ-তরুণীদের আনন্দ মিছিল চলতে থাকে দেশব্যাপী দিনের পর দিন। এছাড়া বাঙালী ঐতিহ্যের নামে মঙ্গল প্রদীপ, রাখিবন্ধন, সিথিতে সিঁদুরসহ নানাবিধ হিন্দুয়ানী সামাজিক আচার-আচরণকে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মাঝে জনপ্রিয় করে তোলা হচ্ছে। একই সাথে সূক্ষ্মভাবে ওপার বাংলার বিধর্মীদের সাথে মুসলিম তরুণীদের বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে সুপরিকল্পিতভাবে। বর্তমানে তা মুসলমান নামধারী মহিলা শিল্পীদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলে তার ক্ষেত্র অচিরেই আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত হবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। ফলে সেদিন হয়তো খুব দূরে নয়, যখন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা আমাদের দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং সর্বোপরি আমাদের মুসলিম পরিচিতিকে মুছে ফেলার জন্য যেমন সোচ্চার হবে, তেমনি ’৪৭-এ ভারত বিভক্তির পূর্বাবস্থায় এদেশকে নিয়ে যাবার জন্য তারা আরো বেশী মাত্রায় তৎপর হবে (পৃষ্ঠা-৮১)।” আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-য়ের পিছনে এত বড় ষড়যন্ত্রের উদঘাটনের নায়ক ১৯৫২ সনের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র হত্যার বিষয়ে কোনও মতামত আছে কি না তা দেখতে চাইলে সেখানে ব্যর্থ হতে হলো। যদিও এই লেখক ১৮৮৫ সনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের ইতিহাসের অনেক ঘটনারই সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করেছেন তাঁর এই ১৪১ পৃষ্ঠার বইতে।
কী অসাধারণ দূরদৃষ্টি লেখকের । কী চমৎকার এই বিশ্লেষণ। এই বইটি না পড়লে জানাই যেত না যে, বাংলাদেশের মুসলমানদের মুসলমানত্ব ধ্বংস করার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাতে জাতিসংঘের ইউনেস্কো পর্যন্ত জড়িত হয়ে আছে। বলাবাহুল্য, এখনই এ সম্পর্কে জাতিসংঘের কাছে একটি প্রতিবাদ লিপি পাঠানো উচিৎ। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি এরকম এরকম একটি ঘৃণ্য পরিকল্পনার বিরুদ্ধে লেখকের এখনই প্রতিবাদ করা উচিৎ। ওঁর কথায় কাজ হতে পারে, উনি সেই অবস্থাতে আছেনও। সে কথায় পরে আসা যাবে। আপাতত এই লেখকের আরো দু একটি উক্তির উপর চোখ বুলানো যেতে পারে। বইটির পৃষ্ঠা ৪২-তে লেখক লিখছেন, ”স্বাধিকার আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য ৭১-এর ২৫য়ে মার্চ দিবাগত রাতে সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সংঘটিত হয় বিশ্বের ইতিহাসে বৃহত্তম গণহত্যা। শেখ মুজিবকে বন্দী করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন ২৬শে মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলামায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। দেশব্যাপী মুক্তিপাগল জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন-মরণ সংগ্রামে।” জানিনা, লেখক কতখানি সতর্ক ছিলেন এই অংশটুকু লেখার সময়। ’বাংলামায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান’ শব্দগুলিতে হিন্দুয়ানীর গন্ধ কি লেখক পান নি? এ তো বঙ্কিমের ’বন্দেমাতরম’ শব্দের মতো শোনাচ্ছে। শোনা যায়, গভর্নর মোনায়েম খান একবার বলেছিলেন যে তিনি নিজে খুব ’গোঁয়ারগোবিন্দ’ লোক। তখন শ্রোতা ভদ্রলোক মোনায়েম খানকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে, স্যার নিজেকে যত খুশি ’গোঁয়ার’ বলুন কিন্তু ’গোবিন্দ’ বলবেন না। ওই শব্দটি একেবারে খাঁটি হিন্দু দেবতার নাম। যাইহোক, এরপর এই লেখক এই বইয়েরই ৪৭ পৃষ্ঠাতে লিখছেন, ”অতঃপর ২৬শে মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা সংবলিত নির্দেশনা অথবা ২৭শে মার্চ মেজর জিয়া কর্তৃক প্রকাশ্য স্বাধীনতা ঘোষণার কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতার কোন উল্লেখ ছিল না বরং উভয় ক্ষেত্রেই ইসলামী মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্তায়লার সাহায্য কামনা করা হয়েছে।” মনে হচ্ছে, লেখকের ইতিহাস পাঠ এত গভীর যে তিনি মনস্থির করতে পারছেন না যে, ঠিক কোন তারিখে কে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল বললে ওঁর সুবিধা হয়। যদিও ওই বইয়ের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনদিনই স্বাধীনতা ঘোষনা করেন নি। জিয়াউর রহমান কালুরঘাটে ড্রামের উপর দাঁড়িয়ে সুইচ টিপে দিয়েছিলেন আর সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল।
