নিউইয়র্কে বাঙালির ঈদ
আদনান সৈয়দ
যারা বাংলাদেশে বসে ভাবছেন নিউইয়র্কে ফিরিঙ্গিদের শহরে বাঙালিদের আবার ঈদ কিসের তাদের মুখে ছাই দিয়ে সবিনয়ে বলতে চাই নিউইয়র্কে বাঙালিদের ঈদের আনন্দ এখন বাংলাদেশের যেকোন শহরের ঈদের আনন্দের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। বরং ঈদকে সামনে রেখে বাঙালির হাজার রকমের জল্পনা-কল্পনা আর হিসেব-নিকেশ দেখে মনেই হয় না যে নিউইয়র্কের এই প্রবাসী বাঙালিরা তাদের প্রিয় জন্মভুমি বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরে আছেন।
যদি প্রশ্ন করা হয় নিউইয়র্কে বাঙালিরা ঈদের আনন্দটাকে কীভাবে উপভোগ করেন তাহলে এর ঝটপট উত্তর হবে শপিং, লং ড্রাইভ, ঈদের দিন দেশে ফেলে আসা প্রিয়জনদের সাথে ফোনে কথপোকথন আর ঈদের দিন এ বাড়ি-ও বাড়ি নিমন্ত্রন খেয়ে। রোজা শুরু হবার পর থেকেই নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এর প্রতিটি কাপড়েরর দোকানে থরে থরে সাজানো রঙিন পোষাক-আসাকের মনোরম ডিসপ্লে ঈদের আপাত উপস্থিতি জানান দিয়ে যায়। ঈদ উপলক্ষ্যে প্রতিটি দোকানে বিশেষ সেলের ধুম হ্্রৎপিন্ডে নাচন ধরে। ” বাই ওয়ান এন্ড গেট এনাদার ওয়ান ইন হেফ প্রাইস!!” । জ্যাকসন হাইটস এর বাংলাদেশ প্লাজায় এলে আপনি যে বাংলাদেশের মৌচাক, চাদনি চক অথবা টুইন টাওয়ার শপিং মল বলে ভুল করবেন তা একরকম চোখ বুজেই বলে দেওয়া যায়। এখানকার ছোট ছোট দোকান গুলোতে অসম্ভব সৌখিন ভাবে থরে থরে সাজানো লেটেষ্ট ডিজাইনের পাজামা-পাঞ্জাবি, শাড়ি, সেলোয়ার-কামিস, ফতোয়া, টুপি, টিপ, রেশমি চুড়ির বাহার দেখলে সত্যি ভিমরি খেতে হয়। এসব ছাড়া কি আর বাঙালির ঈদ জমেরে ভাই! এদিকে জ্যাকসন হাইটস এর ৩৭ এভিনিউ, ৭৩ স্ট্রিটের ফুঠপাতের উপর প্রতিদিনই বসছে বাংলাদেশের বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনের ফুটপাতের মতই ছোট ছোট পসরায় সাজানো দোকান-পাট। এখানে পাওয়া যাচ্ছে আগর বাতি, আঁতর, তাবিজ, তজবি, জরির কাজ করা ঈদের টুপি, সুরমা, আযানের এলার্ম দেওয়া ঘড়ি থেকে শুরু করে গৃহ¯া’ালীর প্রয়োজনিয় জিনিশপত্র পর্যন্ত। ৭৪ স্ট্রিট জুড়ে রয়েছে আমাদের বঙ্গ ললনাদের অসম্ভব প্রিয় জায়গা অসংখ্য ঝকমকে জুয়েলার্সের দোকান। জ্যাকসন হাইটসতো বটেই প্রায় প্রতিটি শহরেই থাকছে বাঙালির কাচাবাজারের জন্য ঠাটারিবাজার, হাটবাজার অথবা শব্জি-মন্ডির মত দোকান পাট। মোট কথা একটা ফাটাফাটি ঈদ উদযাপনের জন্য বাঙালির যা যা উপকরণ প্রয়োজন তার সবকিছুই এই নিউইয়র্কের বাঙালিরা তাদের হাতের নাগালের মধ্যে পেয়ে যাচ্ছেন। আর সে কারনেই ঈদের বাজার কে সামনে রেখে প্রতি সপ্তাহান্তেই বাঙালিরা উপচে পরেন তাদের প্রিয় শহর জ্যাকসন হাইটসএ। চার দিকে বাঙালির কিচির-মিচির, হৈ-হট্ট গোল, গান-বাজনা সবমিলিয়ে জ্যাকসন হাইটস এর আলো-বাতাসে তখন বাঙালির আনন্দের নাচন ধরে। নিউইয়র্কের আশেপাশের শহরগুলো থেকেতো বটেই অনেক দূর দুরান্ত থেকেও বাঙালিরা চলে আসেন তাদের এক চিলতে বাংলাদেশ অর্থাৎ জ্যাকসন হাইটসে শুধুমাত্র এক চুমুক বাঙালি নিঃশাস পেতে। সপ্তাহের প্রতিদিন বিকেলেই দোকানে দোকানে হাজার রকমের ঝকমারি জিনিসপত্রের বাহার আর তার উপর হুমরি খেয়ে পড়া ভিড়-ভাট্টা দেখে তখন কে বলবে যে আপনি নিউইয়র্কের ব্যাস্ত শহরে দিব্যি ঈদ-শপিং নিয়ে মহা মহা ব্যাস্ত?