এই বইয়ের ভূমিকাতে লেখক তাঁর অতি মূল্যবান মন্তব্য প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, ” ... রাজনৈতিকভাবে এ দেশের স্বাতন্ত্র্যকে মুছে ফেলার জন্য দেশের এক দশমাংশ ভূখ- (পার্বত্য চট্টগ্রাম)-কে অন্যের দখলদারীত্বে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।” কেন যে আজ পর্যন্ত এই চুক্তি বাতিল করা হলো না এই কৈফিয়ত এখন নিশ্চয়ই তলব করা যেতে পারে। লেখকের লেখায় কোথাও এদেশে পাকিস্তানের আইএসআই-য়ের (ISI) কথা উল্লেখ নাই। তবে প্রায় সর্বত্রই আছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ’র’ (RAW) এর অপতৎপরতার কথা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ’র’-য়ের হাতের পুতুল ছিলেন সে সম্পর্কে লেখকের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। শেখ হাসিনার সরকারটি যে এ দেশের স্বাধীনতা ভারতের হাতে তুলে দিতে চায় তা তিনি স্পষ্ট ভাবে জানেন। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তাই তিনি লিখছেন, ”একুশ বছর পর এ দলটি ক্ষমতায় এসে জাতীয় শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেশকে আবার ভারতনির্ভন করে তুলেছে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির দাবিদার হলেও এরা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে এদেশের স্বাধীন সত্তার বিরুদ্ধে কাজ করছে। দেশের স্বার্থের চেয়ে প্রতিবেশী ভারতের স্বার্থকেই তারা রক্ষা করে চলেছে। দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক কর্মকা-, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি সবকিছুই আজ ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলছে। গোটা দেশকে ভারতীয় বাজারে পরিণত করা হয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে বাংলাদেশ আজ প্রতিবেশী ভারতের সুপরিকল্পিত পণ্য ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার।”
ইতিহাস ও অর্থনীতির এই প-িত ব্যক্তির অবশ্য দৃঢ় বিশ্বাস যে ২০০১ পরবর্তী বিএনপি-জামাত জোট সরকার এই অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে বাঁচাবে। আওয়ামী লীগৈর আমলে বাংলাদেশ সিকিমের ভারতভুক্তির পূর্বাবস্থায় বিরাজমান ছিল। জোট সরকার সেই অবস্থা থেকে দেশকে সত্যিকারের একটি স্বাধীন ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করবে। সব শেষে এই লেখকের আর একটি আবিস্কারের কথা না লিখলেই নয়। উনি লিখছেন, ”১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়।” যে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন সেই রবীন্দ্রনাথকেই এই বিশ্ববিদ্যলয় প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছর পরে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনেই তিনি বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অমূল্য তথ্যটি লেখক কোনখান থেকে পেলেন? যদি দয়া করে তিনি এই তথ্যসূত্রটি জানাতেন তাহলে এ দেশের এবং ভারতের রবীন্দ্র গবেষকগণ (যথা প্রশান্ত পাল) অনেক উপকারীত হতো। শোনা যায়, এই তথ্যটি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কোন বইতে আছে। কোনও পাঠক বা এই বইয়ের লেখক যদি সেই গ্রন্থটির নাম বলতেন তাহলে দেশবাসীর জ্ঞানবৃদ্ধি হ’ত।
এই পর্যায়ে ধৈর্যশীল পাঠকগণ নিশ্চয়ই বলে বসবেন যে, কেন বইটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে না। ভিত্তিহীন এই সব উক্তি কতক্ষণ তাঁরা সহ্য করবেন। নিঃসন্দেহে আমি তাই’ই করতাম। কিন্তু এক জায়গায় একটু অসুবিধা হচ্ছে। বইটির লেখকের নামটি একটু খটকার কারণ হয়েছে। দেখা যাচ্ছে এই বইয়ের লেখক হচ্ছেন, জনৈক মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন, বীরপ্রতীক, পিএসসি। আমাদের নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায় সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে এই নামে একজন আছেন। তিনিই কী এই ব্যক্তি? এত সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন, এত আওয়ামী লীগ বিদ্বেষ ও ভারত-বিদ্বেষ সম্পন্ন একজন ব্যক্তি নিশ্চয়ই ’নিরপেক্ষ’ সরকারের সদস্য হতে পারেন না? ইনি মুক্তিযুদ্ধেই বা কি কারণে যোগ দিলেন? সব ব্যাপরটিই কেমন যেন গোলমেলে ঠেকছে।
আশাকরি এই রহস্যটি কেউ ভেদ করবেন।