এবার দেখা যাক নিউইয়র্কের বাঙালিরা ঈদের দিনটি ঠিক কেমন করে কাটান? আগেই বলে নেয়া ভালো যে নিউইয়র্ক সিটির প্রায় প্রতিটি শহরেই ঠিক বাংলাদেশের মতই অসংখ্য মসজিদ আছে। আর বলাই বাহুল্য বেশির ভাগ মসজিদ গুলোর পৃষ্ঠপোষক এই বাঙালিরাই। ঈদের দিন সবাই নিজ নিজ মহল্লার মসজিদে ঈদের নামাজ পড়াটাকেই প্রাধান্য দেন। সত্যি চোখ জুড়ে যায় যখন দেখি দলমত নির্বিশেষে পরিচিত-অপরিচিত সবাই ঈদের নামাজের শেষে কোলাকুলি করছেন। তখন শুধু মনে হয় এই কোলাকুলি ভাবটা বাঙালিরা যদি আজিবন ধরে রাখতে পারতেন তাহলে হয়ত আমাদের অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান হয়ে যেত!! তবে এখানে একটা সমস্যার কথা একদম না বললেই নয়। চাঁদ দেখাকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতিটি রোজার ঈদে এই নিউইয়র্কে বাঙালিরা একটা ফেকরা বাধাবেন এটা একদম জানা কথাা। যার ফলাফল নির্মম হতে বাধ্য। নিউইয়র্কে বাঙালিরা বেশিরভাগ সময়ই দুদিন করে ঈদ পালনে এখন অভ্যস্থ হয়ে গেছেন। দেখা যায় ম্যানহাটনের মদিনা মসজিদ হয়ত বলছে শনিবার ঈদ আবার অন্যদিকে এস্টোরিয়ার শাহজালাল মসজিদ হয়ত ঘোষনা দিয়ে বসে আছে যে রোববারই ঈদ হবে। তাতে ঝামেলায় পড়তে হয় আমাদের মত ছা পোষা মানুষদের যাদের আগে থেকেই ঈদের জন্য ছুটি-ছাটা নিয়ে রাখতে হয়। ঈদের নামাজের পরপরই শুরু হয়ে যায় ঈদ আনন্দের সূচনা পর্ব। এ বাড়ি-ও বাড়ি নিমন্ত্রনতো বটেই নিউইয়র্কের আকাশ-বাতাস বিদির্ন করে সেদিন বাঙালিরা ঈদ উৎসবের আনন্দে মেতে উঠেন। রাস্তায়, গাড়িতে, বাড়ির ড্রইং রুমে, সিনেমা হলের টিকেট কাউন্টারে, হাইওয়ে থেকে ছিটকে পড়া ছোট্ট পায়ে চলার মেঠো পথে তখন খনে খনে কানে বাজে রেশমি চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ, নুপুরের মিষ্টি ঝংকার। তখন কাঁচির মত দেখতে চাঁদটাকে কার না ভালো লাগে?
ঈদের হাজারো আনন্দের ঠিক উল্টো পিঠেই দেখি বেদনার আরেক করুন চিত্র! বাংলাদেশে ফেলে আসা প্রিয়জনের কথা মনে করে অনেকেই এই ঈদ দিনে নীরবে নিভৃত্বে শুধু চোখের পানি লুকান। আবেগে আপ্লত হয়ে দেশে ফোন করে হয়ত মাকে মিথ্যেভাবেই জানিয়ে দেন ”মা, ঈদে অনেক আনন্দ করছি, আমার জন্য কিন্তু একদম ভাববে না ”। তারপরও জীবন চলে যায়। ঈদ আসে আবার ঈদ যায়। কেউ কেউ আরো একটা নতুন ঈদের আনন্দের অপেক্ষায় থাকেন আর কেউ হয়ত আরেকটা দুঃখের জন্য প্রতিদিনই প্রতীক্ষার দিন গুনেন।